৬ জানুয়ারি ২০১৭
প্রগতি সম্মেলন কক্ষ,
গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র আয়োজিত
গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র আয়োজিত
“পোশাক শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি
ঃ সমাধান কোন পথে?”
গোলটেবিল আলোচনা’য় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রুহুল আমিন উত্থাপিত বক্তব্য
গোলটেবিল আলোচনা’য় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রুহুল আমিন উত্থাপিত বক্তব্য
সম্মানিত সভাপতি, উপস্থিত সুধীবৃন্দ,
বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের প্রাণপ্রিয় সংগঠন ‘গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র’র পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন।
বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের প্রাণপ্রিয় সংগঠন ‘গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র’র পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন।
প্রিয় সুধীমন্ডলী,
গত চার দশকে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে আসছে। দেশের মোট রপ্তানী আয়ের শতকরা ৮০ ভাগ অর্জনকারী গার্মেন্ট শিল্পের রপ্তানী আয় গত অর্থ বছরে ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে এবং ২০২০ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানীর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
শ্রমিকদের উপর জুলুম-নির্যাতন-দমননীতি চালিয়ে সস্তা শ্রমের উপর বিকশিত গার্মেন্ট শিল্পে আমরা দু’টি চিত্র দেখতে পাই। একটি হলো সামান্য পুঁজি বিনিয়োগকারী মালিকরা নব্য ধনিকে পরিণত হয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। দেশ-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। অপরটি হলো শ্রমিকদের জীবনে চলছে চরম অভাব-অনটন, ক্ষুধা-দারিদ্রতা। আজও অনাহার-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করে রোগাক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয় অসংখ্য শ্রমিককে। বেঁচে থাকলে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত চাকুরী করার কথা কিন্তু ৪০-৪৫ বছর বয়সেই কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে হয়। বাকী ১৫-২০ বছরের কর্মক্ষমতাকে শোষণ-নির্যাতনের মাধ্যমে নীরবে হত্যা করা হয়। সামান্য পুঁজির মালিকরা শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্টকে কোনোরকম বিবেচনায় নেন না। যে কারণে শ্রমিকদের জীবন ধারণ উপযোগী ন্যায্য মজুরি নাই। অতীতের প্রাপ্ত রেশনিং, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বিনোদনের ন্যূনতম ব্যবস্থা নাই। মালিকরা অর্থ-সম্পদ ও প্রাচুর্যের প্রভাবে রাষ্ট্র ও সমাজে ব্যাপক ক্ষমতা অর্জন করার ফলে আইন-কানুনের তোয়াক্কা করে না বিধায় অধিকাংশ কারখানায় আইনানুসারে শ্রমিকদের প্রসুতি কল্যাণ সুবিধা ও অন্যান্য ছুটি প্রদান করা হয় না। উৎসবভাতা, গ্র্যাচুইটি নাই। চাকুরী শেষে সার্ভিস বেনিফিট প্রদান করা হয় না। এমনকি আজও আইডি কার্ড নিয়োগপত্র দেওয়া হয়নি। শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে ও সমাজজীবনে নিরাপত্তা আজ ও পুরোপুরি নিশ্চিত করা হয়নি। যার ফলে এ পর্যন্ত রানাপ্লাজা, তাজরিনের পরেও অব্যাহতভাবে দুর্ঘটনাজনিত হত্যাকান্ড চলছে। এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক কারখানায় অগ্নিকান্ড ও ভবন ধ্বসে প্রায় চার হাজার শ্রমিককে জীবন দিতে হয়েছে। হাজার হাজার শ্রমিককে পঙ্গুত্বের জীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এসব জুলুম নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার তাগিদে কখনও কখনও গার্মেন্ট শ্রমিকরা জীবন বাঁচাতে আন্দোলনের পথ বেছে নেয়। মালিকরা তখন দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের আওয়াজ তোলেন উস্কানীর আওয়াজ তোলেন। সরকারও মালিকদের সুরে সুর মেলায়। শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্টকে বিবেচনায় না নিয়ে দমননীতি চালানো হয়। সাম্প্রতিক আশুলিয়ায় শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনকে দমন করার জন্য নানারকম বিভ্রান্তমূলক অসত্য বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। সে বিষয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। সরকার এবং বিজিএমইএ বললেন যে, শ্রমিকদের পক্ষ থেকে কোনো দাবিনামা পেশ করা হয়নি। আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে গত ৫ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় শ্রম প্রতিমন্ত্রীর নিকট এবং ২০ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ-এর নিকট নিম্নতম মূল মজুরি ১০,০০০/- (দশ হাজার) টাকা এবং মোট মজুরি ১৬,০০০/- (ষোল হাজার) টাকা নির্ধারণের দাবিতে দাবিনামা পেশ করেছি। অপরাপর শ্রমিক সংগঠন মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে দাবিনামা পেশ করেছেন। দাবির বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এবং ফৌজদারী কার্যকলাপ ছাড়াই শ্রমিকদের নামে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দিয়ে শ্রমিক ও নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে কারগারে আটক বলা হয়েছে। হাজার হাজার শ্রমিককে চাকুরীচ্যুত করা হয়েছে। বিজিএমইএ ঘোষণা দিয়ে ১৩(১) ধারায় ৫৯ টি কারখানা বন্ধ করে শ্রমিকদেরকে বন্ধকালীন সময়ের বেতন না দেয়ার ঘোষণা দিলেন যা আইন সংগত নয়। কেননা শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারা অনুসারে কোন কারখানার কোন সেকশন বা বিভাগের শ্রমিকরা বেআইনী-ধর্মঘট করলে অন্য সেকশন বা বিভাগ চালাতে অক্ষম হলে সে ক্ষেত্রে কারখানার মালিক শ্রম পরিদর্শকের অণুমতি সাপেক্ষে ১৩(১) ধারায় কারখানা বন্ধ করতে পারবে। সেক্ষেত্রে শ্রমিকদের বন্ধকালীন প্রথম তিন দিন মজুরি প্রদান করতে হবে। প্রথমতঃ নির্দিষ্ট কোনো কারখানার কোনো সেকশন বা বিভাগে বেআইনী ধর্মঘট হয়নি। ফলে ১৩(১) ধারা প্রযোজ্য নহে। দ্বিতীয়তঃ শ্রম আইন বিজিএমইএকে কারখানা বন্ধ বা খোলার অধিকার দেয়নি।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে, বাংলাদেশে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নেই। ট্রেড ইউনিয়ন করতে গেলেই চাকুরীচ্যুতি, হামলা-মামলার স্বীকার হতে হয়। নানাচাপে সাম্প্রতিক চার শতাধিক গার্মেন্ট কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন দেয়া হলেও মালিকরা তার স্বীকৃতি দেয় না এবং ট্রেড ইউনিয়নের কার্যকলাপ করা সম্ভব হচ্ছে না। যেই মর্মে ইতিমধ্যেই আইএলও সরকার এবং মালিকদের বলেছে। এদিকে আইএলও কনভেনশনের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বারবার শ্রম আইনকে শ্রমিকদের বিপক্ষে মালিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য প্রণয়ন করা হচ্ছে। শ্রম বিধিমালা-২০১৫ নামে একটি বিধিমালা করে শ্রমিকদের নির্যাতনের জন্য মালিকদের হাতে এটিকে একটি হাতিয়ার হিসেবে তুলে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের শ্রমিকদের অতীতের প্রাপ্ত রেশনিং, বাসস্থান, চিকিৎসা শিক্ষা ও বিনোদনের ব্যবস্থা খর্ব করা হয়েছে। অনেক মালিক ১টি ২টি থেকে ২০/৩০টি এমনকি ৪০/৫০টি কারখানার মালিক হলেও শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধার জন্য কোনো ব্যবস্থা করেননি। সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, আমরা এসব অধিকারের কথা বললেই মালিকরা সক্ষমতার কথা বলেন, মজুরিবৃদ্ধি ও প্রদানের ক্ষেত্রে শিল্পের সক্ষমতা এবং শ্রমিকের চাহিদা দুটি বিষয়ই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। আমরা এক্ষেত্রে তিন স্তরের কারখানার কথা জানি। কিছু কারখানা বড় হয়েছে। কিছু মাঝারি, কিছু ছোট কারখানা আছে যেখানে সময়মত মজুরি ও সারাবছর কাজ না থাকায় সেখানকার শ্রমিকদেরকে সম্পূর্ণরূপে অমানবিক জীবনযাপন করতে হয়। এ বিষয়ে কারখানার সক্ষমতা অর্জন না করায় শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আমরা এতোক্ষণ মালিকদের উন্নতি ও শ্রমিকদের উপর অন্যায়ভাবে নির্যাতনের কিছু বিষয় বুঝেছি। একইসাথে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে যে, বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরি পৃথিবীর যেকোনো দেশের শ্রমিকদের মজুরির তুলনায় কম। বর্তমান প্রাপ্ত মজুরিতে খেয়ে পরে বেঁচে থেকে শ্রমিকদের পক্ষে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা রক্ষা করা কোনো ক্রমেই সম্ভব হচ্ছে না। শ্রমিকদের জীবনের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে। মন্ত্রী, এমপি, আমলা, সরকারি, চাকুরীজীবিদের বেতন ভাতা দ্বিগুণ করা হয়েছে কিন্তু গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবির তোলায় শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলছেন, শ্রম আইন অনুসারে ৫ বছরের পূর্বে মজুরি বৃদ্ধির বিধান নেই। বাস্তবে প্রচলিত শ্রম আইন অনুসারে ৩ বছর পর মজুরি বৃদ্ধির আইনী বিধান রয়েছে। যা অতীতে ২ বছর পর পর বৃদ্ধি করার আইনী বিধান ছিল। তাছাড়া বর্তমান আইন অনুসারেও শ্রমিকরা ২ বছর পর পর দাবি নামা পেশ করতে পারে। এমনকি শ্রমিকের জীবনের ব্যয়ভার বৃদ্ধি হলে ১ বছর পরেও শ্রমিকপক্ষ দাবি জানালে মজুরি বৃদ্ধির বিধান রয়েছে। ২০১৩ সালে মজুরি বৃদ্ধির সময় সর্বনিম্ন মূল মজুরি ৩০০০ টাকা এবং মোট মজুরি ৫,৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল যা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। কেননা ৩০০০-৪০০০ টাকা বাড়ীভাড়া বাবদ প্রদান করার পরে মাত্র ১৩০০-২৩০০ টাকায় কিভাবে একটি পরিবারের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বিনোদনের খরচ মেটায়। ২০১৩ সালের মজুরি বৃদ্ধির সময়েই ৩ বছর পর পুনরায় মজুরি বৃদ্ধি করা হবে মর্মে মালিকরা আশ্বাস দিয়েছিলেন যা ইতিমধ্যেই শ্রমসচিব জানিয়েছেন। এমতাবস্থায় সারাদেশের সকল গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা অতিব জরুরি।
আজকের এই আলোচনায় “শ্রমিক বাঁচাও-শিল্প বাঁচাও-দেশ বাঁচাও” নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র’র পক্ষ থেকে শ্রমিকদের বাঁচিয়ে রেখে শিল্পকে বিকশিত ও জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে মজুরি বৃদ্ধির দাবিসহ নিম্নলিখিত সুপারিশ আপনাদের সুচিন্তিত গুরুত্বপূর্ণ মতামতের জন্য পেশ করছি ঃ-
১। নিম্নতম মূল মজুরি দশ হাজার (১০,০০০/-) টাকা, (বাড়ি ভাড়া চার হাজার (৪,০০০/-) টাকা, চিকিৎসা ভাতা এক হাজার (১,০০০/-) টাকা এবং যাতায়াত ভাতা এক হাজার (১,০০০/-) টাকা,) সর্বমোট ষোল হাজার (১৬,০০০/-) টাকা এবং সোয়েটারের পিসরেটসহ সকল শ্রমিকদের একইহারে মজুরি বৃদ্ধি করতে হবে।
২। অতিসত্তর মজুরি বোর্ডের কার্যক্রম শুরু করতে হবে।
৩। গ্রেফতারকৃত শ্রমিক ও নেতৃবৃন্দের মুক্তি দিতে হবে। রাষ্ট্রদ্রোহীসহ সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
৪। চাকুরীচ্যুত শ্রমিকদের চাকুরীতে পুর্নবহাল করতে হবে।
৫। বেআইনীভাবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ১৩ (১) ধারায় বন্ধকালীন সময়ের মজুরি দিতে হবে।
৬। গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য কারখানা ভিত্তিক রেশনিং প্রথা চালু করে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্রদান করতে হবে।
৭। গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য শ্রমিক কলোনী গড়ে তুলে বাসস্থান নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা এবং বিনোদনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৮। শ্রম আইন ও বিধিমালার শ্রমিক স্বার্থবিরোধী ধারা পরিবর্তন করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এবং আইএলও কনভেনশন অনুসারে শ্রমআইন ও বিধিমালা প্রণয়ন ও কার্যকর করতে হবে।
৯। আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ অনুসারে শ্রমিকদের অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করে সংঘবদ্ধ হওয়া পছন্দমত সংগঠন করা, দাবিনামা উত্থাপন, দরকষাকষি এবং ধর্মঘট করার অবাধ অধিকার দিতে হবে।
১০। অর্থবহ আলোচনার মাধ্যমে মজুরি বৃদ্ধি এবং সার্বিক পরিস্থিতির সমাধান করুন।
গত চার দশকে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে আসছে। দেশের মোট রপ্তানী আয়ের শতকরা ৮০ ভাগ অর্জনকারী গার্মেন্ট শিল্পের রপ্তানী আয় গত অর্থ বছরে ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে এবং ২০২০ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানীর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
শ্রমিকদের উপর জুলুম-নির্যাতন-দমননীতি চালিয়ে সস্তা শ্রমের উপর বিকশিত গার্মেন্ট শিল্পে আমরা দু’টি চিত্র দেখতে পাই। একটি হলো সামান্য পুঁজি বিনিয়োগকারী মালিকরা নব্য ধনিকে পরিণত হয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। দেশ-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। অপরটি হলো শ্রমিকদের জীবনে চলছে চরম অভাব-অনটন, ক্ষুধা-দারিদ্রতা। আজও অনাহার-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করে রোগাক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয় অসংখ্য শ্রমিককে। বেঁচে থাকলে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত চাকুরী করার কথা কিন্তু ৪০-৪৫ বছর বয়সেই কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে হয়। বাকী ১৫-২০ বছরের কর্মক্ষমতাকে শোষণ-নির্যাতনের মাধ্যমে নীরবে হত্যা করা হয়। সামান্য পুঁজির মালিকরা শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্টকে কোনোরকম বিবেচনায় নেন না। যে কারণে শ্রমিকদের জীবন ধারণ উপযোগী ন্যায্য মজুরি নাই। অতীতের প্রাপ্ত রেশনিং, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বিনোদনের ন্যূনতম ব্যবস্থা নাই। মালিকরা অর্থ-সম্পদ ও প্রাচুর্যের প্রভাবে রাষ্ট্র ও সমাজে ব্যাপক ক্ষমতা অর্জন করার ফলে আইন-কানুনের তোয়াক্কা করে না বিধায় অধিকাংশ কারখানায় আইনানুসারে শ্রমিকদের প্রসুতি কল্যাণ সুবিধা ও অন্যান্য ছুটি প্রদান করা হয় না। উৎসবভাতা, গ্র্যাচুইটি নাই। চাকুরী শেষে সার্ভিস বেনিফিট প্রদান করা হয় না। এমনকি আজও আইডি কার্ড নিয়োগপত্র দেওয়া হয়নি। শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে ও সমাজজীবনে নিরাপত্তা আজ ও পুরোপুরি নিশ্চিত করা হয়নি। যার ফলে এ পর্যন্ত রানাপ্লাজা, তাজরিনের পরেও অব্যাহতভাবে দুর্ঘটনাজনিত হত্যাকান্ড চলছে। এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক কারখানায় অগ্নিকান্ড ও ভবন ধ্বসে প্রায় চার হাজার শ্রমিককে জীবন দিতে হয়েছে। হাজার হাজার শ্রমিককে পঙ্গুত্বের জীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এসব জুলুম নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার তাগিদে কখনও কখনও গার্মেন্ট শ্রমিকরা জীবন বাঁচাতে আন্দোলনের পথ বেছে নেয়। মালিকরা তখন দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের আওয়াজ তোলেন উস্কানীর আওয়াজ তোলেন। সরকারও মালিকদের সুরে সুর মেলায়। শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্টকে বিবেচনায় না নিয়ে দমননীতি চালানো হয়। সাম্প্রতিক আশুলিয়ায় শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনকে দমন করার জন্য নানারকম বিভ্রান্তমূলক অসত্য বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। সে বিষয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। সরকার এবং বিজিএমইএ বললেন যে, শ্রমিকদের পক্ষ থেকে কোনো দাবিনামা পেশ করা হয়নি। আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে গত ৫ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় শ্রম প্রতিমন্ত্রীর নিকট এবং ২০ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ-এর নিকট নিম্নতম মূল মজুরি ১০,০০০/- (দশ হাজার) টাকা এবং মোট মজুরি ১৬,০০০/- (ষোল হাজার) টাকা নির্ধারণের দাবিতে দাবিনামা পেশ করেছি। অপরাপর শ্রমিক সংগঠন মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে দাবিনামা পেশ করেছেন। দাবির বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এবং ফৌজদারী কার্যকলাপ ছাড়াই শ্রমিকদের নামে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দিয়ে শ্রমিক ও নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে কারগারে আটক বলা হয়েছে। হাজার হাজার শ্রমিককে চাকুরীচ্যুত করা হয়েছে। বিজিএমইএ ঘোষণা দিয়ে ১৩(১) ধারায় ৫৯ টি কারখানা বন্ধ করে শ্রমিকদেরকে বন্ধকালীন সময়ের বেতন না দেয়ার ঘোষণা দিলেন যা আইন সংগত নয়। কেননা শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারা অনুসারে কোন কারখানার কোন সেকশন বা বিভাগের শ্রমিকরা বেআইনী-ধর্মঘট করলে অন্য সেকশন বা বিভাগ চালাতে অক্ষম হলে সে ক্ষেত্রে কারখানার মালিক শ্রম পরিদর্শকের অণুমতি সাপেক্ষে ১৩(১) ধারায় কারখানা বন্ধ করতে পারবে। সেক্ষেত্রে শ্রমিকদের বন্ধকালীন প্রথম তিন দিন মজুরি প্রদান করতে হবে। প্রথমতঃ নির্দিষ্ট কোনো কারখানার কোনো সেকশন বা বিভাগে বেআইনী ধর্মঘট হয়নি। ফলে ১৩(১) ধারা প্রযোজ্য নহে। দ্বিতীয়তঃ শ্রম আইন বিজিএমইএকে কারখানা বন্ধ বা খোলার অধিকার দেয়নি।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে, বাংলাদেশে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নেই। ট্রেড ইউনিয়ন করতে গেলেই চাকুরীচ্যুতি, হামলা-মামলার স্বীকার হতে হয়। নানাচাপে সাম্প্রতিক চার শতাধিক গার্মেন্ট কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন দেয়া হলেও মালিকরা তার স্বীকৃতি দেয় না এবং ট্রেড ইউনিয়নের কার্যকলাপ করা সম্ভব হচ্ছে না। যেই মর্মে ইতিমধ্যেই আইএলও সরকার এবং মালিকদের বলেছে। এদিকে আইএলও কনভেনশনের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বারবার শ্রম আইনকে শ্রমিকদের বিপক্ষে মালিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য প্রণয়ন করা হচ্ছে। শ্রম বিধিমালা-২০১৫ নামে একটি বিধিমালা করে শ্রমিকদের নির্যাতনের জন্য মালিকদের হাতে এটিকে একটি হাতিয়ার হিসেবে তুলে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের শ্রমিকদের অতীতের প্রাপ্ত রেশনিং, বাসস্থান, চিকিৎসা শিক্ষা ও বিনোদনের ব্যবস্থা খর্ব করা হয়েছে। অনেক মালিক ১টি ২টি থেকে ২০/৩০টি এমনকি ৪০/৫০টি কারখানার মালিক হলেও শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধার জন্য কোনো ব্যবস্থা করেননি। সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, আমরা এসব অধিকারের কথা বললেই মালিকরা সক্ষমতার কথা বলেন, মজুরিবৃদ্ধি ও প্রদানের ক্ষেত্রে শিল্পের সক্ষমতা এবং শ্রমিকের চাহিদা দুটি বিষয়ই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। আমরা এক্ষেত্রে তিন স্তরের কারখানার কথা জানি। কিছু কারখানা বড় হয়েছে। কিছু মাঝারি, কিছু ছোট কারখানা আছে যেখানে সময়মত মজুরি ও সারাবছর কাজ না থাকায় সেখানকার শ্রমিকদেরকে সম্পূর্ণরূপে অমানবিক জীবনযাপন করতে হয়। এ বিষয়ে কারখানার সক্ষমতা অর্জন না করায় শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আমরা এতোক্ষণ মালিকদের উন্নতি ও শ্রমিকদের উপর অন্যায়ভাবে নির্যাতনের কিছু বিষয় বুঝেছি। একইসাথে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে যে, বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরি পৃথিবীর যেকোনো দেশের শ্রমিকদের মজুরির তুলনায় কম। বর্তমান প্রাপ্ত মজুরিতে খেয়ে পরে বেঁচে থেকে শ্রমিকদের পক্ষে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা রক্ষা করা কোনো ক্রমেই সম্ভব হচ্ছে না। শ্রমিকদের জীবনের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে। মন্ত্রী, এমপি, আমলা, সরকারি, চাকুরীজীবিদের বেতন ভাতা দ্বিগুণ করা হয়েছে কিন্তু গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবির তোলায় শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলছেন, শ্রম আইন অনুসারে ৫ বছরের পূর্বে মজুরি বৃদ্ধির বিধান নেই। বাস্তবে প্রচলিত শ্রম আইন অনুসারে ৩ বছর পর মজুরি বৃদ্ধির আইনী বিধান রয়েছে। যা অতীতে ২ বছর পর পর বৃদ্ধি করার আইনী বিধান ছিল। তাছাড়া বর্তমান আইন অনুসারেও শ্রমিকরা ২ বছর পর পর দাবি নামা পেশ করতে পারে। এমনকি শ্রমিকের জীবনের ব্যয়ভার বৃদ্ধি হলে ১ বছর পরেও শ্রমিকপক্ষ দাবি জানালে মজুরি বৃদ্ধির বিধান রয়েছে। ২০১৩ সালে মজুরি বৃদ্ধির সময় সর্বনিম্ন মূল মজুরি ৩০০০ টাকা এবং মোট মজুরি ৫,৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল যা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। কেননা ৩০০০-৪০০০ টাকা বাড়ীভাড়া বাবদ প্রদান করার পরে মাত্র ১৩০০-২৩০০ টাকায় কিভাবে একটি পরিবারের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বিনোদনের খরচ মেটায়। ২০১৩ সালের মজুরি বৃদ্ধির সময়েই ৩ বছর পর পুনরায় মজুরি বৃদ্ধি করা হবে মর্মে মালিকরা আশ্বাস দিয়েছিলেন যা ইতিমধ্যেই শ্রমসচিব জানিয়েছেন। এমতাবস্থায় সারাদেশের সকল গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা অতিব জরুরি।
আজকের এই আলোচনায় “শ্রমিক বাঁচাও-শিল্প বাঁচাও-দেশ বাঁচাও” নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র’র পক্ষ থেকে শ্রমিকদের বাঁচিয়ে রেখে শিল্পকে বিকশিত ও জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে মজুরি বৃদ্ধির দাবিসহ নিম্নলিখিত সুপারিশ আপনাদের সুচিন্তিত গুরুত্বপূর্ণ মতামতের জন্য পেশ করছি ঃ-
১। নিম্নতম মূল মজুরি দশ হাজার (১০,০০০/-) টাকা, (বাড়ি ভাড়া চার হাজার (৪,০০০/-) টাকা, চিকিৎসা ভাতা এক হাজার (১,০০০/-) টাকা এবং যাতায়াত ভাতা এক হাজার (১,০০০/-) টাকা,) সর্বমোট ষোল হাজার (১৬,০০০/-) টাকা এবং সোয়েটারের পিসরেটসহ সকল শ্রমিকদের একইহারে মজুরি বৃদ্ধি করতে হবে।
২। অতিসত্তর মজুরি বোর্ডের কার্যক্রম শুরু করতে হবে।
৩। গ্রেফতারকৃত শ্রমিক ও নেতৃবৃন্দের মুক্তি দিতে হবে। রাষ্ট্রদ্রোহীসহ সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
৪। চাকুরীচ্যুত শ্রমিকদের চাকুরীতে পুর্নবহাল করতে হবে।
৫। বেআইনীভাবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ১৩ (১) ধারায় বন্ধকালীন সময়ের মজুরি দিতে হবে।
৬। গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য কারখানা ভিত্তিক রেশনিং প্রথা চালু করে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্রদান করতে হবে।
৭। গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য শ্রমিক কলোনী গড়ে তুলে বাসস্থান নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা এবং বিনোদনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৮। শ্রম আইন ও বিধিমালার শ্রমিক স্বার্থবিরোধী ধারা পরিবর্তন করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এবং আইএলও কনভেনশন অনুসারে শ্রমআইন ও বিধিমালা প্রণয়ন ও কার্যকর করতে হবে।
৯। আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ অনুসারে শ্রমিকদের অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করে সংঘবদ্ধ হওয়া পছন্দমত সংগঠন করা, দাবিনামা উত্থাপন, দরকষাকষি এবং ধর্মঘট করার অবাধ অধিকার দিতে হবে।
১০। অর্থবহ আলোচনার মাধ্যমে মজুরি বৃদ্ধি এবং সার্বিক পরিস্থিতির সমাধান করুন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন