আমি জেলে যাওয়ার
আগে, ২০০০ সালের দিকে আমি যখন শ্রমিক আন্দলনের মাধ্যেমে আমার রাজনীতি জীবন
শুরু করি তখন আমার সিনিয়র শ্রমিকনেতারা আমাকে বলতেন “ট্রেড ইউনিয়ন কর আর রাজনীতি
কর, জেল খাটতে হবে, মামলা-হামলা’র শিকার হতে হবে তোমাকে, এমনকি জীবনও চলে যেতে পারে”
আমি তাদের বলতাম, শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করবো আর মালিক
শ্রেনী আমাকে ছেড়ে দিবে এটা ভাবা যায়না, এগুল মেনে নিয়েই
শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে লড়াই চালিয়ে যাব । আমার সিনিয়র শ্রমিকনেতারা আমাকে তাদের জেল জিবনের গল্প
বলতেন, মালিক শ্রেনীর নির্যাতনের কাহিনী শুনাতেন । আমি শুনতাম আর ভাবতাম, আমাকেও একদিন জেলে যেতে
হবে তাই আমি মানসিক ভাবে সব সময় জেলে যাওয়া প্রস্তুতি নিয়েই থাকতাম । আমাকে কতবার যে থানা পুলিশ, ইন্ডিয়াস্ট্রিয়াল পুলিশ, র্যাব, ডিজিএফআই, এনএসআই ডেকে নিয়ে ধমকিয়েছেন, গুম করে ফেলারও হুমকি দিয়েছেন তার ঠিক হিসাব মনে নেই । ট্রেড ইউনিয়ন করতে গিয়ে বারবার সন্ত্রাসিদের হামলার শিকার হতে হয়েছে আমাকে, বিজিএমইএ এর এই
মামলা সহ ২২ টি মামলা হয়েছে আমার নামে ।
রাম্পুরাতে
অবস্থিত আশিয়ানা গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিকরা
কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করেছিল। মেনে নিতে পারেনি মালিক
পক্ষ বিজিএমইএ । বিজিএমইএ এর পরামর্সে আশিয়ানা গার্মেন্টস এর মালিক ইউনিয়নকে মেনে না নিয়ে, যে সকল শ্রমিকরা ইউনিয়ন গঠন করার মুল ভুমিকা পালন করেছিল, সেই
সকল শ্রমিকদের সাময়িক বরখাস্ত করেছিল মালিক পক্ষ । শ্রমিকরা বরখাস্তের এর প্রতিবাদ
করলে মালিক পক্ষ কারখানা
বন্ধ ঘোষনা করে, ৩১ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখ সকাল ১১ টায়
বিজিএমইএ তে আলচনার মাধ্যেমে সমাস্যা সমাধানের কথা হয় । সে মোতাবেক ৩১ জানুয়ারি
২০১৮, সকাল ১১ টায় শ্রমিকরা কাওরান বাজার অবস্থিত বিজিএমইএ
এর সামনে শ্রমিকরা অবস্থান করে । পুলিশের উপস্থিতে শ্রমিকদের অবস্থান কালে
বিজিএমইএ এর এডিশোনাল সেক্রেটারি খালেদ
মনছুর ও তার দল-বল নিয়ে শ্রমিকদের উপর হামলা করেন, এবং বলেন বিজিএমইএ’তে
আশিয়ানা নিয়ে কোন আলচনা হবেনা, একথা বলে শ্রমিকদের কাছ থেকে
বেনার ও মাইক কেড়ে নেন, এবং লাঠি দিয়ে মাইক ম্যানকে মাইর
দিতে থাকে, মাইক ও রিক্সা ভেংগে দেই, শ্রমিকরা প্রতিবাদ করলে লাঠি-লোহার রড নিয়ে
শ্রমিকদের উপর হামলা করে বিজিএমইএ’র লোক জন, কিন্তু পুলিশ নিরব দর্শকের
ভুমিকা পালন করে । বিজিএমইএ’র হামলায় প্রায় ৪৮ জন নারী
শ্রমিক আহত হয়, শ্রমিকদের আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল
হাস্পাতালে ভর্তি করা হয় । ৩১ জানুয়ারি
রাতে রমনা থানায় মামলা করতে গেলে শ্রমিকদের মামলা গ্রহন করেনি রমনা থানা পুলিশ । শ্রমিকদের মামলা গ্রহন না করলেও বিজিএমইএ’র অতিরিক্ত সচিব
(প্রশাসন) মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে রমনা থানায় হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের
করেন৷ মামলায় গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি এড মন্টু ঘোষ, কার্যকারী সভাপতি কাজী রুহুল আমিন, সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার,
সাংগঠনিক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু, আন্তর্জাতিক
সম্পাদক মঞ্জুর মঈন, সংগঠনের গাজীপুর জেলা কমিটি’র সাধারণ সম্পাদক জালাল হাওলাদার, কেন্দ্রীয় কমিটির
সদস্য সাদেকুর রহমান শামীম, লুৎফর রহমান আকাশ, মো. শাহজাহান সহ ১২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত দেড়শ’ জনকে আসামি করা হয়৷অভিযোগ করা হয়, রামপুরার আশিয়ানা নামের পোশাক শ্রমিক এবং শ্রমিক নেতারা হামলা চালিয়ে
ব্যাপক ভাঙচুর এবং বিজিএমই’র কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হত্যার চেষ্টা করে। বিজিএমইএ এর মিথ্যা
মামলা গ্রহন করে রমনা থানা পুলিশ, ১ এপ্রিল রাতে আশিয়ানা গার্মেন্ট কারখানার নেতা রাসেল ও মুন্নাকে
গ্রেফতার করে পুলিশ, রাসেল ও মুন্নার উপর অমানবিক নির্যাতন
চালায় পুলিশ। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮’ তারিখ আমি সহ মামলার
আসামিরা হাইকোর্ট থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নেই৷ ১ এপ্রিল ২০১৮ ইং তারিখ আমি সহ
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি মন্টু ঘোষসহ আটজন নেতা ঢাকার
মহানগর হাকিম মিজানুর রহমানের আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করি৷ কিন্তু
আদালত মন্টু ঘোষের জামিন মঞ্জুর করে কিন্তু আমাকেসহ বাকিদের কারাগারে পাঠানোর
নির্দেশ দেন৷ মামলার এক নং আসামী গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের
কার্যকারী সভাপতি কাজী রুহুল আমীন জামিন আবেদন না করায় তিনি পালাতক থাকলেন। রুহুল আমীন ভাই আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, যেহেতু আমরা বুঝতে পারছি, আমাদের জামিন দেওয়া হবেনা, আমাদের জেলখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে, তাই আমাদের
নিম্ন আদালতে জামিন আবেদন না করে, আমাদের হায় কোর্টে আবেদন
করা ভাল হবে। কিন্তু
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি মন্টু ঘোষ বললেন, যা হবার হবে আমরা জামিন আবেদন করবো। পরবর্তীতে রুহুল আমীন ভাই হায় কোর্ট থেকে জামিন নেন।
আমাকে সহ সকলকে
হাতে হ্যানকাফ পরিয়ে আদালত এলাকার ছোট্র একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়, তার আগে আমাদের টাকা পয়সা, ব্যাগ-মানিব্যাগ, মাজার বেল্ট অন্য কমরেড দের কাছে জমা দিই, যে পুলিশ
আমাদের নিয়ে আসাছে সেই পুলিশ আমাদের কাছ থেকে টাকা চাচ্ছিল,
পুলিশ এমন ভাবে টাকা দাবি করছিল আমার মনে হচ্ছিল সে তার কাজের মজুরী চাচ্ছে। গরুর পালের মত গুনে গুনে আমাদের পুরুষ সেলে এবং জলি
তালুকদারকে নারী সেলে নিয়ে রাখা হয়।
আমাদের যেখানে রাখা হয়েছিল সেখানে অনেক বন্দি, দাঁড়ানোর মত জায়গা
ছিলনা, ভিতরে সিগারেটের ধোঁয়াতে অন্ধকার প্রায়, আর খোলা বাথরুম, তামাকের গন্ধে আমার মাথা ঝিমঝিম
করছিল। কয়েক জনকে
দেখলাম বাথরুমে মাদক সেবেন করছে, পুলিশ দেখেও না দেখার ভান করে আছে, গ্রেফতার কৃত বেসির ভাগ বন্দীদের বয়স ১৪/১৬/১৮ থেকে ২২ বছর, মাদক ব্যাবসা কিংবা মাদক সেবন করার কারনে পুলিশ তাদের ধরে এনেছে । এই সব মানুষ দেখলে বোঝা যায় বাংলাদেশ
কতটা মাদকে ভাসছে, যুব সমাজ কীভাবে আস্তে আস্তে ধ্বংসের
দিকে যাচ্ছে। কিচ্ছুক্ষণ
পরপর একজন পুলিশ এসে গুনে গুনে বন্দীদের নিয়ে অন্য রুমে রাখছিল পরে আবার তাদের
প্রিজন ভ্যানে তুলে কাওকে কাশেমপুর কারাগারে আবার কাওকে কেরানীগঞ্জ কারাগারে নিয়ে
যাচ্ছিল। আমার
বার বার মনে হচ্ছিল আমাদের যত তাড়াতাড়ি জেলখানাতে নিবে তত ভাল, অন্তত এই খানের নুংড়া দুর্গন্ধ যুক্ত পরিবেশ থেকে তো দূরে থাকতে পারবো। সন্ধ্যা একটু আগে, আমাদের আবার গরুর পালের মত গুনে গুনে পাশের রুমে নিয়ে রাখা হল, আমি ভেবে ছিলাম আগের রুমের থেকে এই রুম একটু ভাল হবে কিন্তু না, এই রুম আরো দুর্গন্ধ যুক্ত। যাক কিছুক্ষণ পর আমদের প্রিজন ভ্যানে
তুলে কেরানীগঞ্জ জেলখানার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, পুলিশের কাছ থেকে
জানতে পারলাম এটাই আজকের শেষ প্রিজন ভ্যান। প্রিজন ভ্যানের ভিতর বসার বেঞ্চ আছে কিন্তু যে পরিমাণ বন্দি তাতে
বসার জায়গা পাওয়ার আশা করা ভুল, তারপরেও আমরা বসার জায়গা পেলাম। প্রিজন ভ্যানের ভিতর সিগারেট এর ধোঁয়াতে
অন্ধকার আর চেঁচামেচি হৈচৈ।
সন্ধ্যার একটু পর কেরানীগঞ্জ জেলখানার ভিতর গেইটে আমাদের প্রিজন ভ্যান থেকে নামানো
হল, প্রথমে একটা রুমে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল, সেখানে
আমাদের নাম-ঠিকানা লেখার পর আমার হাতের আংটি খুলে জমা রেখে দিল আর বলে দিল ‘আপনি যেদিন জেলখানা থেকে বের হবেন সেদিন আংটি নিয়ে যাবেন’। আমি তার কথা মত আংটি জমা রেখে দিলাম। জেল থেকে বের হওয়ার দিন সেই আংটি আমাকে আর ফেরত
দেওয়া হয়নি। নাম ঠিকানা লেখার পর আমাদের খোলা যায়গায় নিয়ে আমাদের বলা হল ‘ফাইল ঠিক কর’, আমি ফাইল কি আগে জানতাম না কিন্তু
দেখলাম চার জন করে লাইন করে বসাকে ফাইল বলে, আমি প্রথম লাইনে
বসলাম, শুরু হল প্রথমে নাম ডাকা, তারপর
দেহ তল্লাসি, কারো কারো শরীরের জামা কাপড়, প্যান্ট, লুঙ্গি, পায়ের
স্যান্ডেল খুলে তল্লাসি করা হচ্ছে, পাছায়, লিঙ্গে, মুখের ভিতর, কানের
ভিতর হাত ঢুকিয়ে চেক করা হচ্ছিল, জামাকাপড় এর সেলাই ধরে ধরে
চেক করছিল। আমি ভাবছিলাম
এত কি তল্লাসি করা হচ্ছে, কিন্তু পরে জানতে পারলাম নগত টাকা ও মাদক, ইয়াবা, হেরুইন, গাঁজা খোঁজা
হচ্ছিল, নগত টাকা পাওয়া গেলে সেটা তারা নিয়ে নিচ্ছিল। তল্লাসি শেষ হলে আমাদের জেলখানার গেইটের
ভিতর নেওয়া হল, আবার ফাইল ঠিক করে গুনে গুনে আমদানীতে নেওয়া হল, আমদানীতে ঢুকানোর আগে আবার ফাইল ঠিক করে গুনে গুনে আমদানীর রুমে প্রবেশ
করানো হল। আমদানীতে ঢুকে
আবার ফাইল ঠিক, কিন্তু আমদানীর রুমে যে পরিমাণ মানুষের ধারণ ক্ষমতা
তার ১০ গুন মানুষ সেখানে আছে। বিড়ি-সিগারেটের
ধুয়া, বাথ রুমের গন্ধ, মানুষের হৈচৈ, ঠেলা ঠলি-ধাক্কা ধাক্কা, বসার যায়গা নেই। এর মধ্যেই ফাইল ঠিক করে আবার গুনা গুনি
হল। রাত্রি ১০ টার
দিকে আমাদের প্লেট দেওয়া হল, দুজনের জন্য একটা প্লেট, সামনা সামনি বসে অপেক্ষা খাবারের। প্রতীক্ষার পর খিচুড়ি ভর্তি প্লেট, দুর্গন্ধ যুক্ত খিচুড়ি, পেটে অনেক ক্ষিদা থাকার
কারনে খেতে বেশি খারাপ লাগেনি। খাওয়া
শেষ হওয়ার পর আবার ফাইল ঠিক, আবার গুনা গুনি শেষ হলে ফ্লোরে
কম্বল বিছানো হলো। কম্বল বিছানোর
আগেই বন্দিরা সবাই ঘুমানোর জায়গা দখল নেওয়ার জন্য ধাক্কা ধাক্কি শুরু করে দেই। চারটা লাইন করে দেওয়া হল, দুই ওয়ালের দিকে দুই লাইনের মাথা আর মাঝ খানে দুই লাইনের মাথা, একজনের পায়ের ভিতর আরেক জনের পা দিয়ে শুয়ে থাকা। চিৎ হয়ে শুই আর কাইত হয়ে শুই একবারি, পরে চিৎ হয়ে শুইলে আর কাইত হওয়া যাবেনা আর কাইত হয়ে শুইলে চিৎ হওয়া
যাবেনা। আমি অনেক
কষ্টে চিৎ হয়ে শুইলাম, কারন আমাকে চিৎ হয়ে শুইতে হইলো এই জন্য
যে, আমার দুই পাশে শুইয়ে থাকা বেক্তিদের বগলের এত দুর্গন্ধ
যে, কাওকে বলে বোঝানো যাবেনা। আমি কোন গতি না পেয়ে শুয়ে না থেকে উঠে বসে থাকলাম। এই থাকার নাম কেস্কি ফাইল। আমার পায়ের
ভিতর পা দিয়ে যে লোকটা শুয়ে ছিল, সে একটা ছোট খাট গার্মেন্ট
কারখানার মালিক, পাওনাদারকে টাকা দিতে পারেনি বলে সে জেলে
এসেছে, সেও আমার মত উঠে বসে থাকলো। লোকটার সাথে সারা রাত্রি গার্মেন্ট
শিল্পের বিভিন্য বিষয় নিয়ে আলচনা করতে করতে কাটিয়ে দিলাম। এর মাঝে রাত্রি ২ টার দিকে প্রায় ৩০ জন মত কয়েদী কোথা থেকে যেন নিয়ে
আসা হলো, আমি প্রথমে মনে করেছিলাম হয়তো তাদের বাইরে থেকে নিয়ে এসেছে কিন্তু পারে
জানতে পারলাম তারা জেল খানার ভিতর মারামারী করার কারনে তাদের এখানে নিয়ে রেখেছে, আগামী কাল সকালে তাদের বিচার হবে। রাত্রি ৩ টার দিকে একজন কে নিয়ে আসা হলো, দেখে মনে হল তিনি অনেক ভদ্রলোক, পরে তার সাথে কথা
বলে জানতে পারলাম তিনি ভূয়া ডাক্তার, ভ্রামান আদালত তাকে
গ্রেফতার করে এক মাসের জেল দিয়েছে। এই
ভাবে বিভিন্য ঘটনার মধ্যদিয়ে রাত্রি পার করলাম।
০২ এপ্রিল ২০১৮
ইং সকাল ০৫ টায় সকল বন্দীদের ঘুম থেকে ডেকে তোলা হলো, আবার ফাইল ঠিক করে গুনাগুনি শেষে আমাদের কেস্টো ডেবিলে নেওয়া হলো। কেস টেবিলকে সবায় কেস্টো টেবিল বলে। খেলার মাঠ, ফুলের বাগান, অনেক বড় জায়গা নিয়ে এসব করা হয়েছে। দুই পাশে দুটো বড় বড় খেলার মাঠের মাঝ খানে বড় একটা
টিন শেড ঘর, ঘরের চারিদিকে খোলা, অনেক
সুন্দর পরিবেশ, বন্দীদের জন্য ঠান্ডা-গরম পানি খাওয়ার
ব্যবস্থা আছে, ঠান্ডা বাতাশ,
হৈচৈ-চিল্লা-চিল্লি নেই, বিড়ি-সিগারেটের ধুয়ার গন্ধ নেই। আমাদের সেখানে ফাইল ঠিক করে নামের সিরিয়াল করে
বসানো হলো। রাতে যে কষ্ট
হয়েছে তা এখানে আসার পর মনে হল আমরা কষ্টের সময় পার করে এসেছি। কিছক্ষন পর নাম ধরে ধরে ডাক দিয়ে টেবিলের পাশে লাইন
ধরে দাঁড় আমাদের দাড় করানো হলো, একে একে নাম ঠিকানা, পরিবার পরিজনের নাম ঠিকানা লেখা শেষ হলে শরীরের জামা খুলে ক্ষত চিহ্ন, তিল চিহ্ন কোথাই কোথাই আছে তা লিখে নিল। যারা এই কাজ গুলি করছিল তারা কেও জেল পুলিশ নই, সবাই পুরাতন কয়েদী, যার বেশির ভাগ সাবেক বিডিআর। ক্ষত চিহ্ন, তিল চিহ্ন দেখা ও লেখা
লেখি শেষ করে, ফাইল ঠিক করে গুনে গুনে আবার আমাদের আমদানী
ফাইলে নিয়ে যাওয়া হল। সকালের
নাস্তা দেওয়া হল, একটা করে লাল গমের আটার রুটি সাথে একটু
আখের গুড়, খেতে আমার তেমন কষ্ট হয়নি কারণ আমি নিজের বাসাতে
প্রতিদিন লাল গমের আটার রূটিই খায়, তবে দুইটা হলে ভাল হতো। অনেকের কাছে সকালের এই নাস্তা খুবী কম। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম পরবর্তি পদক্ষেপ এর জন্য।
আমাদের কোথাই পাঠানো হবে, সবাই একসাথে থাকতে পারবো কিনা এসব নিয়ে আমরা আলাপ আলোচনা
করছি এর মধ্যো একজন কয়েদী এসে আমাদের বললো “আমরা যদি একসাথে থাকতে চায় তাহলে ৫০০০
টাকা দিতে হবে তাহলে সে আমাদের একসাথে রাখার ব্যবস্থা করবেন। প্রথমে আমরা তাকে
বললাম আমরা ৩০০০ টাকা দিব কিন্তু সে তখন রাজি হলোনা।পরে যখন সে রাজি হলো ততক্ষণে
আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা টাকার বিনিময়ে কোন সুযোগ সুবিধা নিবনা।অনেকে অনেক রকম
ভয় দেখাচ্ছিল যে, আমাদের কাকে কোথাই রাখবে, কেও কারো সাথে দেখা করতে পারবোনা
ইত্যাদি ইত্যাদি।
দুপুরের দিকে
একজন কয়েদী আমাদের নাম ধরে ধরে ডেকে সবার কাছে একটি করে আমাদের ছবি যুক্ত কাগজ
দিল, সেই কাগজের নাম কেইস কার্ড, কার্ডে নাম ঠিকানা ছবি কেইসের বিবরন লেখা আছে। কার্ড
হাতে পেয়ে আমরা যানতে পারলাম আমরা সবাই এক বিল্ডিংএর ৪র্থ তলায়। বিল্ডিংএর নাম
যমুনা। আমি, সাদেকুর রহমান শামিম, লুতফর রহমান আকাশ আমরা ৫নং রুমে। মঞ্জুর মইন,
জালাল হাওলাদার ৭নং রুমে। শাজাহান ৪নং রুমে। আবার সবার ফাইল ঠিক করে গুনে গুনে
আমাদের একজন কয়েদী যমুনা বিল্ডিংএ নিয়ে গেলেন। অনেক বড় বিল্ডিং একটা ফ্লোরে ৮টি
রুম আছে রুমে ২০ জন কয়েদী থাকার উপযোগী, রুম গুল এমন ভাবে নির্মান করা হয়েছে যাতে
কয়েদীরা সকাল বিকাল হাটা হাটি করতে পারে, একে অপরের সাথে দেখা করতে পারে। আমি,
সাদেকুর রহমান শামিম, লুতফর রহমান আকাশ যখন ৫নং রুমে প্রবেশ করি তখন রুমের কয়েদীরা
আমাদের স্বাগত জানালেন।রুমের ভিতরেই ওয়াশ রুম, আমরা হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে রুমে
প্রবেশ করলাম। রুমে ঢালা কম্বল এর বিছানা, বিছানার উপর চাদর পাড়া আছে, কম্বল দিয়েই
বালিশ বানানো। একরুমে ৪০ জনেরও বেশি কয়েদী থাকে তার মধ্যো আমাদেও থাকতে হবে।রুমে
একজন ইঞ্চার্জ, একজন রাইটার ম্যান, কয়েকজন সেবক আছে তারা সবাই পুরানা কয়েদী।মাসে
এক প্যাকেট হলিউড সিগারেট এর বিনিময়ে সেবক গন ওয়াশ রুম, ঘর পরিষ্কার করে রাখেন। কাপড়
ধোয়ার জন্য আরো এক প্যাকেট হলিউড সিগারেট দিয়ে হবে, শরীর ম্যাসেজ করলে আরো এক
প্যাকেট হলিউড সিগারেট দিতে হবে। রুমের ভিতর তিন লাইন করে বিছানা পাড়া থাকে।
মাঝখানের লাইনকে ফাইল বলে আর দু-পাশে দুই লাইনকে বেড বলে। আমরা ফাইলেই থাকলাম।
বেডে থাকতে হলে রুমের ইঞ্চার্জকে প্রতি জনের জন্য একপ্যাকেট করে বেন্সন সিগারেট
দিতে হবে, তাহলে আমরা বেডে থাকতে পারবো। আমরা ফাইলেই থাকতে লাগলাম। প্রতিদিন রুমের
রাইটার ম্যান আমাদের চানাচুর, মুড়ি, চা খাওয়াতেন। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬ টায় রুমের
গেইট লক করে দিতেন আর সকাল ৫ টায় খুলে দিতেন, গেইট লাগানোর আগে জমাদ্দার এসে ফাইল
ঠিক করে গুনা গুনি করতো, আবার গেইট খুলার পর জমাদ্দার এসে ফাইল ঠিক করে গুনা গুনি
করতো। রুমের গেইট খুলার পর বিল্ডিংএর মধ্যো হাটা হাটি করতাম। গ্রিল ধরে বাইরে
তাকালে অনেক সুন্দর লাগতো। সামনে জেল কর্মকর্তাদের আবাসিক এলাকা, বাচ্চারা স্কুলে
যাচ্ছে, কেও ঘাসের উপর হাটা হাটি করছে, আর খোলা হাওয়া এসে গায়ে পড়তো যখন আমার প্রান
জুড়িয়ে যেত। আমি প্রতিদিন এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার আম্মুজির কথা ভাবতাম, আমার
আম্মুজি আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না, রাতে ঘুমের মধ্যও আম্মুজি আমাকে খোজে, আমি
যতক্ষণ বাসায় না ফিরি ততক্ষণ আম্মুজি আমার জন্য জেগে থাকে আর আমি আম্মুজিকে ছাড়া
এখানে আছি। আমার বাবা অনেক বার জেলে গিয়েছে, আমার বাবা ভূমিহীন, খেতমজুরদের নিয়ে
তাদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করতেন যার কারণে বার বার বিভিন্য মিথ্যা মামলায় জেলে
যেতেন, ১৯৯৫ সালে শ্রমিক মেহনতি মানুষের পক্ষে লড়াই করতে করতে জীবন দিয়েছেন, আমি
তার সেই দেখানো পথে হাটছি, হইতো বাবার মত আমাকেও একদিন এভাবেই জীবন দিতে হবে। আমরা
৬ জনেই ৪র্থ তলার সিঁড়ির কাছে এসে নিয়মিত আড্ডা দিতাম, আমাদের সাথে আরো অনেকেই
যুক্ত হতো, কেও কেও তার পরিবারের সুখ দুঃখের কথা বলতেন, বাচ্চাদের কথা বলতেন, কি
ভাবে কেন জেলে এসেছেন তাও আলাপ করতেন। আমরা মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম,
৩/৪মাস আমাদের জেলে থাকতে হবে। আমরা ৬জনের ৫জনিই ধূমপান করতাম না তবুও সবার কাছে
হলিউড সিগারেট রাখতে হতো, কারণ সিগারেটের বিনিময়ে সব কিছুই পাওয়া যায়, যেমন তরকারী
বা যে কোন খাবার, চা, কফি, ডিংকসসহ সব ধরণের খাবার, চুল,-দাড়ি কামানো, মোবাইলে কথা
বলা, লাইব্রেরীতে পড়াসহ অনেক কিছুই সিগারেটের বিনিময়ে। আমরা সকালের নাস্তা খাওয়ার
আগেই গোছল সেরে নিতাম, প্রতি বিল্ডিং এর নিচে দুটো করে খোলা চৌবাচ্চা আছে, জগে করে
পানি তুলে তুলে আমরা গোছল করতাম, একসাতে সবাই এই ভাবে গোছলের মজাই আলাদা। সকাল,
দুপুর, বিকালে পানির লাইন ছাড়ার জন্য একজন লাইন ম্যান আছে, সেও একজন পুরানা কয়েদী।
তার সাথে আমার অনেক কথা হয়েছিল, সে বিডিয়ার বিদ্রহের আসামী, তার ১০ বছর সাজা
হয়েছে, সে জেলে বসে প্রতিমাসের ইনকাম দিয়ে ৯ বছরে ৩০ লক্ষ টাকা জমিয়েছে। সকালের
নাস্তায় একটি লাল গমের রুটি আর একটুকরো গুড়। অনেকেই জেলখানার নাস্তা না খেয়ে পিসি
থেকে নাস্তা কিনে খেতে। পিসি হলো, দোকানের নাম, যেখানে কায়েদীরা টাকা জমা রাখতে
পারে এবং প্রয়োজনীয় খাবারসহ সকল জিনিসপত্র পিসিতে পাওয়া যায়। প্রতি বিল্ডিংএর নিচে
এই রকম দুইটা পিসি দোকান আছে। যমুনা বিল্ডিংএ আসার পর ভোর রাতে শীত লাগতো, কারণ
ঘরের ভিতর ৪টা ফ্যান অনেক জোরে ঘুরতো আর জানালা গুল খোলা থাকতো যার কারণে ঘরে
প্রচুর ঠান্ডা বাতাশ। প্রথম রাতে আমার গায়ে দেওয়ার কিছু ছিল না তাই একটু শীতে কষ্ট
করতে হয়েছে। পরদিন একজন দেখা করতে আসলে আমি তাকে গায়ে দেওয়ার চাঁদর কিনে দিতে বলায়
সে একটি বিছানার চাঁদর কিনে দিয়েছিল তাই প্রতি রাতে গায়ে দিতাম। প্রতি রুমেই
নিয়মিত নামাজ হইতো, আমাদের রুমের যে ইমামতি করতো সে ইয়াবা ব্যবসায়ী আর মুয়াজ্জেম
হেরুইন ব্যবসায়ী। মুয়াজ্জেম সাহেব হেরুইন ব্যবসা করে গাজীপুরে ৮% জমি কিনেছেন,
এবার নিয়ে সে ১৭ বার জেলে এসেছে। ইমাম সাহেব থাকেন শনির আখড়াতে সে এর আগে কতবার
জেলে আসছে তার সঠিক হিসাব জানা নেই। ওদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম জেলখানাতে
মাদক ব্যবসায়ীদের নিরাপদ স্থান, জেলে বসেই অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। মাদক ব্যবসা
করতে গিয়ে কেও জেলে আসলে ওদের লোকজন আছে তাদের দেখা শোনা করার জন্য। এই জেল থেকে
কাশেম্পুর জেলখানাতে গেলে ওখানে কার সাথে যোগাযোগ করতে হবে তাও তারা বলে দেই, এখান
থেকে বিদায় দেওয়ার সময় তেল সাবান, চানাচুর মুড়ি সহ তার জা জা প্রয়োজন সব কিছু সাথে
দিয়ে দেই।অনেক মাদক ব্যবসায়ীর মাসিক কন্ট্রাক বেসিক উকিল নিয়গ দেওয়া আছে। ওদের
চলাফেরা দেখলে মনে হবে জেলখানা মানে ওদের নিজের বাড়ী। তবে নারী নির্যাতন মামলাতে
যারা জেলে যায় তাদের কেও পছন্দ করেনা। অস্ত্র মামলা, মার্ডার মামলা, মারামারি,
রাজনীতির মামালা অনেক সন্মানের। এই মামলাতে যারা জেলে আসে তাদের সবাই খুব পছন্দ
করে। অস্ত্র ব্যবসায়ীরা জেলে বসেই ব্যবসা করে, অনেকে জামিন পাওয়ার পর কোথাই কীভাবে
অস্ত্র, মাদক পাওয়া যায় তা জেনে আসে। অনেকে জেলে এসে ভালো হয়ে যাওয়ার পরিবর্তে
অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায়ী হয়ে বের হয়, জেলখানা তো নই যেন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। প্রতি
রুমে রুমে জামাতের লোকেরা তালিম এর নাম করে নিয়মিত মিটিং করেন।
জেলখানার ভিতর
মিনি হাসপাতাল আছে, অনেক সুন্দর পরিবেশ, অনেকে অনেক টাকার বিনিময়ে হাসপাতালের বেড
ভাড়া করে দিনের পর দিন থাকেন। জেলখানার ভিতর মিনি পাগলা গারোধ আছে, সেখানে অনেক পাগল
অপরাধী আছে তবে তাদের সাথে কথা বলে আমার পাগল মনে হয়নি। তবুও সাধারণ বন্দীরা তাদের
থেকে দূরে থাকে। প্রচার আছে ওরা রেগে গেলে নাকি সবার উপর ঢিল ছুড়ে মারে ও অনেক চেঁচামেচি করে। খেলার মাঠের একটু দূরে
ভিআইপি কয়েদীদের জন্য আলাদা বিল্ডিং, সবাই ওদিকে একটু কম কম যাওয়া আসা করে।
প্রতিদিন বেলা ৩টায় সকল বন্দীদের খোলা মাঠে আসার সুজোগ দেওয়া হয়, কেও কেও ফুটবল,
ভলিবল, হাডুডূ, ক্রিকেট খেলা করেন, কেওকেও পানির বোতল বাজীয়ে গান-বাজনা করেন,
অনেকে গোল হয়ে বসে আড্ডা দিতেন। সবাই অনেক মজা করে এই সময়টাতে, অনেকে হাটাহাটি
করেন। আমরা মাঝে মাঝে আড্ডা ও নিয়মিত হাটাহাটি করতাম, হাটাহাটির কারণে অনেক
মানুষের সাথে দেখা হতো। এই ভাবেই নানান রকম ঘটনায় আমাদের প্রতিদিন কাটতো।
আমরা জেলে যাওয়ার
দুইদিন পর জানতে পারলাম বাংলাদেশের প্রধান
জল্লাদ মো. শাহজাহান ভূঁইয়া আমরা যে বিল্ডিংএ আছি সেই বিল্ডিং এর আমাদের
ফ্লোর এর ৮ নং রুমে তিনি থাকেন। আমরা সবাই তার সাথে দেখা করলাম, সে
আমাদের খোঁজ খবর নিলেন, কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলেন। তিনি আমাদের চা
বিস্কুট খাওয়ালেন। তার সাথে আলাপ করে আমরা তার অনেক অজানা অধ্যায়ের জানতে পারলাম।
কিন্তু তাঁর সাথে গণমাধ্যমের সরাসরি যোগাযোগ না থাকার কারণে তথ্য বিভ্রাট হচ্ছে।
তিনি কত বছর জেলে আছেন, কতটি মামলা তাঁর নামে বা এখন পর্যন্ত
কত জনকে ফাঁসি দিয়েছেন তার প্রায় সব তথ্যই ভুলভাবে প্রকাশিত হয়েছে। জল্লাদ
শাহজাহান ইতোপূর্বে অনেক চেষ্টা করেও কোন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিতে পারেননি। তিনি
সারা পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে দীর্ঘসময় (৩৯ বছর) ধরে কারাগারে বন্দী রয়েছেন। তিনি
বাংলাদেশের সব থেকে বেশি আসামীকে (৩৫ জনকে) ফাঁসি দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের সকল
কারাগারের প্রধান জল্লাদ। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫ ঘাতককে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন।
তিনি বাংলাদেশের কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার, জঙ্গি নেতা
বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানী, শারমীন রীমা
হত্যার আসামী খুকু মুনির, ডেইজি হত্যা মামলার আসামী হাসানসহ বঙ্গবন্ধু
হত্যা মামলার আসামীদের ফাঁসি দিয়েছেন। তিনি একমাত্র জল্লাদ যিনি একরাতে দুই
কারাগারে চারজন আসামীকে ফাঁসি দিয়েছেন। কাদের মোল্লাহ সহ সকল যুদ্ধাপরাধীদের
ফাঁসি দেওয়ার পর তিনি সবার আলোচনায় আসেন। জল্লাদ শাহজাহানের জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে
অনেক অর্জন থাকলেও তিনি কারও সামান্যতম সহানুভূতি পান না। পত্রিকায় তাকে নিয়ে
অনেক ভুল খবর প্রকাশিত হলেও তা শুধরানোর পথ নেই কারণ তার সাথে যোগাযোগ করার সুযোগ
খুব কম লোকই পান।
মো: শাহজাহান ভূঁইয়া। জন্ম
গ্রহণ করেন ১৯৫০ সালের ২৬ মার্চ। জন্মস্থান নরসিংদীর পলাশ উপজেলার গজারিয়া
ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামে। তিন বোন এক ভাই। বাবার নাম হাসান আলী ভূঁইয়া। মাতা সব
মেহের। পড়াশোনা করেছেন এইসএসসি পর্যন্ত। তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম খাস হাওলা
ফ্রি প্রাইমারি স্কুল, মাধ্যমিক পড়াশোনা করেছেন পারলিয়া উচ্চ
বিদ্যালয়ে এবং সর্বশেষ উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনা করেছেন নরসিংদী সরকারি কলেজে।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অবিবাহিত। ১৯৭৪ সালে তিনি এইসএসসি পাশ করেন। তার জাতীয়
পরিচয়পত্র নম্বর হচ্ছে- ২৬৯১৬৪৯১০৬১২৯। ছোট থেকেই সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড তাকে খুব
আকর্ষণ করতো। বিশেষ করে তাদের শৃঙ্খলাবোধ তার সব থেকে বেশি ভালো লাগতো। তাই মনে
প্রাণে সব সময় স্বপ্ন দেখতেন সুযোগ পেলেই সেনাবাহিনীতে চাকরি করবেন। বাবার
মাধ্যমে তিনি একবার খবর পান সেনাবাহিনীতে লোক নেওয়া হচ্ছে। এরপর সেনাবাহিনীর
চাকরির জন্য অংশগ্রহণ করলে তিনি টিকে যান। যথা সাধ্য তিন বছর সেনাবাহিনীতে থাকার
পর বড় অফিসারদের ধমকের কারণে জিদ করে বাড়ি চলে আসেন। তিনি বলেন, অফিসারদের কমান্ড আমার ভালো লাগতো না। কারণ আমি তাদের থেকে পড়াশোনা এবং
পারিবারিক দিক থেকে অনেক এগিয়ে ছিলাম। তিনি চাকরি করবেন না বলে ১১ মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত
থাকলে তার সেনাবাহিনীতে চাকরি করার স্বপ্নের কবর এখানেই রচিত হয়। স্বাধীনতার যুদ্ধ
জয়ের ৪ বছর পর। তখন তিনি তরতাজা তরুণ। এইসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছেন ২ বছর আগে।
মনের অজান্তে ভালো লেগে যায় কমিউনিস্ট পার্টি। সেখানে তার নাম লেখিয়ে ফেলেন। তার
পারফরমেন্স দেখে কেন্দ্রে থেকে তাকে ডেকে পাঠানো হয়। তাকে নরসিংদী জেলার কমিউনিস্ট
পার্টির সভাপতির দায়িত্ব দিতে চাইলে তিনি রাজি হয়ে যান। ১৯৭৬ সালে আনুষ্ঠানিক
ভাবে তিনি জেলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এখনো তিনি জেলখানাতে থাকলেও সমাজতন্ত্রের
স্বপ্ন দেখেন। ছেলে হিসেবে শাহজাহান খুবই ভালো ছেলে ছিলেন। পারতপক্ষে কারও উপকার
ছাড়া ক্ষতি করার চেষ্টা করতেন না। তবে তিনি প্রচণ্ড বন্ধু পাগল মানুষ ছিলেন। একবার
তার গ্রামে নারী ঘটিত একটি ঘটনা ঘটে। শাহজাহানের দুই বন্ধুসহ তার নামে অভিযোগ ওঠে।
গ্রামে তাকে নিয়ে বিচারে বসা হয়। সেই বিচারে তাকে অপরাধী প্রমাণিত করে তাকে সাজা
দেওয়া হয়। এরপর থেকেই তার ক্ষিপ্ততা শুরু। তিনি অপমান সহ্য করতে না পেরে
সিদ্ধান্ত নেন অপরাধ জগতে প্রবেশ করে এই অপমানের চরম প্রতিশোধ নিবেন। যেই
সিদ্ধান্ত সেই কাজ। তারপর অনেক লম্বা ইতিহাস। নারীঘটিত ওই ঘটনার পরে তিনি
বাংলাদেশের একজন বহুল পরিচিত সন্ত্রাসীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন। তাছাড়া
কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করার পর থেকে যেকোন অপারেশনে তার চাহিদা দিনকে দিন
বৃদ্ধি পেতে থাকলো। তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন করেছিলেন ১৯৭৯ সালে
মাদারীপুর জেলায়। এবং এটাই ছিল তার জীবনে সর্বশেষ অপারেশন। সেখানে তার অপারেশন
শেষ করে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করেন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ
জানতে পারে শাহজাহানের দল মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় যাবে। মানিকগঞ্জে পুলিশ চেক পোস্ট
বসালে শাহজাহান তার ওই এলাকার বাহিনীর মাধ্যমে তা জেনে যান। সব জেনেই ওই এলাকা
দিয়ে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। রাতভর মানিকগঞ্জে পুলিশের সাথে বন্দুক
যুদ্ধ করেন কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। এরপর ঢাকায় পৌঁছে যখন নরসিংদীর
উদ্দেশ্যে রওনা হন প্রতিমধ্যে পুলিশ তাকে আটক করে ফেলে। তার গতিময় জীবনের এখানেই
সমাপ্তি এবং এরপর থেকে তার বন্দী জীবন শুরু। ১৯৭৯ সালে আটক হওয়ার আগে ও পরে তার
নামে সর্বমোট ৩৬ টি মামলা হয়। এর মধ্যে ১ টি অস্ত্র মামলা, ১
টি ডাকাতি মামলা এবং অবশিষ্ট ৩৪ টি হত্যা মামলা। বিচারকার্যে দেরি হওয়ার কারণে
সাজা ছাড়াই তিনি ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ১৭ বছর হাজতি হিসেবে কারাগারে
থাকেন। ১৯৯৫ সালে তার সাজা হয় ১৪৩ বছর!! পরে ১০০ বছর জেল মাফ করে তাকে ৪৩ বছরের
জন্য জেল দেওয়া হয়। শাহজাহানের জেল থেকে বের হওয়ার তারিখ তার জেল কার্ডের ওপর
লেখা আছে “ডেট অব রিলিজ ২০৩৫”। তিনি যখন ঢাকা কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের
ভেতরে বসে তার রিলিজ ডেট আমাদের দেখালেন তখন একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কার্ডের দিকে
তাকিয়ে থাকেন। কারণ তার রিলিজ ডেটে বয়স হবে ৮৫ বছর। ততদিনে তিনি বাঁচবেন তো?
তখন মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে তার জীবনের কী কোন অর্থ খুঁজতে
পারবেন? জীবনের সোনালী সময় গুলো তাকে এখানেই কাটাতে হবে।
তিনি ভাবলেন জল্লাদ হিসেবে সময় দিলে তার সাজা কিছু দিনের জন্য হলেও কম হবে। তাই
নিজেকে অন্যভাবে প্রস্তুত করার জন্য জেল সুপারের কাছে জল্লাদের খাতায় নাম লেখানোর
আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রথম ১৯৮৯ সালে তিনি সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল
ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে তার জল্লাদ জীবনের সূচনা করেন। এটাই তার জীবনের প্রথম
কারাগারে কাউকে ফাঁসি দেওয়া। তার যোগ্যতা দেখে ৮ বছর পর ১৯৯৭ সালে কারা কর্তৃপক্ষ
তাঁকে প্রধান জল্লাদের আসন প্রদান করেন। প্রধান জল্লাদ হওয়ার পর আলোচিত ডেইজি
হত্যা মামলার আসামী হাসানকে প্রথম ফাঁসি দেন। তিনি জানান একটি ফাঁসি দিতে প্রধান
জল্লাদের সাথে ৬ জন সহযোগী লাগে এবং ফাঁসির রায় কার্যকর করলে প্রত্যেক জল্লাদের ২
মাস ৪ দিন করে কারাদণ্ড মওকুফ করা হয়। এছাড়া কারাগারে যারা জল্লাদ হওয়ার ইচ্ছা
প্রকাশ করে থাকে কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শাহজাহান তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে
থাকেন। উল্লেখ্য, বিশেষ দিনে কারা কর্তৃপক্ষ মিডিয়াকে
দেখানোর জন্য বলে থাকেন এই দিনে একশত থেকে প্রায় এক হাজার বন্দীকে মুক্তি দেওয়া
হয়েছে। আসলে যারা দীর্ঘদিন ধরে কারা ভোগ করছে বা বৃদ্ধ হয়ে গেছেন তাদেরকে মুক্তি
দেওয়ার কথা থাকলেও মূলত: রাজনৈতিক বিবেচনায় বন্দী মুক্তি দেওয়া হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে
যাদের আর মাত্র ২/১ দিন বা এক সপ্তাহ কারাভোগের দিন বাকী আছে তাদেরকে মুক্তি দিয়ে
অনেকে মহৎ মানুষের পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন!!
শাহজাহান বাম রাজনীতি করতো বলে
তার বাবা তাকে খারাপ চোখে দেখতেন। জীবনের সোনালী মুহুর্তে যখন তিনি কারাগারে
প্রবেশ করেন তারপর থেকে তার বাবার সাথে আর কোন দিন যোগাযোগ হয়নি। মা বেচে থাকা
অবস্থায় নিয়মিত দেখতে আসলেও বাবা কোন দিন জেল গেটে তাকে দেখতে আসেননি। এমনকি
বাবার মৃত্যুর ২ মাস পর খবর পান তার বাবা আর বেচে নেই। বেচে আছেন তিন বোন। তারা
থাকেন বাবার রেখে যাওয়া ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের ১১২ নম্বর বাড়ীতে। এখানে
শাহজাহানদের ৬ কাঠা জমি আছে। তিনি অভিযোগ করেন বলেন, সব জমি বোনেরা
নিয়ে নিয়েছে। এই বোনেরাও তাকে ১৫/২০ বছর আগে একবার দেখতে এসেছিলো। তারপর আর কোন
খবর নেই। তিনি জানান সর্বশেষ আট বছর আগে অর্থাৎ ২০১০ সালে একদিন তার বোনের ছেলে দেখতে
এসেছিলো। এই তিন বছরে তারাও আর খবর নেয়নি।
জেলখানায় তিনি জল্লাদ শাহজাহান
নামেই খ্যাত। এমনকি তার জগ-বালতি-প্লেটের ওপরেও লেখা জল্লাদ। হাজতীরা কয়েদী হয়ে
গেলে কারাগারে তাদের মূল্যায়ন একটু বেশিই থাকে। তাই তারও এখানে মূল্যায়ন বেশি।
অন্যদের মতো তিনিও এখানে নতুন হাজতীদের থাকা, খাওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা
করে থাকেন। বিনিময়ে কিছু টাকা পান এবং তা দিয়ে এখানে তিনি একটু আরাম আয়েশে
থাকতে পারেন। এখন তার দায়িত্বে প্রায় ৩৫ জন লোক থাকে। তার মধ্যে ৫ জনকে ফ্রী খাওয়ান
এবং বাকীরা নতুন হাজতী আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকে বলে তারা টাকা দিয়ে থাকেন। নিয়ম
অনুসারে তার এই টাকা সিট বিক্রেতা, সুবেদার, জমাদার, জেলার থেকে শুরু করে জেল সুপার পর্যন্ত ভাগ
পান। তাদের ভাগ দেওয়ার পর যা বাঁচে তা দিয়ে চৌকা থেকে ভালো কিছু সবজি কিনে
তাদেরকে খাওয়ান। সপ্তাহে একদিন পোলাও গোস্ত খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
সপ্তাহে একদিন করে দায়িত্ব
পরিবর্তন করার নিয়ম থাকলেও তিনি বিশেষ অনুরোধে একটি দায়িত্ব পালন করেই দিন যাপন
করেন। ভোর ছয়টার আগে ফাইলে অংশগ্রহণ করার জন্য অন্য সবার মতো তিনিও ঘুম থেকে উঠে যান।
বাইরে থেকে ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে সকালের নাস্তা করেন। দুপুর ১২ টায় ‘বারো গুনতি’র পর লাঞ্চ দেওয়া হয়। শাহজাহান তার সংসারের ৩৫ জন লোক নিয়ে বসেন।
একে একে সবাইকে নিজ হাতে খাবার বেড়ে দেওয়ার পর তিনি খাবার খান। দুপুরের পরে কারা
কর্তৃপক্ষের কোন কাজ থাকলে তিনি তা করেন বা নিজের মতো করে ঘুরে বেড়ান।
বিকেলে পাচটার আগে সবাইকে ঘরে
ফিরতে হয় তখন তিনি তার কক্ষে চলে আসেন। সন্ধার নামাজের পর রাতের খাওয়ার দেওয়া
হয়। তখন তিনি আবার সবাইকে খাওয়ানোর পর নিজে খান। খাওয়া শেষ হলে রাতের বিছানা ঠিক
করে সবার ঘুমানোর ব্যবস্থা করেন তিনি। তার রুমে ২০ জন মানুষের থাকার ধারণ ক্ষমতা
রয়েছে। কিন্তু সেখানে প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন লোক থাকে। তাদের প্রত্যেকের জন্য তার
দোড়ঝাপ একটু বেশিই করতে হয়। এতো কিছুর মধ্যেও তার রুম সব সময়ের জন্য পরিষ্কার
পরিচ্ছন্ন রাখেন। সম্ভব হলে রাতে বিটিভির খবর দেখেন তা না হলে তার বহু পুরানো একটি
রেডিওতে নিয়মিত রাত সাড়ে দশটার বিবিসির খবর শোনেন। রাতে ঘুম না আসলে দাবা অথবা তাশ
খেলে সময় কাটান। কখনও কখনও মধ্য রাতে এফএম রেডিওতে প্রচারিত গান শোনেন। এভাবেই
একসময় তিনি ঘুমিয়ে পরেন। পরের দিন ভোরে আবারও ঘুম থেকে উঠে আগের রুটিনে তার
নিয়মিত পথ চলা। আমরা যে কইদিন জেলখানাতে ছিলাম তিনি আমাদের নিয়মিত খোঁজ খবর
রাখতেন। তিনি আমাদের রুমের যে ইঞ্চার্জ ছিলেন তাকে অনেক গর্ভকরে বলেছিলেন ‘এরা
আমার দলের লোক এদের যেন কোন অসুবিধা না হয়’। তিনি অনেক সহজ সরল, দেখেই মনেই হবেনা
তিনি একজন জল্লাদ, আমরা যেদিন চলে আসি সেদিনো আমরা তার সাথে দেখা করে এসেছি।
১৭৮৮ সালে তৎকালীন শাসকদের
দ্বারা একটি ক্রিমিনাল ওয়ার্ড নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের তথা
কারা বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৮১৮ সালে রাজবন্দিদের আটকার্থে বেঙ্গল
বিধি জারি করা হয়। ১৮৩৬ সালে জেলা ও তৎকালীন মহকুমা সদর ঢাকা, রাজশাহী, যশোর ও কুমিল্লায় কারাগার নির্মাণ করা হয়।
পরবর্তীতে ১৯২৯ সালে ঢাকা ও রাজশাহী কারাগারকে কেন্দ্রীয় কারাগার হিসেবে ঘোষণা
দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে
বাংলাদেশ জেল বা বি,ডি,জে এর যাত্রা শুরু
হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৩ টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগার রয়েছে। কারা
বিভাগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের criminal justice system এর
একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারা সদর দপ্তর, ৭টি বিভাগীয়
কারা দপ্তর এবং ৬৮টি কারাগার নিয়ে বাংলাদেশের কারা বিভাগ গঠিত। কারা বিভাগের সকল
কাজকর্ম কারা সদর দপ্তর থেকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে। কারা মহাপরিদর্শকের নেতৃত্বে
১ জন অতিঃ কারা মহাপরিদর্শক ও ৮ জন কারা উপ-মহাপরিদর্শকের সমন্বয়ে কারা বিভাগের
প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কারাগার পর্যায়ে জেল সুপার / সিনিয়র জেল সুপার দপ্তর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আমরা পাঁচ দিন জেলে থাকার পর আমাদের সাথে যারা দেখা করতে আসতো তাদের মাধ্যমে
বিকালে প্রথম জানতে পারি আমাদের হায় কোর্ট থেকে জামিন হয়েছে কিন্তু
এই খবরটা আমরা অন্য কয়েদীদের আমরা যানায়নি কিন্তু ৬ এপ্রিল
পত্রিকার মাধ্যমে আমাদের জামিনের খবরটা প্রকাশিত হওয়ার কারণে সবাই জানতে পেরে
গিয়েছিল তাই অনেকেই আমাদের কাছে এসে কিভাবে এত তাড়াতাড়ি জামিন পেলাম।
আমাদের উকিল কে ইত্যাদি ইত্যাদি। কেও কেও আমাদের কাছ থেকে মিষ্টি খেতে চাচ্ছিলেন। আমরা
জামিনের খবর শুনেও বেশি খুশী হতে পারছিলাম না কারণ আমাদের মনে হচ্ছিল, আমাদের নামে
অন্যকোন মামলা দেওয়া হবে যাতে আমরা জেল থেকে বের হতে না পারি। ৬ এপ্রিল আমাদের
জামিন হইলেও আমরা জেল থেকে বের হতে পারিনি কারণ পরদিন শুক্র-শনিবার থাকায় আমাদের
জামিন আদেশ স্বাক্ষর হতে পারেনি। ৮ এপ্রিল রবিবার আমাদের রিমান্ড শুনানির জন্য
কোর্টে নেওয়া হলো কিন্তু হায় কোর্ট আমাদের জামিন দেওয়ার কারণে রিমান্ড শুনানি
হলোনা, আমাদের আবার জেলখানাতে পাঠিয়ে দেওয়া হইলো।
আমরা ভেবেছিলাম আমাদের নামে অন্য কোন
মামলা দেওয়া হয়েছে কিন্তু না, ৯ তারিখ অনেক সকালে আমাদের কাছে জামিনের কাগজ চলে
আসলো। আমরা সকলকে বিদায় জানিয়ে রুম থেকে বের হয়ে অন্য বিল্ডিং এ
একটি চেকিং রুম আছে আমরা সেখানে গেলাম। রুম থেকে বের হওয়ার আগে আমরা যে পোষাকে
জেলে গিয়ে ছিলাম সেই পোষাক বাদে সকল পোষাক বিভিন্য জনকে দিয়ে দিলাম। আমরা সেসব
জিনিষ কিনেছিলাম তাও দিয়েদিলাম। সবাই খুব খুশী হয়েছিল। কারণ জেলখানাতে অনেকেই আছেন
যাদের পরিবারের কেও দেখা করতে আসেনা, কেও তাদের প্রয়োজনীয়
কিছু জিনিষ পত্র কিনেও দিয়ে যায়না।
সকালে আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম, যেহেতু
আমাদের জামিনের আদেশ চলে এসেছে তাই কিছুক্ষণ এর মধ্যো আমরা জেলে থেকে বের হয়ে যেতে
পারবো। কিন্তু তা হলোনা পদে পদে এই কাগজ সেই কাগজ করতে করতে অবশেষে জেল গেইটে
আসলাম তখন দুপুর পার হয়ে গেছে। জেল গেইটে ফাইল ঠিক, এই কাগজ সেই কাগজ কত রকম
প্রসেস করার পর ফাইল গেল জেলার এর কাছে। জেলার আমাদের একে একে ডাকলেন, আমাদের
বিভিন্য ধরণের প্রশ্ন করলেন এবং আমাদের এত তাড়াতাড়ি জামিন হয়েছে তাই তিনি আমাদের
কাছ থেকে মিষ্টি খেতে চাইলেন, আমাদের পিসি থেকে বাঁচানো ৯০০
টাকা দিয়ে দিলাম মিষ্টি কেনার জন্য। সব শেষে পুলিশের এসবি কে ৬০০ টাকা দিতে হল
মিষ্টি কেনার জন্য। এই ভাবে পদে পদে বাঁধার সম্মুখীন হয়ে অবশেষে আমরা বিকাল বেলাতে
বের হতে পারলাম, ততক্ষণে আমাদের পেটের ক্ষুদাই আমরা এতটাই দুর্বল
হয়ে পড়েছিলাম যে আমরা আর দাড়াতে পারছিলাম না।
জেল গেইট থেকে আমরা যখন বের হয়ে
দেখলাম অনেকেই আমাদের জন্য ফুলের মালা নিয়ে অপেক্ষা করছে, আমরা ফুলের মালা গলাই
দিয়ে শ্লোগান দিতে দিতে মাইক্রো বাসে প্রথমে পার্টি অফিসে এসে সবার সাথে দেখা করে
বাসায় ফিরলাম। বাসায় ফিরে বুঝতে পারলাম আমার আম্মুজি জানেই না যে আমি জেলে গিয়েছি
এবং আমার পরিবারের লোকজন আমাকে নিয়ে কোন ধরণের ভয় পায়নি বা কোন ধরণের হতাশাতে
ভোগেনি।
জেলখানা হলো একজন নেতার রাজনিতিক
জীবনের একটা প্রমোশন। শ্রমজীবী গরীব মানুষের পক্ষে কথা বললে জেলে যেতে হবে, পুলিশ,
সরকারী মাস্তান বাহিনীর হাতে নির্যাতন এর শিকার হতে হবেই কারণ বর্তমান রাষ্ট্র
ব্যবস্থা ধনীক শ্রেণীর পাহারাদার। যত দিন না শ্রমিক মেহনতি মানুষের সরকার
প্রতিষ্ঠা না হবে, ততদিন এই ধরণের নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করেই আমাদের এগিয়ে যেতে
হবে। কারণ
আজ বাংলাদেশের শ্রমজীবী ও মেহনতি জনগণ নানা সমস্যায় জর্জরিত। শ্রমিক
মেহেনতি মানুষের আন্দোলন
দানা বাঁধতে শুরু করলেই নেমে আসে দমন-পীড়ন। বাংলাদেশের শ্রমিক মেহনতি
মানুষের নেতৃত্বের অধিকাংশই আজ আপোষমুখি ও ধনিক শ্রেণির পকেটস্থ।
স্বত:স্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা শ্রমিক মেহনতি মানুষের আন্দোলন আজ
সুবিধাবাদীদের হাতে পথ হারা। তাই শ্রমিক মেহনতি মানুষ নিজেদের আন্দোলন নিজেদেরই করতে হবে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত।
লিখেছেনঃ খাইরুল মামুন মিন্টু, সাংগঠনিক সম্পাদক, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড
ইউনিয়ন কেন্দ্র।