আগামী কাল ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী
দিবস। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকদের
ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার, মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ এবং
কর্মক্ষেত্রে বৈরী পরিবেশের প্রতীবাদে নারী শ্রমিকরা রাস্তায় নামেন।
১৮৬০ সালের ৮ মার্চ নারী শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে
তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে নিজস্ব ইউনিয়ন গঠনে ব্যর্থ হন।
১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক
নারী সম্মেলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিন পুরুষের পাশাপাশি নারীর সম-অধিকারের দাবিটি
আরও জোরালো করেন।
১৯০৭ সালে জার্মানির স্টুটগার্টে অনুষ্ঠিত হয়
প্রথম আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলন।
১৯০৮ সালে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী
সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা
জেটকিনের নেতৃত্বে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে ১৭টি দেশের ১০০ জন
প্রতিনিধি নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন।
১৯১১ সাল থেকে ৮ মার্চ দিনটিকে ‘নারীর সম-অধিকার
দিবস’ হিসেবে পালিত হয় ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে।
১৯১১ সালের ১৯ মার্চ প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস
উদযাপন করা হয়। এই দিনে সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া
ও জার্মানিতে লক্ষাধিক নারী মিছিল ও সমাবেশের মধ্য দিয়ে এ দিনটি উদযাপন করেন।
১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ
আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে।
১৯৪৫ সালে সান ফ্রান্সিসকোতে ‘জেন্ডার
ইক্যুয়ালিটি’ চুক্তিতে নারী অধিকারের যৌক্তিক দাবিগুলো বিবেচনায় রেখে স্বাক্ষর করে
জাতিসংঘ।
১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী
দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে অনেকটা এগিয়ে যায়।
১৯৭৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে
৮ মার্চ নারী দিবস পালনের জন্য উত্থাপিত বিল অনুমোদন পায়।
১৯৮৪ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণা
করে জাতিসংঘ। ঐতিহাসিক সংগ্রামের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ এই সিদ্ধান্ত নেয়।
২০০৯-এ বিশ্বের ২৯টি দেশে সরকারি ছুটিসহ প্রায়
৬০টি দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালিত হয়েছে।
২০১০ সালে বিশ্বজুড়ে নারী দিবস পালন করা হয় ও
অভূতপূর্ব সাড়া মেলে।
বিশ্বের অনেক দেশে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস
উপলক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে- আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, বুরকিনা
ফাসো, কম্বোডিয়া, কিউবা, জর্জিয়া, গিনি-বিসাউ, ইরিত্রিয়া,
কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, লাওস, মলদোভা, মঙ্গোলিয়া,
মন্টেনেগ্রো, রাশিয়া, তাজাকিস্তান,
তুর্কমেনিস্তান, উগান্ডা, ইউক্রেন, উজবেকিস্তান, ভিয়েতনাম,
জাম্বিয়া, চীন, মেসিডোনিয়া, মাদাগাস্কার। নেপালে শুধু মেয়েরাই সরকারি ছুটি পান।
১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার,
মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ এবং
কর্মক্ষেত্রে বৈরী পরিবেশের প্রতিবাদ করেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সুতা
কারখানার একদল শ্রমজীবী নারী। তাদের ওপরে অমানবিক দমন-পীড়ন চালায় মালিকপক্ষ ও
সরকারের পেটুয়া বাহিনী। ১৮৫৭ থেকে ২০১৯ সালে এসেও আজ আমাদের বাংলাদেশে নারী
শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা
নির্ধারণ এবং কর্মক্ষেত্রে বৈরী পরিবেশের কোন পরিবর্তন হয়নি, প্রতিদিন প্রতিষ্ঠানের
ভিতরে বাহিরে যৌন নির্যাতন সহ বিভিন্ন রকম নির্যাতন করা হয় তাদের উপর। কর্মক্ষেত্র
থেকে বাসায় ফেরার পথে নিয়মিত ধর্ষনের শিকার হচ্ছে নারী শ্রমিকরা। বাংলাদেশের নারী সেলাই (গার্মেন্ট) শ্রমিকেরা ৮ মার্চ এই দিনেও ছুটি পাইনা, তাদের প্রতিদিন অনেক
সকাল থেকে অনেক রাত্রি পর্যন্ত কাজ করতে হয়। সাম্রাজ্যবাদের সস্তা শ্রম লুণ্ঠন এবং মালিকদের
অতি মুনাফা অর্জনের যাঁতাকলে নারী শ্রমিকরা পিষ্ট হচ্ছেন। রাষ্ট্রের বৈদেশিক
মুদ্রা আয়ের শতকরা ৮৩ ভাগ আসে এই গার্মেন্ট শিল্প থেকে। কিন্তু শ্রমিকদের জীবন চলে
নির্মম দুর্বিসহ অবস্থায়। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় শ্রমিকদের দৈন্যদশা
পৃথিবীর দেশে দেশে থাকলেও বাংলাদেশের শ্রমিকদের, বিশেষতঃ গার্মেন্ট শিল্প
শ্রমিকরা প্রায় মধ্যযুগীয় দাস প্রথার মধ্যেই রয়ে গেছেন। বুর্জোয়াদের দ্বারা
স্বীকৃত আইনও গার্মেন্ট মালিকরা মানছে না। বুর্জোয়া আইনের সুবিধাগুলো থেকেও
গার্মেন্ট শ্রমিকরা বঞ্চিত।
বর্তমানে অনেক কারখানায় শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন
অধিকার, সাপ্তাহিক ছুটি, মাতৃত্বকালীন ছুটি, মেডিক্যাল ছুটি
দেয়া হয় না। অসুস্থতাজনিত বা অন্য কোন অনিবার্য কারণে একদিন হাজির না থাকলেও বেতন
কেটে নেয় এবং হাজির না থাকার কারণে বেতন হ্যান্ডার্ফ বা আটকে রাখে, অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের চাকুরী হারাতে হয়। অনেক কারখানায় অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্থায়ী
নিয়োগ দেয়া হয় না। অনেক কারখানায় নিয়গ পত্র, পরিচয় পত্র দেওয়া হয়না। বিশেষ কোনো কারণে কোনো শ্রমিক পরপর কয়েকদিন
হাজির না থাকলে ছাঁটাই করে দেয় অথবা নতুন করে নিয়োগ দেয়, যাতে পুরনো শ্রমিকের সুবিধা (সার্ভিস
বেনিফিট, অর্জিত ছুটি, ঈদ বোনাস ইত্যাদি) ভোগ করতে না পারে। প্রতিদিন নারী
শ্রমিকদের রাত ৮/১০/১২টা পর্যন্ত কাজ করতে বাধ্য হলেও খাতায় হাজিরা তোলে সন্ধ্যা
৭টা পর্যন্ত। এটা করে বিদেশী বায়ারদের চোখ ফাঁকি দেয়ার জন্য। বাস্তবে বিদেশী
বায়াররাও যে এই ফাঁকিবাজী জানে না বা বোঝে না তা নয়। দেশী বিদেশী মিলেই তারা এভাবে
আইন ‘মেনে’ চলে। মালিকদের ইচ্ছা-খুশিমত ছাঁটাই করে, ছাঁটাই করার সময় পাওনা বেতন-ভাতা, আনানুগ পাওনা দেয়া হয় না। নারী
শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয়া হয় না অধিকাংশ গার্মেন্টে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম
করে আদায় করতে হয়। অনেক কারখনাতে প্রসবকালীন তাদের চাকরী হারাতে হয়। আবার অধিকাংশ
কারখানায় সন্তান প্রতিপালনের জন্য কোনো ডে-কেয়ার সেন্টার নেই, যেখানে আছে সেখানে প্রয়োজনীয় এর তুলনায় অনেক কম বাচ্চা রাখা হয়, আবার এক বছরের নিচের বাচ্চাদের রাখা হয়না, যার
কারণে নারী শ্রমিকরা বাচ্চা লালন পালনের জন্য চাকুরী ছাড়তে বাধ্য হয়।
৮ ঘণ্টা শ্রম ঘন্টার স্বীকৃতি থাকলেও গার্মেন্ট
শ্রমিকদের শ্রম দিতে হয় দৈনিক ১২/১৪/১৬ ঘণ্টা। এ ছাড়া হোল নাইটও করতে হয়
বাধ্যতামূলক। ওভার টাইম মজুরী দ্বিগুণ করার আইন থাকলেও তা অনেক কারখানায় দেওয়া
দেয়া হয় না, দিলেও আবার ওভার টাইমের ঘন্টা
মাস শেষে কেটে নেওয়া হয়। প্রডাকশন টার্গেট পূরণ না হলে অতিরিক্ত ফাও কাজ করে তা
পূরণ করে দিতে হয়।
মালিকরা শ্রমিক শোষণ করে টাকার পাহাড় গড়লেও
গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য কোনো সুব্যবস্থা নেই। শ্রমিকদের জন্য ভাত খাওয়ার ভাল
কোনো ক্যান্টিন ব্যবস্থা নেই, অনেক গার্মেন্টে শ্রমিকদের ছাদে বা সিঁড়িতে বসে খেতে
হয়। ডিউটি শেষে নারী শ্রমিকদের অসম্মানজনকভাবে চেক করা হয়। কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতের
জন্য পরিবহণ ব্যবস্থা নেই, পায়ে হেটে চলার জন্য নিরাপদ কোন ব্যবস্থা নেই।
লিখেছেনঃ খাইরুল মামুন মিন্টু, সাংগঠনিক সম্পাদক,
গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন