সুযোগসন্ধানী গার্মেন্ট মালিকরা গাছেরটাও খায় তলারটাও কুড়ায়। তারা শ্রমিকদের শ্রমে-ঘামে প্রচুর অর্থ বিত্তের মালিক হয়েই ক্ষান্ত না, তারা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জনগণের টাকা আত্মসাতের জন্য সবসময়ই সরকারের উপর চাপ রাখে। যেহেতু সরকারের মধ্যে এবং সমাজে মালিকদের প্রভাব অনেক বেশি সেহেতু তারা প্রতিবছরই রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নগদ সুবিধা আদায় করে। এবছরও ২, ২৭৫ কোটি টাকা নগদ আদায় করেছে। এরপরে বিজিএমইএ আরো এক শতাংশ নগদ সহায়তা দাবি করছে। তারা এটাও বলছে যে, প্রধানমন্ত্রী এই সহায়তা দিতে সম্মত এখন শুধু অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগবে। অথচ শ্রমিকদেরতো বটেই শিল্পের এবং জাতির জন্যও প্রয়োজন রেশনিং ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা ও চিকিৎসা ইত্যাদি কিন্তু তার কোনো আলোচনাই নাই, শুধু তেইলার মাথায় তেল দেয়া হচ্ছে। পোশাক খাতে ৪ ধরনের নগদ প্রণোদনা দেয়া হয় যার পুরোটাই মালিকদের জন্য আর শ্রমিকদের শুধু শোষণ বঞ্চনা।
শোষণের অংশ হিসেবে প্রত্যেক শ্রমিককে কাজের চাপ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, এমনকি শ্রমিকদের চাকুরিচ্যুত করে বাড়তি মজুরি সমন্বয় করে নিচ্ছে। আধুনিকায়ন করার মাধ্যমে উৎপাদনের ক্ষেত্রে শ্রমের প্রয়োজনীয়তা কমে যাওয়ায় কিছু কিছু কারখানা শ্রমিকদের চাকুরিচ্যুত করছে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও কারখানাগুলোতে এই সময়ে কাজ কম যা আগামী নভেম্বর মাস নাগাদ পূরণ হবে মর্মে সরকার ও মালিকরা বলে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে কাজ কম থাকায় অনেক কারখানা লে-অফ ঘোষণা করা হয়েছে। ছাঁটাই চলছে। নানা কারণে কারখানায় সংকট হওয়ায় শ্রমিকদেরকে সময়মত মজুরি দেয়া হচ্ছে না। বিনা নোটিশে কারখানা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। আন্দোলন করতে গেলেই বলা হচ্ছে কারখানা চালুই রাখা সম্ভব হচ্ছে না তারপর আবার বেতন দেয়া হবে কোথা থেকে। বরং আন্দোলন করলে কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু মালিকদের জীবনে বিলাসীতার কোনো কমতি নেই। সকল সংকট শুধু শ্রমিকদের পাওনা দিতে গেলে। কিন্তু গার্মেন্ট শিল্পের অতীতের দিকে তাকালে আমরা বলতে পারি যে, এই মালিকরা এতো সম্পদ, এতো অর্থ-বিত্তের মালিকতো এই শ্রমিকদের শ্রমের মজুরি এবং ন্যায়সঙ্গত পাওনা আত্মসাৎ করেই হয়েছে।
আমাদের ভয় দেখানো হয় যে, শ্রমিকরা আন্দোলন করলেই বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের ইমেজ নষ্ট হয়ে যায়। বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার বন্ধ করে দেয়। আমাদেরকে পাট শিল্পের কথা বলে বলা হয় যে, গার্মেন্ট শিল্প যেন পাটের মতো না হয়। বুঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, ট্রেড ইউনিয়ন শিল্প ধ্বংসের জন্য দায়ী। অথচ এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, পাটশিল্প ধ্বংসের প্রধান কারণ ভুলনীতি, দুর্নীতি, বিজেএমসি’র অব্যবস্থাপনা অথচ তা বলা হয় না। সাম্প্রতিক ট্যানারি শিল্পের কথাও বলা হচ্ছে। কিন্তু সেখানে শিল্পের উপর মালিকদের ব্যয়ের চাপ এবং মালিকদের অর্থ পাচার– এগুলোকে আড়াল করে রাখা হয়। ক্রেতারা আমাদেরকে অর্ডার না দিয়ে ভিয়েতনাম, মায়ানমার, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা ইত্যাদি দেশে অর্ডার দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। মনে রাখা দরকার ঐ সব দেশের শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধা তো আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। মাসের পর মাস বেতন বাকি রেখে বিদেশে টাকা পাচার করার সংস্কৃতি তো ভিয়েতনামে নাই। ঐসব দেশে নেই।
শিল্প-অর্থনীতির সাথে রাজনীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কারণ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব যেই রাজনৈতিক দল পালন করছে তারা সুষ্ঠুভাবে শিল্প পরিচালনা করতেও ব্যর্থ। তারা দেশকে অস্থিতিশীলতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তাদের লুটপাটে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ফলে কোনো ধরনের নিরাপত্তা নেই। যেকোনো সময় যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে যার প্রভাবে শিল্পের উৎপাদন, আমদানি-রপ্তানি ব্যহত হবে। এই ধরনের নিরাপত্তাহীনতা দূর করতে না পারলে অর্থনীতিতে অগ্রগতি সম্ভব নয় বরং সংকট ঘনীভূত হতে থাকবে। সুতরাং পরিবর্তন আবশ্যক। পরিবর্তন হলে দেশের প্রধান শিল্প ও রপ্তানি খাত গার্মেন্ট বর্তমানে ৮৩ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। তা আরো বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যেই রাশিয়ার বাজারে বাংলাদেশের উৎপাদিত পোশাক রপ্তানির জন্য আলোচনা চলছে। চীন পোশাক শিল্প কমিয়ে দেওয়ায় চীনের ক্রেতাদের নিকট বছরে ন্যূনতম ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পোশাক বিক্রির সুযোগ রয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগাতে লুটপাটতন্ত্র বন্ধ করে দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকার ও মালিকদেরকে লুটেরা চরিত্রের পরিবর্তন করে দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি। শ্রমিকদের উপর মিথ্যা অভিযোগ আনলে সমস্যার সমাধান হবে না। বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট এর প্রভাব বিবেচনায় রাখতে হবে।
কয়েকটা বিদেশি ক্রেতা তারা সময়মত মূল্য পরিশোধ না করায় বেশ কয়েকটি কারখানা সংকটে পড়েছে। বিদেশি ক্রেতারা আমাদের দেশ থেকে পোশাক কিনে কমপক্ষে ৫-৬ গুণ দামে বিক্রি করা সত্ত্বেও এখানে মূল্য বাড়াচ্ছেন না। তাদের সাথে দর কষাকষির ক্ষমতা বৃদ্ধি না করে আমাদের মালিকরা নিজেদের মধ্যে কাজের অর্ডার প্রাপ্তির প্রতিযোগিতা করে মূল্য কমাতে বিদেশি ক্রেতাদের সুযোগ করে দেয়। অথচ মালিকরা শ্রমিকদের উপর চাপ সৃষ্টি করে শ্রমিকদের পাওনা মেরে দিয়ে সেই টাকাকে মুনাফা হিসেবে দেখতে চায়।
শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে দুঃখ-কষ্টকে আমলে না নিয়ে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব আবিষ্কার করলে চলবে না। বিজিএমইএ বলছে গত ছয় মাসে নাকি ৪৬টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ২৫ হাজার শ্রমিক কর্মচ্যুত হয়েছে। বন্ধের কারণগুলো আমাদেরকে খতিয়ে দেখা দরকার। এখানে বড় পুঁজির সাথে ছোট পুঁজির একটা প্রতিযোগিতা আছে। এই প্রতিযোগিতায় ছোট পুঁজি টিকে থাকতে পারছে না। যার ফলে ছোট ছোট কারখানা বন্ধ হচ্ছে। আবার কোনো কোনো মালিক নিজেই পরিকল্পিতভাবে শ্রমিক এবং ব্যাংকের টাকা মেরে দিতে সংকট তৈরি করে। কেউ কেউ এ দেশ থেকে স্থায়ীভাবে বিদেশে পাড়ি জমাতে কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে। এমনই নানারকম ঘটনা বিরাজমান। যা গার্মেন্ট শিল্পের জন্য এক অশনি সংকেত।
এই পরিস্থিতিতে খবর বেরিয়েছে ১১.৪৯ শতাংশ রপ্তানি বেড়েছে, ৪.৪২ শতাংশ আয় বেড়েছে এটা খতিয়ে দেখা দরকার। আদৌ সঠিক কিনা? রপ্তানি বৃদ্ধির সাথে সাথে মুনাফা বৃদ্ধি হতে হবে। মুনাফা বৃদ্ধির সাথে সাথে শ্রমিকের আয় ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পেতে হবে। কেননা প্রতিদিন খাদ্যদ্রব্য, শিক্ষা ব্যায়, চিকিৎসা ব্যয় ইত্যাদি বেড়েছে। যার ফলে প্রাপ্ত মজুরিতে জীবিকা নির্বাহ করতে প্রয়োজন অনুযায়ী খাবার খেতে পারছেন না। এরপর কারখানায় শারীরিক মানসিক নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে।
২০০৬, ২০০৭ সালের দিকের সময়কালের আন্দোলনে কারখানা ভাঙচুর হতো, অগ্নিসংযোগ হতো। ট্রেড ইউনিয়নসহ বিভিন্ন মহল এর নানামুখী কর্মকাণ্ডের ফলে ভাঙচুর বন্ধ হয়। এটাকে মালিকরা শ্রমিকদের দুর্বলতা মনে করে সন্ত্রাসী ও পুলিশী নির্যাতন বাড়িয়ে দিয়েছে। শ্রমিকদের মধ্যেও দিনদিন ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ক্ষোভ বিক্ষোভে পরিণত হলে শিল্পের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি হয়ে পড়বে। তার ফলে যে ক্ষতি হবে তার দায়-দায়িত্ব মালিকদের নিতে হবে। পোশাকের মূল্য, শ্রমিকের জীবনমানসহ নানামুখী অশনি সংকেত মোকাবেলা করে তৈরি পোশাক শিল্প-দায়িত্বশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখতে হবে।
সরকারকে বিদেশি ক্রেতাদের নিকট থেকে অর্ডার নেয়ার ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণের জন্য একটি কেন্দ্রীয় সেল চালু করা দরকার। তাহলে মালিকদের মধ্যে দরকষাকষির আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কমে যাবে। আমাদের দেশের পোশাকের মূল্য বাড়িয়ে পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
মালিকদের পকেটস্থ নীতিহীন ট্রেড ইউনিয়ন বা বিদেশি মদদপুষ্ট ট্রেড ইউনিয়ন নয়, ব্যক্তিস্বার্থের ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব নয়। বিপ্লবী ধারার ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন এবং নেতৃত্ব শক্তিশালী হতে হবে। ব্যাংকিং, পোর্ট, পরিবহনসহ সর্বত্র ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার ব্যবস্থা করতে হবে। সুষম শিল্প, সুষ্ঠু শিল্প সম্পর্ক গড়ে তুলতে শ্রমিকদের আইনানুগ সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আসুন শিল্প বিকাশে শ্রম শোষণ নয় শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করি। তাহলেই এই শিল্পের সংকট সমাধান হবে নতুবা শ্রমিকদেরকে অবশ্যই তীব্র লড়াই গড়ে তুলতে হবে।
লেখক : কাজী রুহুল আমিন : সদস্য, সিপিবি, কেন্দ্রীয় কমিটি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন