Biplobi Barta

বুধবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

জানতে হবে ইতিহাসের নির্মাতাদের কথা


কারো কারো মৃত্যু মহান। বিশেষ করে শহীদদের। কারো জীবন আবার তার মৃত্যুর চেয়ে মহান। শুধুমাত্র বিশেষ কিছু মানুষের জীবন ও মৃত্যুদুটোই হয় সুমহান। কমরেড তাজুল ইসলাম ছিলেন তেমনি একজন মানুষ। তাঁর মৃত্যু ছিল অসীম সাহসী এক বীর যোদ্ধার। কিন্তু তাঁর স্বল্পকালের জীবন ছিল অসাধারণ প্রেরণাময় দৃষ্টান্তের মহিমায় উজ্জ্বল। শহীদ কমরেড তাজুলের জীবনবৃত্তান্ত দেশবাসীর ভালো করে জানা নেই। কিন্তু তা জানা প্রয়োজন। রাষ্ট্র থেকে তাঁর অমর কীর্তির কথা সেভাবে প্রচারিত হয়নি। প্রচার হয় বড়-বড় অপরাধী, দুর্বৃত্ত, লুটপাটকারী, মাস্তান, সন্ত্রাসী, গডফাদার, দলকানা ভাড়াটিয়া ক্যাডারদেরকথা। তাদের বৃত্তান্তই হেডলাইনপায়। আগামী ১ মার্চ কমরেড তাজুল ইসলামের ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকীকে সামনে রেখে তাঁর সম্পর্কে দুকথা লেখাটি আজ পরম কর্তব্য বলে মনে করছি।
১৯৮৪ সালের ১ মার্চ ১৫ দল ও ৮ দল এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছিল। শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদও তাদের ১০ দফা দাবিতে একই দিন কল-কারখানায় ২৪ ঘণ্টা ধর্মঘট ডেকেছিল। সে বছর লিপ-ইয়ার হওয়াতে ফেব্রুয়ারি মাসটি ছিল ২৯ দিনের। ২৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্র মিছিলে পুলিশের ট্রাকের চাকায় চাপা পড়ে শহীদ হয়েছিলেন সেলিম ও দেলোয়ার। হরতাল ও শ্রমিক ধর্মঘট সফল করার জন্য তত্পরতা আরো তীব্র হয়ে উঠেছিল। এরশাদের বিরুদ্ধে আহূত এর আগের কোনো কর্মসূচিতে আদমজিতে কাজ বন্ধ করা যায়নি। এবার সেখানে ধর্মঘট সফল করতে পারাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কমরেড তাজুলের ওপর সেই বিশেষ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল। আগেরদিন ঢাকায় শলাপরামর্শ শেষে দুপুরের দিকে আদমজি এলাকায় ফিরে যাওয়ার সময় কমরেড তাজুল আমাকে বলেছিল- সেলিম ভাই! টেনশন করবেন না। এবার আদমজিতে কাজ বন্ধ হবেই সেদিন (২৯ ফেব্রুয়ারি) মধ্যরাতের আগে-আগে ধর্মঘট সফল করার জন্য তাজুলের নেতৃত্বে মিল এলাকায় শ্রমিক-মিছিল বের হয়েছিল। শ্রমিকরা কাজে যাওয়া বন্ধ করে বাড়ি-ঘরে ফিরে যেতে শুরু করেছিল। এমনি সময়, স্বৈরশাসক এরশাদের গুণ্ডাবাহিনী মিছিলের সামনে থাকা কমরেড তাজুলকে টার্গেট করে তার ওপর অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তাজুল। অস্ত্রের আঘাতে কমরেড তাজুল মারাত্মক আহত হয়ে জ্ঞানহীন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হলেও চিকিত্সকদের পক্ষে তাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। ১ মার্চ কমরেড তাজুল ইসলাম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
কমরেড তাজুলের মৃত্যু নিছক কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। তিনি জেনে-বুঝে, সচেতনভাবে মৃত্যুভয়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, আদমজিতে শ্রমিক ধর্মঘট সফল করতে শ্রমিক-মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন। এ মৃত্যু ছিল বীরোচিত। এ মৃত্যু ছিল অনন্য সাধারণ। এই মৃত্যু তাজুলকে দিয়েছে অমরত্ব।
কমরেড তাজুলের মহিমান্বিত মৃত্যুর মতো তাঁর ৩৪ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনটিও ছিল এক মহত্ বীরত্বগাথা। তাঁর মৃত্যুর মহিমার চেয়ে সে জীবনের মহত্ত্ব কোনোভাবেই কম ছিল না। কমরেড তাজুলের জন্ম হয়েছিল এক নিতান্ত দরিদ্র পরিবারে। মাতৃহারা সন্তান তাজুলের কৈশোরের একটা সময় কেটেছিল গৃহশিক্ষকের কাজ করে আর আইসক্রিম বিক্রি করে। পড়াশুনার প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণে, জীবিকার জন্য সংগ্রাম করার পাশাপাশি, তাজুল সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করেছিলেন শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন পর্ব। তিনি ছিলেন ছাত্র হিসেবে মেধাবী। কলেজের পাঠ শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে (যে বিভাগে সবচেয়ে ভাল ছাত্ররাই কেবল ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়) অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি অর্জন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা বিভাগের সর্বোচ্চ ডিগ্রি।
পড়াশুনার পাশাপাশি কমরেড তাজুল ছাত্র আন্দোলনে রেখেছিলেন অসামান্য ভূমিকা। স্কুলজীবনেই তিনি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। সেই চেতনা ও দায়িত্ববোধ সযত্নে ধারণ করেই তিনি প্রবেশ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে এসে হয়ে উঠেছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের একজন অগ্রণী সংগঠক। ছাত্র ইউনিয়নের নির্দেশে তখনকার সময়ের সবচেয়ে প্রতিকূল অথচ দুর্বল ছাত্র হল এসএম হলের ছাত্র হিসেবে নাম লিখিয়ে সেই হলে থাকতে শুরু করেছিলেন। সেখানে ছাত্র ইউনিয়নের শাখা সংগঠন ও প্রকাশ্য তত্পরতা কিছুটা জোরদার করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। তাছাড়া, অল্পদিনের মধ্যেই সেখানে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির একটি গ্রুপও গড়ে উঠেছিল। সেই পার্টি গ্রুপে তিনি ছাড়াও ছিলেন শহীদ নিজামউদ্দিন আজাদ, শহীদ লুত্ফুল আজিম, আবুল কালাম আজাদ ও মিজানুর রহমান। আইউব-বিরোধী আন্দোলন ও ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। দেশ-মাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে তাজুল দ্বিধাহীনচিত্তে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ৭১-র মহান মুক্তিযুদ্ধে। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর অধীনে সীমান্তের ওপারে আগরতলার বরদোয়ালি ক্যাম্পেতিনি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদকসহ ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন দায়িত্ব তিনি পালন করেন। ১৯৭৩ সালে তাজুল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করেন। তখন থেকেই তিনি ভাবতে থাকেন যে ছাত্রজীবন শেষ করে তিনি শ্রমিকদের মাঝে বিপ্লবী ট্রেড ইউনিয়ন গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। ১৯৭৫-এর পরে, ছাত্র আন্দোলনের দায়িত্ব পালন করার শেষদিকে, ছাত্র থাকা অবস্থাতেই তিনি আদমজিতে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে নিজেকে যুক্ত করেন। উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণ হিসেবে এ ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। অনেকটাই নিজস্ব আগ্রহ ও উদ্যোগে কমরেড তাজুল কাজ শুরু করেন শ্রমিকদের মধ্যে। পার্টি তাকে দায়িত্ব দেয় আদমজির শ্রমিকদের মাঝে পড়ে থেকে সেখানে ট্রেড ইউনিয়ন ও পার্টির কাজ করার। কঠোর একাগ্রতা ও বিপ্লবী নিষ্ঠার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালনে কমরেড তাজুল সর্বশক্তি দিয়ে কাজে নেমে পড়েন। কয়েকজনের যে ছোট পার্টি টিম পাকিস্তান আমল থেকে আদমজিতে সক্রিয় ছিল, কমরেড তাজুল তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করতে থাকেন।
শ্রমিকদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার প্রয়োজনে এবং ক্রমবর্ধমান দৈনন্দিন কাজগুলো দক্ষভাবে পরিচালনার জন্য তাজুল তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির কথা গোপন রেখে স্বেচ্ছায় আদমজিতে সাধারণ বদলি শ্রমিকেরকাজ নিয়েছিলেন। বসবাস করতে শুরু করেছিলেন আদমজির শ্রমিক কলোনিতে। কিছুদিন পরে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদেরও তিনি নিয়ে এসেছিলেন তাঁর সেই ঢাকা বাজুর বস্তিঘরে। আদমজিনগর হয়ে উঠেছিল তাজুলের আসল ঠিকানা। সেখানে বিপ্লবী ধারার ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার কাজ জোরদার হয়ে উঠেছিল তাজুলের দক্ষ পরিচালনায়। নানামুখী তত্পরতার মধ্যদিয়ে কমরেড তাজুল অল্পদিনের মধ্যেই হয়ে উঠেছিলেন সাধারণ শ্রমিকদেরও প্রিয় নেতা। শ্রমিকদের নিজস্ব দাবিতে শ্রমিকদেরকে আদমজি মজদুর ট্রেড ইউনিয়নেসংগঠিত করার মুখ্য দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন তিনি। শ্রমিক আন্দোলনের পাশাপাশি সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণির অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য তিনি সবসময় যত্নবান ছিলেন। তাছাড়া মানবমুক্তির মহান আদর্শ, সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদের লক্ষ্যে শ্রমিকশ্রেণিকে জাগিয়ে তুলতে এবং তাদেরকে সংগঠিত করতে তিনি নিরলস দায়িত্ব পালন করেছেন। অর্থকষ্ট, অক্লান্ত পরিশ্রম, পারিবারিক সংকট কোনো কিছুই তাকে দমাতে পারেনি।
কমরেড তাজুল যেমন প্রিয় ছিলেন আদমজির শ্রমিকদের কাছে, তেমনি আবার তিনি ছিলেন স্বৈরাচারের পেটোয়া গুণ্ডাবাহিনীর কাছে প্রধান একজনটার্গেট। তাজুলসহ কমিউনিস্ট কর্মীরা ১৯৮৪ সালের ১ মার্চের ধর্মঘট সফল করার কাজকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন। অন্যদিকে ধর্মঘট বানচালের চক্রান্তমূলক প্রস্তুতিও নেয়া হচ্ছিল। প্রশাসনের সঙ্গে মুখ চেনা দালালমাফিয়া নেতাদের আঁতাত ছিল। তাদের টার্গেট ছিল শ্রমিকদের প্রিয় নেতা কমরেড তাজুল। ধর্মঘটের সমর্থনে গভীর রাতে সংগঠিত শ্রমিক-মিছিলে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়েছিল সরকার সমর্থক গুণ্ডারা। লাঠি, লোহার রড, চাকুর আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন তাজুল। তাঁকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন তাজুল। কমরেড তাজুলের মৃত্যুর খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশে। তাঁর মৃত্যুতে স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন পেয়েছিল নতুন মাত্রা। সংগ্রামী মেজাজে উদীপ্ত হয়ে উঠেছিল শ্রমিকরা। তীব্রতর হয়ে উঠেছিল সংগ্রাম। বলা বাহুল্য, মধ্যরাত থেকেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আদমজি কারখানার সব মেশিন। তাজুল তাঁর কথা রেখেছিলেন। জীবন দিয়ে আদমজি পাটকলে সফল করেছিলেন ধর্মঘট।
প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় নিছক একজন ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠার সবরকম সুযোগ ছিল কমরেড তাজুলের। কিন্তু সে পথে তিনি পা বাড়াননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও সর্বোচ্চ ডিগ্রি তাঁকে সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ ও আয়েশী জীবনএনে দিতে পারত। কিন্তু তিনি সচেতনভাবেই তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বেছে নিয়েছিলেন যথার্থ বিপ্লবীর জীবন। যে জীবন ভোগের নয়, ত্যাগের। যে জীবন শুধু নিজের জন্য নয়, সমগ্র জনগণের জন্য নিবেদিত। কমরেড তাজুল অবতীর্ণ হয়েছিলেন সমাজ বিপ্লবের প্রকৃত যোদ্ধা হিসেবে লড়াই করার, এবং সেজন্য নিজেকে তৈরি করার সুমহান প্রয়াসে। কঠোর একাগ্রতা ও বিপ্লবী জেদ ছিল তাঁর সহজাত বৈশিষ্ট্য। আয়েশী মধ্যবিত্ত জীবনের প্রলোভন, আত্মপ্রতিষ্ঠার হাতছানি, পারিবারিক পিছুটানকোনো কিছুই কমরেড তাজুলকে তাঁর আদর্শ-লক্ষ্য এবং বিপ্লবী জীবন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। একজন কমিউনিস্ট হিসেবে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তিনি।
তাজুলের প্রিয় আদমজিতে এখন আর ভেঁপু বাজে না। হাজার হাজার শ্রমিকের জীবনে নেমে এসেছে চরম অন্ধকার। সুবিধাবাদী, আপসকামী, টাউট, প্রতিক্রিয়াশীল, দালাল নেতৃত্ব আদমজি জুটমিলকে রক্ষা করতে পারেনি। আদমজি মিল ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে তারা অংশীদার হয়েছিল। যেদিন আদমজি মিল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল সেই কলঙ্কজনক দিনে সাধারণ শ্রমিকরা বেদনায় হাহাকার করেছিল। বলেছিল—‘তাজুল ভাইযদি জীবিত থাকতেন, তাহলে আদমজি জুটমিলকে কেউ ধ্বংস করার সাহস পেত না। আজও প্রতিক্রিয়াশীলরা শ্রমজীবী জনগণ ও দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে আঘাত হেনে চলেছে। সাম্রাজ্যবাদ, লুটপাটতন্ত্র, গণতন্ত্রহীনতা ও সর্বোপরি সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ছোবলে দেশ আজ বিপন্ন। বিপন্ন দেশের গরিব-মেহনতি মানুষ। দেশ ও মানুষকে বাঁচাতে হলে সমাজপ্রগতির ঝাণ্ডাকে অগ্রসর করে নিতে হবে। এ কর্তব্য পালন করতে হলে আজ অনেক নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর প্রয়োজন। প্রয়োজন অসংখ্য কমরেড তাজুলের। তাই মানুষের কথা জানতে হবে। তাদেরকে মর্যাদা দিতে হবে।
অনেকে এ কথা ভেবে হতাশ হন যে কমরেড তাজুলের মতো মানুষ আজ আর কোথায় পাওয়া যাবে? এ হতাশা অনর্থক। তাজুলের মতো অনেক আত্মনিবেদিত কর্মী আজও সমাজে রয়েছে। তারা হয়তো লোকচক্ষুর আড়ালে কাজ করে যাচ্ছেন। সে কারণেই হয়তো তাদের খবর সবাই পান না। ধরুন না কমরেড তাজুলের কথাই। তিনি শহীদ না হলে কজনই বা তাঁর ত্যাগী-সংগ্রামী জীবনের ইতিবৃত্ত জানার সুযোগ পেত? একসময়ের অজানা কমরেড তাজুল সেভাবেই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে কাজ করেছেন। এখনও অনেক তাজুলসেভাবেই কাজ করছে। তাদের খবর আজও অজানা থেকে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের বিপ্লবী জীবনের মহিমা তাতে বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলা যায় না। যে সমাজ বাস্তবতা কমরেড তাজুলেরজন্ম দিয়েছে সেই বাস্তবতাই আরো অগণিত কমরেড তাজুলেরউদ্ভবের সম্ভাবনা নিরন্তর সৃষ্টি করে রাখছে। ইতিহাস ক্রমাগত জন্ম দিতে থাকবে অসংখ্য কমরেড তাজুলের। তাই, ‘তাজুলের মতো মানুষ আজ আর কোথায় পাওয়া যাবেএ প্রশ্ন নিয়ে সংশয়ের কোনো কারণ থাকতে পারে না।
জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে পরাজিত হননি কমরেড তাজুল। তাজুলের জীবন-প্রদীপ নিভে গেছে। কিন্তু তাঁর মৃত্যু হয়নি। মহত্ আদর্শ এবং মহত্ জীবনের কোনো মৃত্যু নেই। তাজুল চিরঞ্জীব। তাঁর রক্তপতাকা হাতে মহাকাল এগিয়ে চলেছে। সমাজ প্রগতির লড়াইয়ে তাঁর বিপ্লবী জীবনের আহ্বান উদ্দীপ্ত করে চলেছে বিপ্লবী কর্মীদের, ছড়িয়ে পড়ছে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে। এক তাজুলের রক্ত থেকে লাখো তাজুল জন্ম নিচ্ছে। অজানা এই বীর বিপ্লবীরাই ইতিহাসের প্রকৃত নির্মাতা। তাই, জানতে হবে ইতিহাসের নির্মাতা এসব মহাবীরদের কথা। তাজুলদের কথা।
লেখক: মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি

মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

বিপ্লবের ধ্রুবতারা শহীদ কমরেড তাজুল ইসলাম


 আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে যে শহীদের আত্মদান বিপ্লবের ধ্রুবতারার মতো অগুনতি তরুণকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, শ্রমজীবী মানুষের দৃপ্ত পদচারণায় সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের বিকাশের সম্ভাবনাকে ভাস্বর করে তুলেছিল, বিশেষ করে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক কর্মীদের সামনে জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে জ্বলজ্বল করছিল, আজ তার স্মৃতি প্রায় বিস্তৃত, আজকের তরুণ প্রজন্ম তাকে খুব একটা জানে বলেও মনে হয় না। এটা দুর্ভাগ্যজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেও সেটাকে গোপন করে সাধারণ বদলি শ্রমিক হিসেবে কষ্টকর কায়িক শ্রমের কাজ করতেন এবং এভাবে একজন শ্রমজীবীর মতোই আর্থিকভাবে কষ্টকর জীবনযাপন করতেন। কারণ তিনি চেয়েছিলেন নিজেকে শ্রেণিচ্যুতকরে শ্রমিকের সঙ্গে পরিপূর্ণরূপে মিশে গিয়ে তাদেরকে বিপ্লবের জন্য সচেতন ও সংগঠিত করতে। তিনি একজন আদর্শ কমিউনিস্টের ভূমিকা পালন করেছেন যা আজকের দিনে সত্যিই বিরল। তিনি ছিলেন একই সঙ্গে লড়াকু সৈনিক, যিনি আদমজীর শ্রমিকদের এরশাদ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত করেছিলেন এবং সংগ্রামের ময়দানে নামিয়েছিলেন। এই সংগ্রামে তিনি ছিলেন সামনের কাতারের বীর যোদ্ধা। সেইজন্য সেদিনের সামরিক শাসনের ভাড়াটিয়া দালালরা তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল। সেই দিনটি ছিল ১৯৮৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি। এই মহান শহীদকে আমরা যে আজকাল খুব বেশি স্মরণ করি না, তার কারণ প্রধানত দুটি বড় বুর্জোয়া দলের নেতৃত্বাধীনে পরিচালিত প্রধান ধারার যে রাজনীতি এখন চলছে, তাতে আত্মত্যাগের কোনো মূল্য নেই, আছে কেবল ভোগ সর্বস্বতা, নোংরামি, টাকার খেলা ও আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি বর্জিত প্রদর্শনবাদ। তাই রাজনীতির এই অধঃপতনের যুগে তাজুল ইসলামকে ভুলে যাওয়া হবে, মিডিয়াতেও তাঁর প্রচার হবে না, এটাই স্বাভাবিক মনে হয়। তবে নিশ্চিতভাবেই এটাই শেষ কথা হতে পারে না। রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়নের হাত থেকে, দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করে সেই আগের ধারায় প্রবাহিত করতে হবে। জনগণের গণতন্ত্র ও শোষণমুক্তি প্রশ্ন প্রাধান্যে থাকবে। আরও থাকবে জনগণের স্বার্থে সামাজিক অর্থনৈতিক ইস্যু এবং যেখানে সংগ্রাম ও ত্যাগের মহিমায় উজ্বল হবে রাজনৈতিক মঞ্চ। তাই বিপ্লবী তাজুল ইসলামের শহীদ দিবস উপলক্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর জীবন, কাজ ও আদর্শের সঙ্গে আজকের নতুন প্রজন্মকে পরিচিত করানোর উদ্দেশ্যেই এই লেখা। গরিব কৃষক পরিবারে তাজুলের জন্ম। চাঁদপুরের মতলব উপজেলার ইছাখালী গ্রামে। বেশ কষ্টের মধ্যে তাঁকে লেখাপড়া করতে হয়েছিল। তবে তিনি ছিলেন মেধাবী ছাত্র। ক্লাসে বরাবর প্রথম স্থান অধিকার করতেন। স্কলারশিপের টাকা দিয়ে তাঁর লেখাপড়ার ব্যয়ভার বহন করতে হয়েছিল। কৈশরের একটা সময় তার কেটেছিল আইসক্রিম বিক্রি করে। তবু লেখাপড়ায় ছেদ ঘটতে দেয়া হয়নি। এমনকি তিনি স্কুলের হকি টিমের অধিনায়কও ছিলেন। শুনেছি তিনি ভালো গানও গাইতেন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ও রবীন্দ্র সংগীত। ঢাকা কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। বোঝাই যাচ্ছে খুব ভালো ছাত্র না হলে তিনি অর্থনীতি বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেতেন না। এই সময়ই তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। স্বাধীনতার পর তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদকের পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নেরযৌথ উদ্যোগে ভারতে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ লাভ করছিলেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন করলেই অথবা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করলেই সকলেই যে মেহনতি মানুষের স্বার্থে জীবনকে পুরোপুরি বিলিয়ে দিতে পারেন, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তাজুল ইসলাম ছিলেন স্বল্প সংখ্যক ব্যতিক্রমীদের একজন, যিনি নিজেকে শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির সংগ্রামে পরিপূর্ণরূপে উৎসর্গ করছিলেন। ষাটের দশকে বেশ কিছু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে শ্রমিক কৃষক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আমি নিজেও ছাত্র জীবনের ও ছাত্র আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে টঙ্গীর শিল্প এলাকায় শ্রমিক বস্তিতে থেকে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করেছিলাম। তবে তাজুল ইসলামের মতো কারখানার শ্রমিক হয়ে কাজ করিনি। এতোটা অগ্রসর হতে আমি পারিনি। এটা বোঝা যায় যে, কমরেড তাজুল ইসলাম ছিলেন অনেকের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর। তাঁর সঙ্গে যারা বিশেষভাবে ঘনিষ্ট ছিলেন তাদের কাছ থেকে তার চরিত্রের বিভিন্ন দিকের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে তাঁর দৃঢ় মনোবল ও আদর্শ নিষ্ঠা সম্পর্কে জানা যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি একবার মুজিব বাহিনীর প্ররোচনায় গ্রেফতার হন এবং তারপরে আরেকবার দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন তার বন্ধু ও সহকর্মী কমরেড আবুল কালাম আজাদ। কমরেড আজাদ লিখেছেন, “মুজিব বাহিনীর লোকেরা আমাদের বাঁকা চোখে
দেখতে শুরু করলো। ... তারপরও আমাদের বিপদ ঘটেনি, সংগঠনের কাজ শেষে একদিন তাজুল ও আমি মতলব থেকে আমাদের বাড়ি ফেরার পথে গভীর রাতে পথিমধ্যে দুষ্কৃতিকারী দ্বারা ঘেরাও হই, সে এক ভয়ানক কাহিনী। আমরা নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যাই। ... আমি তাকে বিচলিত হতে দেখিনি... আমাকে বলে... মৃত্যু যদি অনিবার্য হয় তবে তাদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা না চেয়ে ইন্টারন্যাশনাল গাইতে গাইতে মরবো...।ঠিক এই ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তার স্মৃতিচারণে, “মুক্তিযুদ্ধের পর পরেই মুজিব বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর বন্ধু আবুল কালাম আজাদকে বলেছিলেন, মরতে হয় দুবন্ধু এক সাথে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল গান গাইতে গাইতে মরবো। আমাদের কমরেডরা যেন জানতে পারে আমরা কাপুরুষতার পরিচয় দেইনি, বীরের মতো মরেছি। শ্রমিকদের মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে শ্লোগান দিতে দিতে ঘাতকদের উন্মক্ত হামলায় বীরের মতো জীবন দিয়ে তাজুল তার সেই অসম সাহসী প্রত্যয়কে সত্য প্রমাণ করে গেলেন।বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে তিনি দুঃখ-কষ্টের জীবনের অবসান ঘটাতে পারতেন। মেধাবী ছাত্রের জন্য বড় চাকুরী, বড় সামাজিক মর্যাদা, বিত্ত বৈভব অর্জন করা কঠিন ছিল না। কিন্তু সে পথের ধারে কাছেও তিনি গেলেন না। সাধারণ বদলি শ্রমিকের চাকুরী নিলেন আদমজীতে। তাত চালাতেন। থাকতেন বস্তিতে। সামান্য পয়সায় দুসন্তান নিয়ে সস্ত্রীক থাকতেন। তাও আবার একদিন দুই দিন নয়, দুই এক বৎসরও নয়, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এক দশক এইভাবে সাধারণ বদলি শ্রমিকের কাজ করেছেন ও জীবন কাটিয়েছেন। সত্যিই খুবই ব্যতিক্রমী এই বিপ্লবী মানুষটি। নারী নেত্রী কমরেড বেলা নবী যিনি কমরেড তাজুল ইসলাম ও তার স্ত্রী নাসিমা ইসলাম খুকুর খুব ঘনিষ্ট ছিলেন। তিনি তাদের সম্বন্ধে লিখেছেন, “দুই পুত্র সন্তানের জনক জননী আদমজী পাটকল এলাকায় এক ঝুপড়ি ঘর নিয়ে বসবাস শুরু করে। ওদের বাচ্চারা প্রয়োজনীয় দুধটুকুও পেত না। ... মাঝে মাঝে খুকু ভেঙ্গে পড়লে তাজুল তাকে এই বলে সান্তনা দিত যে শ্রমিকদের বাচ্চাদের দিকে চেয়ে দেখ। ওরাও দুধ পায় না। ওরা যদি বিনা দুধে বেঁচে থাকতে পারে তবে আমাদের বাচ্চারাও বেঁচে থাকবে।তাঁর স্ত্রী নাসিমা ইসলাম খুকুও এক অসাধারণ নারী। তিনি ধনী পরিবারের মেয়ে। তার বাবার ইচ্ছা ছিল জামাতা সিএসপি হবে। সেই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সে হলো কিনা কারখানার বদলি তাত শ্রমিক। তাজুলের শ্বশুর এটা মানতে পারেননি। কিন্তু মেনে নিয়েছিলেন স্ত্রী খুকু, যিনি নিজে কষ্ট করে ছোটখাট চাকুরী করে কোনোমতে সংসার টানার ও স্বামীর রাজনৈতিক কাজে সাহায্য করে গেছেন। ১৯৭২ সালে তাদের বিয়ে হয়। জীবনের এগারোটি বছর তারা খুবই দারিদ্র্যের মধ্যে, কিন্তু গভীর ভালবাসার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন। বেলা নবী লিখেছেন, ‘... এত বেদনার মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল গভীর ভালবাসার, যার জন্য জীবনের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে না পারার দুঃখকে জয় করতে পেরেছিলেন হাসিমুখে।স্ত্রী খুকুর এক নিকট আত্মীয় ছিলেন মেজর জেনারেল, আর্মি মেডিকেল কোরের ডিরেকটর জেনারেল ও পরে মন্ত্রী। তিনি খুকুকে বলেছিলেন এমন বাবার মেয়ে হয়ে এত কষ্ট করতে পারো? ভাবতে অবাক লাগে। আমি কোনদিন নীতি বহির্ভূত কাজ করিনি। কিন্তু তোমার জন্য করবো। তাজুলকে বুঝিয়ে রাজী করাও। একটা টেন্ডার দাখিল করতে বলো। ও রাজনীতিক করুক, তুমি বাচ্চাদের নিয়ে বেশ কিছুদিন চলতে পারবে।বলাই বাহুল্য, তাজুল ইসলাম এই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি, বরং স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘লোভকে জয় করতে হবে।এইরকম ব্যতিক্রমী পুরুষ, দৃঢ় মনোবল ও নীতিনিষ্ঠ মানুষটি পার্টির কাজেও ছিলেন দক্ষ সংগঠক। তিনি প্রদর্শকবাদীতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। আদমজীর শ্রমিকদের একজন হয়ে সেখানে দারুণ প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পার্টি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। পার্টির সাপ্তাহিক পত্রিকা একতার একশ কপি সেখানে বিক্রি হতো। সাচ্চা ও সংগ্রামী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজনৈতিক অঙ্গনেও সাড়া সৃষ্টি করেছে। গড়ে উঠেছে ১৫ ও ৭ দল। শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) গড়ে উঠেছে। রাজনৈতিক জোটদ্বয় ও স্কপের পক্ষ থেকে হরতাল ডাকা হয়েছে পহেলা মার্চ। সেই হরতাল সংগঠিত করার জন্য ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতের বেলায় এক শিফটের শ্রমিকদের নিয়ে মিছিল বের হয়েছে আদমজীতে হরতালের প্রচার উপলক্ষে। এই মিছিল সংগঠিত করেন তিনি। মিছিলের সামনে ছিলেন তিনি। এই মিছিলের ওপর এরশাদের দালালরা হামলা চালায়। প্রধান টার্গেট ছিল তাজুল। তিনি গুরুতরভাবে আহত হন এবং পরে মৃত্যুবরণ করেন। এই মৃত্যু ছিল সাহসী মৃত্যু, বীরের মৃত্যু, শহীদের মৃত্যু। বিপ্লবীর যেমন মৃত্যু নেই তেমনি তাজুল ইসলামেরও মৃত্যু নেই। এখন প্রয়োজন মৃত্যুহীন তাজুলের অসামান্য জীবন আদর্শকে নতুন প্রজন্মের প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। আজকের দূষিত বুর্জোয়া রাজনৈতিক ধারাকে বদলিয়ে সুস্থ প্রগতিশীল রাজনীতির ধারাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রয়োজন হবে তাজুল ইসলামের। কমিউনিস্ট আন্দোলন ও পার্টিকে সত্যিকারের প্রলেতারীয় বিপ্লবী ধারা গড়ে তুলতে হলেও আমাদের প্রয়োজন হবে কমরেড তাজুলকে।


লেখক : হায়দার আকবর খান রনো, প্রেসিডিয়াম সদস্য, সিপিবি, (২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ইং তারিখ সাপ্তাহিক একতা’য় প্রকাশিত লেখা থেকে নেওয়া)