আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে যে শহীদের আত্মদান বিপ্লবের ধ্রুবতারার মতো
অগুনতি তরুণকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, শ্রমজীবী মানুষের দৃপ্ত পদচারণায় সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের বিকাশের
সম্ভাবনাকে ভাস্বর করে তুলেছিল, বিশেষ করে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক কর্মীদের সামনে জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত
হিসেবে জ্বলজ্বল করছিল, আজ তার স্মৃতি প্রায় বিস্তৃত, আজকের তরুণ প্রজন্ম তাকে খুব একটা জানে বলেও মনে হয় না। এটা দুর্ভাগ্যজনক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেও সেটাকে গোপন করে সাধারণ বদলি শ্রমিক
হিসেবে কষ্টকর কায়িক শ্রমের কাজ করতেন এবং এভাবে একজন শ্রমজীবীর মতোই আর্থিকভাবে
কষ্টকর জীবনযাপন করতেন। কারণ তিনি চেয়েছিলেন নিজেকে ‘শ্রেণিচ্যুত’ করে শ্রমিকের সঙ্গে পরিপূর্ণরূপে মিশে
গিয়ে তাদেরকে বিপ্লবের জন্য সচেতন ও সংগঠিত করতে। তিনি একজন আদর্শ কমিউনিস্টের
ভূমিকা পালন করেছেন যা আজকের দিনে সত্যিই বিরল। তিনি ছিলেন একই সঙ্গে লড়াকু সৈনিক, যিনি আদমজীর
শ্রমিকদের এরশাদ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত করেছিলেন এবং সংগ্রামের ময়দানে
নামিয়েছিলেন। এই সংগ্রামে তিনি ছিলেন সামনের কাতারের বীর যোদ্ধা। সেইজন্য সেদিনের
সামরিক শাসনের ভাড়াটিয়া দালালরা তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল। সেই দিনটি ছিল
১৯৮৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি। এই মহান
শহীদকে আমরা যে আজকাল খুব বেশি স্মরণ করি না, তার কারণ প্রধানত দুটি বড় বুর্জোয়া
দলের নেতৃত্বাধীনে পরিচালিত প্রধান ধারার যে রাজনীতি এখন চলছে, তাতে আত্মত্যাগের
কোনো মূল্য নেই, আছে কেবল ভোগ সর্বস্বতা, নোংরামি, টাকার খেলা ও আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি বর্জিত প্রদর্শনবাদ। তাই রাজনীতির এই
অধঃপতনের যুগে তাজুল ইসলামকে ভুলে যাওয়া হবে, মিডিয়াতেও তাঁর প্রচার হবে না, এটাই স্বাভাবিক মনে
হয়। তবে নিশ্চিতভাবেই এটাই শেষ কথা হতে পারে না। রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়নের হাত
থেকে,
দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করে সেই আগের ধারায় প্রবাহিত করতে হবে। জনগণের
গণতন্ত্র ও শোষণমুক্তি প্রশ্ন প্রাধান্যে থাকবে। আরও থাকবে জনগণের স্বার্থে
সামাজিক অর্থনৈতিক ইস্যু এবং যেখানে সংগ্রাম ও ত্যাগের মহিমায় উজ্বল হবে রাজনৈতিক
মঞ্চ। তাই বিপ্লবী তাজুল ইসলামের শহীদ দিবস উপলক্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে
তাঁর জীবন, কাজ ও আদর্শের সঙ্গে আজকের নতুন প্রজন্মকে পরিচিত করানোর উদ্দেশ্যেই এই
লেখা। গরিব কৃষক পরিবারে তাজুলের জন্ম।
চাঁদপুরের মতলব উপজেলার ইছাখালী গ্রামে। বেশ কষ্টের মধ্যে তাঁকে লেখাপড়া করতে
হয়েছিল। তবে তিনি ছিলেন মেধাবী ছাত্র। ক্লাসে বরাবর প্রথম স্থান অধিকার করতেন।
স্কলারশিপের টাকা দিয়ে তাঁর লেখাপড়ার ব্যয়ভার বহন করতে হয়েছিল। কৈশরের একটা সময়
তার কেটেছিল আইসক্রিম বিক্রি করে। তবু লেখাপড়ায় ছেদ ঘটতে দেয়া হয়নি। এমনকি তিনি
স্কুলের হকি টিমের অধিনায়কও ছিলেন। শুনেছি তিনি ভালো গানও গাইতেন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত
ও রবীন্দ্র সংগীত। ঢাকা কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করার পর তিনি ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। বোঝাই যাচ্ছে খুব ভালো ছাত্র না হলে
তিনি অর্থনীতি বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেতেন না। এই সময়ই তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী
হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। স্বাধীনতার পর তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির
প্রচার সম্পাদকের পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ‘ন্যাপ-কমিউনিস্ট
পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের’ যৌথ উদ্যোগে ভারতে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ লাভ করছিলেন। ১৯৭৩ সালে তিনি
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন করলেই অথবা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করলেই সকলেই
যে মেহনতি মানুষের স্বার্থে জীবনকে পুরোপুরি বিলিয়ে দিতে পারেন, এমনটা ভাবার কোনো
কারণ নেই। কিন্তু তাজুল ইসলাম ছিলেন স্বল্প সংখ্যক ব্যতিক্রমীদের একজন, যিনি নিজেকে শ্রমিক
শ্রেণির মুক্তির সংগ্রামে পরিপূর্ণরূপে উৎসর্গ করছিলেন। ষাটের দশকে বেশ কিছু
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে শ্রমিক কৃষক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আমি নিজেও
ছাত্র জীবনের ও ছাত্র আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে টঙ্গীর শিল্প এলাকায় শ্রমিক
বস্তিতে থেকে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করেছিলাম। তবে তাজুল ইসলামের মতো কারখানার
শ্রমিক হয়ে কাজ করিনি। এতোটা অগ্রসর হতে আমি পারিনি। এটা বোঝা যায় যে, কমরেড তাজুল ইসলাম
ছিলেন অনেকের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর। তাঁর সঙ্গে যারা বিশেষভাবে ঘনিষ্ট ছিলেন
তাদের কাছ থেকে তার চরিত্রের বিভিন্ন দিকের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে তাঁর দৃঢ় মনোবল
ও আদর্শ নিষ্ঠা সম্পর্কে জানা যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি একবার মুজিব
বাহিনীর প্ররোচনায় গ্রেফতার হন এবং তারপরে আরেকবার দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত
হয়েছিলেন। তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন তার বন্ধু ও সহকর্মী কমরেড আবুল কালাম আজাদ। কমরেড
আজাদ লিখেছেন, “মুজিব বাহিনীর লোকেরা আমাদের বাঁকা চোখে
দেখতে শুরু করলো। ... তারপরও আমাদের বিপদ ঘটেনি, সংগঠনের কাজ শেষে একদিন তাজুল ও আমি
মতলব থেকে আমাদের বাড়ি ফেরার পথে গভীর রাতে পথিমধ্যে দুষ্কৃতিকারী দ্বারা ঘেরাও হই, সে এক ভয়ানক কাহিনী। আমরা নিশ্চিত
মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যাই। ... আমি তাকে বিচলিত হতে দেখিনি...
আমাকে বলে... মৃত্যু যদি অনিবার্য হয় তবে তাদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা না চেয়ে
ইন্টারন্যাশনাল গাইতে গাইতে মরবো...।” ঠিক এই ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন সিপিবি’র সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম
সেলিম তার স্মৃতিচারণে, “মুক্তিযুদ্ধের পর পরেই মুজিব বাহিনীর
দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর বন্ধু আবুল কালাম আজাদকে বলেছিলেন, মরতে হয় দু’বন্ধু এক সাথে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল গান গাইতে গাইতে মরবো। আমাদের
কমরেডরা যেন জানতে পারে আমরা কাপুরুষতার পরিচয় দেইনি, বীরের মতো মরেছি। শ্রমিকদের মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে শ্লোগান দিতে দিতে
ঘাতকদের উন্মক্ত হামলায় বীরের মতো জীবন দিয়ে তাজুল তার সেই অসম সাহসী প্রত্যয়কে
সত্য প্রমাণ করে গেলেন।” বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে তিনি
দুঃখ-কষ্টের জীবনের অবসান ঘটাতে পারতেন। মেধাবী ছাত্রের জন্য বড় চাকুরী, বড় সামাজিক মর্যাদা, বিত্ত বৈভব অর্জন করা কঠিন ছিল না।
কিন্তু সে পথের ধারে কাছেও তিনি গেলেন না। সাধারণ বদলি শ্রমিকের চাকুরী নিলেন
আদমজীতে। তাত চালাতেন। থাকতেন বস্তিতে। সামান্য পয়সায় দু’সন্তান নিয়ে সস্ত্রীক থাকতেন। তাও আবার
একদিন দুই দিন নয়, দুই এক বৎসরও নয়, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এক দশক এইভাবে
সাধারণ বদলি শ্রমিকের কাজ করেছেন ও জীবন কাটিয়েছেন। সত্যিই খুবই ব্যতিক্রমী এই
বিপ্লবী মানুষটি। নারী নেত্রী কমরেড বেলা নবী যিনি কমরেড তাজুল ইসলাম ও তার স্ত্রী
নাসিমা ইসলাম খুকুর খুব ঘনিষ্ট ছিলেন। তিনি তাদের সম্বন্ধে লিখেছেন, “দুই পুত্র সন্তানের জনক জননী আদমজী
পাটকল এলাকায় এক ঝুপড়ি ঘর নিয়ে বসবাস শুরু করে। ওদের বাচ্চারা প্রয়োজনীয় দুধটুকুও
পেত না। ... মাঝে মাঝে খুকু ভেঙ্গে পড়লে তাজুল তাকে এই বলে সান্তনা দিত যে
শ্রমিকদের বাচ্চাদের দিকে চেয়ে দেখ। ওরাও দুধ পায় না। ওরা যদি বিনা দুধে বেঁচে
থাকতে পারে তবে আমাদের বাচ্চারাও বেঁচে থাকবে।” তাঁর স্ত্রী নাসিমা ইসলাম খুকুও এক অসাধারণ নারী। তিনি ধনী পরিবারের মেয়ে।
তার বাবার ইচ্ছা ছিল জামাতা সিএসপি হবে। সেই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সে হলো কিনা
কারখানার বদলি তাত শ্রমিক। তাজুলের শ্বশুর এটা মানতে পারেননি। কিন্তু মেনে
নিয়েছিলেন স্ত্রী খুকু, যিনি নিজে কষ্ট করে ছোটখাট চাকুরী করে
কোনোমতে সংসার টানার ও স্বামীর রাজনৈতিক কাজে সাহায্য করে গেছেন। ১৯৭২ সালে তাদের
বিয়ে হয়। জীবনের এগারোটি বছর তারা খুবই দারিদ্র্যের মধ্যে, কিন্তু গভীর ভালবাসার মধ্য দিয়ে
কাটিয়েছেন। বেলা নবী লিখেছেন, ‘... এত বেদনার মধ্যে
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল গভীর ভালবাসার, যার জন্য জীবনের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে না পারার দুঃখকে জয় করতে পেরেছিলেন
হাসিমুখে।’ স্ত্রী খুকুর এক নিকট আত্মীয় ছিলেন মেজর
জেনারেল, আর্মি মেডিকেল কোরের ডিরেকটর জেনারেল ও
পরে মন্ত্রী। তিনি খুকুকে বলেছিলেন ‘এমন বাবার মেয়ে হয়ে এত কষ্ট করতে পারো? ভাবতে অবাক লাগে। আমি কোনদিন নীতি বহির্ভূত
কাজ করিনি। কিন্তু তোমার জন্য করবো। তাজুলকে বুঝিয়ে রাজী করাও। একটা টেন্ডার দাখিল
করতে বলো। ও রাজনীতিক করুক, তুমি বাচ্চাদের নিয়ে বেশ কিছুদিন চলতে
পারবে।’ বলাই বাহুল্য, তাজুল ইসলাম এই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি, বরং স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘লোভকে জয় করতে হবে।’ এইরকম ব্যতিক্রমী পুরুষ, দৃঢ় মনোবল ও নীতিনিষ্ঠ মানুষটি পার্টির
কাজেও ছিলেন দক্ষ সংগঠক। তিনি প্রদর্শকবাদীতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। আদমজীর
শ্রমিকদের একজন হয়ে সেখানে দারুণ প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পার্টি সংগঠন গড়ে
তুলেছিলেন। পার্টির সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘একতা’র একশ কপি সেখানে বিক্রি হতো। সাচ্চা ও
সংগ্রামী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজনৈতিক
অঙ্গনেও সাড়া সৃষ্টি করেছে। গড়ে উঠেছে ১৫ ও ৭ দল। শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ
(স্কপ) গড়ে উঠেছে। রাজনৈতিক জোটদ্বয় ও
স্কপের পক্ষ থেকে হরতাল ডাকা হয়েছে পহেলা মার্চ। সেই হরতাল সংগঠিত করার জন্য ২৯
ফেব্রুয়ারি রাতের বেলায় এক শিফটের শ্রমিকদের নিয়ে মিছিল বের হয়েছে আদমজীতে হরতালের
প্রচার উপলক্ষে। এই মিছিল সংগঠিত করেন তিনি। মিছিলের সামনে ছিলেন তিনি। এই মিছিলের ওপর এরশাদের দালালরা হামলা
চালায়। প্রধান টার্গেট ছিল তাজুল। তিনি গুরুতরভাবে আহত হন এবং পরে মৃত্যুবরণ করেন।
এই মৃত্যু ছিল সাহসী মৃত্যু, বীরের মৃত্যু, শহীদের মৃত্যু। বিপ্লবীর যেমন মৃত্যু নেই তেমনি তাজুল ইসলামেরও মৃত্যু নেই। এখন প্রয়োজন মৃত্যুহীন তাজুলের অসামান্য
জীবন আদর্শকে নতুন প্রজন্মের প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। আজকের
দূষিত বুর্জোয়া রাজনৈতিক ধারাকে বদলিয়ে সুস্থ প্রগতিশীল রাজনীতির ধারাকে
প্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রয়োজন হবে তাজুল ইসলামের। কমিউনিস্ট আন্দোলন ও পার্টিকে
সত্যিকারের প্রলেতারীয় বিপ্লবী ধারা গড়ে তুলতে হলেও আমাদের প্রয়োজন হবে কমরেড
তাজুলকে।
লেখক
: হায়দার আকবর খান রনো, প্রেসিডিয়াম সদস্য, সিপিবি, (২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ইং তারিখ সাপ্তাহিক
একতা’য় প্রকাশিত লেখা থেকে নেওয়া)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন