Biplobi Barta

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৯

সাভার রানা প্লাজায় শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের ৬ বছর পার হলেও ক্ষতিগ্রস্থ্ শ্রমিক ও শ্রমিক পরিবার ক্ষতিপূরণ পায়নি।


আগামী ২৪ এপ্রিল ২০১৯ রানা প্লাজায় শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের ৬ বছর পূর্ন হতে চলেছে। সাভার রানা প্লাজায় ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ১১৩৪ জন শ্রমিককে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হয়েছে, ২৪৩৮ জন শ্রমিক স্থায়ী ভাবে পঙ্গুত্য বরণ করে বেঁচে আছে। ক্ষতিগ্রস্থ্ শ্রমিক ও শ্রমিক পরিবার ক্ষতিপূরণ পায়নি। দেশি-বিদেশি মানুষের অনুদানে তারা যে টুকু সহযোগিতা তারা পেয়েছে তা দিয়ে কোনরকম বেঁচে আছে। রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্থ্ শ্রমিকদের সহযোগিতা দেওয়ার নাম করে যে সব সরকারী-বে-সরকারী বিভিন্ন সংস্থা যারা টাকা পয়সা এনেছিল তারা এখন রানা প্লাজার শ্রমিকদের থেকে অনেক ভালো কেও কেও আছে ফুলে ফেঁপে অনেক বড় হয়ে গেছে। আবার কেও এমপি-মন্ত্রী হয়েছে, কেও কেও বাড়ী গাড়ীর মালিক হয়েছে। রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকরা তারা কেও কেও চিকিৎসার অভাবে ছটফট করছে, বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাতে পারছেনা। অনেক পরিবার অর্ধা হারে অনাহারে কোন রকম বেঁচে আছে। কিছু আহত শ্রমিক আছে যারা পেটের তাগিদে অনেক কষ্ট করেও কোন না কোন কর্মে নিয়জিত হয়েছেন। তবে বেশীর ভাগ শ্রমিক বেকার জীবন যাপন করছেন। কিছু শ্রমিক আছে যারা কাজ করার ইচ্ছে থাকলেও তাদের কোথাও কাজ দেওয়া হচ্ছেনা। আমরা সরকারের কাছে দাবী জানিয়ে আসছি রানা প্লাজা ভবনের স্থানে জমি অধিগ্রহন করে শ্রমিকদের জন্য মার্কেট নির্মান করে ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকদের পুনঃবাসন ব্যবস্থা করা, এই মার্কেটে নিয়মিত চিকিৎসা দেওয়ার জন্য সরকারী উদ্যোগে হাসপাতাল নির্মান করা, যাতে আহত শ্রমিকরা এখানে চিকিৎসা নিতে পারে। নিহত শ্রমিকদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ভবনের সামনে স্থায়ী বেদী নির্মান করা। রানাপ্লাজা ধ্বসের ঘটনায় দায়ী বেক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা। 

রানা প্লাজায় ৬ টি গার্মেন্ট কারখানার মালিকদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তারা এখন অন্য যায়গায় গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে ব্যাবসা চালিয়ে যাচ্ছেন, ভবন মালিক রানা রানা প্লাজায় শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের মামলাতে জামিনে আছে কিন্তু অন্য মামলাতে জেলে আছে, রানা জেলে থাকলেও আলিশান জীবন যাপন করছেন। রানা প্লাজায় শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী গার্মেন্ট মালিক ও সরকারী কর্মকর্তারা সবায় এক প্রকার দায়মুক্তি নিয়েছেন।
রানা প্লাজায় শ্রমিক হত্যাকাণ্ড এটা নতুন কিছু না। বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্প গড়ে ওঠার পর থেকেই এমন দুর্ঘটনা ঘটতেই আছে। 

১৯৯০ সালে আগষ্টে গ্লোব নিটিং কারখানায় আগুনে মারা যান ১২ জন শ্রমিক এবং ১৭ ডিসেম্বরে ঢাকার মিরপুরে সারাকা গার্মেন্টসে আগুনে পু‍‌ড়ে মারা গিয়েছিলেন ৩০ জন পোশাক শ্রমিক। ১৯৯৫ সালে রাজধানীর ইব্রাহিমপুরের লুসাকা অ্যাপারেলসের কারখানায় নিহত হন ১০ জন গার্মেন্ট কর্মী। ১৯৯৬ সালে  ঢাকার তাহিদুল ফ্যাশনে ১৪ জন এবং সানটেক্স লিমিটিডের কারখানায় ১৪ জন আগুনে পুড়ে মারা যান। ২০০০ সালে ২৫ নভেম্বর নরসিংদী চৌধুরী নিটওয়্যার এ্যাণ্ড গার্মেন্ট লিমিটেডে আগুনে পুড়ে মারা যান ৫৩ জন শ্রমিক ও ডিসেম্বরে নরসিংদীর শিবপুরে এক গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ৪৮ জন শ্রমিক এবং একই বছর বনানীর চেয়ারম্যানবাড়িতে গ্লোব নিটিং ফ্যাশন লিমিটেড গার্মেন্টে কারখানায় মারা যান ১২ জন শ্রমিক।

২০০১ সালে ঢাকার মিরপুরের কাফরুলে অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ২৫ জন শ্রমিক এবং মিরপুরে মিকো সুয়েটার লিমিটেডে আগুন লাগার পর পদদলিত হয়ে নিহত হন ২৪ জন শ্রমিক। ২০০৪ সালে ৩ মে মিসকো সুপার মার্কেট কমপ্লেক্সের এক গার্মেন্টে আগুন লেগে ৯ জন শ্রমিক মারা যান এবং নরসিংদীর শিবপুরে গার্মেন্ট কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৪৮ শ্রমিক নিহত হন। ২০০৫ সালে ৭ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের একটি গার্মেন্টে আগুন লেগে ২২ জন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেন এবং সাভারের আশুলিয়া পলাশ বাড়ীতে ১১ এপ্রিলে স্পেক্ট্রাম গার্মেন্টসের ভবন ধ্বসে নিহত হয়েছিলেন অন্তত ৮৬ জন। ২০০৬ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি গাজিপুরের যমুনা স্পিনিং মিলে আগুনে পুড়ে মারা যান ৬ জন শ্রমিক ও ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের কেটিএস কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলে আগুনে ৯১ জন শ্রমিক পুড়ে মারা যান তার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই ঢাকার তেজগাঁয়ে অবৈধভাবে সংস্কার চালানোর সময় ফিনিক্স ভবন ধ্বসে মারা গেছিল ১৮ জন শ্রমিক এবং একই বছর মার্চ মাসে সায়েম ফ্যাশন লিমিটেডে আগুনে ৩ জন শ্রমিক মারা যান। ২০১০ সালে ২৫শে ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে গরীব এ্যাণ্ড গরীব সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে আগুনে মারা যান ২১ জন শ্রমিক এবং ২৪শে ডিসেম্বর আশুলিয়াতে হামিম গার্মেন্টস অগ্নিকান্ডে নিহত হয় ৩০ জন। 

২০১২ সালে ২৪শে নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরিন ফ্যাশন ফ্যাক্টরিতে বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে মারা গেলেন ১১ জন পোশাক-শ্রমিক। ২০১৩ সালে ২৪শে এপ্রিল সাভার রানা প্লাজায় ভবন ধ্বসে মারা যান ১১৩৪ জন পোশাক-শ্রমিক এবং ২৬ জানুয়ারি ঢাকার মোহাম্মদপুরে এলাকায় স্মার্ট এক্সপোর্ট নামের কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ৭ জন শ্রমিক আগুনে পুড়ে মারা যায়। ২০১৬ সালে ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ টঙ্গীর টাম্পাকো ফুয়েল কারখানায় আগুনে পুড়ে ৪০ জন শ্রমিক মারা যায়। ২০১৭ সালে ৩ জুলাই গাজীপুরের কোনাবাড়ী নয়াপড়া এলাকায় মাল্টিফ্যাব লিমিটেড পোশাক কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় ১৩ শ্রমিক মারা যায় । 

বাংলাদেশে পোশাক শিল্প গড়ে ওঠার পর প্রথম দিক থেকেই আগুনে পুড়ে, ভবন ধ্বসে, বয়লার বিস্ফোরণে শ্রমিক হত্যাকাণ্ড ঘটেই চলেছে অথচ এপর্যন্ত দায়ী বেক্তিদের কোন বিচার বা শাস্তি হয়েছে বলে আমি শুনিনি। প্রথম দিকেই কারখানায় শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী বেক্তিদের যদি শাস্তি নিশ্চিত করা হতো তাহলে এত শ্রমিকের প্রান হারাতে হতো না। এবং এই সব দুর্ঘটনার আগে-পরে, মাঝে মাঝে কিছু দিন পরে পরেই বিভিন্ন দুর্ঘটনায় গার্মেন্ট শ্রমিক মারা যেতেই আছে। এর একটি ঘটনাতেও কারো কোন শাস্তি হয়নি। কয়েকটি কারখানার মালিক নাম মাত্র ক্ষতিপূরণ দিলেও প্রায় বেশীর ভাগ কারখানার মালিক শ্রমিক-শ্রমিক পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেননি এবং এই সব দুর্ঘটনায় হাজার হাজার শ্রমিক আহত হয়ে যারা বেচে আছে তাদের চিকিৎসা, ক্ষতিপূরণ, পুনবাসন কোনটায় করেননি গার্মেন্ট মালিকরা। অথচ এই সব গার্মেন্ট মালিকরা তারা তাদের ব্যাবসা দিনে দিনে আরো উন্নত করে চলেছেন।
২৪ এপ্রিল রানা প্লাজার ঘটনার পর বায়ারদের দুটি জোট একোর্ড এবং এলাইন্স বাংলাদেশে গার্মেন্ট কারখানা গুলোর ভবনের নিরাপত্তা তদারকির পরে গার্মেন্ট কারখানা গুলো অনেকটা নিরাপদ মনে হলেও যতেষ্টনা। কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তার পাশাপাশি কারখানার বাইরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

যেমন, শ্রমিকদের নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থার জন্য পরিবহণ ও পায়ে হেটে চলা শ্রমিকের জন্য রাস্তার পাশে ফুটপাত, রাস্তার পাশে ময়লা ফেলা বন্ধ এবং অলিগলি সহ সকল রাস্তায় বাতির ব্যবস্থা করা, কারখানার গেইটে শ্রমিক ছাউনি নির্মান করা, স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ বাস্থানের ব্যবস্থা, সরকারী স্কুল-কলেজ নির্মান করে শ্রমিকদের সন্তানের লেখাপড়া ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করার জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালুকরা, প্রতি শিল্পাঞ্চলে বার্নইউনিট সহ সরকারী হাসপাতাল নির্মান করা। শ্রমিকদের বাচ্চাদের রাখার জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার নির্মান করা।

খাইরুল মামুন মিন্টু, সাংগঠনিক সম্পাদক, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন