Biplobi Barta

সোমবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৯

শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী গার্মেন্ট মালিক ও সরকারী কর্মকর্তারা সবায় এক প্রকার দায়মুক্তি নিয়েছেন।

 ২৪ এপ্রিল ২০১৩ সকাল ৮:৪৫ এ সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা নামের একটি বহুতল ভবন ধসে পড়ে। ভবনের কয়েকটি তলা নিচে দেবে যায়। কিছু অংশ পাশের একটি ভবনের ওপর পড়ে। এ ঘটনায় এক হাজার ১৩৪ জন শ্রমিক নিহত এবং দুই হাজার পাঁচ শতেরও বেশি মানুষ আহত হয় যা বিশ্বের ইতিহাসে ৩য় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এই ঘটনার ১৭ দিন পর ১০ মে ধ্বংসস্তূপ থেকে রেশমা নামের এক মেয়েকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
 
সাধারণ জনগণ, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধারকাজ চালায়। ভবনটিতে ৬টি পোশাক কারখানা, একটি ব্যাংক এবং একাধিক অন্যান্য দোকান ছিল, সকালে ব্যস্ত সময়ে এই ধসের ঘটনাটি ঘটে। ভবনটিতে ফাটল থাকার কারণে ভবন না ব্যবহারের সতর্কবার্তা থাকলেও তা উপেক্ষা করা হয়েছিল। এর মাত্র পাঁচ মাস আগে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর তাজরিন পোশাক কারখানায় একটি বড় অগ্নিকান্ডের পর এই দুর্ঘটনাটি হয়, যেটি বাংলাদেশে ঘটা সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল দুর্ঘটনা। গার্মেন্ট শ্রমিক সংগঠন গুলোর দাবী, এটি একটি পরিকল্পিত শ্রমিক হত্যাকান্ড। 

ভবনটি রানা প্লাজা হিসেবে পরিচিত এবং এর মালিক সোহেল রানা সাভার পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিল। সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশেই নয়তলা রানা প্লাজা ভবনটি। এতে ভূগর্ভস্থ তলায় গাড়ি রাখার জায়গা। দ্বিতীয় তলার বিপণিকেন্দ্রে বহু দোকান ছিল। তৃতীয় থেকে সপ্তম তলা পর্যন্ত পোশাক কারখানা। এর ওপরের দুটি তলা খালি ছিল। ব্রাক ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় ছিল প্রথম তলায়। 

রানা প্লাজায় ৬টি গার্মেন্টস কারখানায় প্রায় ৫০০০ এর মত শ্রমিক কাজ করত যার বেশীর ভাগ শ্রমিক ছিল নারী। ২০০৭ সালে রানা প্লাজা নির্মাণ করার আগে জায়গাটি ছিল পরিত্যক্ত ডোবা। ভবন নির্মাণ করার আগে বালু ফেলে এটি ভরাট করা হয়। ভবনের উপরের চার তলা অনুমতি ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছিল।

২৩ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে ফাটল নিশ্চিত হওয়ার পর ভবন ছেড়ে শ্রমিকদের চলে যেতে বলা হচ্ছে সত্ত্বেও, গার্মেন্টস শ্রমিকদের পরের দিন কাজে ফিরতে বলা হয়, কারখানা গুলোর তাদের সুপারভাইজার ভবনটিকে নিরাপদ ঘোষণা করে শ্রমিকদের কাজে ফেরার জন্য চাপ প্রদান করে, কাজে যোগদান না করলে চাকুরী হারাতে হবে বলে শ্রমিকদের ভয় দেখান। শ্রমিকরা চাকুরী হারানোর ভয়ে তারা কাজে যোগদেন, এসময় ভবন মালিক সোহেল রানা ও তার গুন্ডা বাহিনীর লোকজন এবং পুলিশ প্রশাসনের লোকজন উপুস্থিত ছিল। ব্যাংক এবং দোকান মালিকরা ভবনে ফাটলের কারণে তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছিল।
কারখানায় ফাটল সম্পর্কে স্থানীয় সংবাদ চ্যানেলে দেখানো হয়েছিল। ৯তলা ভবনটি ২৪ এপ্রিল ২০১৩ সকাল ৯:০০ টার দিকে প্রথম তলা বাদে বাকি সবগুলি তলা ধসে পড়ে। ধসে পড়ার সময় ভবনটিকে প্রায় ৪০০০ শ্রমিক ছিল। ২৪ এপ্রিল ২০১৩ সকাল নয়টার দিকে হঠাৎ করে বিকট শব্দ এবং কাঁপনে শ্রমিকরা ভূমিকম্পের আশঙ্কা করেন। আশে পাশের মানুষ বেরিয়ে দেখেন বিরাট এলাকা ধুলা বালিতে ধোঁয়াটে হয়ে পড়েছে। এ ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করে ঘটনার পরদিন অর্থাৎ ২৫ এপ্রিল একদিনের জাতীয় শোক পালন করা হয়।

২৪ এপ্রিল ২০১৩ সকাল থেকেই গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কর্মিরা রানা প্লাজায় উদ্ধার কাজ শুরু করে। গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের উদ্যোগে রানা প্লাজায় আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা ও অন্যান্য সহায়তা দেওয়ার জন্য সাভারের থানা বাস স্ট্যান্ডে ক্যাম্প স্থাপন করেন। রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য রানা প্লাজা গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন করে এবং রানা প্লাজায় আহত শ্রমিক ও ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকের পরিবারের লোকজন নিয়ে দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার, আহত-নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ, আহত শ্রমিকের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা, নিখোঁজ শ্রমিকের সন্ধান, ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিক ও শ্রমিক পরিবারকে পুনঃবাসন এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাড়ানোসহ ৬ দফা দাবীতে সাভারে গড়ে তোলে। এঘটনার পর গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়নগঞ্জ ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে একি দাবিতে ব্যপক আন্দোলন গাডে তোলে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ শে এপ্রিল ২০১৩ ঢাকা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ভবন মালিক সোহেল রানা,  ঐ ভবনের নিউ ওয়েভ বটমস লিঃ এর মালিক বজলুস সামাদ আদনান, ফ্যন্টম গার্মেন্টসের মালিক আমিনুল ইসলাম, নিউ ওয়েভ বটমস লিঃ এর আরও এক জন  মালিক, মাহবুবুর রহমান তাপস, সাভার পৌর প্রকৌশলী ইমতেমাম হোসেন ও সাভার পৌর সহকারী প্রকৌশলী আলী মিয়াকে অভিযুক্ত করে একটি মামলা দায়ের করেন। এই দুর্ঘটনার কারণ তদন্ত করতে সরকারীভাবে আলাদা কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এদের সাত দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেবার আহ্বান করা হয়। ২৭শে এপ্রিল এই ভবনের দুটি গার্মেন্টসের মালিককে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া সাভার পৌরসভার দুজন প্রকৌশলী, ইমতেমাম হোসেন ও সহকারী প্রকৌশলী, আলী মিয়াকেও গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেয়া হয়। ২৮শে এপ্রিল এই ঘটনায় দায়ী ভবন মালিক সোহেল রানাকে বেনাপোল সীমান্ত থেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় র‍্যাব গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে সবাই জামিনে থাকলেও ভবন মালিক সোহেল রানা জেলে আছে।  কিন্তু একে কেন্দ্র করে করা মামলা গুলোর একটি ছাড়া বাকি প্রায় কোনটিরই আজও নিষ্পত্তি হয় নি। এ ঘটনার পর মামলা হয়েছে মোট ১৪টি। এর মধ্যে রয়েছে অবহেলা-জনিত মৃত্যুর অভিযোগে পুলিশের মামলা, রাজউকের করা ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন এবং নিহত একজন পোশাক শ্রমিকের স্ত্রীর দায়ের করা খুনের মামলা।

মূলত: ঘটনার পরেই সাভার থানা পুলিশ একটি মামলা করে। পরে একজন শ্রমিকের স্ত্রীও খুনের মামলা করলে দুটি মামলা একটিতে রূপ নেয় তদন্তের পর। অন্য আরেকটি মামলা হয়েছিলো ভবন নির্মাণ সম্পর্কিত। বাকী এগারটি মামলা করেছিলো কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। এসব মামলার কোনটিরই চূড়ান্ত ফল আসেনি। তবে দুদকের মামলায় সাজা হয়েছে যদিও সেটি ছিল ভিন্ন মামলা। মূলত সব মামলার প্রায় আসামিরা একই। অর্থাৎ একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছিলো ভিন্ন ভিন্ন অভিযোগে। এখন শ্রম আদালতে এগারটি মামলা বিচারাধীন আছে। বিচারিক আদালতে ফৌজদারি মামলা ও ক্ষতিপূরণের মামলাও বিচারাধীন।

ফাটল নিশ্চিত হওয়ার পর শ্রমিকদের কাজে ফেরার জন্য চাপ প্রদান করে ২৪ এপ্রিল ১১৩৪ জন শ্রমিককে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং ২৪৩৮ জন শ্রমিক স্থায়ী ভাবে পঙ্গুত্য বরণ করে বেঁচে আছে। ক্ষতিগ্রস্থ্ শ্রমিক ও শ্রমিক পরিবার ক্ষতিপূরণ পায়নি। দেশি-বিদেশি মানুষের অনুদানে তারা যে টুকু সহযোগিতা তারা পেয়েছে তা দিয়ে কোনরকম বেঁচে আছে। রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্থ্ শ্রমিকদের সহযোগিতা দেওয়ার নাম করে যে সব সরকারী-বে-সরকারী বিভিন্ন সংস্থা যারা টাকা পয়সা এনেছিল তারা এখন রানা প্লাজার শ্রমিকদের থেকে অনেক ভালো কেও কেও আছে ফুলে ফেঁপে অনেক বড় হয়ে গেছে। আবার কেও এমপি-মন্ত্রী হয়েছে, কেও কেও বাড়ী গাড়ীর মালিক হয়েছে। রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকরা তারা কেও কেও চিকিৎসার অভাবে ছটফট করছে, বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাতে পারছেনা। অনেক পরিবার অর্ধা হারে অনাহারে কোন রকম বেঁচে আছে। কিছু আহত শ্রমিক আছে যারা পেটের তাগিদে অনেক কষ্ট করেও কোন না কোন কর্মে নিয়জিত হয়েছেন। তবে বেশীর ভাগ শ্রমিক বেকার জীবন যাপন করছেন। কিছু শ্রমিক আছে যারা কাজ করার ইচ্ছে থাকলেও তাদের কোথাও কাজ দেওয়া হচ্ছেনা। আমরা সরকারের কাছে দাবী জানিয়ে আসছি রানা প্লাজা ভবনের স্থানে জমি অধিগ্রহন করে শ্রমিকদের জন্য মার্কেট নির্মান করে ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকদের পুনঃবাসন ব্যবস্থা করা, এই মার্কেটে নিয়মিত চিকিৎসা দেওয়ার জন্য সরকারী উদ্যোগে হাসপাতাল নির্মান করা, যাতে আহত শ্রমিকরা এখানে চিকিৎসা নিতে পারে। নিহত শ্রমিকদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ভবনের সামনে স্থায়ী বেদী নির্মান করা। রানাপ্লাজা ধ্বসের ঘটনায় দায়ী বেক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা। 

রানা প্লাজায় ৬ টি গার্মেন্ট কারখানার মালিকদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তারা এখন অন্য যায়গায় গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে ব্যাবসা চালিয়ে যাচ্ছেন, ভবন মালিক রানা রানা প্লাজায় শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের মামলাতে জামিনে আছে কিন্তু অন্য মামলাতে জেলে আছে, রানা জেলে থাকলেও আলিশান জীবন যাপন করছেন। রানা প্লাজায় শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী গার্মেন্ট মালিক ও সরকারী কর্মকর্তারা সবায় এক প্রকার দায়মুক্তি নিয়েছেন।
লিখেছেনঃ খাইরুল মামুন মিন্টু, সাংগঠিক সম্পাদক, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন