Biplobi Barta

রবিবার, ৪ মার্চ, ২০১৮

সিপিবির ৭০ বছর : শুরুর দিনগুলো


প্রায় শতাব্দীকাল আগে আমাদের দেশে কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। শুরুতে সেটি ছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর নবগঠিত পাকিস্তানে ১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ স্বতন্ত্রভাবে পৃথক কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করা হয়েছিল। সেই পার্টির নাম এখন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিবা সিপিবি। সেই হিসাবে এ পার্টির বয়স এখন ৭০ বছর হতে চলেছে। এ পার্টিতে আমার ৫৩ বছরের সংশ্লিষ্টতা। আপেক্ষিক বিচারে অনেকটাই পার্টির শুরুর দিক থেকে। আমার কাছে এই সংশ্লিষ্টতা পরম গৌরব ও সম্মানের।
পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই পূর্ব বাংলার (পূর্ব পাকিস্তানের) কমিউনিস্টদের বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি যে, বাঙালি জাতির জাতীয় মুক্তি অর্জন কার্যত অপূর্ণই থেকে গিয়েছিল। ইংরেজ রাজত্ব শেষ হলেও ঔপনিবেশিক শাসকরা বিদায় নেয়ার আগে সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির মাধ্যমে বিভেদের বিষ গলাধঃকরণ করতে বাধ্য করে গিয়েছিল। গোটা উপমহাদেশে তারা এভাবে তাদের আধিপত্য ও প্রভাব বহুলাংশে অটুট রাখার ব্যবস্থা করতে পেরেছিল। এভাবে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের হাত থেকে জাতীয় মুক্তির অনেক কর্তব্য অনার্জিত থেকে গিয়েছিল। তদুপরি, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার (পূর্ব পাকিস্তানের) ওপর বৈষম্য ও বাঙালি জাতিসত্তার বিরুদ্ধে নির্মম জাতিগত শোষণ চাপিয়ে দিয়েছিল। বাঙালির ওপর এভাবে চেপে বসেছিল আরেকটি নতুন ঔপনিবেশিক ধরনের শোষণ।
দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে তাই কমিউনিস্ট পার্টি ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়স্লোগান দিয়ে গোটা উপমহাদেশে সশস্ত্র অভ্যুত্থান সংগঠিত করার পথে অবতীর্ণ হয়েছিল। এ কথা ঠিক যে, এটি ছিল কমিউনিস্টদের বাম-হঠকারী বিচ্যুতির প্রকাশ। ভারতের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলার পরিস্থিতির আলোকে এই ভুল স্লোগানের মধ্যেও এক গভীর সত্য অন্তর্নিহিত ছিল। পাকিস্তানের আজাদি যে ভুয়া আজাদিতা ১৯৪৮ সালেই কমিউনিস্টরা ঘোষণা করেছিল। পাকিস্তান যে একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র এবং এ ধরনের কৃত্রিম রাষ্ট্র যে চিরস্থায়ী হতে পারে না, সেই উপলব্ধি সাধারণভাবে কমিউনিস্টদের মধ্যে শুরু থেকেই ছিল।
সাম্রাজ্যবাদী ও পশ্চিম পাকিস্তানি (পাঞ্জাবি) একচেটিয়া ধনিকশ্রেণির শোষণকে নিরঙ্কুশ করার জন্য পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী শুরু থেকেই বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-জাতীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ প্রভৃতির বিরুদ্ধে হিংস্র আক্রমণ চালিয়েছিল এবং সূচনা করেছিল জাতিগত শোষণ, বৈষম্য ও নিপীড়নের এক নিষ্ঠুর অধ্যায়। ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো ক্ষুন্ন করে এক ধরনের ফ্যাসিস্ট শাসনে জাতিকে আবদ্ধ করে ফেলা হয়েছিল। এসবের বিরুদ্ধে, প্রায় এককভাবে হওয়া সত্ত্বেও, প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল কমিউনিস্ট পার্টি। এটি ছিল এক অসীম সাহসী চ্যালেঞ্জিং কাজ।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই কমিউনিস্টদের ওপর তাই নেমে এসেছিল নির্যাতনের কঠোর স্টিম রোলার। পাকিস্তানি শাসকরা নানা ধরনের সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল, ফ্যাসিস্ট জিগির তুলে বিরোধী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার পথ গ্রহণ করেছিল। কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে শির কাতাল দেঙ্গেবলে উন্মত্ত হুঙ্কার দেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানি শাসনের এহেন ফ্যাসিস্ট রুদ্র রূপের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সে সময় একমাত্র কমিউনিস্টরা ছাড়া আর তেমন কেউ ছিল না।
পাকিস্তানের নিপীড়নমূলক, অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক, শোষণমূলক (জাতিগত ও শ্রেণিগত) অধ্যায়ের সূচনাতেই তাই সবচেয়ে আগে নিষ্ঠুর বর্বরতা নিয়ে আঘাত নেমে এসেছিল দৃঢ়চেতা আদর্শনিষ্ঠ কমিউনিস্টদের ওপর। কমিউনিস্ট পার্টির জন্য প্রকাশ্যে কাজ করা অসম্ভব করে তোলা হয়েছিল। এরূপ শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যেও নির্যাতন, জেল-জুলুম, হুলিয়া, হামলা-মামলা, হত্যা, নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি উপেক্ষা করে কমিউনিস্টদেরকেই পাকিস্তানি জামানায় প্রায় এককভাবে সূচনা করতে হয়েছিল গণতন্ত্র, জাতীয় অধিকার ও রুটি-রুজির জন্য সংগ্রামের নতুন অধ্যায়। সংগ্রাম ও গৌরবের পথে কমিউনিস্টদের পথচলার শুরু হয়েছিল এভাবেই।
নব পর্যায়ের এই সংগ্রামের প্রথম দিকেই রাজপথে, প্রতিরোধের প্রান্তরে, জেলখানায় শহীদ হয়েছিলেন অসংখ্য কমিউনিস্ট। রানী মাবলে খ্যাত কমরেড ইলা মিত্রের নেতৃত্বে নাচোল বিদ্রোহ, বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়া ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন’, কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে গারো পাহাড় এলাকার টঙ্ক আন্দোলন’, অজয় ভট্টাচার্য-বারীণ দত্তের নেতৃত্বে সিলেটের নানকার বিদ্রোহপ্রভৃতি জঙ্গি সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বহু কমরেড। ঢাকা জেলে অনশন-সংগ্রামে জীবন দিয়েছিলেন শিবেন রায়। রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে এ দেশের প্রথম জেল হত্যাকা-েশহীদ হয়েছিলেন হানিফ, বিজন, দেলওয়ার, কম্পরাম সিংহ, সুখেন, সুধীন ও আনোয়ার। জেলখানাগুলো ভরে তোলা হয়েছিল কমিউনিস্ট বন্দিদের দ্বারা। কমিউনিস্টদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় রুটি-রুজির প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্র, বাঙালি জাতির অধিকার, বিশ্ব শান্তি ইত্যাদি ইস্যুও ক্রমেই সামনে আসতে শুরু করেছিল। নিজ নিজ অধিকার নিয়ে কথা বলার সাহস ক্রমেই গণমানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হতে শুরু করেছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের মধ্যে থাকা বাঙালি মধ্যবিত্তের স্বার্থরক্ষাকারী একটি অংশ, বহুলাংশে কমিউনিস্টদের সাহসী প্রয়াসের দ্বারা সূচিত নব পর্যায়ের এই সংগ্রামে যুক্ত হয়েছিল। ফলে পরিস্থিতি খুব তাড়াতাড়ি পাল্টে যেতেশুরু করেছিল। এই পাল্টে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির অবদান ছিল অনন্য এবং এক হিসেবে প্রধান।
৪৮ থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন ও তারপর৫২-এর ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসের রক্তদানের মধ্য দিয়ে এইপাল্টে দেওয়ারপ্রক্রিয়া অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। ভাষা আন্দোলনে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির ছিল গুরুত্বপূর্ণ সক্রিয় অবদান। এই আন্দোলনকে জাত্যাভিমান ও উগ্র-সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের ভ্রান্তি থেকে মুক্ত রেখে তাকে সঠিক গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ধারায় অগ্রসর করে নিতে এবং এই আন্দোলনে গণমানুষকে সম্পৃক্ত করার কাজে কমিউনিস্টদেরই ছিল প্রধান সচেতন রাজনৈতিক ভূমিকা। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, একুশের অমর শহীদ বরকত ব্যক্তিগতভাবে কমিউনিস্ট ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন।
ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়া সচেতনতা ও জাগরণ যেন রাজনীতির অঙ্গনে যথাযর্থভাবে প্রতিফলিত হয় সে জন্য ৫৪ সালের নির্বাচন সামনে রেখে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গড়ে উঠেছিল। রচিত হয়েছিল যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক ২১ দফা কর্মসূচি। নির্বাচনে মুসলিম লীগের চরম ভরাডুবি ঘটিয়ে যুক্তফ্রন্ট ৯৮ শতাংশ আসনে জয়লাভ করেছিল। যুক্তফ্রন্ট গঠনে সবাইকে রাজি করাতে, ২১ দফা কর্মসূচি রচনায় এবং নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় নিশ্চিত করতে, কার্যত নিষিদ্ধ হয়ে থাকা সত্ত্বেও কমিউনিস্ট পার্টির ছিল অগ্রগণ্য ভূমিকা।
ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পূর্ব বাংলার ছাত্র-তরুণদের মধ্যে অভিজ্ঞতা ও চেতনার এক সমৃদ্ধ ভা-ার গড়ে উঠেছিল। অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, প্রগতিবাদী চেতনার যে প্রসার তাদের মধ্যে ঘটেছিল, তার ওপর ভিত্তি করে জাতি এগিয়ে যেতে পেরেছিল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পথে।
পরবর্তী প্রায় দুই দশক ধরে চলা সংগ্রামের সেসব অসীম সাহসী পদচারণার ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির ছিল গৌরবমন্ডিত অগ্রগণ্য ভূমিকা। একের পর এক ষড়যন্ত্র করেও ক্রমঅগ্রসরমান আন্দোলনের ধারা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তানি শাসকরা ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করে আইয়ুবি একনায়কত্ববাদী স্বৈরতন্ত্রের জালে বাঙালি জাতির সংগ্রামকে অবরুদ্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। আঘাত এসেছিল সব গণতান্ত্রিক শক্তির ওপর। কিন্তু এবারও সবচেয়ে আগে ও বেশি করে বর্বর আঘাত নেমে এসেছিল কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি প্রভৃতি বামপন্থি সংগঠনের অকুতোভয়, দৃঢ়চেতা, আপসহীন নেতাকর্মীদের ওপর। গ্রেপ্তার, নির্যাতন, সামরিক আইনে বেত্রদ-, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে রাস্ট্রিকেশন, হুলিয়া-গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইত্যাদির বেশিরভাগই বরাদ্দ ছিল বামপন্থিদের জন্য।
প্রবল নির্যাতন-অত্যাচার উপেক্ষা করে পর্যায়ক্রমে গড়ে উঠেছিল আইয়ুবি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। সেই সংগ্রামেরও অগ্রভাগে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবির পাশাপাশি শিক্ষার দাবি, বাঙালির অধিকারের দাবি, সাম্রাজ্যবাদকে রুখে দাঁড়ানোর দাবি, শ্রমিক-কৃষকের রুটি-রুজির দাবি প্রভৃতি দাবিতে সংগ্রাম ক্রমান্বয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। ৬২, ’৬৪, ’৬৬ সালে পরিচালিত হয়েছিল জাতীয় পর্যায়ের সংগ্রামের বড় বড় অধ্যায়। অবশেষে সংগঠিত হয়েছিল ৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান। পতন হয়েছিল আইয়ুব শাহির।
এসব ধারাবাহিক সংগ্রামের প্রায় সবটা সময় কমিউনিস্ট পার্টি তার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার মাধ্যমে তাকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এবং সময়ে সময়ে এই অবদান ছিল নির্ধারক, ক্রান্তিকালীন এবং কখনো কখনো সাময়িকভাবে নেতৃত্বমূলক। সংগ্রামের সে পথ ধরেই রচিত হয়েছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষ সশস্ত্র পর্বের ঐতিহাসিক পটভূমি।
অনেকের মনে একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন হলো - শুরুর দিনগুলোয় জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করার মতো যে শক্তি-সামর্থ্য কমিউনিস্ট পার্টির ছিল, তা আজ সেভাবে ও ততটা নেই কেন? আন্তর্জাতিকভাবে ও জাতীয়ভাবে পরিস্থিতির অনেক ক্ষেত্রে পেছন দিকে চলে যাওয়া এর একটি প্রধান কারণ। এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রায় তিন দশক ধরে কমিউনিস্ট পার্টিকে ভিন্ন ধরনের হলেও কঠিন ও জটিল নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তা ছাড়া ৭০ বছরের পথ চলার ক্ষেত্রে পার্টি নানা ভুলত্রুটিও করেছে। সব মিলিয়ে জোয়ার-ভাটার এই দেশে নেমে এসেছে সাময়িকভাটারলক্ষণ। তবে এই ভাটার পর্বআস্তে আস্তে কাটতে শুরু করেছে। এখন কর্তব্য হলো' ‘জোয়ারেরসেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য দৃঢ়তা ও একাগ্রতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। সে ক্ষেত্রে পার্টির শুরুর দিনগুলোর অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা অনুপ্রেরণার অনন্ত উৎস ও আশায় বুক বেঁধে পথ চলার পাথেয় হয়ে আছে।

লেখকঃ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন