শ্রমিক অসন্তোষ আর ট্রেড ইউনিয়নের ঝামেলা এড়াতে রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পে শুরু হয়েছে মেশিন নির্ভর আধুনিক প্রযুক্তি । এতে ৮ জন শ্রমিক হাতে যে কাজটি করতেন, এখন সেই কাজ একটি মেশিনই আরো সুচারুভাবে করে দেবে । তবে আশঙ্কার কথা হচ্ছে, এই প্রযুক্তি নির্ভরতা বাড়লে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। গত দুই বছরে ৬০ শতাংশ সোয়েটার কারখানায় এই প্রযুক্তি নিয়ে আসা হয়েছে। এ কারণে প্রতিনিয়তই এসব কারখানা থেকে শ্রমিক ছাঁটাই করা হচ্ছে ।
এ সম্পর্কে গার্মেন্টস মালিকরা বলেন পোশাক খাতে খরচ বেড়ে যাওয়ায় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে দিন দিন শ্রমিক সংখ্যা কমিয়ে আনার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে । শ্রমিকদের বড় একটি অংশ কাজ করে সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে । পর্যায়ক্রমে তাদের সবাইকে বাদ দেয়া হবে । সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে কেন এই প্রযুক্তি প্রয়োজন হলো জানতে চাওয়া হলে গার্মেন্টস মালিকরা বলেন, তারা লক্ষ্য করে দেখেছেন, পোশাক খাতে নিটিং সেকশনের শ্রমিকরাই আন্দোলন-ভাংচুর, জ্বালাও-পোড়াও বেশি করে থাকেন । মালিকরা টাকা বিনিয়োগ করে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়বেন আর শ্রমিকরা আন্দোলন করে কারখানা ভাংচুর করবেন, তা হতে পারে না । এজন্য তাদের জায়গায় এখন সব কারখানায় 'জ্যাকার্ড' মেশিন বা অটো মেশিন নিয়ে আসা হচ্ছে । খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একজন শ্রমিকই এ ধরনের ৭টি মেশিন চালাতে পারেন । মালিক পক্ষ বলছে, তারা টাকা দিয়ে ব্যবসা করছেন । এ কারণে কথায় কথায় ধর্মঘট এবং রাস্তা বন্ধ করে দেয়া তারা মানবেন না। আন্দোলন ঠেকাতে তাদের এর বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই । পোশাক মালিকরা জানান, বর্তমানে নিটওয়্যার সব কারখানায় জ্যাকার্ড মেশিন আনা হচ্ছে । আর ওভেন গার্মেন্টের জন্যও নতুন নতুন অটোমেশিন আসছে । গার্মেন্ট মালিকদের সামনে এর বিকল্প কিছু নেই । কারণ, শ্রমিকরা ইউনিয়ন করে কথায় কথায় কারখানা বন্ধ করে দেন । ভাংচুর ও রাস্তা অবরোধ করেন । এ কারণে এই মেশিন দিয়ে শ্রমিক কমানো হবে । তাদের মতে, এই মেশিনে খরচ কম, উৎপাদন বেশি এবং পণ্যের গুণগত মানও ভালো ।
এ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড
ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাংগঠিন সম্পাদক শ্রমিক নেতা খাইরুল মামুন মিন্টু এই প্রযুক্তির
ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুই দিকই তুলে ধরে বলেন, পোশাকের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং খরচ
কমানোর জন্য এই প্রযুক্তি মালিকদের ব্যবসায়িক দিক দিয়ে ইতিবাচক। তবে শ্রমিক
অসন্তোষ আর ট্রেড ইউনিয়নের ঝামেলা এড়ানোর বিষয়টি মানতে নারাজ তিনি । তিনি মনে করেন, মালিকরা
শ্রমিক কমিয়ে বেশি লভ্যাংশ বের করতেই এ ধরনের মেশিন ব্যবহার করছেন । এই প্রযুক্তি
ব্যবহারের ফলে পোশাক খাতে শ্রমিকদের বড় একটি অংশ বেকার হয়ে যাচ্ছে এবং যাবে । তিনি উদাহরণ দিয়ে
বলেন, যেখানে
একটি কারখানায় ১০ হাজার শ্রমিক লাগত, এখন হয়তো আড়াই হাজার
শ্রমিক কাজ করবেন । শিল্পে এ ধরনের মেশিন বসানোর কারণে উৎপাদন খরচ
কমবে আর এর নেতিবাচক সুযোগ নেবেন ক্রেতারা । তখন তারা পোশাকের
দাম আরো কমিয়ে দিতে পারেন বলে আশঙ্কা এই শ্রমিক নেতার । গার্মেন্টস মালিকরা আরো জানান, নতুন
প্রযুক্তিতে শ্রমিকের হাতে কোনো কাজ থাকবে না । শুধু দেখা যাবে, ৭টি
মেশিন একজন হেলপারই পরিচালনা করতে পারবেন । ৭-৮ জন শ্রমিক যে
কাজ কারতেন, এখন একটি অটোমেশিন একাই সেই কাজ করবে । এতে পোশাক খাতে
শ্রমিক অসন্তোষে আন্দোলনের জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো ঘটনা ঘটবে না । তিনি জানান, দেশে
৫ শতাধিক সোয়েটার কারখানায় এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে । গত দুই বছরে ৬০
শতাংশ সোয়েটার কারখানায় এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ধরনের মেশিন ভারত, ভিয়েতনাম
ও চীনসহ অনেক দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে। জানা গেছে, সাধারণত
গার্মেন্টে কয়েক ধরনের মেশিন ব্যবহার হয়। এর মধ্যে রয়েছে ডায়িং, প্রিন্টিং, স্পিনিং, উইভিং,
নিটিং, ফিনিশিং, টেস্টিং, ওয়াশিং এবং এমব্রয়ডারি । বর্তমানে নিটিংয়ের
জন্য ৯৫ শতাংশ গার্মেন্টে কম্পিউটারচালিত এই মেশিন নিয়ে আসা হচ্ছে। আর নতুন যারা
গার্মেন্ট খুলছেন, তাদের শতভাগ এই মেশিন । রপ্তানি
প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকার (ইপিজেড) সব কারখানায় এই মেশিন । মালিকরা বলছেন, নিটওয়্যার
খাতে একটি মেশিনের দাম ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। কিন্তু জ্যাকার্ড মেশিনের
দাম প্রায় ১৫ লাখ টাকা । একজন শ্রমিকই ৭টি পর্যন্ত মেশিন চালাতে পারে । কম্পিউটারচালিত এই মেশিনে
সুতা পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে কাটে ।
গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাংগঠিন
সম্পাদক শ্রমিক নেতা খাইরুল মামুন মিন্টু আরো বলেন, বিষয়টি
তারা শুনেছেন । এটি উদ্বেগজনক। প্রযুক্তির তারা বিরোধিতা করেন
না, তবে
এমন প্রযুক্তি চান না, যা মানুষের অধিকার নষ্ট করবে । সূত্র আরো জানায়, সাম্প্রতিক
সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে শ্রমিকদের আন্দোলনে গার্মেন্ট মালিকরা উদ্বিগ্ন । বড় কোনো কারখানা
বন্ধ করে দিলে সমস্যায় পড়তে হয় । ফলে বেশি দাম দিয়ে এসব মেশিন কেনা সম্ভব হলে
আন্দোলন এড়ানো যাবে । তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গার্মেন্টে
প্রতি বছর সরকার অনেক ধরনের সহায়তা দেয় । অন্যান্য পণ্য
আমদানিতে সরকারকে যে পরিমাণ শুল্ক দিতে হয়, গার্মেন্ট মেশিনারিজ এবং কাপড়
আমদানিতে শুল্ক তার চেয়ে কম । এছাড়া বিশ্ব মন্দার সময় এই খাতের রপ্তানি ধরে
রাখতে নগদ সহায়তা দেয়া হয়েছে । এর সবকিছুর উদ্দেশ্য এই খাতে লাখ লাখ লোকের
কর্মসংস্থান । এরপরও শ্রমিকরা বেকার হলে সরকারের এতসব সহায়তা
নিরর্থক হবে। এছাড়া অসম প্রতিযোগিতায় পড়ছে ছোট কারখানাগুলো । কারণ, এই
মেশিন কেনার সামর্থ্য যাদের নেই, সেসব ছোট ফ্যাক্টরি বন্ধ
হয়ে যাবে বা যাচ্ছে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন