Biplobi Barta

Sunday, July 22, 2018

বর্তমান জীবনযাত্রার ব্যয়ের কথা চিন্তা করলে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে নিম্নতম মাসিক বেতন ১৬ হাজার টাকা করার যে দাবি তোলা হয়েছে, তা যৌক্তিক বলেই আমি মনে করি।


চার দশকে দেশের পোশাক শিল্পের উন্নতি অন্য রকম। ৪০ হাজার ডলারের রফতানি আয় পৌঁছেছে প্রায় ৩ হাজার কোটি ডলারে। স্ফীত হয়েছে মালিকদের সম্পদ। এর সবটাই সম্ভব করেছে সস্তা শ্রম ও শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা। এ শিল্পের ভরসার জায়গাও এখনো নিম্ন মজুরিই। ১৯৮৫ সাল থেকে কয়েক দফা বেড়ে ২০১৩ সালে ৫ হাজার ৩০০ (৬৬ দশমিক ২৫ ডলার) টাকায় পৌঁছেছে শ্রমিকদের নিম্নতম মাসিক মজুরি। তারপরও তা এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।
এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মজুরির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, কম্বোডিয়ায় ন্যূনতম মাসিক মজুরি ১৪০ ডলার। ভিয়েতনামে এ মজুরি প্রায় ১৪৭ ডলার, ফিলিপাইনে ২০২, ইন্দোনেশিয়ায় প্রায় ১৬০, মালয়েশিয়ায় ২২৩, থাইল্যান্ডে ২৬৫, চীনে ২৩৪ ও মিয়ানমারে ৮০ ডলার। এছাড়া সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারতে নিম্নতম মাসিক মজুরি প্রায় ১৪৪ ডলার, পাকিস্তানে ১০৬, শ্রীলংকায় প্রায় ৬৯, নেপালে ৭৪ ও আফগানিস্তানে ৭৩ ডলার।
তবে জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় বাংলাদেশের বিদ্যমান এ মজুরিকেও সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করেন না গার্মেন্ট শ্রমিকরা ২০১৩ সালে নিম্নতম মজুরি কমিশনের মাধ্যমে যে মজুরি নির্ধারণ করা হচ্ছে, বার্ষিক ৫ শতাংশ হারে তা বাড়ানোর বিধান রাখা হয়েছে কিন্তু অনেক কারখানার মালিকরা তা মানেন না। তার পরেও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে মজুরি বৃদ্ধির এ হার কোন ভাবেই ইতিবাচক না। তাই আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান মজুরি কোন ভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ না।
দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প খাত পোশাক শিল্পে ১৯৮৫ সালে নিম্নতম মজুরি ছিল ৫৪২ টাকা। ১৯৯৪ সালে এটি বাড়িয়ে ৯৩০ টাকা করা হয়। এর এক যুগ পর ২০০৬ সালে মজুরি বাড়িয়ে করা হয় ১ হাজার ৬৬২ টাকা। এর পর ২০১০ সালে নিম্নতম মজুরি বেড়ে হয় ৩ হাজার টাকা। সর্বশেষ ২০১৩ সালে নিম্নতম মজুরি ৫ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করে নিম্নতম মজুরি কমিশন। তবে মজুরি বৃদ্ধির জন্য প্রতিবারই আন্দোলন করতে হয়েছে শ্রমিকদের। অনেকটা নিয়ম মেনেই বিভিন্ন অজুহাতে মজুরি বৃদ্ধিতে অনীহা দেখিয়েছেন শিল্প মালিকরা। ২০১৮ সালেও তার ব্যতিক্ষম না
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোশাক শিল্পে কর্মরতদের মধ্যে একটি বড় অংশ নিম্নহারে মজুরি পায়। এ খাতের ৮০ শতাংশ নারী শ্রমিকের মজুরি ৫ হাজার ৩০০ থেকে ৭ হাজার টাকার মধ্যে। অন্যদিকে ৭০ শতাংশ পুরুষ শ্রমিক ৫-৭ হাজার টাকা মজুরি পান।
গার্মেন্ট মালিকেরা শ্রমিকদের বোঝাতে চান “অর্থনীতির প্রেক্ষাপট চিন্তা করলে মজুরিকে একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা সঠিক নয় বলে মনে করেন গার্মেন্ট মালিকেরা। তেনারা মনে করেন, এর সঙ্গে আরো বেশকিছু বিষয় জড়িত। শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা কতটুকু তা দেখতে হবে। চীনে মজুরি যেমন আমাদের চেয়ে বেশি, সেখানে কর্মদক্ষতাও বেশি। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে এখানে যে মজুরি দেয়া হয়, তা অন্য অনেক দেশের জীবনযাপন ব্যয়ের তুলনায় যথেষ্ট। আবার এখানে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ভূমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য যেসব ব্যয় রয়েছে, তা তুলনামূলক বেশি। এসব বিষয়ই পরস্পর-সংশ্লিষ্ট। আরেকটি বিষয় হলো, দেশে শ্রমের মজুরি কম হলেও বাধ্যতামূলক বা জোরপূর্বক কাজে নিয়োজিতের ঘটনা নেই”।
গার্মেন্ট মালিকদের এই কথা কোন ভাবেই মেনে নেওয়ার মত না, কারণ আমাদের দেশের শ্রমিকদের কর্মদক্ষতার কারনেই গার্মেন্ট শিল্প আজ দিনে দিনে বিকশিত হচ্ছে দেশের জীবনযাপন ব্যয়ের তুলনায় শ্রমিকদের অনেক কম মজুরি দিয়ে বাধ্যতামূলক বা জোরপূর্বক ওভার টাইম করানো হচ্ছে
সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যানুযায়ী, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক মিলিয়ে শ্রমশক্তি দেশের মোট জনসংখ্যার ৫৮ দশমিক ৫ শতাংশ। দেশের উৎপাদন, নির্মাণ, কৃষি ও মত্স্য খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম গড় মজুরি ৯ হাজার টাকারও বেশি।
দেশের খাতভিত্তিক ন্যূনতম মজুরি মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে আমি মনে করি। বিপুল জনগোষ্ঠী আমাদের দেশের জন্য সম্পদ। তবে এখানে বৈষম্যপূর্ণ মজুরি কাঠামো বিদ্যমান। বৈষম্যমূলক এ মজুরি কাঠামোর ফলে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও শ্রমের ক্ষেত্রে এক ধরনের এক্সপ্লয়টেশন রয়েছে। এ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। তবে সরকার ও মালিকদের সদিচ্ছার অভাবে সেটি হচ্ছে না।
জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোস্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক (ইউএন-এসকাপ) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে শ্রম উৎপাদনশীলতায় বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্থানে। বাংলাদেশে শ্রমের গড় উৎপাদনশীলতা বছরে মাত্র ৮ হাজার ডলার। এর চেয়ে কম শ্রমের গড় উৎপাদনশীলতা রয়েছে শুধু কম্বোডিয়ায়। দেশটির শ্রমিকদের গড় উৎপাদনশীলতা ৬ হাজার ডলার। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকা ১৪তম, পাকিস্তান ২০ ও ভারত ২২তম স্থানে রয়েছে। দেশ তিনটির শ্রমের গড় উৎপাদনশীলতা যথাক্রমে ২৩ হাজার, ১৮ হাজার ও ১৫ হাজার ডলার।
সংস্থাটি তথ্য বলছে, শ্রমের মজুরির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। নিম্ন উৎপাদনশীলতার এটি অন্যতম কারণ। এজন্য বিভিন্ন খাতে মজুরি বাড়ানোর প্রতি নজর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। কারণ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহূত উপকরণ তথা শ্রমের দক্ষ ব্যবহারের ওপর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে। কারণ শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেশি হলে অধিক বিনিয়োগ ও অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এছাড়া ব্যবহূত উপকরণগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধি করা গেলে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি বাড়ে, যা জাতীয় প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্প মালিকরা সস্তা শ্রমকে শক্তির বদলে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। এ কারণে বর্তমান বিশ্ববাজারে প্রতিযোগী সক্ষমতা বৃদ্ধিতে শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি হলেও এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেই। পাশাপাশি শ্রমিক ও তার পরিবারের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতেও খুব অল্প সংখ্যক শিল্প মালিকই এগিয়ে এসেছেন। অথচ শ্রমিকদের দুপুরের খাবার, চিকিৎসা, ডে-কেয়ার সেন্টারসহ বিভিন্ন সেবা ও প্রণোদনা নিশ্চিত করা গুটিকয় প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে মালিকদের মুনাফা কমেনি। বরং অসন্তোষ কম থাকায় উৎপাদন নির্বিঘ্ন হচ্ছে।
অথচ আজ দেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জনকারী বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এ দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান যে গুরুত্বপূর্ণ, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের নতুন মজুরি নির্ধারণের জন্য ২০১৮ সালে এসে আবার একটি নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করা হচ্ছে। এতে মালিকপক্ষ থেকে ন্যূনতম মূল মজুরি তিন হাজার ছয় শত টাকা ধরে, ছয় হাজার ৩০০ টাকা নিম্নতম মোট মজুরি নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা ২০১৩ সাল থেকে প্রতি বছর ০৫% হারে বেতন বৃদ্ধির হিসাব করলে ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে ৭৪২ টাকা কম প্রস্তাব করা হয়েছে এর আগে সর্বশেষ ২০১৩ সালে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছিল। তখন তিন হাজার টাকা মূল বেতন ধরে পোশাক শ্রমিকদের জন্য ৫ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। বর্তমান জীবনযাত্রার ব্যয়ের কথা চিন্তা করলে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে নিম্নতম মাসিক বেতন ১৬ হাজার টাকা করার যে দাবি তোলা হয়েছে, তা যৌক্তিক বলেই আমি মনে করি।

বিগত বেতন বোর্ড সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণ করেছে। গত পাঁচ বছরে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন এক পয়সা না বাড়লেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অনেক বেড়েছে। এর অর্থ শ্রমিকদের প্রকৃত বেতন আরও কমে গেছে। শিল্পের উন্নয়ন চাইলে শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়ন করতে হবে। শ্রমিকদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার মতো মজুরি দিতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না শ্রমিকদের পেছনে মালিকপক্ষ যে বিনিয়োগ করবে, অনেক বেশি তা তুলে নিতে পারবে।

লেখকঃ খাইরুল মামুন মিন্টু, সাংগঠিক সম্পাদক, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র


No comments:

Post a Comment