৭ নভেম্বর তারিখটি অনন্য। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এ তারিখের উল্লেখ চিরদিন
অক্ষয় হয়ে থাকবে। একশ বছর আগে ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর রুশ দেশে সংঘটিত
হয়েছিল মহান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। মানব ইতিহাসে এর আগে অনেক দেশে আরও
অনেক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু রুশ বিপ্লব ছিল সেসব বিপ্লব থেকে ভিন্ন ও
গুণগতভাবে নতুন মাত্রিকতাসম্পন্ন। বস্তুত সেই বিপ্লবের মাধ্যমে ‘বিপ্লবের’
ক্ষেত্রেও সাধিত হয়েছিল একটি বিপ্লব। বলা যায়, এটি ছিল এক ‘মহাবিপ্লব’।
এই বিপ্লব মানবজাতির ইতিহাসে সূচনা করেছিল এক নতুন যুগের।
যুগ যুগ ধরে মানুষ শোষণহীন, সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন দেখেছে। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন কার্ল মার্কস-ফ্র্রেডারিখ এঙ্গেলস। তাদের মতাদর্শকে ধারণ করে কমরেড ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিনের পরিচালনায় ও বলশেভিক পার্টির (কমিউনিস্ট পার্টির) নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে, পুরনো জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসারে ২৫ অক্টোবর, আর নতুন গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসারে ৭ নভেম্বর রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ নামে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
‘সোভিয়েত বিপ্লবই’ প্রথম সফল বিপ্লব, যার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল শোষণহীন এক নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা। সূচিত হয়েছিল শোষণমুক্ত সমাজের পথে মানবসভ্যতার যাত্রা। এ বিপ্লব পুঁজিবাদের ভিত্তিমূলে বড় রকমের ভাঙন ও চিড় ধরিয়েছিল। দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিয়েছিল বিশ্বের বিপুলসংখ্যক মানুষকে। মানুষ পেয়েছিল মুক্তির স্বাদ। কায়েম হয়েছিল শোষিত শ্রমিকশ্রেণির রাজত্ব। এর আগের অন্য সব বিপ্লব থেকে অক্টোবর ‘সোভিয়েত বিপ্লবের’ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যটি ছিল এই যে, আগের সব বিপ্লব কেবল শাসকশ্রেণির এবং শোষণের রূপ ও পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছিল। কিন্তু শোষণের অবসান ঘটাতে পারেনি। অন্যদিকে ‘সোভিয়েত বিপ্লবের’ মধ্য দিয়ে শুধু শোষক-শাসকশ্রেণির ও সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনই ঘটেনি, সূচনা হয়েছিল মানুষের ওপর মানুষের শোষণের চির অবসানের যুগ। সূচিত হয়েছিল শ্রেণিহীন সমাজ নির্মাণের পথে যাত্রা।
এই মহান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আগে রাশিয়া ছিল পিছিয়ে থাকা একটি দেশ। রাশিয়াকে বলা হতো ‘ইউরোপের পশ্চাৎভূমি’। জারের আমলে (সে দেশের বাদশাহকে জার বলা হতো) অনাহার, দারিদ্র্য ও অসহনীয় শোষণ ছিল জনগণের নিত্যসঙ্গী। উন্নত শিল্প দূরের কথা, সাধারণ মাপের শিল্প উৎপাদনের ব্যবস্থাও সেখানে তখন তেমনভাবে ছিল না। দ্য ‘গ্রেট রাশিয়ান’দের দ্বারা অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলো শোষিত হতো। জারের শাসনামলে রাশিয়ায় সামান্যতম গণতান্ত্রিক অধিকারও ছিল না। জারের শাসনের ভিত্তি ছিল বৃহৎ জমিদারতন্ত্র।
রাশিয়ার বিপ্লবী শক্তিগুলো, বিশেষত বলশেভিক পার্টি তথা কমিউনিস্ট পার্টি জার স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল। এসব সংগ্রাম ধীরে ধীরে বিপ্লবে রূপ নিয়েছিল। ১৯০৫ সালে এরূপ এক বিপ্লব ব্যর্থ হয়। তার পর ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আরেকটি বিপ্লব হয়। সেই বিপ্লবে জার স্বৈরতন্ত্র উৎখাত হয় এবং মেনশেভিক দলের নেতা কারনেস্কির ‘অস্থায়ী সরকার’ গঠিত হয়। এ সরকার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর সঙ্গে আপস করে ও বুর্জোয়াশ্রেণির স্বার্থরক্ষার পথে অগ্রসর হয়। এর ফলে সে সরকারটি ক্রমেই গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ সুযোগে জারতন্ত্রের পতিত শক্তি প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার চেষ্টা করতে থাকে। এসবের কারণে ‘অস্থায়ী সরকার’ শ্রমিক, কৃষক ও সৈন্যদের তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষের মুখে পড়ে। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর সে দেশে শ্রমিক, কৃষক ও সৈন্যদের নতুন এক ধরনের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক সংস্থা হিসেবে ‘সোভিয়েত’ গড়ে উঠেছিল। সোভিয়েতগুলোর মধ্যে বলশেভিক পার্টির অবস্থান ক্রমে শক্তিশালী হতে থাকে।
‘সোভিয়েতগুলোর হাতে সব ক্ষমতা দাও’ - এ আহ্বানে বলশেভিক পার্টি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। শ্রমিক বিক্ষোভ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। শ্রমিকরা বিভিন্ন কারখানায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। যুদ্ধক্লান্ত সৈনিকরাও ‘শান্তি’র জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা ‘অস্থায়ী সরকারের’ বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়তে শুরু করে। এ রকম এক পটভূমিতে লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক পার্টি অস্থায়ী সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ২৫ অক্টোবর (৭ নভেম্বর) শ্রমিকদের সশস্ত্র অংশ এবং বিপ্লবী সেনারা অস্থায়ী সরকারকে উৎখাত করতে প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে যুদ্ধজাহাজ ‘অরোরা’ থেকে ফাঁকা শেল নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে বিপ্লবী সৈনিক (যারা আসলে উর্দি পরা কৃষক) ও রেড গার্ড বাহিনীর সহায়তায় রাজধানী পেট্রোগ্রাডের শ্রমিকরা বুর্জোয়া সরকারের কেন্দ্র ‘উইন্টার প্যালেসে’ অভিযান শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যেই পতন হয় ‘উইন্টার প্যালেসের’। ‘অস্থায়ী সরকারের’ হাত থেকে ক্ষমতা চলে আসে শ্রমিক, কৃষক ও সৈনিকদের ‘সোভিয়েতের’ হাতে। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে প্রতিবিপ্লবীদের প্রতিরোধ ভেঙে মস্কো, গোটা রাশিয়া এবং পুরনো জার সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশে বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিকশ্রেণি ক্ষমতা দখল করে নেয়।
বিপ্লবের পর লেনিনের নেতৃত্বে গঠিত নতুন সোভিয়েত সরকারের প্রথম পদক্ষেপগুলো ছিল, প্রথমত, ‘শান্তির ডিক্রি’র মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য অবিলম্বে শান্তি আলোচনা শুরুর ঘোষণা করা। দ্বিতীয়ত, ‘জমির ডিক্রি’র মাধ্যমে খোদ কৃষককে জমির ওপর অধিকার প্রদানের ব্যবস্থা করা। তৃতীয়ত, সর্বপর্যায়ের সোভিয়েতগুলোর হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা সংহত করা। অন্য ডিক্রিগুলো ছিল নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, অবৈতনিক চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যরক্ষা এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের নতুন ইউনিয়ন গঠন সম্পর্কিত।
মহান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয়ের পর সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের কাজ শুরু করার আগেই সোভিয়েত বিপ্লব প্রতিবিপ্লবী শক্তির আক্রমণের মুখে পড়ে। অন্তত ১৪টি সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশের সামরিক বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আগ্রাসন শুরু করে। এদের সঙ্গে যুক্ত হয় দেশের অভ্যন্তরে ক্ষমতাচ্যুত শাসকশ্রেণির অনুগত শ্বেত সেনাবাহিনী। চার বছরের গৃহযুদ্ধের পর ‘লাল ফৌজ’ দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সেসব প্রত্যক্ষ আক্রমণগুলো পরাভূত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। ‘লাল ফৌজে’র হাজার হাজার যোদ্ধাকে প্রাণ দিতে হয়।
সোভিয়েতবিরোধী আঘাত আরও ঘৃণ্যরূপ ধারণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ফ্যাসিবাদ বিশ্বকে গ্রাস করতে যুদ্ধ শুরু করে। হিটলারের নাৎসি বাহিনী দেশের পর দেশ দখল করে নিতে থাকে। কিন্তু ‘লাল ফৌজে’র অসীম সাহসী লড়াই ও বীরত্বের কাছে পর্যুদস্ত হয়ে ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল হিটলারের সেই কথিত অপরাজেয় বাহিনী সোভিয়েত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তিন কোটি মানুষের প্রাণের বিনিময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন রক্ষা করে বিশ্বকে, মানবসভ্যতাকে। মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের অমূল্য অবদানের কারণেই বিংশ শতাব্দীর মহাবিপদ ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করা সম্ভব হয়।
এসব প্রবল বাধা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্রুত উন্নতি ঘটতে থাকে। মাত্র দুই দশকের মধ্যেই দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শোষিত-বঞ্চিত সব শ্রেণি নির্মম শোষণ থেকে মুক্তি পেয়েছিল। প্রত্যেক নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করা হয়েছিল কাজ, খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সাধারণ মৌলিক চাহিদাগুলো। এক দশকের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করা হয়েছিল। কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য এসেছিল। নতুন নতুন শিল্প গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। দ্রুত শিল্পায়নের লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক সরকার ১৯২৭ সালে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। দু-তিনটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়। ১৯২৯-৩৩ সালের মহামন্দায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন উন্নত পুঁজিবাদী দেশ আক্রান্ত হয়ে পড়লেও এ মহামন্দা সোভিয়েত ইউনিয়নকে স্পর্শ করতে পারেনি। এসবের ফলে সমাজতন্ত্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মর্যাদা গোটা বিশ্বে আরও ছড়িয়ে পড়ে।
সমাজতন্ত্র প্রতিটি নাগরিকের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যা অর্জনের ব্যবস্থা করে দেয়, মানুষকে দীর্ঘ আয়ু দান করে, নারীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার, শ্রমিকসহ মেহনতি মানুষকে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদান এবং বঞ্চিত ও নিপীড়িত জাতিসমূহকে মুক্ত করে। সব ধরনের পুরনো সংস্কৃতি যেমন - গোষ্ঠীবাদ, জাতীয়তাবাদ, সংকীর্ণতাবাদ ইত্যাদির অপসারণ করা হয়। প্রতিক্রিয়াশীলতা, ভোগবাদ, কুসংস্কার, কূপম-ূকতার বিরুদ্ধে ব্যাপক সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটানো হয়। প্রলেতারিয়েতের মধ্যে নতুন চেতনা, মূল্যবোধ ও আত্মমর্যাদার উন্মেষ ঘটে। নিপীড়িত মানুষের শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। শুধু শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই নয়, বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রেও ঘটে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আধুনিক বিজ্ঞানের চর্চা অগ্রসর করা হয়। মহাবিশ্বকে স্পর্শ করে স্পুটনিক। ১৯৫৯ সালে মহাশূন্যে প্রথম পাড়ি দেয় সোভিয়েত নভোচর ইউরি গ্যাগারিন। সব মিলিয়ে সোভিয়েত ব্যবস্থা উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন সৃষ্টি করতে থাকে নতুন মানুষ। একটি পিছিয়ে পড়া দেশ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে ওঠে একটি ‘পরাশক্তি’। সমাজতন্ত্রের পথ অনুসরণের ফলেই তার পক্ষে এসব কথার চোখ ধাঁধানো সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়।
সোভিয়েত বিপ্লবের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের আন্দোলন জোরদার ও বিস্তৃত হয় এবং একই সঙ্গে ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামও তীব্রতা লাভ করে। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই বেগবান হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপসহ বিশ্বের প্রায় এক ডজন দেশ সমাজতন্ত্রের পথ গ্রহণ করে। চীনে বিপ্লব সফল হয়। গড়ে ওঠে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা। এশিয়া, আফ্রিকার শতাধিক দেশ অর্জন করে রাজনৈতিক স্বাধীনতা। সদ্য স্বাধীন এসব দেশের জাতীয় অর্থনীতির পুনর্গঠনেও সোভিয়ত ইউনিয়ন আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে। ঔপনিবেশিক ও নয়া-ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর পক্ষে দাঁড়ায় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। অস্ত্র, গোলাবারুদ সরবরাহ, সামরিক সহায়তা, মার্কিন সপ্তম নৌবহরের হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করা, জাতিসংঘে পাক-মার্কিন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তিন-তিনবার ভেটো প্রদানসহ সর্বাত্মক কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন প্রদানসহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এবং যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তা এর একটি অকাট্য প্রমাণ।
৭৩ বছর টিকে থাকার পর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়েছে। সেখানে গড়ে ওঠা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান হয়েছে। একদিকে সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী ষড়যন্ত্র ও অপরদিকে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণে নানা ভুল-ত্রুটির কারণে এটি ঘটেছে। সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে হলে সেসব ভুল-ত্রুটি সম্পর্কে খোলামেলা আত্মপর্যালোচনা প্রয়োজন। সেগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা প্রয়োজন। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সোভিয়েতের বিলুপ্তির কারণ তার লক্ষ্য ও তত্ত্বের মধ্যে ছিল না। বিলুপ্তির কারণ ছিল প্রয়োগে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর পুঁজিবাদপন্থি অনেক প-িত সমাজতন্ত্রকেই নাকচ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হওয়ার অর্থ যে সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম ও প্রাসঙ্গিকতা বিলুপ্ত হওয়া বোঝায় না, তার নিদর্শন আজ আমরা দেশে দেশে, এমনকি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখতে পাচ্ছি।
সমাজতন্ত্রের শক্তি কিছুটা দুর্বল হলেও তা নিঃশেষ হয়নি। বরঞ্চ দেশে-দেশে তা আবার জেগে উঠতে শুরু করেছে। তা এখন বর্ধিষ্ণু। পক্ষান্তরে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের ক্ষয় ক্রমাগত ঘটে চলেছে। তা এখন ক্ষয়িষ্ণু। বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এখন গভীর সংকটে। একবিংশ শতাব্দীতে নয়া-উদারনীতিবাদ গোটা পৃথিবীতে বৈষম্য বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ৬৬টি ধনী পরিবারের কাছে যে সম্পদ আছে, তা ৩৫০ কোটি মানুষের মোট সম্পদের চেয়ে বেশি। কয়েক বছর আগে বিশ্ব পুঁজিবাদ ভয়াবহতম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল। তখন খোদ যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে উঠেছিল ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ মুভমেন্ট, ‘ধনী ১ শতাংশের বিরুদ্ধে বাকি ৯৯ শতাংশের’ লড়াই। পুঁজিবাদের অবক্ষয় ও সংকটাবস্থা প্রতিনিয়তই বাড়ছে।
অক্টোবর বিপ্লবের মহান আদর্শ, সমাজতন্ত্রের মহান নীতিগুলো আজও অম্লান। মুক্তিকামী মানবতার কাছে তার অবদান অনিঃশেষ। মহান ‘অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’ যে স্বপ্ন দেখিয়েছে ও দেখিয়ে চলেছে, তা মানব ইতিহাসের অগ্রসরমাণ ধারায় অনির্বাণ শিখা হয়ে বেঁচে থাকবে চিরকাল।
লেখক: মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
৫ নভেম্বর ২০১৭, দৈনিক আমাদের সময় প্রকাশিত
যুগ যুগ ধরে মানুষ শোষণহীন, সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন দেখেছে। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন কার্ল মার্কস-ফ্র্রেডারিখ এঙ্গেলস। তাদের মতাদর্শকে ধারণ করে কমরেড ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিনের পরিচালনায় ও বলশেভিক পার্টির (কমিউনিস্ট পার্টির) নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে, পুরনো জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসারে ২৫ অক্টোবর, আর নতুন গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসারে ৭ নভেম্বর রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ নামে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
‘সোভিয়েত বিপ্লবই’ প্রথম সফল বিপ্লব, যার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল শোষণহীন এক নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা। সূচিত হয়েছিল শোষণমুক্ত সমাজের পথে মানবসভ্যতার যাত্রা। এ বিপ্লব পুঁজিবাদের ভিত্তিমূলে বড় রকমের ভাঙন ও চিড় ধরিয়েছিল। দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিয়েছিল বিশ্বের বিপুলসংখ্যক মানুষকে। মানুষ পেয়েছিল মুক্তির স্বাদ। কায়েম হয়েছিল শোষিত শ্রমিকশ্রেণির রাজত্ব। এর আগের অন্য সব বিপ্লব থেকে অক্টোবর ‘সোভিয়েত বিপ্লবের’ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যটি ছিল এই যে, আগের সব বিপ্লব কেবল শাসকশ্রেণির এবং শোষণের রূপ ও পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছিল। কিন্তু শোষণের অবসান ঘটাতে পারেনি। অন্যদিকে ‘সোভিয়েত বিপ্লবের’ মধ্য দিয়ে শুধু শোষক-শাসকশ্রেণির ও সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনই ঘটেনি, সূচনা হয়েছিল মানুষের ওপর মানুষের শোষণের চির অবসানের যুগ। সূচিত হয়েছিল শ্রেণিহীন সমাজ নির্মাণের পথে যাত্রা।
এই মহান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আগে রাশিয়া ছিল পিছিয়ে থাকা একটি দেশ। রাশিয়াকে বলা হতো ‘ইউরোপের পশ্চাৎভূমি’। জারের আমলে (সে দেশের বাদশাহকে জার বলা হতো) অনাহার, দারিদ্র্য ও অসহনীয় শোষণ ছিল জনগণের নিত্যসঙ্গী। উন্নত শিল্প দূরের কথা, সাধারণ মাপের শিল্প উৎপাদনের ব্যবস্থাও সেখানে তখন তেমনভাবে ছিল না। দ্য ‘গ্রেট রাশিয়ান’দের দ্বারা অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলো শোষিত হতো। জারের শাসনামলে রাশিয়ায় সামান্যতম গণতান্ত্রিক অধিকারও ছিল না। জারের শাসনের ভিত্তি ছিল বৃহৎ জমিদারতন্ত্র।
রাশিয়ার বিপ্লবী শক্তিগুলো, বিশেষত বলশেভিক পার্টি তথা কমিউনিস্ট পার্টি জার স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল। এসব সংগ্রাম ধীরে ধীরে বিপ্লবে রূপ নিয়েছিল। ১৯০৫ সালে এরূপ এক বিপ্লব ব্যর্থ হয়। তার পর ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আরেকটি বিপ্লব হয়। সেই বিপ্লবে জার স্বৈরতন্ত্র উৎখাত হয় এবং মেনশেভিক দলের নেতা কারনেস্কির ‘অস্থায়ী সরকার’ গঠিত হয়। এ সরকার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর সঙ্গে আপস করে ও বুর্জোয়াশ্রেণির স্বার্থরক্ষার পথে অগ্রসর হয়। এর ফলে সে সরকারটি ক্রমেই গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ সুযোগে জারতন্ত্রের পতিত শক্তি প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার চেষ্টা করতে থাকে। এসবের কারণে ‘অস্থায়ী সরকার’ শ্রমিক, কৃষক ও সৈন্যদের তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষের মুখে পড়ে। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর সে দেশে শ্রমিক, কৃষক ও সৈন্যদের নতুন এক ধরনের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক সংস্থা হিসেবে ‘সোভিয়েত’ গড়ে উঠেছিল। সোভিয়েতগুলোর মধ্যে বলশেভিক পার্টির অবস্থান ক্রমে শক্তিশালী হতে থাকে।
‘সোভিয়েতগুলোর হাতে সব ক্ষমতা দাও’ - এ আহ্বানে বলশেভিক পার্টি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। শ্রমিক বিক্ষোভ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। শ্রমিকরা বিভিন্ন কারখানায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। যুদ্ধক্লান্ত সৈনিকরাও ‘শান্তি’র জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা ‘অস্থায়ী সরকারের’ বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়তে শুরু করে। এ রকম এক পটভূমিতে লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক পার্টি অস্থায়ী সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ২৫ অক্টোবর (৭ নভেম্বর) শ্রমিকদের সশস্ত্র অংশ এবং বিপ্লবী সেনারা অস্থায়ী সরকারকে উৎখাত করতে প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে যুদ্ধজাহাজ ‘অরোরা’ থেকে ফাঁকা শেল নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে বিপ্লবী সৈনিক (যারা আসলে উর্দি পরা কৃষক) ও রেড গার্ড বাহিনীর সহায়তায় রাজধানী পেট্রোগ্রাডের শ্রমিকরা বুর্জোয়া সরকারের কেন্দ্র ‘উইন্টার প্যালেসে’ অভিযান শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যেই পতন হয় ‘উইন্টার প্যালেসের’। ‘অস্থায়ী সরকারের’ হাত থেকে ক্ষমতা চলে আসে শ্রমিক, কৃষক ও সৈনিকদের ‘সোভিয়েতের’ হাতে। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে প্রতিবিপ্লবীদের প্রতিরোধ ভেঙে মস্কো, গোটা রাশিয়া এবং পুরনো জার সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশে বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিকশ্রেণি ক্ষমতা দখল করে নেয়।
বিপ্লবের পর লেনিনের নেতৃত্বে গঠিত নতুন সোভিয়েত সরকারের প্রথম পদক্ষেপগুলো ছিল, প্রথমত, ‘শান্তির ডিক্রি’র মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য অবিলম্বে শান্তি আলোচনা শুরুর ঘোষণা করা। দ্বিতীয়ত, ‘জমির ডিক্রি’র মাধ্যমে খোদ কৃষককে জমির ওপর অধিকার প্রদানের ব্যবস্থা করা। তৃতীয়ত, সর্বপর্যায়ের সোভিয়েতগুলোর হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা সংহত করা। অন্য ডিক্রিগুলো ছিল নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, অবৈতনিক চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যরক্ষা এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের নতুন ইউনিয়ন গঠন সম্পর্কিত।
মহান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয়ের পর সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের কাজ শুরু করার আগেই সোভিয়েত বিপ্লব প্রতিবিপ্লবী শক্তির আক্রমণের মুখে পড়ে। অন্তত ১৪টি সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশের সামরিক বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আগ্রাসন শুরু করে। এদের সঙ্গে যুক্ত হয় দেশের অভ্যন্তরে ক্ষমতাচ্যুত শাসকশ্রেণির অনুগত শ্বেত সেনাবাহিনী। চার বছরের গৃহযুদ্ধের পর ‘লাল ফৌজ’ দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সেসব প্রত্যক্ষ আক্রমণগুলো পরাভূত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। ‘লাল ফৌজে’র হাজার হাজার যোদ্ধাকে প্রাণ দিতে হয়।
সোভিয়েতবিরোধী আঘাত আরও ঘৃণ্যরূপ ধারণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ফ্যাসিবাদ বিশ্বকে গ্রাস করতে যুদ্ধ শুরু করে। হিটলারের নাৎসি বাহিনী দেশের পর দেশ দখল করে নিতে থাকে। কিন্তু ‘লাল ফৌজে’র অসীম সাহসী লড়াই ও বীরত্বের কাছে পর্যুদস্ত হয়ে ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল হিটলারের সেই কথিত অপরাজেয় বাহিনী সোভিয়েত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তিন কোটি মানুষের প্রাণের বিনিময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন রক্ষা করে বিশ্বকে, মানবসভ্যতাকে। মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের অমূল্য অবদানের কারণেই বিংশ শতাব্দীর মহাবিপদ ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করা সম্ভব হয়।
এসব প্রবল বাধা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্রুত উন্নতি ঘটতে থাকে। মাত্র দুই দশকের মধ্যেই দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শোষিত-বঞ্চিত সব শ্রেণি নির্মম শোষণ থেকে মুক্তি পেয়েছিল। প্রত্যেক নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করা হয়েছিল কাজ, খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সাধারণ মৌলিক চাহিদাগুলো। এক দশকের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করা হয়েছিল। কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য এসেছিল। নতুন নতুন শিল্প গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। দ্রুত শিল্পায়নের লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক সরকার ১৯২৭ সালে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। দু-তিনটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়। ১৯২৯-৩৩ সালের মহামন্দায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন উন্নত পুঁজিবাদী দেশ আক্রান্ত হয়ে পড়লেও এ মহামন্দা সোভিয়েত ইউনিয়নকে স্পর্শ করতে পারেনি। এসবের ফলে সমাজতন্ত্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মর্যাদা গোটা বিশ্বে আরও ছড়িয়ে পড়ে।
সমাজতন্ত্র প্রতিটি নাগরিকের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যা অর্জনের ব্যবস্থা করে দেয়, মানুষকে দীর্ঘ আয়ু দান করে, নারীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার, শ্রমিকসহ মেহনতি মানুষকে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদান এবং বঞ্চিত ও নিপীড়িত জাতিসমূহকে মুক্ত করে। সব ধরনের পুরনো সংস্কৃতি যেমন - গোষ্ঠীবাদ, জাতীয়তাবাদ, সংকীর্ণতাবাদ ইত্যাদির অপসারণ করা হয়। প্রতিক্রিয়াশীলতা, ভোগবাদ, কুসংস্কার, কূপম-ূকতার বিরুদ্ধে ব্যাপক সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটানো হয়। প্রলেতারিয়েতের মধ্যে নতুন চেতনা, মূল্যবোধ ও আত্মমর্যাদার উন্মেষ ঘটে। নিপীড়িত মানুষের শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। শুধু শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই নয়, বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রেও ঘটে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আধুনিক বিজ্ঞানের চর্চা অগ্রসর করা হয়। মহাবিশ্বকে স্পর্শ করে স্পুটনিক। ১৯৫৯ সালে মহাশূন্যে প্রথম পাড়ি দেয় সোভিয়েত নভোচর ইউরি গ্যাগারিন। সব মিলিয়ে সোভিয়েত ব্যবস্থা উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন সৃষ্টি করতে থাকে নতুন মানুষ। একটি পিছিয়ে পড়া দেশ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে ওঠে একটি ‘পরাশক্তি’। সমাজতন্ত্রের পথ অনুসরণের ফলেই তার পক্ষে এসব কথার চোখ ধাঁধানো সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়।
সোভিয়েত বিপ্লবের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের আন্দোলন জোরদার ও বিস্তৃত হয় এবং একই সঙ্গে ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামও তীব্রতা লাভ করে। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই বেগবান হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপসহ বিশ্বের প্রায় এক ডজন দেশ সমাজতন্ত্রের পথ গ্রহণ করে। চীনে বিপ্লব সফল হয়। গড়ে ওঠে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা। এশিয়া, আফ্রিকার শতাধিক দেশ অর্জন করে রাজনৈতিক স্বাধীনতা। সদ্য স্বাধীন এসব দেশের জাতীয় অর্থনীতির পুনর্গঠনেও সোভিয়ত ইউনিয়ন আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে। ঔপনিবেশিক ও নয়া-ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর পক্ষে দাঁড়ায় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। অস্ত্র, গোলাবারুদ সরবরাহ, সামরিক সহায়তা, মার্কিন সপ্তম নৌবহরের হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করা, জাতিসংঘে পাক-মার্কিন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তিন-তিনবার ভেটো প্রদানসহ সর্বাত্মক কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন প্রদানসহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এবং যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তা এর একটি অকাট্য প্রমাণ।
৭৩ বছর টিকে থাকার পর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়েছে। সেখানে গড়ে ওঠা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান হয়েছে। একদিকে সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী ষড়যন্ত্র ও অপরদিকে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণে নানা ভুল-ত্রুটির কারণে এটি ঘটেছে। সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে হলে সেসব ভুল-ত্রুটি সম্পর্কে খোলামেলা আত্মপর্যালোচনা প্রয়োজন। সেগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা প্রয়োজন। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সোভিয়েতের বিলুপ্তির কারণ তার লক্ষ্য ও তত্ত্বের মধ্যে ছিল না। বিলুপ্তির কারণ ছিল প্রয়োগে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর পুঁজিবাদপন্থি অনেক প-িত সমাজতন্ত্রকেই নাকচ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হওয়ার অর্থ যে সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম ও প্রাসঙ্গিকতা বিলুপ্ত হওয়া বোঝায় না, তার নিদর্শন আজ আমরা দেশে দেশে, এমনকি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখতে পাচ্ছি।
সমাজতন্ত্রের শক্তি কিছুটা দুর্বল হলেও তা নিঃশেষ হয়নি। বরঞ্চ দেশে-দেশে তা আবার জেগে উঠতে শুরু করেছে। তা এখন বর্ধিষ্ণু। পক্ষান্তরে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের ক্ষয় ক্রমাগত ঘটে চলেছে। তা এখন ক্ষয়িষ্ণু। বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এখন গভীর সংকটে। একবিংশ শতাব্দীতে নয়া-উদারনীতিবাদ গোটা পৃথিবীতে বৈষম্য বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ৬৬টি ধনী পরিবারের কাছে যে সম্পদ আছে, তা ৩৫০ কোটি মানুষের মোট সম্পদের চেয়ে বেশি। কয়েক বছর আগে বিশ্ব পুঁজিবাদ ভয়াবহতম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল। তখন খোদ যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে উঠেছিল ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ মুভমেন্ট, ‘ধনী ১ শতাংশের বিরুদ্ধে বাকি ৯৯ শতাংশের’ লড়াই। পুঁজিবাদের অবক্ষয় ও সংকটাবস্থা প্রতিনিয়তই বাড়ছে।
অক্টোবর বিপ্লবের মহান আদর্শ, সমাজতন্ত্রের মহান নীতিগুলো আজও অম্লান। মুক্তিকামী মানবতার কাছে তার অবদান অনিঃশেষ। মহান ‘অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’ যে স্বপ্ন দেখিয়েছে ও দেখিয়ে চলেছে, তা মানব ইতিহাসের অগ্রসরমাণ ধারায় অনির্বাণ শিখা হয়ে বেঁচে থাকবে চিরকাল।
লেখক: মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
৫ নভেম্বর ২০১৭, দৈনিক আমাদের সময় প্রকাশিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন