লেখক : হায়দার আকবর খান রনো, প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
কার্ল মার্কসের জীবদ্দশা থেকেই শুরু
হয়েছিল তাঁর বক্তব্য ও তত্ত্বকে বিকৃত করে এমনভাবে পরিবেশন করা যাতে মার্কসীয়
তত্ত্ব ভুল বলে প্রতীয়মান হয়। এই প্রবণতা এখনও আছে। মার্কসকে যারা ভালভাবে অধ্যয়ন
করেননি তাদেরকে সহজেই একটা বুঝ দেয়া যায় যে মার্কসবাদ কোনো প্রমাণিত ও
বিশ্বাসযোগ্য মতবাদ নয়। আরও বলা হয় যে, মার্কসবাদ এখন প্রাচীন হয়ে গেছে, বর্তমান যুগে অচল। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিপ্লবের তত্ত্ব এখন নাকি বিশ্ব
পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খায় না, ইত্যাদি। আমি
এই রচনার সংক্ষিপ্ত পরিসরে মার্কস সংক্রান্ত বহুবিধ প্রচলিত ভুল ধারণা খণ্ডন করার
চেষ্টা করছি না। ইংরেজ অধ্যাপক টেরি ইগলটন (Terry Eagleton) একটা গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন ‘Why Marx was right’ (কার্ল মার্কস কেন সঠিক ছিলেন) এই শিরোনামে।
সেখানে তিনি এই রকম কয়েকটি ভুল ধারণা খণ্ডন করেছেন খুবই যুক্তি ও তথ্য সহকারে।
আগ্রহী মার্কসবাদী কর্মীদের আমি বইটি পাঠ করার জন্য অনুরোধ করবো। আমি এই ছোট নিবন্ধে আপাততঃ একটি বিষয়ে
প্রচলিত ভুল ধারণা খণ্ডন করার চেষ্টা করবো বাস্তব সত্য তথ্যকে তুলে ধরে। একটা কথা
মার্কসবাদ বিরোধীরা বলে থাকেন যে, মার্কস নিজেই
নাকি স্বীকার করেছিলেন, তিনি নিজেও নাকি মার্কসবাদী ছিলেন না।
মার্কসেরই নিজের কথা ‘আমি মার্কসবাদী নই’(?)। ব্যাপারটা যদি সত্যিই তাই হয়ে থাকে, তাহলে তা দাঁড়াচ্ছে কোথায়? যখন মার্কসবাদের প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং কার্ল মার্কসই নিজের মতবাদের প্রতি
আস্থা রাখতে পারছেন না তখন তো আমাদের জন্য মার্কসবাদী হবার চেষ্টা করাই বৃথা।
মার্কসবাদকে ধরাশায়ী করার জন্য এর চেয়ে সহজ আর কি হতে পারে? আসলে মার্কস আদৌ এমন কথা বলেননি। কিন্তু এমন মিথ্যা
কথাটা মার্কসের নাম নিয়েই প্রচলিত আছে। সম্প্রতি মার্কসবাদী বলে দাবীদার মার্কিন নাট্যকার হাওয়ার্ড জিন (Howard Zinn) একটি নাটক লিখেছেন ‘Marx in Soho’। সেখানেও তিনি মার্কসের স্বগতোক্তি বসিয়ে দিয়েছেন। মার্কস
বলছেন, ‘আমি নিজেই কি মার্কসবাদী’। নাটকটির বঙ্গানুবাদ করেছেন জাভেদ হোসেন। নাটকটি ঢাকায় পাঠ
করে শুনিয়েছিলেন নাট্যশিল্পী মামুনুর রশীদ। মনে হয় নাট্যকার হাওয়ার্ড জিনও বিশ্বাস
করছেন মার্কস বোধ হয় সত্যিই বলেছিলেন ‘আমি নিজেই মার্কসবাদী নই’ অর্থাৎ আবার
সেই সন্দেহের বীজ ঢুকিয়ে দেয়া, মার্কস কি আদৌ
নিজের তৈরি মতবাদে আস্থা রাখতেন? অথচ আসল ঘটনা
জানলে এমন সন্দেহের বিন্দুমাত্র জায়গা নেই। আসল ঘটনাটি তাহলে কী ছিল? মার্কস ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তাঁর প্রিয় শিষ্য ও জামাতা পল লাফার্গকে একথা
বলেছিলেন ‘এই যদি হয় তোমাদের মার্কসবাদ তাহলে
আমি মার্কসবাদী নই।’ কেন? লাফার্গ ছিলেন ফরাসী সমাজতন্ত্রী দলের অন্যতম নেতা। ফরাসী সমাজতন্ত্রীরা
নিজেদের মার্কসবাদী বলে মনে করতেন কিন্তু তারা মার্কসীয় বিপ্লবী মতবাদকে ঠিকমতো
বুঝে উঠতে পারেননি। তারা যেভাবে ব্যাখ্যা করতেন তাতে মার্কসবাদকে সংস্কারবাদে
পরিণত করা হয়। তাই মার্কস তাদের প্রতি বিরক্ত ছিলেন, যদিও লাফার্গসহ ফরাসী সমাজতন্ত্রীদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল না। মার্কস
তাঁর বিরক্তিভাব প্রকাশ করেছিলেন এই কথা বলে যে, ‘তাহলে আমি মার্কসবাদী নই।’ মার্কস যে
লাফার্গকে এমন কথা বলেছিলেন তা জানতেন মার্কসের সহযোদ্ধা ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস। তিনিই
বিভিন্ন সময় (চারবার) মার্কসের বিরক্তি মিশ্রিত উক্তিটির কথা উল্লেখ করেছিলেন, মার্কসের নাম করে অপব্যাখ্যা, বিশেষ করে সংস্কারবাদকে খণ্ডন করার জন্য। এঙ্গেলস কখনও
ভাবতে পারেননি যে, এই কথাকে আবার উল্টো ব্যাখ্যা করে
মার্কসবাদকেই বাতিল করার অপপ্রয়াস চালানো হবে। মার্কস বিশেষজ্ঞ হাল ড্রপার (Hal Draper) এর লেখা গ্রন্থ Karl Marx and
Theory of
Revolution গ্রন্থের
দ্বিতীয় খণ্ডে এই ঘটনাটি বিশদভাবে উল্লেখিত আছে এবং এইভাবে তিনি মার্কসের নামে
প্রচলিত ভুল ধারণাকে খণ্ডন করেছেন। এবার দেখা যাক, ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস কখন কিভাবে ও কেন
ঘটনাটি প্রকাশ করেছিলেন– (এক) মার্কসের জীবদ্দশায় ১৮৮১ সালে
বার্নস্তাইনের (যিনি পরবর্তীতে সংশোধনবাদের জনকে পরিণত হয়েছিলেন) কাছে লেখা এক
চিঠিতে ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস লিখেছিলেন, “ফ্রান্সের তথাকথিত মার্কসবাদীরা এমনই এক বিশেষ ধরণের বস্তু (an altogether peculiar product) যে মার্কস লাফার্গকে বলতে বাধ্য
হয়েছিলেন, ‘তাহলে নিশ্চিত যে আমিও মার্কসবাদী নই’।” উক্ত চিঠিতে বস্তুতঃ মার্কসবাদী নামে একদল সংস্কারবাদীর প্রসঙ্গ টেনেই
এঙ্গেলস এই কথা লিখেছিলেন। তাঁর মানে এসে দাঁড়াল এই যে, মার্কসের মতবাদকে যারা সংস্কারবাদে পরিণত করতে চেয়েছেন
তাদের সম্পর্কেই বিরক্তি প্রকাশ করে মার্কস লাফার্গকে বলেছিলেন, এই যদি হয় তোমাদের মার্কসবাদ তাহলে আমি মার্কসবাদী নই।
অর্থাৎ মার্কস সংস্কারবাদের সঙ্গে তাঁর বিপ্লবী মতবাদের পার্থক্য সুনির্দিষ্ট করতে
চেয়েছিলেন। পাঠক লক্ষ্য করুন, এই কথার কী
ভয়ঙ্কর অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে। (দুই) ১৮৯০
সালের ৫ আগস্ট কনর্যােড স্মিডট (Conrad Schmidt) এর কাছে লেখা চিঠিতে ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস আবার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছিলেন।
চিঠির অংশবিশেষ বঙ্গানুবাদ করে নিচে উদ্ধৃত হল। “ইদানিংকালে ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণার বেশ কিছু সংখ্যক ভয়ঙ্কর বন্ধু রয়েছে, যারা এই বস্তুবাদী ধারণাকে ব্যবহার করে ইতিহাসকে না পড়ার
অজুহাত হিসাবে। এই কারণেই সত্তরের দশকের শেষের দিকে ফরাসী সমাজতন্ত্রীদের সম্পর্কে
মার্কস মন্তব্য করেছিলেন, “আমি যা বুঝতে পারছি তা হল, আমিই তাহলে মার্কসবাদী নাই’।” (মস্কো থেকে ইংরেজিতে প্রকাশিত মার্কস এঙ্গেলস এর Selected Correspondence শীর্ষক পত্র সংকলন- ৪১৫ পৃষ্ঠা
দ্রষ্টব্য) (তিন) ১৮৯০ সালের ২৭ আগস্ট এঙ্গেলস
সরাসরি পল লাফার্গকে চিঠি লিখে মার্কসের মন্তব্যটি স্মরণ করিয়ে দেন। (মস্কো থেকে
ইংরেজিতে প্রকাশিত Friedarick
Engels and Paul Lafargue শীর্ষক পত্র সংকলনের দ্বিতীয় খণ্ডের ৩৮৫ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য) “এই ভদ্রলোকরা মার্কসবাদের কথা বলেন, কিন্তু তারা হচ্ছেন সেই ধরণের লোক যাদেরকে আপনি দশ বছর
আগে ফ্রান্সে চিনতেন এবং যাদের সম্বন্ধে মার্কস বলেছিলেন, ‘এই যদি হয় তোমাদের মার্কসবাদ তাহলে
আমি মার্কসবাদী নই’।” কারা এই ভদ্রলোকগণ? তারা হচ্ছেন জার্মান পার্টিতে
প্রবেশকারী একদল বুদ্ধিজীবী যারা ‘ঔঁহমবৎ’ ফ্যাকশন হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তারা
নিজেদের মার্কসবাদী দাবি করলেও আসলে ছিলেন সংস্কারবাদী। (ঠিক দশ বছর আগে ফরাসী
সমাজতন্ত্রীরা যা ছিলেন) (চার) জার্মানির সেই Junger ফ্যাকশন সম্পর্কে তাদের সমালোচনা করে এঙ্গেলস এবার
প্রকাশ্যেই পার্টি পত্রিকায় লিখেছিলেন ১৮৯০ সালে। এঙ্গেলস লিখেছিলেন “মার্কস তাঁর এই ধরনের শিষ্যদের সম্পর্কে আগেই ধারণা করতে পেরেছিলেন এবং
তাদের প্রসঙ্গেই বলেছিলেন ‘তাহলে আমি মার্কসবাদী নই’।” এঙ্গেলসের এই লেখটি Hal Draper এর ‘Karl Marx and Theory of Revolution’
গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে উদ্ধৃত হয়েছে।
তাহলে এঙ্গেলসের চারটি বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারি যে, মার্কস কখনই বলেননি যে, তিনি মার্কসবাদী নন। যারা মার্কসের বিপ্লবী মতবাদকে সংস্কারবাদে পরিণত করে মার্কসীয় মতবাদ বলে
চালাচ্ছিলেন তাদের প্রসঙ্গেই বিরক্তি সহকারে অথচ কৌতুকের ভাষায় তিনি তাঁর প্রিয়
জামাতাকে বলেছিলেন, ‘এই যদি হয় তোমাদের মার্কসবাদ তাহলে
আমি মার্কসবাদী নই।’ মার্কস এখানে সংস্কারবাদের বিরোধিতা
করেছেন। অথচ বুর্জোয়ারা কী বিকৃত অর্থে মার্কসকে উদ্ধৃত করছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন