Biplobi Barta

বুধবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৭

ধারাবাহিক উপন্যাস- ওড়না

লেখকঃ জাফর আহ্মমেদ, সম্পাদক, শ্রমিক আওয়াজ (পর্ব-৩)

দুএকদিন পর পরই রাহাত সর্দার রুমানার রুমে ঢুকে পড়ে। সফেদ দাঁড়ি, সৌম্য চেহারাতে ভদ্রতার ছাপ থাকলেও রুমানার রুমে ঢোকার উদ্দেশ্য মোটেও ভদ্র নয়। রুমে ঢুকেই গদ গদ করে রুমানার সাথে আলাপ শুরু করতে চায়। রাহাত সরদার সদ্য টাকার মালিক হওয়ার ফুটানী আর নারী শরীরের সৌন্দর্য নিয়ে আলাপ করতে চায়। কিন্তু রুমানার রাজনীতি, মানুষের অধিকার ও ঔচিত্য বোধের কথাতে চাপা পড়ে যায় তার উদ্দেশ্য। রুমানার যুক্তির কাছে পেরে ওঠেনা। তাই বলে হার মানে না। রুমানার শরীর বৃত্তীয় সৌন্দর্য যতটা না তার চেয়ে তার বলার ভঙ্গি, যুক্তি, জানার পরিধি কাছে টানার মত। সবাই ঠিকই বুঝে আলুর দোষের এই রোগীর আরও একটি উদ্দেশ্য নিয়ে আসে তাহলো এ রুমে কোন অতিথি এলো কি না! অতিথি আসা মানেই পানি খরচ বেশি, বাধরুমের চাপ, গ্যাসের খরচ বৃদ্ধি, বাড়িতে আরও একজন মানুষের ভার বেড়ে যাওয়া। রুমানারও যে এতে কোন লাভ হয়-তা কিন্তু না। রুমমেট বানু মাঝে মাঝে বিরক্ত হলেও আবার ঠিক হয়ে যায। বানুর রুমানার রসায়নটা মিলেও ভাল। অতিথি যেন রুমানার পিছু ছাড়ে না। আজ এলাকার মেয়ে, কাল কোন বান্ধবীর আত্মীয়, আরেকদিন কোন পরিচিত লোকের আত্মীয়। নিজের রাখার জায়গা নেই তো রুমানার কাছে পাঠাও। বাস মিটে গেলে সব ঝামেলা। মাসের অর্ধেক দিন একজন না একজন গেস্ট থাকেই। আসে কয়েকদিন থেকে চাকুরি সংগ্রহ করে অন্যত্র মেচ নিয়ে চলে যায়। রুমানাও না করতে পারে না, দয়ার শরীর! রাহাত সরদার তাই সুযোগ পেলেই রুমে একবার ভুলকি মারে।
আজ রুামানার রুমে ভুলকি মারা বেড়ে গেছে, বরং কয়েকবার। গতকাল সন্ধ্যায় আসমা এসেছে চাকুরি করার জন্য। ওর বাড়ি পুটয়াখালি। দুপুরে কলতলায় পানি আনতে গিয়ে আসামাকে দেখে রাহাত সরদার। তুমি কে গো, রুমানার রুমের গেস্ট ? লোকটার এ তাকানো ভাল না লাগায় কথা শুনেও না শোনার ভান করে দ্রুত রুমে চলে আসে। পেছনে পেছনে রুমানার রুম পর্যন্ত এসে গেছে। বেশ খানিক সময় ধরে কথাও বলে গেছে।
পুটয়াখালির আন্ধারমানিক নদীর পাড়ে আসমাদের বাড়ি। বাবা লোকমান আলীর চার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে আসমা বড়। মাঠে কৃষি কাজ করে সব ছেলেমেয়েকে পড়াশোনায় করায়। আসমা এবার বিএ পরীক্ষা দিয়েছে, ভাল ছাত্রী। পড়াশোনা করবে বলে বিয়ে-সাদীও দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব এলেও রুমানার অনিচ্ছায় বিয়ে হয়নি। ও পড়াশোনা করবে, চাকুরি করবে। আবার দুএকজনের সাথে বিভিন্ন সময়ে বন্ধুর সম্পর্ক পর্যন্ত গড়ালেও প্রেম পর্যন্ত পৌছেনি। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাল লাগে না আসমার। চাকুরি করে বাবাকে একটু আয়েশ দেবে। ছোট্ট ভাইবোনগুলোকে ভাল করে লেখাপড়া করাবে। তখন না হয় নিজের মাস্টার্সটাও প্রাইভেটে শেরে নেবে। সাভারের আশুলিয়ায় চাচাত ভাইয়ের সাথে কথা বলে চাকুরির জন্য ঢাকায় চলে আসে। চাচাত ভাই লতিফ মিয়া আশুলিয়ায় একটি কারখানার লাইন চীফ। রুমানা লতিফ এর পরিচিত। আপাতত ঠিকানা হয়েছে রুমানায় বাসায়। তবে খরচ-খরচান দেয় লতিফ মিয়া।
বাসাটি ভোর থেকে লোকে ভরপুর থাকে। সকাল সাতটায় বাসা খালি হতে শুরু কওে, ন’টার মধ্যে পুরো বাসা খালি হয়ে যায়। তারপর বাড়ি জুড়ে নিরবতা নেমে আসে। নারীরা গার্মেন্টস কারখানাতে যায়। পুরুষরা হয় গার্মেন্টস কারখানায় না হয় রিকসা-ভ্যান চালাতে বা অন্য কোন কাজে বের হয়ে যায়। চারটের পর থেকে বাড়িতে লোকজন আসতে থাকে। পুরো বাড়িতে দুটি শিশু থাকে। বাকীদের হয় সন্তান নেই। দুয়েকজনের সন্তান থাকলেও গ্রামের বাড়িতে বাবা-মার কাছে রেখে এসেছে। সন্তান কাছে রাখা বাড়তি খরচ মেটানোর মত আয় অধিকাংশ শ্রমিকেরই নেই। ¯^ামী-স্ত্রী মিলে কারখানায় চাকুরি করলে বাড়িতে কিছু টাকা পাঠাতে। এ জন্য সন্তানকে বাবা-মার কাছে গ্রামে রেখে আসতে হয়। কিছু সঞ্চয়ও থাকে। সন্তান কাছে থাকলে এগুলো সম্ভব হয় না। তাই প্রায় সন্তানওয়ালা দম্পতি সন্তান গ্রামের বাড়িতেই রাখে। আর তাছাড়া অধিকাংশ শ্রমিকই সন্তান লালন-পালনের বাড়তি খরচ জোগাড় করতে পারবে কিনা-এ ভয়ে দেরিতে সন্তানের বাবা-মা হয়।
-না, এখন না। ভেতর থেকে বাইরে এমন শব্দ আসছে। আসমার কথা। ভেজানো দরজার কাছে এসেই চমকে উঠে বানু। নীচের দিকে তাকিয়ে আরও চমকে ওঠে, ওমা এতো পুরুষের স্যান্ডেল, ভেতরে পুরুষ কে। কে সে ? আসমা একা আছে! এখনো তো রুমানা ফেরেনি। ও কারখানা ছুটির পর বাইরে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আড্ডা দেয়, তারপর বাসায় ফেরে। আমিই বরং অন্যদিনের চেয়ে আগে এসেছি, পাঁচটায় ছুটি নিয়ে চলে এসেছি। ওভারটাইম করিনি। দরজাটা আস্তে করে সরিয়ে দিয়ে বানু নিশ্চিত হয়, ব্যাটা বাড়িওয়ালা।
-না ডাক্তারের কাছে যাওয়ার মত অসুন্থতা না। এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। রুমের মধ্যে এসে কদিন ধরে বসে আছি এ জন্য একটু মাথা ধরেছে। আসমা খাটের উপর বসে। অপর খাটে ল্যাটামেরে বসে থাকা রাহাত সর্দারকে উদ্দেশ্য করে আসমা এ সব কথা বলে। রাহাত সর্দার আসমার তাকিয়ে থাকে। আসমনার কথা শোনে, নাকি কি দেখছে বোঝা যাচ্ছিলো না। দুপুরে কলতলায় আসমাকে দেখে রাহাত সর্দারের বুকের মধ্যে ধড়-পড় শুরু করে। সালোয়ার কামিজের ফাঁকে পুরুষ্ট বুক, বলিষ্ট উরুর বেদের মেয়ে সিনেমার অঞ্জু ঘোষকে আবিস্কার। চোখের সামনে থেকে যেন যেতে চায় না। রুমে ঢুকে বানু।
-ওই যে আপু এসেছে, বলে আসমা। রাহাত সর্দারের সম্বিত ফিরে পাওয়ার অবস্থা।
-তুমি তাড়াতাড়ি চলে এলে, ভাল হলো-বানুকে উদ্দেশ্য করে বলে রাহাত সর্দার।
-তোমাদের গেস্ট অসুস্থ্য। ডাক্তারের বাড়ি যাওয়ার কথা বলছিলাম। তুমি এলে, ভালই হলো।
বানু কি বলবে বুঝতে পারে না। ভেতরে ভেতরে এক ধরনের ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। ওষুধ, ডাক্তার- রাহাত সর্দারের এ ধরনের কথা শুনে নিজেকের সামলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। আবারও এও ভাবে বাড়িওয়ালা গেস্ট নিয়ে আবার চিল্লা-পাল্লা শুরু করে দেয় কিনা। রুমানা ছাড়া অন্য কেউ এই ব্যাটার মুখে লাগাম দিতে পারে না।
-জি চাচা, আজ একটু তাড়াতাড়ি চলে এলাম। আসমা আপা আছে, তাকে সাথে একটু ঘুরবো বাইরে। কথা বলতে দু খাটের মাঝামাঝি স্থানে টেবিলে নিজের ব্যাগটা রাখে। চোখে মুখে একটু বিরুক্তিও ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে। কাপড় বদল করবে- ব্যাটা ওঠেনা, মনে মনে বলে বানু। এক রুমের মাঝে দুই দিকে দুটি সিঙ্গেল খাট। মাঝে দেওয়াল সংলগ্ন একটি টেবিল, দেয়ালে আয়না। সেখানে সাজ- গোঁজ করে। রুমে ঢুকতেই বাইরের দিকে এক খাটের পাশে খাওয়ার হাড়ি পাতিল রাখার একটি র‌্যাক। অপর খাটের পেছনে জামা কাপড় রাখার আলনা। আর খাটের নীচে দুজনের কয়েকটা ব্যাগ। রুমানা আর বানু এক সাথেই থাকে। ওর বাড়ি চুয়াডাঙ্গা জেলার সীমান্ত ঘেষা জীবননগর উপজেলায়। ১৭ বছর বছরে বিয়ে হয়েছিল। বছর না ঘুরতেই আসগর মিয়া গরুর রাখালি করে ভারত থেকে গরু আনতে গিয়ে সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। দুই বছর বাবার ঘরে থাকে। পরে আর বিয়ে-থা হয়নি। ঢাকায় চলে আসে কারখানায় চাকুরি করতে। এরপর গার্মেন্টস কারখানায় চাকুরির ৬ বছরের চার বছরই রুমানার সাথে থাকে।
আসমা এক খাটের মাঝখানে জড়ষড় হয়ে বসে আছে। যেন বাসর পরবর্তি দিনের আলোয় উদ্ভাসিত ¯^জন বেষ্টিত লাজ-লজ্যমাখা নতুন বউ; যেন শিশির ধোয়া দুর্বা ঘাস। অপর খাটে রাহাত সর্দার। বানু কোন ইঙ্গিতেই রাহাত সর্দারকে বোঝাতে পারছে না কাপড় বদলাবে। তার এখন চলে যাওয়া উচিত। সারাদিন মেশিনে কাজ করে শরীরও ঘামে দুর্ঘন্ধ ছড়াচ্ছে। নিজের কাছেই খারাপ লাগছে। উপরে ফ্যান চললেও শরীরে বাতাশ লাগে না। কি করবে বুঝতে পারে না। বাইরে গিয়ে বদলাবে তাও পারে না, লোকজন আসা শুরু করেছে। গণবাধরুম হওয়ায় বাধরুমেও কাপড় বদলাতে পারে না। লোকটাকে উঠে যেতেও বলতে পাওে না।
এই বয়সের দুটি মেয়ের সান্নিধ্য বয়স্ক মানুষটার যেন নেশা ধরে গেছে। একজন কলেজ পড়া, আরেকজন ¯^াস্থ্য সচেতন কর্মজীবি।
-নাহ, আর পারছি না। কাপড়ে শরীরটা যেন ছিড়ে যাচ্ছে। হায় ফেলে বানু। তারপর ওড়নাটা গুছিয়ে ভি-আকৃতির করে বুকের নিচে নামিয়ে দুই কাঁধের উপর তুলে পেছনে ছেড়ে দিয়ে খাটের ওপর বসে। বুকের ক্লিভটা বের হয়ে যায়। রাহাত সর্দারের জিহবা যেন লালা পড়া শুরু করে।
-চাচা, আপনি কি একটু আসবেন ! বানু আপু কাপড় বদলাবে। আসমা বাইরে যেতে বলে রাহাত সর্দারকে। বাড়িওয়ালা আসমার কথা প্রথমে বুঝতে পারে না। বানুও না। পরে বানু সম্বিত ফিরে পায়, ওকে তো যেতে বলছে।
-হ, মাঝে মাঝে আসবো। সিন্ধ হাসি হেসে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে আসমার দিকে তাকায়।
-চাচা, বলছিলাম 
কি, আপু সারাদিন কারখানায় কাজ করে ঘেমে বাসায় এসেছে। আপনি যদি একটু বাইরে যান, উনি কাপড় চেঞ্চ করবে।
-আ, হ। যাই। তোমরা থাকো বলে বের হয়ে যায় রাহাত সর্দার।
-তুমি এমন করে বলতে পারলে ? আমি তো চিন্তাই করতে পারিনি। আসলে তুমি না খুবই বুদ্ধিমান। এই লেখাপড়ার গুন, আসমার প্রতি কৃতজ্ঞতায় প্রকাশ করে বানু। দরজাটা ভেতর থেকে আটকিয়ে কাপড় বদল শুরু করে বানু।
-আপনাদের বাড়িওয়ালা লোকটা বোধ হয় ভাল না। তাই না?
-বাড়িওয়ালার আবার কি দেখছো, চাকুরি করতে গেলে আর খারাপ লোককে মোকাবেলা করতে হবে।
-বলেন কি? কারখানার সব পুরুষ কি খারাপ?
-আরে না। একজন, দুইজন থাকলেই হলো। শ্রমিকরা তো ভাই, বোন, বন্ধুর মত। দুএকজন কর্মকর্তা খারাপ হয়। এ সব খারাপ কর্মকর্তারা পরিবেশ খারাপ করে। আবার বায়ার, বায়িং হাউজের লোকজন দিয়েও পরিবেশ খারাপ করে। এতে মালিকের সায় থাকে। আবার কোন কোন মালিক নিজেই খারাপ।
-তারপর? উৎসাহ নিয়ে বানুর দিকে তাকিয়ে থাকে উত্তরের আসায়। কামিজটা রেখে সালোয়ারটা পা দিয়ে বের করে আলনার উপরে রাখে। হাটু পর্যন্ত ঢেকে থাকে কামিজে। তারপর অন্য একটি সালোয়ার পরে। তারপর কামিজটাও বদল করে। সঙ্গে সঙ্গে কথাও বলে। প্রতিদিনই এভাবে কাপড় বদলাতে হয়। রুমানা ও বানুর সম্পর্ক এতই কাছের হয়ে গেছে যে দুজন খুব সহজভাবে নেয়। নিজেদের আয় রোজগার ও সামর্থ এটা হতে বাধ্য করেছে। তিন, চার দিনে আসমার সাথেও এমন খোলা-মেলা হয়ে গেছে। গোশলখানায় গোসল করে কোনমতে কাপড় বদলিয়ে রুমে এসে অফিসের কাপড় পরে। এটা ব্যাসেলর নারী শ্রমিকের নিত্যদিনের সাথী। কেউ কম আয়ে কুলিয়ে ওঠতে না পারার কারণে একা রুম এক রুম ভাড়া নিতে পারে না, কেউ সাধ্য থাকার পরও নিঃসঙ্গতা কাটাতে এক বা একাধিক রুমমেট খুঁজে নেয়। আনন্দ ফুর্তি করে বাস করে।
কাপড় বদল করে রুমে থেকে বের হয়ে বানু।
-আপা বসেন, হাত মুখটা ধুয়ে আসি।
-আচ্ছা, বলে আসমা। আসমাও একটু নড়ে চড়ে বসে। মাঝখানটা থেকে খাটের এক পাশে আস।েমনের মাঝখানটাতে নানা প্রশ্ন বুঁদ বুঁদ করে। নিজের কখন একটি চাকুরি পাবে, সে চাকুরি কেমন হবে, বাড়িতে কত টাকা পাঠাবে। বাড়িতে বাবা খুব কষ্ট করে। সারাদিন পরিশ্রম করার পরও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। নামাজ শেষে আমাদের ভাইবোনদের জন্য দোয়া করে। আমরা যেন লেখাপড়া করে মানুষ হতে পারি। টাকা পাঠাতে পারলে বাবার কষ্ট দূর হবে। শান্তি করে নামাজ রোজা করবে।
বানু রুমে আসে, এ সময়টাতে কলতলায় লোক কম থাকে।
-সারাদিন রুমের মধ্যে, যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি আজ আগেই আসতে চেয়েছিলাম। সুপারভাইজারের অনুমতি পেতে দেরি হয়ে গেল। আলনা থেকে একটি গামছা নিয়ে মুখ মুঝতে মুছতে বলে বানু।
-জরুরি কাজ, ওভারটাইম করবো না। তারপরও কারখানা থেকে আসতে দেবে না। যেন সুপারভাইজার যা বলবে তাই।
-কেন অফিসে কাজ থাকে, কাজ শেষ করার আগে ছুটি নাও তো দিতে পারে?
-নারে পাগল। আসমার কাছে গিয়ে বসে বানু।
- আইনে আছে, নিয়মিত ডিউটি করার যদি ওভারটাইম করানো লাগে তাহলে শ্রমিকের সম্মতি নিয়ে ওভারটাইমের কাজ করাবে। এ জন্য নিয়মিত সময়ের জন্য প্রতি ঘন্টার যে পরিমান বেতন ওভারটাইমে তার দ্বিগুন হবে।
-ও আপনি আইনও জানেন।
-জানি কি আর অল্প সাধে। গার্মেন্টস মালিকরা পারে তো সারাদিন-রাত কাজ করিয়ে নেয়। শ্রমিকরা আন্দোলন, মিটিং, মিছিল করে বলেই তো শ্রমিকের উপর থেকে জুলুম কমেছে। মিটিং মিছিল না হলে জুলুম আরও থাকতো। রুমানা আপারা কত আন্দোলন করেছে। কয় বছর আগে যখন সারা দেশে গার্মেন্ট শ্রমিকরা আন্দোলন করেছে তখন কেউ শ্রমিকের সাথে পারেনি। মালিকরাও না পেরে রাস্তায় শুয়ে পড়ে প্রতিবাদ করেছিল।
বানুর কথা শুনে আসমার চোখ চিক চিক করে উঠে, অধির আগ্রহ নিয়ে শুনে। সন্ধ্যা এগিয়ে আসার সাথে সাথে রুমের বাইরের শব্দও বৃদ্ধি পায়। এ বাড়ির ভাড়াটে মানুষগুলো কর্মস্থল থেকে ফিরতে থাকে। হাক ডাক শোনা যায়। এ শব্দ রুমের মধ্যেও প্রতিধ্বনি হয়। আসমা বানুর কাছেকাছি এসে বসে।
- এখন আন্দোলন হয় না?
-হয় না আবার, হয়। কিন্তু মালিকরা চোখ খোলা রাখে। কোন শ্রমিক এক সাথে হয়ে কথা বলেছে তো সেই শ্রমিককের আর চাকুর নেই, কারখানা থেকে বের করে দেয়।
-বের করে দেয় মানে, প্রশ্ন করে আসমা।
-মানে ছাঁটাই করে।
-তারপর, জানতে চায় আসমা।
-তারপর শ্রমিকরাও কুকুরকে যোগ্য মুগুর দেয়। বেতন বোনাস বা অন্য কোন দাবি না মেনে পুলিশ বা ঝুট মাস্তান দিয়ে শ্রমিককে মার-ধর করলে শ্রমিকরা শ্রম আদালতে মামলা করে দেয়। বা এক জোট হয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয়, ভাংচুর করে। এতে বাধ্য হয়ে মালিকরা কথা শোনে।
-ঝুট মাস্তান আবার কি?
-ও আচ্ছা, হাসে বানু। তারপর আবার বলে, মালিকরা শ্রমিকদের দমানোর জন্য কিছু স্থানীয় লোককে পুষে রাখে। আর এর বিনিময়ে গার্মেন্টস কারখানার বিভিন্ন রকমের টুকরো কাপড় এই সব লোককের কাছে কম দামে বিক্রি করে। এই টুকরো কাপড়ের ব্যবসা করার জন্য একাধিক মাস্তান নিজেদের মধ্যে গন্ডগোল করে শক্তির জানান দেয়। যে জিতে সে ওই ব্যবসা পায়। এই সব লোক মালিকের যে কোন কাজে লাগে। শ্রমিকরা আন্দোলন করলে কারখানার বাইরে ও ম্যাচে, বাসায় গিয়ে মারধর করে আসে।
-পারে শ্রমিকের সাথে?
- শ্রমিকরা এক থাকলে তো মালিকরাই সোনার গাঁও হাসপাতলের সামনে শুয়ে পড়ে। এক না থাকলে তো গেটের সিকিউরটিই চাকুরি থেকে ছাঁটাই করে।
-ওই যাহ্! আপনাকে সঙ্গে করে বাইরে ঘোরার জন্য আগে আসলাম, কিন্তু আমিই বসে গল্প করছি। এ গল্প তো রোজই করি, চাকুরি শুরু করলে আবার তখন গল্প করারই সময় পাওয়া যাবে। বেড়ানোর সময় পাওয়া যাবে না। চলেন, বের হন।
আসমা সম্মতি সূচক ইঙ্গিত করে। দেওয়ালে ঝোলানো আয়নার সামনে দাঁড়ায়। চিরনিটা হাতে নেয়। চুলগুলো গুছিয়ে নেয়।
-বের হন। আসমাকে আয়নার কাছে যেতে ইঙ্গি করে বানু। তারপর দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। কয়েকমিনিট পর আসমাও বের হয়।
(অতপর)

1 টি মন্তব্য:

  1. বরং উপন্যাসের খসড়াই বলি। যখন পুরোপুরি রুপ পাবে তখনই এটাকে উপন্যাস বলবো। আশা করি শ্রমজীবি মানুষের জীবনকে স্পর্শ করে যাবে। তারপরও কারও কোন মন্তব্য, উপদেশ নির্দেশনা থাকলে তা পাথেয় হবে।

    উত্তরমুছুন