Biplobi Barta

রবিবার, ২০ আগস্ট, ২০১৭

বিদ্রোহ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সে অচলায়তন ভেঙ্গে নতুন যুগের সূচনা করেছিলো

২২শে মে বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের জন্য স্মরণীয় দিন। গার্মেন্ট মালিকদের শোষণ, বঞ্চণা আর শ্রমিক আন্দোলনের যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল ২০০৬ সালের এইদিনে আশুলিয়ার গার্মেন্ট শ্রমিকরা বিদ্রোহ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সে অচলায়তন ভেঙ্গে নতুন যুগের সূচনা করেছিলো।
২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত কম মজুরি (৯৩০ টাকা ন্যুনতম মজুরি) ১২ থেকে ১৮ ঘন্টা পরিশ্রম, কথায় কথায় ছাটাই, নিয়োগপত্র ছিল না, ট্রেড ইউনিয়নের কথা বলা যেত না। শ্রমিকরা মজুরির প্রশ্নে কোন কথা বলবে-এমন কথা ভাবাই যেত না।
শ্রমিকদের পানি পান করতে দিত না, বেশি পানি খেলে বার বার টয়লেটে যাবে আর তাতে কাজ কম হবে না বলে। শ্রমিকরা কোন রকম ছুটি ভোগ করতে পারতো না, অসুখ হলেও না। জাতীয় দিবসেও ছুটি পাওয়া যেত না-এমন কি মে দিবসেও শ্রমিকদের রাত-দিন কাজ করতো। নিয়োগ পত্র ছিলোনা ছিলোনা ট্রেড ইউয়িন করার অধিকার। মালিক পক্ষ যদি জানতে পারতো কোন শ্রমিক টেড্র ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে জানলেই তার চাকুরি চলে যেত।
৭০এর দশকের মাঝামাঝিতে পোশাক শিল্পের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল এ খাতের শ্রমিকদের শ্রমিকি মর্যাদার সৃষ্টি হয়নি। বরং দর্জি শ্রমিক, কাজের বুয়া এমনটাই ভাবা হোত। এ সময় শ্রমিকরা অধিকারের প্রশ্নে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে এমন প্রেরণাও ছিল না।
 ৬০ এর দশক থেকে শ্রমিক আন্দোলনের যে ঐতিহ্য তৈরি হয়েছিল, নেতা তৈরি হয়েছিল। ৮০ দশকে এসে অনেক নেতা আন্দোলন সংগ্রাম, ত্যাগের পথ থেকে ভোগের  পথে পা বাড়ায়। শ্রমিক আন্দলনে না থেকে তারা সরকারি দলে ভিড়ে গিয়ে কিভাবে এমপি, মন্ত্রী হওয়া যায়-সে পথ খুঁজতে থাকে। ৬৯ সালে গনঅভুত্থান ৮০ দশকে সৈরাচার বিরোধী আন্দলনে শ্রমিকেদর ভুমিকা ছিলো অনন্য। ৮০ দশকে গড়ে উঠা স্কপ শ্রমিক সার্ত্থে ৫দফা দাবিতে আন্দোলন করছিলো । সৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের  তিন জোট ক্ষমতায় গেলে স্কপের ৫ দফা বাস্তবাইন করবে অঙ্গিকার করলেও শ্রমিকরা সৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয় এবং ৯০ সালের ডিসেম্বরে সৈরাচারের পতন ঘটে। কিন্তু দূর্ভাগ্য কোন রাজনৈতিক দল শ্রমিকদের দেওয়া  কথা রাখেনি । পরবর্তিতে যারাই ক্ষমতায় গিয়েছে তারাই শ্রমিক নির্যাতনের  নতুন নতুন পথ বের করেছে । সরকারি মালিকানার মিলগুলি ব্যক্তি মালিকানাই ছেড়ে দেওয়ায়  সরকারি সিদ্ধান্তের  প্রতিবাদে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তাকে দমন করতে পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে ১৭ জন শ্রমিককে গুলি হত্যা করে এবং সরকারি  মিল কারখানা বন্ধ করে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বেকার করে দিয়ে শ্রমিকদের মনোবল ভেঙ্গে দেয় । আর সম্ভাবনাময় শিল্প হিসাব গড়ে উঠা তৈরি পোশাক শিল্প যতটা বাড়তে থাকে তেমনি বাড়তে থাকে নির্যাতন । শ্রমিকরা  দাসত্বের শৃঙ্খলে আটকাতে থাকে দ্বিগুন হারে।

 সে সময় সব শিল্প খাতের শ্রমিকদের উপর নেমে আসে মালিকদের চরম অত্যাচার ও নির্যাতন। সে সময় গার্মেন্ট খতে ৫৪টার মত সংগঠন শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করতো তার প্রায় সব গুলি গার্মেন্ট মালিক বা বিদেশি এনজিও দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাদের প্রায় সকল নেতা কর্মি শ্রমিক স্বার্থ  থেকে নিজেদের আখের গোছাতে ততপর ছিলো।

২০০৬ সালে ২২শে মে শ্রমিকরা সকল অত্যাচারের জবাব দিতে সে দিন রাস্তাই নেমে আসে। শুধু গার্মেন্ট শিল্পে নয় গোটা শ্রমিক আন্দোলনকে নতুন পথ দেখিয়ে ছিলো সে দিন আশুলিয়ার শ্রমিকরা। বুঝিয়ে ছিলো আন্দোলনের বিকল্প নাই। আন্দোলেনের চাপে সরকার মালিক দিশেহারা হয়ে ত্রি-পক্ষিয় চুক্তি করতে বাধ্য হয়। কিন্তু সেই আন্দোলন নিয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোন গবেষণা হয়নি।
গার্মেন্ট শিল্পের সাথে যুক্ত সকল সংগঠন দাবি করে নিজ নিজ সম্পৃক্ততার। তাই দাবি রাখে সত্য অনুসন্ধানের।

২০০৬ সালের আন্দোলনের পটভুমিকা: ২০০০ সালের শুরুর দিকে আশুলিয়ার বিভিন্ন তৈরি পোশাক শিল্পসহ ইপিজেডের বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিকরা কারখানা পর্যায়ে ইস্যু ভিত্তিক ছোট্টসূচি পালন করছিল। সে সময়ে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি হিসাবে আমি তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের পাশাপাশি আশুলিয়ায় শ্রমিকদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছি। সে সময় আশুলিয়ায় বসুন্ধারা আবাসিক এলাকায় শ্রমিক আওয়াজের সম্পাদক জাফর ভাইয়ের ম্যাচ কেন্দ্রিক শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করার একটি কার্যক্রম গড়ে তুলি। তেজগঁওয়ে রতন ভাই, ডলি, শামীম ভাইসহ গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাকালিন সময়ে জাফর ভাইও ট্রেড ইউনিয়নের সাথে যুক্ত ছিল।

 বসুন্ধরা-বগাবাড়ি এলাকা কেন্দ্রিক কার্যক্রম চালানোর সময় পরিচয় হয় সিপিবির কর্মি ছালাম ভায়ের সাথে। বগাবাড়ি বাজারে সালাম ভাইয়ের দর্জির দোকান ছিলো। তাকে পাওয়ার পর সাংগাঠনিক কাজ জোরদার হয়। ২০০৪ সালে রিংসাইনের আন্দোলন হয়। সে সময় মঞ্জু ভাইও ছুটে আসে আশুলিয়ায়। তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ছালাম ভায়ের দোকানের সাথে অফিস এবং মোস্তফা ভাইকে হোল টাইমার ঠিক করা হয়। তিন মাস পরে তা বাতিল করেন মঞ্জু ভাই। এদিন হঠাৎই দেখা হয় সিরাজুল ইসলাম সুমনের সাথে। তেজগাঁও থাকতে সে আমাদের সংগঠনের কর্মি ছিল। সেই পরিচয় করিয়ে দেয় ইউনির্ভাস সোয়েটার কারখানার নিটিং অপারেটর আলি রেজা তুহিনের সংঙ্গে। সে সময় তুহিন বললো, ইদ্রিস ভাই আমাদের বাঁচান এই ছিলো তার প্রথম কথা।

তুহিন জানালো প্রতি দিন ১৪/১৬ ঘন্টা দাঁড়িয়ে সোয়েটারের ক্রসেস মারতে হয়। পা ফুলে যাই। আর পারিনা। কিছু একটা করেন। এ কথা তুহিনের হলেও আমি তুহিনের কথার মধ্যে সকল গার্মেন্ট শ্রমিককে আবিস্কার করি।  শুরু হয় এক সাথে পথ চলা। ইউনির্ভাসের তুহিন চৌধুরী, কুদ্দুস আকবর তাহের রিংসাইনের মিন্টু, মফিজ সাইফুল, মজিবর আরো অনেকে যাদের নাম মনে করতে  পারছি না। অনুমপম সোয়েটার শ্রমিকসহ আশে-পাশের কারখানার শ্রমিকসহ প্রায় শতাধিক শ্রমিক মওলার ম্যাচে মিটিং করি। এভাবে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের একটি শক্ত যাত্রা শুরু হয়।
 ওই সময় সাভার অঞ্চল ভিত্তিক কারখানার শ্রমিকদের নিয়ে আমাদের কার্যক্রম জোরদার হয়। এমনিভাবে দিনের পর দিন মিটিং করে কর্ম সভা করে আগামি আন্দোলনের জন্য তৈরি করা হয়। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মার্চ থেকেই মে দিবসকে লক্ষ্য স্থির করে বড় ধরনের সমাবেশের প্রস্তুতি নিই।
 আশুলিয়ার ফেন্টাসির সংলগ্ন ইউনির্ভাস গার্মেন্ট কারখানায় তুহিন চৌধুরী, কুদ্দুস আকবর তাহেরসহ ১১জনের একটা টিম দাঁড় করাই। এ প্রস্তুতি টিমটি বড় ধরনের ভুমিকা রাখে। এ সময় শ্রমিকদের আদর্শিক ধারাতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য পল্লী বিদ্যুৎ বালুর মাঠে মে দিবসের স্থান ঠিক হয়। সেই সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ওয়াজেদ ভাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিনসহ অনেকে। ওই কর্মসূচি ২২ মের আন্দোলনে বড় ধরনের ভুমিকা রাখে।

সাভার-আশুলিয়ার আঞ্চলিক কার্যক্রম গড়ে ওঠে। সেখান থেকেই বিভিন্ন সময়ে দাবি নামা উপস্থাপন করি। নিয়োগ পত্র সাপ্তাহিক ছুটি, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারসহ দশ দফা দাবি ঠিক হয়। ৩রা মে দাবিনামা পেশ করা হয় মালিক পক্ষ পনেরো দিনের সময় নেয়। ১৮ মে পর্যন্ত মালিক পক্ষ থেকে কোন সিদ্ধান্ত না দেওয়াই ঐদিনই স্মৃতিসৌধের মধ্যে কর্মিসভা করা হয়। সেদিন আমরা সিদ্ধোন্তে নিই আমাদের পিছানে ফিরে তাকানোর সময় নেই। এখন চরম সিদ্ধান্ত নিতে হবে কি ভাবে আগাবো।
কর্মসুচি ঠিক করতে ১৯ মে আমরা স্মৃতিসৌধের মধ্যে আমরা মিলিত হই। যদি কারখানাই ধর্মঘট কিংবা রাজপথ অবরোধের মত কঠিন কর্মসুচি হয় আমার পক্ষে সে সময় উপস্থিত থাকা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই নারায়নগঞ্জের শ্রমিনেতা গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের উপদেষ্টা মন্টু ঘোষ ও সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিনকে নিয়ে যাই। সিদ্ধান্ত হয় মন্টু ঘোষ ও রুহুল আমিন আন্দোলনকে  এগিয়ে নিতে সকল ধরনের সহযগিতা করবে।
২১শে মে জামগড়ায় কর্মিসভায় সন্ত্রাসিদের হামল করে। তার জের ধরে আশুলিয়া থানার সামনে অবস্থান। তার প্রতিবাদে পরদিন ২২শে সকাল ১০টাই ইউনির্ভাস সোয়েটার কারখানার সামনে অবস্থান কর্মসুচির ঘোষণা করা হয়। সকাল থেকেই কারখার সামনে শ্রমিকরা জড়ো হতে থাকে। অবস্থান কর্মসুচিতে সংহতি জানাতে আশে-পাশের কারখানার শ্রমিকরাও কারখানা থেকে বেরিয়ে আসে। শ্রমিকদের এতো দিনের ক্ষোভ বিক্ষোভ রুপ নেয়। আশুলিয়া বাইপাল রোডে যান চলাচল বন্ধ করে সমাবেশ চলতে থাকে।
যানবাহন না পাওয়াই মন্টু ঘোষ ও রুহুল আমিনের যেতে দেরি হয়। ততক্ষনে ইপিজেডসহ এলাকাই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সকল অঞ্চল থেকে মিছিলসহ সমাবেশের স্থনে আসতে থাকে। এ সময় আশে-পাশের কারখানায় ভাংচুরের ঘটনা ঘটে।  তখন সমাবেশ সংক্ষিপ্ত করে মিছিলসহ বাইপাইলের দিকে রওনা করেন। মিন্টু তানজির থেকে মিছিল করে ঐমিছিলের সাথে যুক্ত হয়। ইপিজেডের শ্রমিকরা বিশাল মিছিল করে আসতে থাকে। এলাকার নেতাসহ সকলে ঢাকায় ফিরে এসে তাৎক্ষনিক প্রেস ব্রিফিং করে শ্রমিকদের সকল দাবিদাওয়া মেনে নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতির সমাধানে আহবান জানানো হয়। সেই সাথে ২৩শে মে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। এর আগে গাজিপুরে এসকিইউ কারখানর শ্রমিক হত্যার কেন্দ্র করে গার্মেট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র ও গার্মেট শ্রমিক ঐক্য ফোরাম যৌথ ভাবে ২৩শে মে গাজিপুর জেলায় ধর্মঘটের ঘোষণা দেন। এই দুই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২৩শে মে ঢাকা নারায়নগঞ্জ গাজিপুর সকল এলাকার শ্রমিকরা এতো দিনের অত্যাচার নির্যাতনের জবাব দিতে রাস্তায় বেরিয়ে এসে বিক্ষোভ করতে থাকে।
দুপুরের দিকে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে থেকে আমাদের সাথে যোগাযোগ করে আলোচনার জন্য। আমরা ২৫ জনের প্রতিনিধি নিয়ে সচিবালয়ে যায়। আগে থেকে মান্নান ভুঁয়ারসহ তিন মন্ত্রী দুইজন প্রধান মন্ত্রীর উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। দীর্ঘ আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম পরের দিন সকল শ্রমিক সংগঠন মালিক এবং সরকার ত্রি-পক্ষে আলোচনার মাধ্যমে শ্রমিকদের সকল সমস্যার সমাধান করা হবে।
 এই প্রর্থম বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিক মালিক এবং সরকারের ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়। এ চুক্তির ধারাবাহিকতায় ন্যুনতম মজুরি বোর্ড গঠিত হয়। শ্রমিকদের অধিকারের আদায়ের একটি মাইল ফলক ঘোষিত হয়।
লেখকঃ ইদ্রীস আলী, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন