লেখক: মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি(সিপিবি)
দেশে
এখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের পৃথক-পৃথক দু’টি ‘ভিশন’ নিয়ে অনেকটা মজার ধরণের
বির্তকে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। মজার এ কারণে যে, ‘ভিশন’ দু’টিকে পাল্টাপাল্টি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে
বলে বলা সত্ত্বেও দু’পক্ষের মধ্যে ‘ভিশনের’ বিষয়বস্তু নিয়ে
তেমন কোনো বিতর্ক হচ্ছে না। বিতর্ক চলছে প্রধানতঃ কে কার ‘ভিশন’ নকল করছে –তা নিয়ে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পেছনে পর্যাপ্ত জনসমর্থন নেই। তথাপি ক্ষমতায় থাকার জন্য সে মরিয়া। আরেক দফা
ক্ষমতায় থাকতে হলে তাকে তার স্বপক্ষে যথাসম্ভব জনমত সৃষ্টি করতে হবে। তাদের ইতোমধ্যেকার কর্মকাণ্ড এতোটাই গণধিকৃত যে সেসব দেখিয়ে তা করা সম্ভব
নয়। তাই জনগণের সামনে ভবিষ্যতের ‘ভিশনের’ মুলা ঝুলিয়ে তা করার জন্য সে চেষ্টা করেছে। এ উদ্দেশ্যে
সে ‘ভিশন-টুয়েনটি টুয়েনটি ওয়ান’ ফেরী করে চলেছে। এটিকে তারা তাদের প্রচারণার ক্ষেত্রে ‘তুরুপের তাস’ বলে গণ্য করছে। শুধু তাই নয়, আরো দূরবর্তী লক্ষ্য থেকে ‘ভিশন-টুয়েনটি ফরটির’ কথাও সে বলে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বিএনপিও ছাড়বার পাত্র নয়। বিএনপিও মনে করছে, এ বিষয়ে সেই বা কেন পিছিয়ে থাকবে। তাই, কিছুদিন আগে খুব ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ও বেশ ঘটা করে সে পাল্টা তার ‘ভিশন-টুয়েনটি থারটি’ ঘোষণা করেছে। ফলে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে, অন্যান্য
বিষয়ের পাশাপাশি, তাদের পৃথক-পৃথক দু’টি ‘ভিশনের’ ভালো-মন্দ নিয়ে বিতর্ক ও দু’টি ‘ভিশনের’ ভেতর কোনটি শ্রেষ্ঠতর–সে বিষয়ে বাক-বিতণ্ডার
সূত্রপাত ঘটবে- বলে মনে করা গিয়েছিল। কিন্তু তা হচ্ছে না কেন? হওয়ার সুযোগই বা আছে কতটুকু? প্রশ্ন সেখানেই। দুই দলের দুই ‘ভিশনের’ ভালো-মন্দ নিয়ে তেমন বাক-বিতণ্ডা যে
হচ্ছে না তার কারণ হলো, নীতিগত ও সামাজিক-অর্থনৈতিক নীতি-দর্শনগত ভিত্তি, তথা মৌলিক মর্মবাণীর দিক থেকে বিবেচনা করলে এ দু’টি দলের হাজির করা দু’টি ভিন্ন-ভিন্ন ‘ভিশনের’ মধ্যে পার্থক্য
নিতান্তই কম। সে দু’টি ভিশনের মধ্যে যতোটা না ‘বেমিল’ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ‘মিল’ রয়েছে তার চেয়ে শতগুণ বেশি। যে কোনো দু’টি ‘ভিশনের’ মধ্যে বেমিল বা পার্থক্য যদি তেমন না থাকে, তাহলে সেগুলো নিয়ে জমজমাট
বাক-বিতণ্ডা ও প্রতিযোগিতার সুযোগই বা থাকতে পারে কতোটুকু? একথা যে কতো সত্য তার প্রমাণ, বিএনপি তার ‘ভিশন’ ঘোষণার পরপরই দু’পক্ষের বিতর্কটি শুরুতেই যে বিষয়ে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছিল, সে ঘটনাতেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ‘ভিশনের’ বিষয়বস্তু তথা তার ত্রুটি-বিচ্যুতি, ঘাটতি-সীমাবদ্ধতা, নীতি-দর্শনগত অভিমুখীনতা ইত্যাদির বদলে দু’পক্ষই শুরুতেই-কে কাকে ‘নকল‘ করেছে সে বিষয়টি নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। এ নিয়ে
শুরু হয়ে গিয়েছিল পরষ্পরের
পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। আওয়ামী লীগ বললো যে, তারাই আগে ‘ভিশন’ ঘোষণা করেছে। বিএনপি সেটিকেই ‘নকল’ করে ও আওয়ামী
লীগের ‘অনুগামী’ হয়ে তাদের ‘ভিশন’ হাজির করেছে। জবাবে বিএনপি বললো যে, এই ‘ভিশন’ বহু আগে, এমনকি জিয়াউর রহমানে শাসনামলে, বিএনপিই প্রথম হাজির করেছিল। যেমন কিনা, শেখ মুজিবের ‘কমান্ড ইকনমির’ আবর্ত থেকে মুক্ত করে ‘মুক্ত বাজারের নয়া-উদারবাদী’ ব্যবস্থায় দেশকে পরিচালনা করার ‘ভিশন’ বিএনপি-ই প্রথম উপস্থিত করেছিল। সেই ‘ভিশনের’ ‘অনুগামী’ হয়ে এবং তা ‘নকল’ করেই আওয়ামী লীগ তার ‘ভিশন’ রচনা করেছে। কে কার ‘অনুগামী’ ও কে কাকে ‘নকল’ করেছে এ বিষয়ে
কার বক্তব্য সঠিক সে বিচারে না
গিয়েই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, উভয় দলই স্বীকার করছে যে-দু’দলের ‘ভিশন’ দু’টি হলো একটি অপরটির ‘নকল’ বা অনেকটা ‘কার্বন কপির’ মতো। উভয় দলের ‘ভিশনের’ সামাজিক-অর্থনৈতিক
ও নীতি-দর্শনগত ভিত্তিভূমির মধ্যে কোনো তফাৎ যে তেমন নেই, দু’টি দলই পরস্পর সম্পর্কে ‘অনুগামী’ হওয়া ও ‘নকল’ করার অভিযোগের দ্বারা তা কার্যতঃ স্বীকার করে নিয়েছে। তাছাড়া, বুর্জোয়া ধারার এ দু’টি দলের ‘ভিশন’ দু’টি সমগোত্রীয়ও বটে। দু’পক্ষের ‘ভিশন’ দুটি পাশাপাশি
রেখে মিলিয়ে দেখলে, ‘ভিশন’ দু’টির উপাদান, অভিমুখীনতা ও শ্রেণিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে তেমন কোনো
পার্থক্য যে নেই, সে সত্যটি চোখে না পড়ে পারে না। সেকারণেই ‘ভিশনের’ মর্মবাণী নিয়ে
বিতর্কের বদলে, তাদের পরস্পরের মধ্যেকার বিতর্কের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে, ‘ভিশন’ রচনার ক্ষেত্রে কে কার ‘অনুগামী’ হয়েছে ও কে কার ‘নকল’ করেছে, সে প্রসঙ্গটি। আওয়ামী লীগের ‘ভিশন-২০২১’ এবং বিএনপির ‘ভিশন-২০৩০’–এই উভয় ‘ভিশনের’ সামাজিক-অর্থনৈতিক ভিত্তি হলো
পুঁজিবাদী বাজার-অর্থনীতির নয়া-উদারবাদী নীতি-দর্শন। মুক্তিযুদ্ধের নীতি-দর্শন পরিপূর্ণভাবে পরিত্যাগ করে এই দক্ষিণপন্থি-প্রতিক্রিয়াশীল
নীতি-দর্শন চালু করার উদ্দেশ্যেই পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তন
সংগঠিত করা হয়েছিল। খুনী মোশতাক, জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া, মইনউদ্দিন-ফকরুদ্দীন প্রমুখের নেতৃত্বে পঁচাত্তর পরবর্তী পর্যায়ক্রমিক সব
সরকারই, এমনকি হাসিনার নেতৃত্বাধীন খোদ আওয়ামী লীগ সরকারও, এই একই নীতি-আদর্শের ধারাকে ভিত্তি করে রাষ্ট্র চালিয়েছে। এখনো সে পথেই
রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। রাষ্ট্র পরিচালনার ধরনে এবং উপরিকাঠামোর ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্য থাকলেও, প্রায় চার দশক ধরে সব সরকারের আমলেই, দেশের
সামাজিক-অর্থনেতিক নীতি-দর্শন মুক্তিযুদ্ধের এই উল্টোমুখী ধারাতেই পরিচালিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের ধারার উল্টোমুখী পথের পরিণতিতে যে ‘ভিশন’ সৃষ্টি হয়, তার চরিত্র ‘পাকিস্তানি ধারা’ অভিমুখীন হতে বাধ্য। পাকিস্তানের ‘ভিশন’ ছিল সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতি তত্ত্ব ও সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ-একচেটিয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে রচিত। সেই ‘ভিশনের’ অন্যতম উপাদান ছিল জাতিগত শোষণ, গণতন্ত্রহীনতা, শ্রেণিগত শোষণ-বৈষম্য ইত্যাদি। এটিই হলো ‘ভিশন-পাকিস্তান’। সেই প্রতিক্রিয়াশীল ‘ভিশন-পাকিস্তানের’ বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং তাকে পরিত্যাগ করে, তার বিপরীতমুখী সমাজতন্ত্র অভিমুখীন-প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ‘ভিশন’। সেটিই হলো ‘ভিশন-মুক্তিযুদ্ধ’ বা ‘ভিশন-১৯৭১’। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ‘ভিশন-১৯৭১’ পরিত্যাগ করে তার বিপরীত ধারার ‘ভিশন’ প্রবর্তন করার অর্থ হলো, নেতীকরণের-নেতীকরণ (negation of negation)-এর সূত্র অনুসারে, কোনো না কোনো রূপে ‘ভিশন-পাকিস্তানের‘ পুনঃস্থাপন। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে, এদেশের আপামর জনগণ বিজয়ী যুদ্ধশেষে যে স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, তাকে অবলম্বন করেই ১৯৭২ সালে রচিত হয়েছিল আমাদের সংবিধান। সেই সংবিধানকে বহুবার ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। তথাপি, সংবিধানের ‘দ্বিতীয় ভাগে’ ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ শিরোনামের অধ্যায়ে ১৮টি পৃথক-পৃথক অনুচ্ছেদে এখনো সেই স্বপ্ন বা ‘ভিশনের’ দিকনির্দেশনা লিপিবদ্ধ করা আছে, সংবিধানে বর্ণিত এই মূলনীতিসমূহের মাঝেই প্রতিফলিত রয়েছে ‘ভিশন-মুক্তিযুদ্ধ’ তথা ‘ভিশন-১৯৭১’-এর রূপকল্প। ‘ভিশন-১৯৭১’–এর মর্মবাণী কি ছিল তা বোঝার সুবিধার্থে সংবিধানের এই উল্লিখিত অধ্যায় থেকে সামান্য দু’একটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি। সংবিধানের এই দ্বিতীয় ভাগের শুরুর অনুচ্ছেদেই বলা হয়েছে– “জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা–এই নীতিসমূহ —— রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।” ১০-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে– “মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজলাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনেতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।” ১৩-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে– “উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদনব্যবস্থা ও বণ্টন প্রণালীসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন জনগণ ——।” ১৫-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে–“রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে —— নাগরিকদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা —— (ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা; (খ) —— যুক্তিসংগত মজুরীর বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার; (গ) যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার; (ঘ) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি —— ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্যলাভের অধিকার।” এ ধরণের আরো অনেক উদ্ধৃতি তুলে ধরা যায়। যেটুকু এখানে উদ্ধৃত হয়েছে, সেটুকু থেকেই ‘ভিশন-১৯৭১’-এর চেহারা, চরিত্র, বৈশিষ্ট্য, অভিমুখীনতা ও নীতি-আদর্শগত ভিত্তির স্বরূপ বুঝে নিতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ‘ভিশন-৭১’এর এসব মৌলিক নীতি-দর্শনগত ভিত্তির সাথে আওয়ামী লীগের ‘ভিশন-২০২১’ ও বিএনিপর ‘ভিশন-২০৩০’ পাশাপাশি রেখে মিলিয়ে দেখা হলে এদের মধ্যকার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী চরিত্র স্পষ্ট না হয়ে পারে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ের ‘ভিশনের’ সামাজিক-অর্থনৈতিক নীতি-দর্শনগত ভিত্তি হলো পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতি ভিত্তিক নয়া-উদারবাদ তথা পুঁজিবাদ। আর, ‘ভিশন-১৯৭১’-এর অন্যতম নীতি-দর্শনগত ভিত্তি হলো সমাজতন্ত্র। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই দুই বিপরীতমুখী নীতি-দর্শনগত দিক নির্দেশনা ও পথ একইসাথে পাশাপাশি অনুসৃত হতে পারে না। একটিকে অনুসরণ করার অর্থ হলো অবধারিতভাবে অপরটিকে পরিত্যাগ করা। আওয়ামী লীগ ও বিএনিপ উভয় দলই ‘ভিশন-১৯৭১’ পরিত্যাগ করে তাদের ‘ভিশন-২০২১’ ও ‘ভিশন-২০৩০’ রচনা করেছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ হলো জাতি ও জনগণের এযাবতকালের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জন। ঐতিহাসিক সে অর্জনই ‘ভিশন-১৯৭১’-এর জন্ম দিয়েছিল। তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্ত ও কোটি-কোটি মানুষের সাহস, বীরত্ব ও আত্মত্যাগের ফসল হলো ‘ভিশন-১৯৭১’। সেই ‘ভিশন-১৯৭১’ বাস্তবায়ন হয়নি। সে ‘ভিশন’ ফেলে দেয়া হয়েছে। বস্তুতঃ তা বাস্তবায়নের সূচনা করার সুযোগ ও সময়ই হয়নি। ‘ভিশন-১৯৭১’ যে বাস্তবায়িত হয়নি সে কথা ভুলে গিয়ে দেশের বুর্জোয়া দলগুলো চার দশক ধরে তার উল্টোপথে হাটছে। বুর্জোয়া শক্তি ও দলগুলো ‘ভিশন-১৯৭১’ কে ভূলুণ্ঠিত করে তার বিপরীতমুখী ধারার ‘ভিশন-২০২১’ এবং ‘ভিশন-২০৩০’ এখন সামনে এনেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত ‘ভিশন-১৯৭১’ হারিয়ে যেতে দেয়া যায় না। বুর্জোয়ারা ‘ভিশন-একাত্তর’কে ভূলুণ্ঠিত করলেও, জনগণ সেই বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নিতে রাজি নয়। একাত্তরে রচিত জনগণের সে স্বপ্ন তথা ‘ভিশনকে’ ধারণ করে এদেশের বামপন্থিরা ঘোষণা দিয়েছে যে, বুর্জোয়ারা ‘ভিশন-একাত্তরের’ পতাকা হাত থেকে ফেলে দিলেও, সেই পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে তারাই এগিয়ে যাবে। এটিই তাদের শপথ। কমিউনিস্ট-বামপন্থিদের ‘ভিশন’ হলো– ‘ভিশন-১৯৭১’। তাই নিঃশঙ্ক চিত্তে ঘোষণা করা যায়– ‘ভিশন-১৯৭১’– এর মৃত্যু নেই।
মুক্তিযুদ্ধের ধারার উল্টোমুখী পথের পরিণতিতে যে ‘ভিশন’ সৃষ্টি হয়, তার চরিত্র ‘পাকিস্তানি ধারা’ অভিমুখীন হতে বাধ্য। পাকিস্তানের ‘ভিশন’ ছিল সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতি তত্ত্ব ও সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ-একচেটিয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে রচিত। সেই ‘ভিশনের’ অন্যতম উপাদান ছিল জাতিগত শোষণ, গণতন্ত্রহীনতা, শ্রেণিগত শোষণ-বৈষম্য ইত্যাদি। এটিই হলো ‘ভিশন-পাকিস্তান’। সেই প্রতিক্রিয়াশীল ‘ভিশন-পাকিস্তানের’ বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং তাকে পরিত্যাগ করে, তার বিপরীতমুখী সমাজতন্ত্র অভিমুখীন-প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ‘ভিশন’। সেটিই হলো ‘ভিশন-মুক্তিযুদ্ধ’ বা ‘ভিশন-১৯৭১’। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ‘ভিশন-১৯৭১’ পরিত্যাগ করে তার বিপরীত ধারার ‘ভিশন’ প্রবর্তন করার অর্থ হলো, নেতীকরণের-নেতীকরণ (negation of negation)-এর সূত্র অনুসারে, কোনো না কোনো রূপে ‘ভিশন-পাকিস্তানের‘ পুনঃস্থাপন। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে, এদেশের আপামর জনগণ বিজয়ী যুদ্ধশেষে যে স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, তাকে অবলম্বন করেই ১৯৭২ সালে রচিত হয়েছিল আমাদের সংবিধান। সেই সংবিধানকে বহুবার ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। তথাপি, সংবিধানের ‘দ্বিতীয় ভাগে’ ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ শিরোনামের অধ্যায়ে ১৮টি পৃথক-পৃথক অনুচ্ছেদে এখনো সেই স্বপ্ন বা ‘ভিশনের’ দিকনির্দেশনা লিপিবদ্ধ করা আছে, সংবিধানে বর্ণিত এই মূলনীতিসমূহের মাঝেই প্রতিফলিত রয়েছে ‘ভিশন-মুক্তিযুদ্ধ’ তথা ‘ভিশন-১৯৭১’-এর রূপকল্প। ‘ভিশন-১৯৭১’–এর মর্মবাণী কি ছিল তা বোঝার সুবিধার্থে সংবিধানের এই উল্লিখিত অধ্যায় থেকে সামান্য দু’একটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি। সংবিধানের এই দ্বিতীয় ভাগের শুরুর অনুচ্ছেদেই বলা হয়েছে– “জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা–এই নীতিসমূহ —— রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।” ১০-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে– “মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজলাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনেতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।” ১৩-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে– “উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদনব্যবস্থা ও বণ্টন প্রণালীসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন জনগণ ——।” ১৫-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে–“রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে —— নাগরিকদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা —— (ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা; (খ) —— যুক্তিসংগত মজুরীর বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার; (গ) যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার; (ঘ) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি —— ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্যলাভের অধিকার।” এ ধরণের আরো অনেক উদ্ধৃতি তুলে ধরা যায়। যেটুকু এখানে উদ্ধৃত হয়েছে, সেটুকু থেকেই ‘ভিশন-১৯৭১’-এর চেহারা, চরিত্র, বৈশিষ্ট্য, অভিমুখীনতা ও নীতি-আদর্শগত ভিত্তির স্বরূপ বুঝে নিতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ‘ভিশন-৭১’এর এসব মৌলিক নীতি-দর্শনগত ভিত্তির সাথে আওয়ামী লীগের ‘ভিশন-২০২১’ ও বিএনিপর ‘ভিশন-২০৩০’ পাশাপাশি রেখে মিলিয়ে দেখা হলে এদের মধ্যকার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী চরিত্র স্পষ্ট না হয়ে পারে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ের ‘ভিশনের’ সামাজিক-অর্থনৈতিক নীতি-দর্শনগত ভিত্তি হলো পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতি ভিত্তিক নয়া-উদারবাদ তথা পুঁজিবাদ। আর, ‘ভিশন-১৯৭১’-এর অন্যতম নীতি-দর্শনগত ভিত্তি হলো সমাজতন্ত্র। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই দুই বিপরীতমুখী নীতি-দর্শনগত দিক নির্দেশনা ও পথ একইসাথে পাশাপাশি অনুসৃত হতে পারে না। একটিকে অনুসরণ করার অর্থ হলো অবধারিতভাবে অপরটিকে পরিত্যাগ করা। আওয়ামী লীগ ও বিএনিপ উভয় দলই ‘ভিশন-১৯৭১’ পরিত্যাগ করে তাদের ‘ভিশন-২০২১’ ও ‘ভিশন-২০৩০’ রচনা করেছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ হলো জাতি ও জনগণের এযাবতকালের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জন। ঐতিহাসিক সে অর্জনই ‘ভিশন-১৯৭১’-এর জন্ম দিয়েছিল। তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্ত ও কোটি-কোটি মানুষের সাহস, বীরত্ব ও আত্মত্যাগের ফসল হলো ‘ভিশন-১৯৭১’। সেই ‘ভিশন-১৯৭১’ বাস্তবায়ন হয়নি। সে ‘ভিশন’ ফেলে দেয়া হয়েছে। বস্তুতঃ তা বাস্তবায়নের সূচনা করার সুযোগ ও সময়ই হয়নি। ‘ভিশন-১৯৭১’ যে বাস্তবায়িত হয়নি সে কথা ভুলে গিয়ে দেশের বুর্জোয়া দলগুলো চার দশক ধরে তার উল্টোপথে হাটছে। বুর্জোয়া শক্তি ও দলগুলো ‘ভিশন-১৯৭১’ কে ভূলুণ্ঠিত করে তার বিপরীতমুখী ধারার ‘ভিশন-২০২১’ এবং ‘ভিশন-২০৩০’ এখন সামনে এনেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত ‘ভিশন-১৯৭১’ হারিয়ে যেতে দেয়া যায় না। বুর্জোয়ারা ‘ভিশন-একাত্তর’কে ভূলুণ্ঠিত করলেও, জনগণ সেই বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নিতে রাজি নয়। একাত্তরে রচিত জনগণের সে স্বপ্ন তথা ‘ভিশনকে’ ধারণ করে এদেশের বামপন্থিরা ঘোষণা দিয়েছে যে, বুর্জোয়ারা ‘ভিশন-একাত্তরের’ পতাকা হাত থেকে ফেলে দিলেও, সেই পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে তারাই এগিয়ে যাবে। এটিই তাদের শপথ। কমিউনিস্ট-বামপন্থিদের ‘ভিশন’ হলো– ‘ভিশন-১৯৭১’। তাই নিঃশঙ্ক চিত্তে ঘোষণা করা যায়– ‘ভিশন-১৯৭১’– এর মৃত্যু নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন