Biplobi Barta

বুধবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৭

মুক্তিযুদ্ধেও যে পতাকা আজ ভূলুন্ঠিত



লেখকঃ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
"সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার" কালজয়ী বাণী নিয়ে ফরাসী দেশের বিকাশমান বুর্জোয়া শ্রেণির নেতৃত্বে ১৭৮৯ সালে ঐতিহাসিক "ফরাসী বিপ্লব" সংগঠিত হয়েছিল। পতন হয়েছিল বাস্তিল দূর্গের। অবসান হয়েছিল সামন্তবাদের। কিন্তু বুর্জোয়ারা অচিরেই সেই বিপ্লবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। "সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার" সেই বাণীকে ও বিপ্লবের পতাকাকে তারা পরিত্যাগ করে ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছিল। প্রায় ১০০ বছর পর সে দেশের শ্রমিক শ্রেণি ঘোষণা দিয়ে বলেছিল- বুর্জোয়াদের পরিত্যাগ করা "সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার" বাণীকে আমরা হাতে তুলে নিলাম, সে পতাকাকে আমরা সর্বহারা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করবো। ১৮৭১ সালে তারা শ্রমিক রাষ্ট্র "প্যারি কমিউন" প্রতিষ্ঠা করে সেই পতাকাকে পুনরায় উড্ডীন করেছিল।
বাংলাদেশে অনেকটা ফরাসী দেশের ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটছে। বুর্জোয়া শ্রেণির নেতৃত্বে "জাতীয়তাবাদ-সমাজতন্ত্র-গণতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতার" বাণী নিয়ে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। দেশে এখনো বুর্জোয়া শ্রেণির শাসন চলছে। কিন্তু শাসক বুর্জোয়া দলগুলো সেই বাণী তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারাকে পরিত্যাগ করে তাকে ধুলায় নামিয়ে দিয়েছে। ভূলন্ঠিত সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারা ও পতাকাকে আবার উড্ডীন করার দায়িত্ব এখন ঐতিহাসিক কারণে এসে পড়েছে এদেশের মেহনতি শ্রেণির ওপর। প্রয়োজন হয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের নতুন আরেক অধ্যায় রচনার।
জাতি হিসেবে এ যাবৎকাল পর্যন্ত আমাদের গৌরব করার মতো যতকিছু আছে, তার মধ্যে শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরের বিজয়ী গৌরবগাঁথা। চার দশকের বেশি অতিবাহিত হওয়ার পরেও জাতি সেই গৌরবের তিলক, বিজয়ের অমূল্য চিহ্ন হৃদয়ে ধারণ করে চলেছে। একাত্তর আমাদেরকে বিজয় দিয়েছে, গৌরব দিয়েছে। সেই বিজয়-গৌরব ম্লান হবার নয়। ম্লান হয় নি কিছুমাত্র।
কিন্তু স্বাধীনতার পঞ্চম দশকে পদার্পণ করার পরেও জাতি আজ কঠিন এক প্রশ্নের সম্মুখীন। একাত্তরের অমূল্য বিজয়ের সেই গৌরবের সুধা কি জাতি ধরে রাখতে পেরেছে? অমূল্য বিজয়ের সেই ফসল কি দেশবাসীর ঘরে ঘরে তুলে দেয়া সম্ভব হয়েছে? এই প্রশ্নের দ্ব্যর্থহীন জবাব হচ্ছে, না! এই না পারার মধ্যেই পরাজয়ের গ্লানি, হতাশার দুঃখবোধ দেশের মানুষকে দংশন করে চলেছে।
এই গ্লানি আর দুঃখবোধের জন্য কিন্তু একাত্তরের বিজয় দায়ী নয়। দায়ী একাত্তর পরবর্তী প্রায় চার দশকের ঘটনাবলী। ইতিহাসের মাপকাঠিতে বিচার করে একথা স্বীকার করে নিতে হয় যে, একাত্তরের অর্জিত বিজয়সম্ভারকে আরো সমৃদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ধারাকে দৃঢ়মূল করা তো দূরের কথা, সে দিনের বিজয় ও সাফল্যগুলোকে পরিপূর্ণভাবে ধরে রাখাটাও সম্ভব হয় নি। আরো এগিয়ে যেতে না পারাটা নিঃসন্দেহে বেদনাবহ, কিন্তু কিছু একটা অর্জনের পরেও তা ধরে রাখতে না পারার গ্লানি ও যন্ত্রণা অপরিসীম। জাতির জন্য এটা একটা কলঙ্ক। সেই কলঙ্ক মোচনের কাজটিই এখনো জাতির সামনে প্রধান কর্তব্য হিসেবে বিরাজ করছে।
একাত্তরের বিজয়ী মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে সংগঠিত হয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠিত ও প্রগতির পথে বিকশিত হওয়ার অমূল্য সুযোগ এনে দিয়েছিল। বিজাতীয় শক্তির ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে আমরা সেদিন যে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, সেই রাষ্ট্রে সাম্য, মৈত্রী, শোষণমুক্তি, শান্তি, স্বাধীনতা ও প্রগতির পথে নবজীবনের সূচনা করার পথ তৈরি হয়েছিল। জাতির সামনে উন্মোচিত হয়েছিল যুগান্তকারী পটপরিবর্তন সাধন করে নবযুগ সূচনার বাস্তব সম্ভাবনা।
বাঙালি জাতির দীর্ঘকালের গণসংগ্রামের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের মরণপণ প্রত্যয় ও দেশবাসীর সম্মিলিত আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে আমরা আমাদের দেশের সংবিধান রচনা করেছিলাম। বাহাত্তরে রচিত সেই সংবিধানে ভাষা ও রূপ পেয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা ও ধারা। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- এই চার নীতিকে ঘোষণা করা হয়েছিল রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে।
ঘোষণা করা হয়েছিল যে, এই চারটি নীতির ভিত্তিতেই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে।
আত্মশক্তির উপর দাঁড়িয়ে স্বাধীন জাতীয় বিকাশের ধারায় দেশকে এগিয়ে নেয়ার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে "জাতীয়তাবাদ"-কে অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। সেই জাতীয়তাবাদের প্রত্যয়ের মাঝে ছিল গভীর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী উপাদান। যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে, যার ঔপনিবেশিক ধরনের শোষণ-শাসনের জিঞ্জির ভেঙে আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলাম, সেই পাকিস্তান ছিল আমেরিকাসহ বিশ্বসাম্রাজ্যবাদের পদলেহী একটি রাষ্ট্র। সাম্রাজ্যবাদ তার "ভাগ কর-শাসন কর" নীতি অনুযায়ী সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে, ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে, প্রতিক্রিয়াশীল দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ করে পাকিস্তানের সৃষ্টি সম্ভব করে তুলেছিল। এই কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্মের আগে থেকেই "পাকিস্তান আন্দোলন"- এর জন্ম দেয়া হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্রমূলক খেলার একটি অংশ হিসেবে। রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর সেই পাকিস্তান রাষ্ট্র হয়ে উঠেছিল সাম্রাজ্যবাদের ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-সামরিক আধিপত্যবাদী স্ট্র্যাটাজির একটি প্রধান হাতিয়ার। সিয়াটো, সেন্টো ও বিভিন্ন পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বদৌলতে পাকিস্তান হয়ে উঠেছিল বিশ্বের এই অঞ্চলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একটি সামরিক ও রাজনৈতিক আউটপোস্ট। পাকিস্তান পরিণত হয়েছিল মার্কিন ও সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির অবাধ শোষণের লীলাক্ষেত্রে।
অনেকদিন পর্যন্ত বুর্জোয়া-জাতীয়তাবাদী কোনো কোনো রাজনৈতিক মহল এমন একটি ভ্রান্তি ও মোহে আচ্ছন্ন ছিল যে, সাম্রাজ্যবাদী প্রভুর কাছে তদবির ও দেন-দরবার করে বাঙালির স্বাধিকার আদায় করে নেয়া যাবে। যেভাবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের তোয়াজ করে ও তাদের ষড়যন্ত্রের সহযোগী হয়ে ভারত ভেঙে আদায় করা সম্ভব হয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তানের বাস্তবতাই ছিল এমনই যে, তাকে নিয়ে বেচা-কেনা করার সুযোগ সাম্রাজ্যবাদের ছিল না। তাই দেন-দরবারে কাজ হয় নি। স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র তুলে নিতে হয়েছিল। পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটির পাশাপাশি একই সাথে প্রতিপক্ষ হিসেবে লড়াই করতে হয়েছিল আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। সাম্রাজ্যবাদের কাছে পদানত, নতজানু, নির্ভরশীল ও অনুগত হয়ে চলার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সংঘাতে গিয়ে, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে, সেই শক্তিকে পরাভূত করেই বিজয় ছিনিয়ে আনতে হয়েছিল। একাত্তরের সংগ্রাম পরিণত হয়েছিল বাঙালি জাতির সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়-মুক্তির সংগ্রামে। এই জাতীয় মুক্তির অন্তর্নিহিত মর্মবাণীকে অবলম্বন করেই মুক্তিযুদ্ধের "জাতীয়তাবাদকে" অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি রূপে সংবিধানে সন্নিবেশিত করা হয়েছিল।
জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সে পথেই শুরু হয়েছিল নবপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যাত্রা। কিন্তু বুর্জোয়া শাসকদল ছিল এই নীতি ধরে দেশকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে দুর্বল ও দোদুল্যমান চরিত্রের। তাতেও সাম্রাজ্যবাদ নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে এই নীতি ও পথ সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করে উল্টো পথে যাত্রা শুরু করা হয়েছিল। দেশকে বিশ্বসাম্রাজ্যবাদের স্বার্থের সাথে বেঁধে ফেলে এদেশকে সাম্রাজ্যবাদনির্ভর একটি রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারার পরিপন্থী সেই ভ্রান্ত পথ ধরেই আজও দেশ অগ্রসর হচ্ছে। দেশের প্রধান বুর্জোয়া দলগুলো সাম্রাজ্যবাদের পদলেহনে পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা করছে।
পাকিস্তান ছিল সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারী-একনায়কত্ববাদী ব্যবস্থায় পরিচালিত একটি রাষ্ট্র। ভাষার অধিকার, সার্বজনীন ভোটাধিকার, নির্বাচিত সরকার দ্বারা দেশ পরিচালনা করার অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মৌলিক নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহের গ্যারান্টি- পাকিস্তানে এসব ছিল নির্বাসিত। সত্তরের নির্বাচনের গণরায়কে কার্যকর হতে যখন বাঁধা দেয়া হলো, তখনই গর্জে উঠেছিল বাংলাদেশ। নির্বাচনের গণরায় বাস্তবায়নের প্রয়োজনেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হয়েছিল। পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসন পদ্ধতির অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক সমাজ ও শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ। মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহের অলঙ্ঘনীয় নিশ্চয়তা, আইনের শাসন, নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন ও পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থা, পূর্ণ কর্তৃত্ববান নির্বাচিত স্বশাসিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, ভূমি সংস্কার, সকল নাগরিকের জন্য অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসা-বাসস্থানের নিশ্চয়তা, বৈষম্যের অবসান ইত্যাদি নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রকৃত গণতন্ত্রায়নের পথে সুনির্দিষ্ট নীতি ও পদক্ষেপের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল সংবিধানে। সেসব ব্যবস্থার আলোকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি রূপে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল "গণতন্ত্র"।
কিন্তু গণতন্ত্রের ভিত্তিমূল সুদৃঢ় করার প্রয়াসে শুরু থেকেই ছিল দুর্বলতা। আর, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতায় যে পরিবর্তন ঘটানো হয়, তারপরে কয়েক দফায় চলেছে সরাসরি কিংবা বেসামরিক লেবাসে সামরিক বাহিনীর শাসন-কর্তৃত্ব। বছরের পর বছর ধরে লালিত হয়েছে স্বৈরাচারের অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ভিত্তি। নব্বইতে রক্ত দিয়ে সামরিক স্বৈরশাসন উচ্ছেদ করে নির্বাচিত বেসামরিক সরকার ও পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের ধারা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলেও গণতন্ত্র নিরঙ্কুশ করা সম্ভব হয় নি। স্বৈরাচারের অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ভিত্তির মূল উপাদানগুলো এখনো বহাল রাখা হয়েছে। চলছে লুটপাটের অর্থনীতি, লুটের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে সংঘাত, অপরাধমূলক কুৎসিত সব অপরাজনীতির খেলা, রাজনীতিতে নমিনেশন বাণিজ্য-টাকার খেলা-ক্যাডার লালন ইত্যাদির রোগাক্রান্ত দাপট এবং সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের আধিপত্য। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা এখনো দূর হয় নি। গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো ক্রমাগত খর্বিত হচ্ছে। বুর্জোয়া দলগুলোর হাতে গণতন্ত্র নিরাপদ নয়। সর্বত্র চলছে নৈরাজ্য। "অস্থিতিশীলতা"ই এখনো হয়ে রয়েছে জাতীয় জীবনের সবচেয়ে স্থিতিশীল বৈশিষ্ট্য।
পাকিস্তানি আমল থেকেই দেশবাসীকে সংগ্রাম করতে হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উদ্ভট পাকিস্তানি মতাদর্শের বিরুদ্ধে। বাঙালি জাতির নিজস্ব জাতীয় আত্মপরিচয়ের উপলব্ধি ও জাতিগত জাগরণের মধ্য দিয়ে এই উপলব্ধি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ধর্ম আলাদা-আলাদা হলেও জাতি হিসেবে পরিচয় প্রায় সর্বাংশেরই এক, তা হলো বাঙালি। তাই বাঙালির জাতি-রাষ্ট্রে ধর্ম পরিচয়ের ভিত্তিতে নাগরিক অধিকারকে বিভাজিত করার কোনো সুযোগ থাকতে পারে না। এই নীতিরই স্বাভাবিক আরেকটি প্রত্যয় হলো- এদেশের আদিবাসীরাসহ সব জাতি-বর্ণ নৃগোষ্ঠীগত পরিচয় নির্বিশেষে সব নাগরিকরা সমান মর্যাদাসম্পন্ন। হিন্দু-মুসলমান, আমির-ফকির, বাঙালি-আদিবাসী নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সামনে সব নাগরিকই সমান অধিকার ও মর্যাদা সম্পন্ন। "ধর্ম যার-যার, কিন্তু রাষ্ট্র সবার" -এই নীতি নিয়ে বহুকাল ধরে সংগ্রাম হয়েছে। এটাই রাষ্ট্রনীতিতে ধর্ম নিরপেক্ষতা বলে পরিচিত। পাকিস্তানের মতো ধর্মভিত্তিক, সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি অনুসরণ করে দেশ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয় নি। পাকিস্তানি আদর্শে রচিত দ্বিখন্ডিত এক "বাংলাস্থান"রূপী নব্য পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য শহীদরা বুকের রক্ত ঢালে নি। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যয় ছিল স্পষ্ট। স্বাধীন বাংলাদেশ চলবে অসাম্প্রদায়িক ধারায়। সেই অনুসারে সংবিধানে অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয় "ধর্মনিরপেক্ষতা"-কে।
কিন্তু সে পথে দেশের অগ্রগতি নিশ্চিত করা হয়নি। পঁচাত্তরের পর সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, পাকিস্তানি ভাবাদর্শ প্রভৃতিকে রাষ্ট্রীয় নীতি ও কাজকর্মে প্রবেশ করানো হয়েছে। শুধু সাম্প্রদায়িক অপশক্তিই নয়, উগ্র ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদী কালোশক্তিকেও ভিত রচনার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতাকে ভিত্তি করে বিপজ্জনক অন্ধকারের কালোশক্তির থাবার বিস্তারই কেবল ঘটেনি, সাম্প্রদায়িক মনোভাব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রসারিত হয়েছে। কয়েকটি বুর্জোয়া দল তাদেরকে মদত দিচ্ছে এবং সাম্প্রদায়িকতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এই বিপদের বিরুদ্ধে সুদৃঢ় রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনায় বুর্জোয়া শ্রেণি ও তাদের অন্যান্য দলগুলো ব্যর্থ। জনগণের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-প্রগতিবাদী চেতনা সৃষ্টির জন্য ভাবাদর্শগত ও সাংস্কৃতিক-সামাজিক আন্দোলন পরিচালনার কাজের ক্ষেত্রেও তারা ব্যর্থ।
পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিল সাম্রাজ্যবাদ, একচেটিয়া পুঁজি ও সামন্তবাদের নিয়ন্ত্রিত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় পরিচালিত। পূর্ব বাংলায় ধ্রুপদী সামন্তবাদের অস্তিত্ব সে সময়কালে ততটা না থাকলেও, সামন্তবাদের অবশেষ হিসেবে নানা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। সাধারণ মানুষ জাতিগত শোষণের পাশাপাশি শ্রেণিগত শোষণে নিষ্পেষিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধ তাই জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার জন সংগ্রামের পাশাপাশি হয়ে উঠেছিল বাংলার শোষিত মানুষের অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার লড়াই। মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষের অংশগ্রহণই ছিল প্রশ্নাতীতভাবে প্রধান। শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে সাম্যের সমাজ নির্মাণের সংগ্রাম এদেশে পরিচালিত হচ্ছিল বহু বছর ধরে। সমাজতন্ত্র হয়ে উঠেছিল জনপ্রিয় স্লোগান। পাকিস্তানের পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করে সমাজতন্ত্রের ধারায় স্বাধীন দেশকে গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে পরিচালিত হয়েছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সংবিধানে তাই অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল "সমাজতন্ত্র"।
সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ করার পাশাপাশি, দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কোন্ ধরনের নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে তারও বিস্তারিত নির্দেশনা সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। এ বিষয়ে কয়েকটি উদ্ধৃতি দিলেই দেশের অর্থনৈতিক নীতি-ব্যবস্থা সম্পর্কে সাংবিধানিক নির্দেশনা স্পষ্ট হবে। সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের "রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি" প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, "মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত, ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজলাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।" মালিকানা সম্পর্কে বলা হয়েছে,- "উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বণ্টন প্রণালীসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন জনগণ এবং এই উদ্দেশ্যে মালিকানা-ব্যবস্থা নিম্নরূপ হইবে; (ক) রাষ্ট্রীয় মালিকানা, অর্থাৎ অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান প্রধান ক্ষেত্র লইয়া সুষ্ঠু ও গতিশীল রাষ্ট্রায়ত্ত সরকারি খাত সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের মালিকানা; (খ) সমবায়ী মালিকানা, অর্থাৎ আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে সমবায়সমূহের সদস্যদের পক্ষে সমবায়সমূহের মালিকানা এবং (গ) ব্যক্তিগত মালিকানা, অর্থাৎ আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে ব্যক্তির মালিকানা।" লক্ষণীয় যে, সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাকে প্রাধান্য দিয়ে সমবায়ী ও ব্যক্তি মালিকানাকে আইনের দ্বারা সীমাবদ্ধকৃত অবশিষ্টাংশ (residual)- হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। তার পরপরই বলা হয়েছে যে, "রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে- কৃষক ও শ্রমিককে- এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি প্রদান করা।" কর্মসংস্থান ও কর্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে, "কর্ম হইতেছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয় এবং "প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী"- এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।" উল্লেখ্য যে, এখানে "প্রত্যেকের নিকট হইতে... কর্মানুযায়ী" কোটেশনের উদ্ধৃত অংশটি মার্কস-এঙ্গেলস রচিত "কমিউনিস্ট ইশতেহার" থেকে হুবহু উদ্ধৃত করা হয়েছে। এই সংবিধানে আরো বলা হয়েছে, "রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং ... নাগরিকদের জন্য ... (ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা।"
পঁচাত্তরে পর এইসব নীতি পরিত্যাগ করে অবাধ মুক্তবাজার নীতির ভিত্তিতে সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর লুটেরা পুঁজিবাদের পথ গ্রহণ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি - উভয় বুর্জোয়া দলই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারা বিরোধী এই অর্থনৈতিক দর্শন অনুসরণ করে চলছে। উভয় বুর্জোয়া দলের সরকারের সেই ধারাতেই অর্থনীতি চলছে।
"৭২-এর সংবিধান বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফসল। আর মুক্তিযুদ্ধ ছিল দীর্ঘ দু"যুগের সংগ্রামের ফসল। বাঙালি জাতির দীর্ঘ সংগ্রামের সমগ্র চেতনা ও ধারার নির্যাস হলো "৭২-এর সংবিধান। এ সংবিধান কোনো রাজনৈতিক লেনদেন, গোপন শলাপরামর্শ অথবা সুযোগ-সুবিধার বিবেচনা থেকে প্রণীত হয় নি। এই সংবিধান গণমানুষের সংগ্রামের অমোঘ শক্তি এবং ইতিহাসের গতিপথের মিলিত রূপ। "৭২-এর সংবিধান বাংলার মানুষের ঐক্যের প্রতীক। বাংলার মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার সামগ্রিকতাকে ধারণ করেই এই সংবিধান রচিত হয়েছে। এটার একটি অখন্ড রাজনৈতিক চরিত্র রয়েছে। আর এই সংবিধানের মর্মবাণী নিহিত রয়েছে চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, তথা- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম-নিরপেক্ষতার মধ্যে। এই চার নীতিকে কোনোভাবেই খন্ডিত করে আংশিকভাবে গ্রহণ করার সুযোগ নেই।
রাষ্ট্রীয় চার নীতিকে পরিত্যাগ করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারা থেকে বিপথে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই চার নীতির ধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনাটাই বর্তমানে জাতির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং কর্তব্য। দৃঢ়তা ও নির্ভেজাল প্রত্যয়ের সাথে সেই কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়েই সোনার বাংলা গড়ার পথে দেশকে এগিয়ে নেয়া ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ফসল ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হতে পারে।
একথা আজ প্রমাণিত যে দেশের বুর্জোয়া শ্রেণি ও তাদের রাজনৈতিক দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারাকে কার্যত: পরিত্যাগ করেছে। বড় দুুটি বুর্জোয়া দলের নেতৃত্বই লুটেরা-বুর্জোয়াদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারা বহন করার ক্ষমতা তাদের আর নেই। কিন্তু, লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত সেই কালজয়ী চেতনা-ধারা নিঃশেষ হবার নয়। তাহলে, বুর্জোয়ারা যে চেতনা-ধারাকে, যে "পতাকাকে" ভূলুণ্ঠিত করেছে তাকে আজ উর্ধ্বে তুলে ধরার স্বক্ষমতা রাখে কোন শ্রেণি? যে শ্রেণি হলো দেশের মেহনতি শ্রেণি। এই ঐতিহাসিক উপলব্ধি ধারণ করে শ্রমিক শ্রেণি ও মেহনতি মানুষদের রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকান্ড জোরদার করা আজ বিশেষ জরুরি হয়ে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অজেয় পতাকার ভবিষ্যত এখন প্রধানত তাদের হাতে।
(২৪।৮।২০১৪)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন