লেখকঃ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি
ডানহাত ও বামহাত যদি পরস্পরের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হয় তা হলে দেহের সর্বনাশ অনিবার্য। বিচার বিভাগ এবং আইন ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে সম্পর্ক হলো রাষ্ট্রের ডানহাত-বামহাতের মতো। এদের মধ্যে বিবাদ চলতে থাকলে তা দেশের জন্য বিপজ্জনক। দেশ এখন তেমনই এক বিপদের মুখে। এ বিবাদকে যেভাবে তীব্র করে তোলা হচ্ছে তা গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে উঠেছে। সরকারের উচিত বিবাদে উস্কানি না দিয়ে এখনই তা বন্ধ করা।
দেশের শীর্ষ আদালতের একটি রায়কে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রধান বিচারপতি ও হাইকোর্টের আপিল বিভাগকে (সুপ্রিমকোর্ট) নিয়ে যেসব ভিত্তিহীন বৈরী প্রোপাগান্ডা, উত্তেজনাপূর্ণ কথাবার্তা ও উত্তপ্ত আচরণে লিপ্ত হয়েছে তা উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। কোর্টের এই রায়কে তারা তাদের মধ্যকার ‘গদির দ্বন্দ্বের’ বিষয়বস্তুতে পরিণত করেছে। এই রায়ের ফলে, ‘এই বুঝি তার গদি গেল’ ভেবে আওয়ামী লীগ সুপ্রিমকোর্টের বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধংদেহি আচরণ চালাচ্ছে। অন্যদিকে এই রায়ে তাদের ‘ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম হয়েছে’ ভেবে সরকারকে বরখাস্ত করার জন্য বিএনপি সুপ্রিমকোর্টের কাছে ‘আবদার’ করেছে। এভাবে দেশের ‘বিচার বিভাগের’ সঙ্গে ‘আইন বিভাগ’ ও ‘নির্বাহী বিভাগের’ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের এক নাজুক পরিস্থিতি জন্ম নিয়েছে। এই অবস্থা যে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক অগ্রগতির জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, সে বোধটুকুও এ দল দুটির লোপ পেয়েছে বলে আশঙ্কা হয়।
তাদের পরিকল্পনা ও পছন্দসই ‘রায়’ না দেওয়ায় তারা বিভিন্ন বানানো তথ্য ও ভুলভাবে উদ্ধৃত করাসহ নানা নোংরা পথে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার চরিত্র হননের প্রচেষ্টাও চালাচ্ছে এবং হুমকি-ধমকি দিয়ে তাকে নতি স্বীকার করাতে চাইছে। রায় বাতিলের জন্য বেঁধে দেওয়া সময় পার হয়ে যাওয়ায় তারা এখন প্রধান বিচারপতির অপসারণের এক দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে। আক্রমণকে ‘উইচ হান্টিং’-এর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট ঘেরাও করে তাদের দাবি আদায় করা হবে বলেও তারা হুমকি দিয়ে রেখেছে। এভাবে হুমকি দিয়ে পছন্দসই রায় আদায় করার প্রচেষ্টা হলো আইনের
শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সংবিধানের নির্লজ্জ বরখেলাপ। এটি হলো আদালতের বিরুদ্ধে
একটি বিদ্রোহ করার মতো ঘটনা। এ অবস্থায় ওৎপেতে থাকা ষড়যন্ত্রের শক্তি সুযোগ নিতে পারে, এমন আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়েছে।
দেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা আছে। তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউই তা কখনই বাস্তবায়ন করেনি। ক্ষমতায় থাকাকালে তারা উভয়ই বিচার বিভাগকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বে রাখার জন্য সব সময় সচেষ্ট থেকেছে। আর যখন তারা বিরোধী দলে থেকেছে তখনই কেবল তারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সপক্ষে মিথ্যা বুলি কপচেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় তারা কখনই বিশ্বস্ত ছিল না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি প্রভৃতি লুটেরা-বুর্জোয়ার স্বার্থরক্ষাকারী দলগুলো যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রদানে অক্ষম, চার দশকের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা সে কথাই প্রমাণ করছ বস্তুত এ হলো আমাদের দেশের প্রচলিত বুর্জোয়া রাজনীতির দেউলিয়াপনারই অভিপ্রকাশ । সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা কার হাতে থাকবে, তা নিয়েই বিবাদ। এটি কি সংসদের হাতে থাকবে, নাকি তা ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের’ হাতে থাকবেÑ বিতর্ক তা নিয়ে। ’৭২-এর সংবিধানে এই ক্ষমতা ছিল সংসদের হাতে। বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে তার উদ্যোগেই, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল। পরে জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে তা ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের’ কাছে অর্পণ করেন। ২০১৪ সালে সুপ্রিমকোর্টের রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করা হলেও বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের’ হাতেই রেখে দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে তা আবার সংসদের কাছে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এই পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে মামলা করা হলে হাইকোর্ট সে বিষয়ে যে বিভক্ত রায় দেন, চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য তা সুপ্রিমকোর্টে আসে। ৭ জন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিমকোর্টের ফুল বেঞ্চ এ বিষয়ে শুনানি শেষে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে যে রায় দিয়েছেন, সেই রায় নিয়েই ক্ষমতাসীনরা প্রশ্ন তুলেছে ও বিতর্কে লিপ্ত হয়ে হুমকি-ধমকি দেওয়া শুরু করেছে।
আমি আইনবিদ নই, সংবিধান বিশেষজ্ঞ তো নই-ই। তথাপি রাজনীতির জ্ঞান থেকে সুপ্রিমকোর্টের এই রায় নিয়ে সামান্য দু-একটি বিষয় এখানে তুলে ধরব। আদালতের অন্যান্য সব রায়ের মতো ষোড়শ সংশোধনী সম্পর্কিত সুপ্রিমকোর্টের রায়েরও দুটি অংশ আছে। এর মধ্যে একটি হলো তার সিদ্ধান্তমূলক অংশ। এই সিদ্ধান্তাংশ হলো নির্দেশমূলক। রায়ের আরেকটি অংশ হলো আদালতের পর্যবেক্ষণ। কোন কোন বিবেচনার ভিত্তিতে আদালত তার সিদ্ধান্তে উপনীত হলো, পর্যবেক্ষণে তার বিবরণ বর্ণিত থাকে। সিদ্ধান্তমূলক অংশ মেনে চলা বাধ্যতামূলক। পর্যবেক্ষণাংশের সব কথা মেনে নেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। তা নিয়ে প্রকাশ্যে বিতর্ক করা যেতে পারে, প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। কিন্তু রায় প্রত্যাহার বা পরিবর্তন করার জন্য চাপ বা হুমকি দেওয়া কিংবা শিষ্টাচারবহির্ভূত হুমকিমূলক বিষোদ্গার করা একটি অপরাধ। অথচ ক্ষমতাসীন মহল এই অন্যায় ও বেআইনি কাজে লিপ্ত হয়েছে। এসব গর্হিত কর্মকা-ের মাত্রা তারা বাড়িয়েই চলছে। সরকারের এরূপ কর্মকা- তার আরেক দফা ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করার তাগিদ থেকেই পরিচালিত হচ্ছে বলে মানুষ মনে করে।
সুপ্রিমকোর্ট তার প্রদত্ত রায়ের সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতে গিয়ে জাতির যৌথ প্রজ্ঞা বা ‘কালেকটিভ উইসডম’, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও তার চেতনাধারা, সংবিধানের প্রস্তাবনা অধ্যায়ের গুরুত্ব, সেখানে ‘আমি’র বদলে ‘আমরা’ দিয়ে লেখা শুরু হওয়ার তাৎপর্য, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার গুরুত্ব, তা কেন সংবিধানের মূল কাঠামোগত ভিত্তির অংশ, জনগণই যে প্রজাতন্ত্রের ক্ষমতার মালিক, চূড়ান্ত সার্বভৌমত্ব যে একমাত্র জনগণের হাতেই ন্যস্ত, রাষ্ট্রের তিনটি মূল বিভাগের সার্বভৌম ক্ষমতার আপেক্ষিকতা এবং তাদের ক্ষমতার এখতিয়ার ও শক্তির ভারসাম্যমূলক আন্তঃসম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় রায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।
ক্ষমতাসীনরা রায়ের বিরোধিতা করার পেছনে তাদের যুক্তি উপস্থিত করার চেষ্টা করেছেন। তাদের যুক্তি হলো, অন্য সবার ক্ষেত্রে যেমন, তেমনই বিচারপতিদেরও জবাবদিহিতার একটি ব্যবস্থা থাকা উচিত। সেই জবাবদিহিতার উপযুক্ত স্থান হলো জাতীয় সংসদ। কারণ জাতীয় সংসদই হলো জনগণ দ্বারা নির্বাচিত সদস্যদের সংস্থা। সে কারণে সেটিই হলো সর্বোচ্চ সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী। তাই বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতেই ন্যস্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। তা ছাড়া ’৭২-এর সংবিধানে এই ব্যবস্থাই বহাল ছিল। তাই তদনুসারে পাস হওয়া ষোড়শ সংশোধনী বহাল রাখাই যুক্তিযুক্ত। তাদের প্রথম যুক্তির প্রসঙ্গে এ কথাটি তারা ভুলে গেছেন যে, সংবিধানমতে একমাত্র জনগণের সার্বভৌমত্বই হলো চূড়ান্ত। আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের ভারসাম্যপূর্ণ কাজের মাধ্যমেই তা তারা প্রয়োগ করতে পারে। কোনো একটি বিভাগ অন্যটির ঊর্ধ্বে স্থান নয়। অন্যদিকে এ কথাটিও তারা আড়াল করে রাখেন যে, বঙ্গবন্ধু নিজেই চতুর্থ সংশোধনী দ্বারা বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদ থেকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করেছিলেন। তাদের দ্বিতীয় যুক্তি প্রসঙ্গে এ কথা মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করার সময় বর্তমান ক্ষমতাসীনরাই রাষ্ট্রধর্ম প্রসঙ্গ, ৩৮ অনুচ্ছেদ ইত্যাদিসহ ’৭২-এর সংবিধানের কিছু কিছু অংশ নিজেরাই পরিবর্তন করেছিলেন।
ক্ষমতাসীনদের নানাবিধ যুক্তি নাকচ করে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরা বিস্তারিত আলোচনা, ব্যাখ্যা, দৃষ্টান্ত ও উদ্ধৃতি দিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ রচনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট যে যুক্তির ধারা তুলে ধরেছেন তা হলো অনেকটা এ রকমÑ (১) বাংলাদেশের সংবিধান একটি লিখিত সংবিধান হওয়ায় তার আক্ষরিক অনুসরণ বাধ্যতামূলক। (২) সংবিধানের শুরুতে লিপিবদ্ধ থাকা প্রস্তাবনাটি হলো সংবিধানের মূল ভিত্তি। এই মূল ভিত্তিকে অগ্রাহ্য করে সম্পাদিত কোনো সাংবিধানিক সংশোধনী বৈধ নয়। (৩) ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’Ñ এই মর্মে ৭ অনুচ্ছেদ মোতাবেক প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌম কর্তৃত্বের চূড়ান্ত অধিকারী হলো জনগণ। তার সেই সার্বভৌমত্ব কার্যকর হওয়ার কথা রাষ্ট্রের তিনটি পরস্পর পরিপূরক বিভাগ তথা আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব প্রয়োগসহ সংবিধানে বর্ণিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিধানসমূহ কার্যকর করার মাধ্যমে। (৪) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অলঙ্ঘনীয় এবং তা সংবিধানের মূল চরিত্র ও কাঠামোর অংশ। (৫) বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। কিন্তু সে ব্যবস্থা এমন হতে হবে যাতে করে তার দ্বারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কোনোক্রমে ক্ষুণœ না হয়। (৬) আমাদের দেশের সংসদীয় ইতিহাসে জনপ্রতিনিধিত্বশীলতার শর্ত পূরণের দিক থেকে অধিকাংশ সময়ে সংসদগুলো ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি ‘ক্ষমতালোভীরা দুবার (দুটি সামরিক সরকারের আমলে) আমাদের রাষ্ট্রকে ‘ব্যানানা রিপাবলিকে’ পরিণত করেছিল।... তারা নানারকম ধোঁকাবাজির আশ্রয় নিয়েছে। কখনো ভোটের নামে, কখনো জোরপূর্বক নির্বাচনের মাধ্যমে, কখনো নির্বাচন না করে।... এসব অগণতান্ত্রিক শাসনামলের নোংরা রাজনীতির চর্চা আমাদের সার্বিক রাজনীতির মারাত্মক ক্ষতি করেছে। Ñ[রায় থেকে উদ্ধৃতি]। (৭) সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বহাল থাকার কারণে জনপ্রতিনিধিরা তাদের নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের মতানুসারে অভিমত দেওয়ার বদলে দলের নির্দেশানুসারে অভিমত প্রদানে বাধ্য থাকেন। (৮) এসব কারণে বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা সংসদের হাতে থাকলে তা ক্ষমতাসীন দল ও তার প্রধান নেতার দ্বারা প্রভাবিত হবে। ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণœ হবে। (৯) তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণœ রেখেই তার জবাবদিহিতার জন্য ভিন্নতর (রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিপরিষদ, সংসদ ইত্যাদির ক্ষেত্রে যে ব্যবস্থা আছে তা থেকে ভিন্নতর) ব্যবস্থা করা আবশ্যক। সে ক্ষেত্রে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের’ কাছে জবাবদিহিতার এবং তার হাতে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা ন্যস্ত হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।
যুক্তির এই ধারাবাহিকতার আলোকে সুপ্রিমকোর্ট ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে তার চূড়ান্ত রায় প্রদান করেছে। সেই সঙ্গে বিচারকদের ‘কোড অব কনডাক্ট’ বা আচরণবিধিও সে অনুমোদন করেছে। এই রায়ের ফলে বিচার বিভাগের পক্ষে নির্বাহী ও আইন বিভাগের হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে বিচার বিভাগের স্বাধীন পদচারণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রসার ঘটানো সম্ভব হবে। ক্ষমতাসীনদের আপত্তি আসলে ঠিক এখানেই। কারণ তা তাদের আরেক দফা ক্ষমতায় থাকার পথে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারে।
ক্ষমতাসীনরা তুমুল হইচই তুলে অভিযোগ করে চলেছে যে, রায়ের পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাকে খাটো করে দেখিয়ে তার অবমাননা করা হয়েছে। পুরো রায়টি পাঠ করে আমি কিন্তু কোথাও এর বিন্দুমাত্র সত্যতা খুঁজে পেলাম না। বঙ্গবন্ধু যে ‘জাতির পিতা’ ও ‘তার নেতৃত্বেই যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে’ এসব কথা একাধিক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধ আখ্যায়িত করে সেখানে জনগণের ভূমিকা ও ‘ফাউন্ডিং ফাদার্সদের’ ভূমিকা বর্ণনা করা হয়েছে। ‘ফাউন্ডিং ফাদার্স’ আর ‘ফাদার অব দি নেশন’ এক অর্থ বহন করে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুধু ৯ মাসের ব্যাপার ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের কালপর্ব হলো দীর্ঘকালীন। সেই সুদীর্ঘ কালপর্বে বিভিন্ন ব্যক্তির ভূমিকার স্বীকৃতি দিলে তার দ্বারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব-ভূমিকাকে কোনোভাবেই খাটো করা হয়Ñ এমন ভাবা কোনোক্রমেই সঠিক নয়। ক্ষমতাসীনদের আরেকটি অভিযোগ হলো, পর্যবেক্ষণে জাতীয় সংসদ ও সাংসদদের মর্যাদা হরণ করে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বেশি কথা বলার প্রয়োজন হয় না। দেশের রাষ্ট্রপতি স্বয়ং সংসদ ও সাংসদদের সম্পর্কে যেসব মন্তব্য একাধিকবার করেছেন, পর্যবেক্ষণে সেসবের চেয়ে বরং কমই বলা হয়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের মূল দুটি অভিযোগই যুক্তিহীন।
সুপ্রিমকোর্টের এই রায়ের বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের কোনো ভিন্নমত থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনিভাবে ‘রিভিউ’ চাওয়ার সুযোগ আছে। সে পথ গ্রহণ না করে উচ্চ আদালত ও প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধংদেহি বাক্যবাণ প্রয়োগ, হুমকি প্রদান ও আচরণ করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অপরদিকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণের অন্যতম নায়ক বিএনপির পক্ষ থেকে রায়ে উল্লাস প্রকাশ করে সরকারকে ‘বরখাস্ত’ করার জন্য সুপ্রিমকোর্টের কাছে ‘আবদার’ করাও দুরভিসন্ধিমূলক। প্রকৃতভাবে এসবই হলো তাদের ‘ক্ষমতার খেলার’ অংশ।
ষোড়শ সংশোধনী সম্পর্কে সুপ্রিমকোর্টের রায় নিয়ে আরও অনেক কথা আলোচনার আছে। স্থানাভাবে সেগুলো এখানে যুক্ত করা গেল না। সুযোগ পেলে বারান্তরে লেখা যাবে। তবে দুশ্চিন্তা হিসেবে এখনো যা রয়ে গেল তা হলোÑ বিচার বিভাগ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এই ক্ষমতার খেলা দেশের জন্য বড় রকম বিপদ ডেকে আনতে পারে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন