- স্বাক্ষাৎকারে কমরেড
জসিম উদ্দিন মণ্ডল
উপমহাদেশের অন্যতম
প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, স্বদেশি আন্দোলন
করেছেন। ছেচল্লিশের ভয়াবহ দাঙ্গায় পাঁচ হাজার মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন। জ্যোতি
বসুর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। ১৭ বছর জেল খাটা এই
বিপ্লবী নেতার মুখোমুখি হয়েছেন ওমর শাহেদ। ছবি তুলেছেন কাকলী প্রধান
।।এই সমাজ ভাঙিতেই হইব।।
আপনার রাজনীতির শুরু কত
বছর বয়সে?
কলকাতায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে ১০-১১ বছর বয়সে
আমার কমিউনিস্ট জীবন শুরু। বাবার চাকরিসূত্রে তখন আমরা কলকাতায় নারিকেলডাঙা রেল
কলোনিতে থাকতাম। বাবা রেলওয়ের টালি ক্লার্ক ছিলেন। কলোনির চারদিক ছোট প্রাচীর ঘেরা
ছিল। বন্ধুবান্ধবরা সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রায়ই প্রাচীরের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে
গল্পগুজব করতাম। তখন তো হিন্দু-মুসলমান প্রশ্ন ছিল না, সবাই অসাম্প্রদায়িক
ছিলেন। আমরা দেখতাম, মিছিল
যাচ্ছে, মিছিলকারীরা
নানা স্লোগান দিচ্ছে। স্লোগানগুলো ভালো লাগত। কমিউনিস্ট পার্টির মিছিল গেলে দেখতাম, ওদের স্লোগানগুলো অন্য
পার্টির চেয়ে আলাদা। সেগুলো আরো ভালো লাগত। আমরা চার-পাঁচজন মিলে বলাবলি করতাম, চল তো মনুমেন্টের নিচে
গিয়ে শুনি ওরা কী বলে? ওখানে
ওরা আমাদের এ সমাজ ভাঙার কথা বলত।
কেন
ভাঙতে হবে সে ব্যাখ্যা দিয়ে বলত, পৃথিবীতে দুটি শ্রেণি—একটি ধনী, অন্যটি গরিব। গরিবের
সংখ্যাই বেশি। এরাই সব তৈরি করে; কিন্তু এদেরই খাবার
জোটে না। আমি তো গরিব লোকের ছেলে, প্যান্টুলেনে তালি দিয়ে
পরতে হয়। আমি বলতাম, কথাগুলো
তো ঠিকই বলে। এদের রাজত্ব কবে হবে?
তখন ভারতীয় কমিউনিস্ট
পার্টির অবস্থা কেমন ছিল?
আমি
কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম দিকের সদস্য। তখন বড়লোক, মধ্যবিত্ত, আমাদের মতো গরিবের
ছেলেও পার্টিতে যেত। পার্টিতে যেসব জোতদার, জমিদার, তালুকদারের ছেলে-মেয়েরা
আসতেন, তাঁরাও
মহাত্যাগী ছিলেন। তাঁরা আজকের নেতাকর্মীর মতো ছিলেন না। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির
প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজাফ্ফর আহমদের কথাবার্তা, হাবভাব, চলাফেরা দেখে অভিভূত
হয়ে যেতাম। মানুষ এত ভালো কী করে হয়? তিনি সবাইকে ‘আপনি’ করে বলতেন। তিনি কাউকে ‘তুমি’ বলতে পারতেন না।
ল্যাংটা ছেলেকেও ‘আপনি’ বলতেন। একটি বিস্কুটও
একলা খেতে পারতেন না। ভাগ করে খেতেন। মফস্বল থেকে কেউ পার্টি অফিসে এলে আপনার
এলাকায় পার্টি কেমন আছে, পার্টি
কেন শক্তিশালী হচ্ছে না—এসব
কথা তাঁর ছিল না। তিনি বলতেন, ‘বউ ভালো আছে? আপনি ভালো আছেন? ছেলে-মেয়ে ভালো আছে? ওদের জামাকাপড় আছে তো? ঘরে খুঁটি আছে? বৈশাখী ঝড়ে চাল উড়ে
যাবে না তো?’ এসব কথা এখন ভাবা যায়?
গান্ধী, নেহরু, আবুল কালাম আজাদ
বক্তৃতায় কমিউনিস্টদের কথা কিছু বলতেন?
মহাত্মা
গান্ধী, জওয়াহেরলাল
নেহরুর সঙ্গে মওলানা আবুল কালাম আজাদের বক্তৃতার অনেক তফাত ছিল। গান্ধী, নেহরু মার্ক্সবাদ
সম্পর্কে একটি শব্দও বলতেন না। তবে আবুল কালাম আজাদ তাঁর বক্তৃতায় যা-ই বলতেন না
কেন, মার্ক্সবাদের
কথা এক-আধবার উল্লেখ করতেন। নিশ্চয়ই মার্ক্সবাদ তাঁর পছন্দ ছিল।
ব্রিটিশবিরোধী
আন্দোলনের স্মৃতি মনে আছে?
তখন
কলকাতা থেকেই তো সব আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করা হতো। এ আন্দোলনের সব কথা তো মনে
নেই। সে কী আজকের কথা? ৮৫
বছর আগের কথা (হাসি)। যাঁরা এই আন্দোলন করতেন, তাঁরা পোস্টার লাগাতে
বললেই আমরা সব দলেরই পোস্টার লাগাতাম। তাঁরা হয়তো বলতেন, ধর্মতলায় পোস্টার
লাগাবে। আমরা ধর্মতলার দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে বিপ্লবীদের সাহায্য করতাম।
পুলিশ তাড়া করলে, কোনো
বাড়ির মধ্যে গেলে, বাড়ির
বউরাও তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে বলতেন, ‘এই খোকা কোথায় যাস? তোরা কারা?’ বলতাম, ‘আমরা স্বদেশি। ’ ‘ও পুলিশ তাড়া করেছে?’
‘হ্যাঁ।
’ ‘ঢোক, ঢোক চৌকির নিচে’ বলে চৌকির নিচে ঢুকিয়ে
তাঁরা চৌকির ওপর বসে থাকতেন।
বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন?
দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধে আমি সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়েছি। ১৯৪০ সালে রেলে আমার চাকরি হয়। দ্বিতীয়
মহাযুদ্ধে আমার কাঁধে লেখা ছিল ‘আইই (ইন্ডিয়ান ইঞ্জিনিয়ার্স)’। মুম্বাই, মাদ্রাজসহ বিভিন্ন
বন্দর থেকে যেসব কামান, বারুদের
গাড়ি আসত, সেগুলো
ট্রেনে আসামে পৌঁছে দিতাম। ট্রেনের ইঞ্জিনের বয়লারে কয়লা ভরতাম। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫
সাল পর্যন্ত যুদ্ধে সব রকমের সাহায্য করেছি। পার্টি থেকে তখন বলেছিল, কোনো রেস্ট পাওয়া যাবে
না। বোমের গাড়ি, কামানের
গাড়ি পৌঁছাতেই হবে। পৌঁছে দিয়েছি।
ভারতীয় কমিউনিস্ট
পার্টির সদস্য হয়েছিলেন কবে?
১৯৪০
সালে। আমাদের রেল শ্রমিকদের ইউনিয়নের নাম ছিল ‘রেল রোড ওয়ার্কার্স
ইউনিয়ন’।
তখন ‘টাকা’ নয়, ‘আনি’ চালু ছিল। মাসে এক, দুই, চার পয়সা চাঁদা দিতাম।
মার্ক্সবাদের ক্লাস করতাম। আমরা প্রশ্ন করতাম, তাঁরা ব্যাখ্যা করতেন।
তখন বুঝলাম, কমিউনিস্ট
পার্টি গরিব লোকের, যাঁরা
উত্পাদন করেন তাঁদের পার্টি এবং তাঁরাই পৃথিবীর মালিক। আমি এখনো কমিউনিস্ট আছি এ
কারণে যে এই পার্টি ছাড়া অন্য কোনো পার্টি দিয়ে বিপ্লব হবে না।
পার্টি করা কলোনির
লোকেরা কিভাবে দেখতেন?
কলোনির
লোকেরা ঠাট্টা করতেন, এরা
বলে ব্রিটিশ খেদাবে! এরা বলে ধনী উচ্ছেদ করবে! কিন্তু লাল ঝাণ্ডা যে সাচ্চা লোকদের
পার্টি এটাও তাঁরা বলতেন। তাঁরা জানতেন, এই পার্টিতে এমন সব
সেলাক আছেন, যা
অন্য কোনো পার্টিতে নেই। তবে মা-বাবা কিছু বলতেন না।
অনেক বিখ্যাত কমিউনিস্ট
নেতার সান্নিধ্যে এসেছেন।
কমরেড
আবদুল হালিম পরে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে স্পিকার হয়েছিলেন। তিনি গরিবের ছেলে ছিলেন।
সুকান্ত ভট্টাচার্য আমার খুব প্রিয় কবি। ওকে আমি খুব স্নেহ করতাম। সে পার্টি অফিসে
আসত। খুব নম্র, ভদ্র, নিরীহ ছেলে ছিল। আমি
খালি বলতাম, ‘তুমি বলে কবিতা লেখো? তুমি বলে কবি?’ সে মাথা ঝাঁকিয়ে, মুখ লজ্জায় বাঁকা করে
ফেলত আর বলত, ‘না, না, আমি কোনো কবিতা লিখি
না। ’ ও
মারা গেলে আমি খুব কেঁদেছিলাম। পিসি জোশি তখন কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি ছিলেন।
বড় লোকের সন্তান হলেও তিনি পার্টিতে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। খোকা রায়, ইলা মিত্রের সঙ্গেও
পার্টি করেছি। ইলা মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে হলেও জমিদারের বউ ছিল। সে একেবারে সাঁওতাল
হয়ে থাকত, তারা
তাকে ‘দেবী’ মনে করত। সে এত সিম্পল
ছিল যে ভাবা যায় না। মোহাম্মদ ফরহাদ খুব ডেডিকেটেড, পণ্ডিত লোক ছিল। রেল
রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি বীরেন দাশগুপ্ত খুব ভালো, সত্, অমায়িক লোক ছিলেন। রেল
রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জ্যোতি বসু।
তাঁর পক্ষে আপনি
নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছিলেন।
১৯৪৬
সালে পার্বতীপুরে পার্টির হয়ে আমি জ্যোতি বসুর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা
চালিয়েছিলাম। আমাদের বিপক্ষে মুসলিম লীগের হুমায়ূন কবীর দাঁড়িয়েছিলেন। নির্বাচনের
দিন মুসলিম লীগওয়ালারা আমাদের প্ল্যাটফর্মেই উঠতে দিচ্ছিল না। লাল ঝাণ্ডার যত লোক
ছিলাম, আমরা
যাওয়ার পর মুসলিম লীগাররা তাড়া করে এলো। আমরাও রেডি হয়ে গিয়েছিলাম, মুসলিম লীগের গুণ্ডারা
এলে মারামারি করব। শ্রমিকদের মারামারি তো ভদ্রলোকেরা কল্পনাও করতে পারবে না।
পার্বতীপুরের রামরতন কট্টর কমিউনিস্ট বিহারি ছিল। আমি খুব ডানপিটে ছিলাম। আমরা
১৫-১৬ জন, আমার
ও রামরতনের হাতে লোহার রড। এখনো আমার মাথায় দাগ আছে (দাগ দেখিয়ে)—মাথায় লোহার রড দিয়ে
বাড়ি মেরেছিল। আমরাও এলোপাতাড়ি মারামারি করে মুসলিম লীগওলাদের ধানের মাঠে ফেলে
দিয়ে এলাম। জ্যোতিদা জিতেছিলেন। তিনি আমার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন। রাজনীতি শেখাতেন, মার্ক্সবাদ পড়াতেন।
আমরা একসঙ্গে ওঠাবসা করতাম। তিনি খুব ভালো লোক ছিলেন।
রেলে কোন পদে যোগ
দিয়েছিলেন?
খালাসি, বেতন ১৩ টাকা। ইঞ্জিনের
ছাই, ময়লা
ইঞ্জিনের সিমেন্টের কংক্রিটের গর্তে পড়ে থাকত। আমরা পাঁচ বা ১০ জন গর্তে নেমে শাবল
দিয়ে ময়লাগুলো ওপরে তুলে দিতাম। ওপরে দাঁড়িয়ে অন্যরা সেগুলো ঝুড়ি ভর্তি করে খাদের
মধ্যে ফেলত। খালাসি থেকে ফায়ারম্যান হলাম। তখন কাজ ছিল বয়লারে কয়লা ভরা। ১৯৪৯ সালে
দেশের খাদ্য পরিস্থিতির চরম সংকটের সময় আমাদের কেনা চাল মিলিটারি ট্রেন থেকে
নামিয়ে নিয়ে গেল। বললাম, চাল
ফেরত না দিলে ধর্মঘট। এরপর তারা লিখিত দিয়েছিল—রেলের কর্মচারীরা চাল
আনা-নেওয়া করতে পারবে। কিন্তু আমাকে সাসপেন্ড করা হলো। পরে খুদের আন্দোলনে আমরা
পাঁচ-ছয়জন আসাম মেইল ঠেকিয়ে দিলাম। আবার সাসপেন্ড করল। এত বড় নামকরা ট্রেন ঠেকিয়ে
দেওয়ায় আমাদের নামে ‘ওয়ারেন্ট’ বেরোলো। আট মাস পালিয়ে
থাকার পর ধরা পড়লাম। আমাদের জেলে নিয়ে গেল। আমার সঙ্গের খালাসি ‘দেলোয়ার’ পরে রাজশাহী জেলের
খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছে। শুরু হলো জেলজীবন, চাকরি গেল।
পরে সংসার চালিয়েছেন
কিভাবে?
সেলিনা
বানু, রাজশাহীর
মুসলিম লীগের একচ্ছত্র নেতা মাদার বকশ, মোক্তার আতাউর রহমানরা
সাহায্য করতেন। পার্টির পাবনা জেলার সেক্রেটারি অমূল্য লাহিড়ীর অনেক জমিজমা ছিল।
জমি বিক্রি করে তিনি পার্টি চালাতেন। এভাবে চলত।
ছেচল্লিশের দাঙ্গায়
বীরের ভূমিকা পালন করেছিলেন।
দাঙ্গার
মধ্যে শিয়ালদহ থেকে রানাঘাটের উদ্দেশে ট্রেন ছাড়লাম। মানুষের ভীষণ চাপাচাপিতে
ট্রেনের মধ্যেই পাঁচ-সাতটি ছেলে মারা গেল। তার মধ্যেই পাঁচ-সাতটি মেয়ে এসে উঠে
পড়ল। ট্রেনের ড্রাইভার ছিল অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ‘ভিভি’। সে বলল, ‘এরা যে উঠল, যাবে কী করে?’ বললাম, ‘এরা তো জীবনের ভয়েই
ইঞ্জিনরুমে উঠে পড়েছে, কিন্তু
বয়লারের মহা আগুন তো দেখেনি। ’ সে বলল, ‘নামাব কী করে?’ বললাম, ‘দেখি। ’ ওদের বললাম, ‘যদি রাজি থাকো রানাঘাট
পর্যন্ত উপুড় হয়ে থাকতে হবে। ’ তারা বলল, ‘তুমি যেভাবে বলবে
সেভাবে থাকব। আমরা কলকাতায় ফিরে যেতে পারব না। ’ তারা উপুড় হয়ে থাকল।
আমিও ইঞ্জিনে কয়লা দিতে থাকলাম। বয়লার যখন খুলেছি, মেয়েগুলো ঘামে স্নান
করে ফেলেছে। তারা বলল, ‘আর কত দূর?’ বললাম, ‘এই তো ঘণ্টাখানেক। ’ আমাদের কাছে মেসেজ ছিল—কোনো জায়গায় দাঁড়াবে
না। সব লাইন ক্লিয়ার, সোজা
চলে যাবে। ড্রাইভার বলল, ‘মণ্ডল কত স্পিডে যাব?’ বললাম, ৪২। আমরা যাচ্ছি।
ব্যারাকপুরে গাড়িতে বোম মারল। তারপর লাইনের মধ্যে লাল কাপড় দিল। লাল কাপড় মানে ‘ডেঞ্জার’। তাহলে আমরা দাঁড়াব, তারা দাঙ্গা করবে।
ট্রেনের হুইসেল বাজছে, তাও
তারা লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার বলল, ‘মণ্ডল এখন কী করবে?’ বললাম, ‘এরা ৫০০ আর আমার ট্রেনে
পাঁচ হাজার মানুষ আছে। ৫০০ মারব, না পাঁচ হাজারকে বাঁচাব? ওদের ওপর দিয়েই যাব। ’ ড্রাইভার পানির পাইপ
খুলে দিল। হুসহুস শব্দ হচ্ছে। তাও রায়টওয়ালারা যায় না, মিছিল সরে না। তারা হাত
তুলছে। তখন ড্রাইভার বলল, ‘এই স্পিডে যাবে?’ বললাম, ‘না, স্পিড আরো দুই বেল
বাড়িয়ে দিব। ’ ৪২-এ
আসছিলাম, ৪৪
করে দিলাম। বয়লারে ডাবল কয়লা দিয়ে ইঞ্জিনের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছি—তারা অবাক হয়ে দেখছে, ট্রেন থামছে না। অনেকে
এদিক-ওদিক লাফ দিল। তবে ভয়ংকর দাঙ্গাবাজরা লাইনের মধ্যেই থাকল। আমরা তাদের চষে, ডলে, হাড়-হাড্ডি গুঁড়ো করে
চলে গেলাম। পরে ইঞ্জিনের বয়লারে মাংস লেগে থাকতে দেখেছি। তখন কত দাঙ্গাবাজ
মারা গেছে, সে
হদিস এখন পর্যন্ত হয়নি।
দেশভাগের পরে ঈশ্বরদী
চলে এলেন কেন?
বাবা
ঈশ্বরদীতে চাকরি করতেন। তিনি ওখানে বাড়ি বানিয়েছিলেন। তবে আমার পৈতৃক বাড়ি
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানায়। তখন আমি রেলে ফায়ারম্যান। কত মাইল গিয়েছি, কত মাইল এসেছি, তার ওপর বেতন নির্ভর
করত। কখনো ৪০, কখনো
মাসে ৫০ টাকা বেতন হতো। ঈশ্বরদীতে তো অনেক বিহারি আছে। তারা বুঝেছিল, আমরা না বুঝে
পাকিস্তানে এসেছি। আমাদের না পাকিস্তানওলারা দেখছে, না ভারতীয়রা। এই লোকটি
বিহারির পক্ষেও না, বাঙালির
পক্ষেও না। লোকটি নিরপেক্ষ, সবার
ভালো চায়। তাদের মধ্যে অনেকে পার্টি করত। ফলে রাজনীতি করতে অসুবিধা হয়নি।
সেখানে আপনার
সহায়-সম্পদ আছে?
আমার
নিজের কিছু নেই। তবে এখন মেয়েরা বাড়িঘর বানিয়েছে। আমার পাঁচ মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ে
সালেহা বেগম মনার জামাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিল।
তার নাম ইদ্রিস আলী। সে মারা গেছে। মেয়ে সাভারে বাড়ি বানিয়ে পাঁচ ছেলে-মেয়ে নিয়ে
থাকে। মেজো মেয়ে আলেয়া বেগম পান্নার জামাই হাতেম আলী মাস্টার খুলনা জুট মিলে চাকরি
করত। সে খুব জনপ্রিয় শ্রমিক নেতা ছিল। কমিউনিস্ট পার্টি করত। বন্দুকওয়ালাদের সঙ্গে
বিপ্লব করতে গিয়েছিল। তাদের সবাইকে বলেছিলাম, ‘পাঁচ ইঞ্চি রিভলবার
দিয়ে যারা মেশিনগানের মোকাবেলা করতে যায়, তারা পাগল। ’ আবদুল হক খুব ত্যাগী
কমিউনিস্ট ছিল। সে দেখল, এভাবে
ঘরে বসে থেকে, বিপ্লবী
কথা বলে বিপ্লব হবে না। মানুষের কাছে যেতে হবে। সে কলকাতা থেকে কিছু রিভলবার কিনে
দল বানাল। পরে সেই লাইন বাদ দিয়ে হাতেম আলী মাস্টার আবার কমিউনিস্ট পার্টিতে
এসেছে। দক্ষিণবঙ্গের পাটকলগুলোতে সব ট্রেড ইউনিয়ন সে করেছে। আমিও শ্রমিক নেতা
ছিলাম। কিন্তু সে এত জনপ্রিয় ছিল যে তার ধারে-কাছে যেতে পারিনি। সে এত সহজ, সরল ছিল যে শ্রমিকদের
কাছ থেকে ‘মাস্টার’ উপাধি পেয়েছিল। এটি
বাংলাদেশে খুব বিরল। সে মুসাবিদা খুব ভালো করত। ভালো দরখাস্ত লিখতে পারত। ১৯৯২
সালে অসুস্থ হয়ে সে খুলনার আড়াই শ বেডের হাসপাতালে মারা গেছে। সেই মেয়ের ঘরে ছয়
নাতি, তিন
নাতনি আছে। সেজো মেয়ে আফরোজা বেগম মীনার জামাই আহসান হাবিব লিংকন এরশাদের আমলে
একবার জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য হয়েছিল। পরে কাজী জাফর গ্রুপে ছিল। এখন আনোয়ার
হোসেন মঞ্জুর দল করে। তারা কুষ্টিয়ায় থাকে। তাদের অনেক সহায়-সম্পত্তি আছে। এর পরের
মেয়ে বিলকিস বেগম বিলুর স্বামী ফজলুর রহমান হান্টু একবার ঈশ্বরদী পৌরসভার
কাউন্সিলর হয়েছিল। এখন ব্যবসা করে। তার এক ছেলে, এক মেয়ে। এর পরের মেয়ে
আলোর স্বামী স্ট্রোকে মারা গেছে। সে আমার সঙ্গে থাকে। আমাকে সেজো মেয়ে আর ছোট মেয়ে
দেখাশোনা করে। বাম রাজনীতি করে বলে মেয়েদের নেতাদের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছি। ৫০ বছর আগে
তো প্রায় সবাই সত্ নেতা ছিল। তারাও সত্ নেতা ছিল। আমার একমাত্র ছেলে রবিউল আলম
ক্যান্সারে মারা গেছে।
খুদবিরোধী আন্দোলনটি
কিভাবে করেছিলেন?
১৯৪৯
সালের এই আন্দোলন এক দিনে তৈরি হয়নি। জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে শ্রমিকরা এ আন্দোলনে
এসেছেন। দক্ষিণবঙ্গের সীমান্ত যশোর থেকে ভারতের চিলাহাটির হলদেবাড়ি—পুরো এলাকায় আমি
আন্দোলন অর্গানাইজ করেছিলাম। সে জন্য কাজে যেতাম না। বারবার সাসপেন্ড হতাম। আমি
বলতাম, ‘তোমরা বলতে সাধের পাকিস্তান হলে, মুসলমানদের পাকিস্তান
হলে, আল্লাহ
চালাবে, ফেরেশতারা
দেখবে, মানুষের
সুখের সীমা থাকবে না; তো
একচোটে খুদে নেমে গেলে? খুদ
তো মুরগি খায়। এটা মানুষকে খাওয়াবে?’ খুদ রান্না করলে গন্ধ
হতো। এসব কারণে শ্রমিকদের বউয়েরা ব্যাপক সাড়া দিয়েছিলেন। ফলে স্ট্রাইক হলো। আমাকে
সাসপেন্ড করল। আট মাস লুকিয়ে থাকার পরে গ্রেপ্তার করে পাবনা জেলে নিয়ে গেল। জেলে
গিয়ে দেখলাম, ঘানি
টানায়। আমি বললাম, ‘ঘানি গরু ঘোরায়, মানুষ দিয়ে ঘোরানো যাবে
না। আমি ঘানি ঘোরাতে পারব না। ’ জেলে সরকারের দালাল
গফুর বলল, ‘হারামজাদা শুয়োরের বাচ্চা, শালা, তুমি বড় নেতা হয়ে এসেছ? ওসব নেতা গফুরের কাছে
চলবে না। ঘানি টানতেই হবে। ’ যেই না সে কথাটি বলল, শালকাঠের খাটের ওপর বসে
ছিলাম, পায়া
তুলে গফুরের দিকে তেড়ে গেলাম। দু-তিনজন আমাকে ঠেকিয়ে বলল, ‘মারামারি করবেন না, আরো বিপদ হবে। ’ গফুর ভয়ে ঘানিঘর থেকে
দৌড়ে সিপাইদের কাছে গিয়ে বলল, ‘মণ্ডল আমাকে মারতে
আসছে। সে ঘানি ঘুরাবে না। ’ এর
মধ্যে হুইসেল, পাগলা
ঘণ্টা বেজে গেল। দুই-তিন শ সিপাই চারদিক থেকে আমাকে ঘিরে ফেলল। ঘিরেই যখন ফেলল, মনে হলো, শালার ঘানি ভেঙে দিই।
খাটের পায়া দিয়ে ঘানিতে বাড়ি দিলাম। চায়না লোহার ঘানি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
পর পর তিনটি ঘানি ভেঙে ফেললাম। পরে সেলে নিয়ে গিয়ে আমাকে ন্যাংটা করে রাখল। যাতে
কারো সঙ্গে মিশতে না পারি। ভাত দিল, খেলাম না। বললাম, আমার বিচার না হওয়া
পর্যন্ত খাব না। পর পর তিন দিন না খেয়ে থাকলাম। ওরা মাঘ মাসের শীতে সেলের মধ্যে
পানি ঢেলে দিল। আমি উলঙ্গ, শুয়ে
আছি। এর মধ্যে ‘কই, জসিম উদ্দিন কই’ বলে জেলা প্রশাসক এলেন।
সেলের রেলিং ধরে দাঁড়ানো আমাকে দেখে তিনি খেপে বোম হয়ে বললেন, ‘জেলার সাহেব ওকে উলঙ্গ
কে করেছে? কেন
করলেন?’ আমি বললাম, ‘ডিসি সাহেব, আপনি ওখানে গেলে হবে
না। আগে আমার কথা শুনবেন। তারপর খাব। ’ তিনি বললেন, ‘সব কথা শুনব। আগে
কাপড়চোপড় পরেন, খান।
শিগগির তাঁর কাপড় নিয়ে আসো। ’ তিন-চারজন মিলে
জোরজবরদস্তি করে কাপড় পরাল। এরপর তিনি বললেন, ‘কী নালিশ?’ বললাম, ‘বন্দিদের দিয়ে ঘানি
ঘোরানো যাবে না। সকালের ছোলা সিদ্ধে পোকা থাকে। সেটি খাওয়ানো চলবে না। চার ছটাক
চালের ভাতে পেট ভরে না। ছয় ছটাক দিতে হবে। এই জমাদার আমাদের দুই হাঁটুর মধ্যে হাত
ঢোকাতে বাধ্য করে কাঁধের নিচে ডাণ্ডা দিয়ে ঘুঘুর ফাঁদ বানিয়ে রাখে। এসব করা যাবে
না। ’ পরে
সব বন্ধ হলো। তবে আমাকে রাজশাহী জেলে পাঠিয়ে দিল।
সেখানে খাপড়া ওয়ার্ডে
গুলি চালানো বিলের সঙ্গে কী হয়েছিল?
খাপড়া
ওয়ার্ডের শহীদরা তো সব মহা দেশপ্রেমিক। অতি সত্, ত্যাগী। না হলে জানালা, দরজা বন্ধ করতে গিয়ে
ওভাবে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান জেল সুপার বিলের নির্দেশে চালানো গুলিতে কেউ অকাতরে গুলি
খেয়ে মারা যায়? এ
রকম উদাহরণ পৃথিবীতে নেই, বাংলাদেশেও
নেই। জেলে নতুন কয়েদি এলে জমাদাররা বিলের কাছে নিয়ে গিয়ে তাকে সালাম করাত। আমি
বললাম, ‘জমাদার, বিল জেলখানায় সাত
কমিউনিস্টকে গুলি করে মেরেছে। আমি কিন্তু বিলকে সালাম করতে পারব না। ’ তারা বলল, ‘করতেই হবে। ’ আমাকে জোর করে নিয়ে
গেল। বিল এসে আমি হাত তুলছি কি না সে অফিসরুম থেকে দেখল। সালাম দিলাম না। সে আমাকে
ডাণ্ডাবেড়ি, হাত
পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে রাখাসহ কত যে শাস্তি দিয়েছিল। তা-ও গলাতে পারেনি। পরে
আমাকে রাজবন্দি ওয়ার্ডে নিল।
ফ্যামিলি অ্যালাউন্স
কিভাবে আদায় করলেন?
একদিন
দেখি, জেলের
ভেতরে সাড়া পড়ে গেছে। আমাদের সেলগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে। দালানকোঠায় চুনকামের বহর, নতুন এক সেট পোশাক দেখে
সন্দেহ হলো। খবর নিয়ে জানলাম, গভর্নর নুরুল আমিন ও
মন্ত্রী আজিজ আহমদ খান আসছেন। তাঁরা রাজবন্দিদের সঙ্গে আলাপ করতে এলে আমরা
ফ্যামিলি অ্যালাউন্সের দাবি তুললাম। বললাম, আমাদের বিনা বিচারে আটক
রাখা হয়েছে। তাই এই সময় চলার জন্য পরিবারগুলোকে ফ্যামিলি অ্যালাউন্স দিতে হবে।
আজিজ আহমদ খানকে আমি আলাদাভাবে এই দাবির কথা বললে তিনি বিবেচনা করবেন বলে আশ্বাস
দিলেন। তাঁরা জানতেন, না
হলে আমি গোলমাল করব। আমি তো সারা জীবন সব জায়গায় প্রতিবাদ করেছি। আজও, এখনো বিশ্বাস করি, মার্ক্সবাদ, মার্ক্সবাদের অঙ্ক
সঠিক। আমি কাটারিভোগ তৈরি করব, সেটি আমার ছেলে-মেয়ে, আমি খেতে পারব না? আমার কপালে নেই? এ কথা আমি এখনো বিশ্বাস
করি না। অতএব, এই
ধনতান্ত্রিক সিস্টেম আর বরদাশত করা যাবে না। এই সমাজ আমাকে ‘ভাঙিতেই হইবে’। পরে বিনা বিচারে আটক
বন্দিদের পরিবারগুলোকে ১৫০ টাকা করে ফ্যামিলি অ্যালাউন্স দেওয়ার ব্যবস্থা করা
হয়েছিল।
জেল থেকে বেরিয়ে
পাকিস্তানের যোগাযোগমন্ত্রীকে কিভাবে ঘেরাও করেছিলেন?
মুসলিম
লীগের মন্ত্রী আবদুর রব নিশতার সৈয়দপুরে রেল কারখানা দেখতে গিয়েছিলেন। আমরা
শ্রমিকরাও গেলাম। তিনি বললেন, ‘কী ব্যাপার?’ কথাবার্তার পর বললেন, ‘এদের বহু চাহিদা, এখন কথা বলার সময় নেই।
চলে যাব। ’ এই
কথা শুনে সামাদ নামের লাল ঝাণ্ডার এক শ্রমিক তাঁর রেলের কম্পাউন্ডে উঠে ট্রেন জোড়া
লাগানোর আংটা কেটে দিল। পার্বতীপুর যাওয়ার জন্য যখন ইঞ্জিন চালু করল, গোটা ট্রেন পড়ে রইল।
হৈহৈ শুরু হলো। কর্মকর্তারা মন্ত্রীকে বললেন, ‘আপনার ট্রেন শ্রমিকরা
কেটে রেখেছে। কিভাবে যাবেন?’ তখন মন্ত্রী বললেন, ‘ঠিক আছে, শ্রমিকদের কথা শুনব। ’ পরে আমাদের রেশনে খুদের
বদলে চাল দেওয়া হলো।
১৯৫৪ সালে জেল
খেটেছিলেন কেন?
আমাকে
৯২-এর ক-ধারায় গ্রেপ্তার করেছিল। রাজশাহী, ঢাকা জেলে ছিলাম। খুব
কষ্টে কেটেছে। ঢাকা জেলে সত্যেন সেন, নগেন সরকার, শহীদুল্লাহ কায়সারের
সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এসব লোকের সঙ্গে আমি জেল খেটেছি। তাঁদের কাছ থেকে শিখেছি।
তাঁরা আমাদের পড়াতেন। সত্যেনদা, নগেনদা আমার গুরু। খুব
সত্, খুব
ভালো লোক ছিলেন। ঢাকা জেলের ২৬ নম্বর সেলেই তো সত্যেনদা উদীচীর জন্ম দিলেন। আমি
রোজ বলতাম, ‘দাদা, এ দেশের মানুষ গান খুব
পছন্দ করে। মুকুন্দ দাসের মতো একটি গানের দল না বানাতে পারলে এ দেশে বিপ্লব হবে
না। ’ রণেশদা
(দাশগুপ্ত), সত্যেনদা
বসে আলাপ করে এক দিন বললেন, ‘হ্যাঁ গানের দল হবে। কী নাম হবে?’ আমরা কত কী নাম বললাম।
একদিন সকালে উঠে তাঁরা বললেন, নাম হবে ‘উদীচী’। মানে পূর্ব দিক থেকে
আলোর উদয় হয়। জেল থেকে বেরোনোর পর তাঁরা দল তৈরি করলেন।
পাকিস্তান আমলে
কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়ে গেলে কিভাবে ছিলেন?
নানা
জায়গায় পালিয়ে ছিলাম। না খেয়ে থাকতে হতো। সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, ঈশ্বরদীর গ্রামে গ্রামে
আজ এই বাড়ি, কাল
ওই বাড়িতে থেকেছি। তখন মনি সিংদের সঙ্গে যোগাযোগ হতো।
জিয়াউর রহমানের আমলেও
তো জেল খেটেছেন?
তার
নীতি সমর্থন করিনি বলে দুই বছর জেল খাটাল। ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, কুষ্টিয়া জেলে ছিলাম।
এরশাদও সামরিক শাসন সমর্থন করিনি বলে জেলে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পালিয়ে ছিলাম বলে
ধরতে পারেনি।
মুক্তিযুদ্ধের জীবন?
আমরা
তো পাকিস্তানের জন্মই স্বীকার করিনি। আমার স্ত্রী, ছেলে-মেয়েরা সবাই
মুক্তিযোদ্ধা। এই কারণে যুদ্ধের সময় পুরো ঈশ্বরদীতে কোনো বাড়ি পোড়েনি অথচ আমার
বাড়ি পুড়িয়ে খুঁটি পর্যন্ত তুলে নিয়ে গিয়েছিল। বাড়ির চিহ্নই ছিল না। পরে সেই জমি
বিক্রি করে খেয়েছি। আমরা কুষ্টিয়া-পাবনা সেক্টরে গেরিলা বাহিনীতে কুষ্টিয়ার
কমিউনিস্ট জাহিদ রুমীর অধীনে যুদ্ধ করেছি। আমাদের কাজ ছিল—দেশের ভেতরে যাওয়া ও
যুদ্ধের জন্য ছেলেদের জোগাড় করা, যারা সীমান্তের ভেতরে
বউ, ছেলে-মেয়ে
নিয়ে আছে, তাদের
দেখভাল করা। ভারতে ট্রেনিং নেওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের দেশে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেওয়া।
গ্রামগুলোতে আমাদের অনেক নিরাপদ ঘাঁটি ছিল। জলপাইগুড়ি, দিনহাটাসহ সব সীমান্তে
আমি ঘুরে বেড়াতাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় গোটা ভারতের অর্ধেক চষে আমি, ইন্দ্রজিত্ গুপ্ত, রণেশ মিত্র, ইলা মিত্রের কাজই ছিল
মুক্তিযোদ্ধাদের অর্গানাইজ করা। কে কোথায় ট্রেনিং নিয়ে এসেছে, ক্যাম্পে জায়গা হচ্ছে
কি না সব দেখাশোনা করা। আমার দুই মেয়েকে জ্যোতি বসু মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে কাজ
দিয়েছিলেন। অথচ আমার মেয়েরা কেউ মুক্তিযোদ্ধার সনদ পায়নি।
কিভাবে চলেন?
মুক্তিযোদ্ধার
ফান্ডে। আমি রাজনীতি করে টাকা-পয়সা বানাইনি। টাকা বানাতে পারতাম, বানানো জানি। কিন্তু
মার্ক্সবাদ, শ্রেণি, শ্রেণিসংগ্রাম বিশ্বাস
করি। আমি জানি, গরিবকে
না মারলে বড়লোক হওয়া যায় না। সারা জীবন, এখনো এটি হাড়ে হাড়ে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিলিয়ে
দেখেছি। তবে আমার এই রাজনীতির কারণে পরিবারের অনেক কষ্ট হয়েছে। ১৭ বছর জেল খেটেছি।
তবু স্ত্রী সরেনি। স্ত্রী সাহায্য না করলে কারো বাপের ক্ষমতা নেই রাজনীতি করে।
ঢাকামুখী রাজনীতি
করেননি কেন?
আমি
এখন কমিউনিস্ট পার্টির উপদেষ্টা। যে কথা আমরা ঢাকায় বলি, সেটি যদি গ্রামে না
নিয়ে যাই, আমতলা, বাঁশতলা, কাঁঠালগাছের নিচে, হাটে, ঘাটে, মাঠে, গ্রামের মানুষের কাছে
না নিয়ে যাই, তাহলে
কিভাবে হবে? সে
জন্য ঢাকায় আসতে চাইনি। আমার কথা হলো, পার্টিকে গ্রামে নিতে
হবে। এখন তারা যাচ্ছে।
এত ভালো বক্তৃতা কিভাবে
দেন?
সিক্স
পর্যন্ত পড়েছি। তবে মার্ক্সবাদ শুনে, পড়ে শিখেছি। তা ছাড়া
মানুষের সঙ্গে মিশি। আমার বক্তৃতা গরিবরা বেশি শোনে। কারণ গরিব যে ভাষায় শুনতে চায়, সেই ভাষা আমি জানি। ওই
জীবনযাপন করি, ওভাবে
চলাফেরা করি।
সবচেয়ে প্রবীণ
কমিউনিস্ট হিসেবে কোনো স্বপ্ন?
আমি
তো ব্রিটিশ, সাধের
পাকিস্তান, বাংলাদেশও
দেখলাম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার দেখলাম। সব তো একই। পরিবর্তন তো দেখছি না। ব্রিটিশ, পাকিস্তান, বাংলাদেশওলা—সবাই তো একই কথা বলে।
ফলে স্বপ্ন
একটাই—সমাজতন্ত্র।
সমাজতন্ত্র হবেই।
(২৫
আগস্ট, ২০১৭ দৈনিক কালেরকন্ঠ প্রকাশিত)