Biplobi Barta

বৃহস্পতিবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৭

গণহত্যা বন্ধ এবং রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে হবে

মায়ানমার রাষ্ট্র কর্তৃক নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চলমান জাতিগত গণহত্যার প্রতিবাদে ৩১ আগস্ট ২০১৭ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ-এর মানববন্ধন চলাকালে অনুষ্ঠিত সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেছেন, অবিলম্বে চলমান গণহত্যা বন্ধ করে রোহিঙ্গাদের মায়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। জাতিসত্তার সকল অধিকারসহ শরণার্থীদের নিজ ভ‚মিতে পুনর্বাসন করতে হবে। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মহলকে সোচ্চার হতে হবে এবং রোহিঙ্গা-সংহতিতে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে হবে।
বাসদ-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন সিপিবি’র সাধারণ সম্পাদক কমরেড মো. শাহ আলম, বাসদ-এর কেন্দ্রীয় নেতা কমরেড বজলুর রশিদ ফিরোজ, সিপিবি’র কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ কমরেড মাহাবুবুল আলম প্রমুখ। সমাবেশ পরিচালনা করেন সিপিবি’র সহকারী সাধারণ সম্পাদক কমরেড কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন।
কমরেড খালেকুজ্জামান বলেন, সাম্রাজ্যবাদ ও আঞ্চলিক আধিপত্যকারী শক্তিসমূহের মদদ ও উসকানিতে মায়ানমার রাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিপীড়ন চালিয়ে আসছে। গত কয়েকদিন ধরে আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরোচিত হামলা, নির্যাতন, বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা চালাচ্ছে সে দেশের সরকারের মদতপুষ্ট সেনাবাহিনী। আমরা এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। হাজার হাজার নারী-শিশু-বৃদ্ধ জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে, যা বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটকে আরো নাজুক করে তুলেছে।
তিনি বাংলাদেশ সরকারের ভ‚মিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং শরণার্থী সংকট মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ সরকারের উচিত ক‚টনৈতিক পদক্ষেপ জোরদার করা। তা না করে সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে যৌথ সামরিক অভিযানের প্রস্তাব দিয়েছে। সরকারের এ প্রস্তাব নিন্দনীয়। এ পদক্ষেপ চলমান জাতিগত নিপীড়ন ও গণহত্যায় প্রচ্ছন্ন মদদ জোগাবে।
সমাবেশে কমরেড মো. শাহ আলম বলেন, বর্বর হামলার ফলে লাখ লাখ রোহিঙ্গার জীবনে নেমে এসেছে চরম মানবিক বিপর্যয়। রোহিঙ্গা সমস্যা মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও, তার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের ওপর। জীবন বাঁচাতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং পড়বে। আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে হবে। একই সঙ্গে জাতিসংঘের উদ্যোগে গঠিত কফি আনান কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়নে মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বঙ্গোপসাগর উপক‚লকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদী ও আঞ্চলিক আধিপত্যকারী শক্তিসমূহের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকটকে পুঁজি করে কোনো সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যাতে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার সুযোগ না পায়, সেদিকেও সকলকে সতর্ক থাকতে হবে।

সারাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ কর

টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে নারী ধর্ষণ ও হত্যকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং সারাদেশে অব্যাহত নারী-শিশু ধর্ষণ হত্যার ঘটনায় সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতার প্রতিবাদে কমিউনিস্ট পার্টি নারী সেল এবং সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের উদ্যোগে ৩১ আগস্ট ২০১৭ প্রেসক্লাবে দুপুর ১২টায় বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নারী সেলের আহবায়ক লক্ষ্মী চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে এবং সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শম্পা বসুর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক ও নারী সেলের নেত্রী জলি তালুকদার, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের উপদেষ্টা শামসুন্নাহার জোৎস্না, সিপিবি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অ্যাড. মাকছুদা আক্তার লাইলী এবং সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের ঢাকা নগর কমিটির সদস্য রুখসানা আফরোজ আশা প্রমুখ।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন চলন্ত বাসে ধর্ষণ ও হত্যার মতো বর্বর ঘটনায় দায়ীদের অবিলম্বে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। অব্যাহত খুন ও ধর্ষণের বিচার না হওয়ায় এ ধরনের বর্বরোচিত ঘটনা দেশে মহামারী আকার ধারণ করছে।
বক্তারা বলেন, গত কয়েক দশক ধরে দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী হওয়া সত্ত্বেও ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন বেড়ে যাওয়ার ঘটনা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে নারীর প্রতি রাষ্ট্র ও সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিই মূলত এর জন্য দায়ী এবং ধর্ষণ ও হত্যার একটি রাজনীতি আছে। লুটেরা ধনিকদের রাজনীতির ফলেই দেশে আজ নারী ধর্ষণ, খুন, নিপীড়ন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
বক্তারা বলেন, বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এতটাই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন যে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার পর বিচারের জন্য থানায় গেলেও অনেক সময় মামলা পর্যন্ত গ্রহণ করতে চায় না।
নেতৃবৃন্দ নারী নির্যাতন ও সহিংসতা বন্ধের জন্য সকল প্রগতিশীল বিবেকমান, দেশপ্রেমিকদের প্রতি গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে বলেন পাড়া মহল্লায় নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিগ্রেড গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে নারী ধর্ষণ ও খুনের জন্য দায়ী যে সমস্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের অবিলম্বে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। 

বুধবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৭

ধারাবাহিক উপন্যাস- ওড়না

লেখকঃ জাফর আহ্মমেদ, সম্পাদক, শ্রমিক আওয়াজ (পর্ব-৩)

দুএকদিন পর পরই রাহাত সর্দার রুমানার রুমে ঢুকে পড়ে। সফেদ দাঁড়ি, সৌম্য চেহারাতে ভদ্রতার ছাপ থাকলেও রুমানার রুমে ঢোকার উদ্দেশ্য মোটেও ভদ্র নয়। রুমে ঢুকেই গদ গদ করে রুমানার সাথে আলাপ শুরু করতে চায়। রাহাত সরদার সদ্য টাকার মালিক হওয়ার ফুটানী আর নারী শরীরের সৌন্দর্য নিয়ে আলাপ করতে চায়। কিন্তু রুমানার রাজনীতি, মানুষের অধিকার ও ঔচিত্য বোধের কথাতে চাপা পড়ে যায় তার উদ্দেশ্য। রুমানার যুক্তির কাছে পেরে ওঠেনা। তাই বলে হার মানে না। রুমানার শরীর বৃত্তীয় সৌন্দর্য যতটা না তার চেয়ে তার বলার ভঙ্গি, যুক্তি, জানার পরিধি কাছে টানার মত। সবাই ঠিকই বুঝে আলুর দোষের এই রোগীর আরও একটি উদ্দেশ্য নিয়ে আসে তাহলো এ রুমে কোন অতিথি এলো কি না! অতিথি আসা মানেই পানি খরচ বেশি, বাধরুমের চাপ, গ্যাসের খরচ বৃদ্ধি, বাড়িতে আরও একজন মানুষের ভার বেড়ে যাওয়া। রুমানারও যে এতে কোন লাভ হয়-তা কিন্তু না। রুমমেট বানু মাঝে মাঝে বিরক্ত হলেও আবার ঠিক হয়ে যায। বানুর রুমানার রসায়নটা মিলেও ভাল। অতিথি যেন রুমানার পিছু ছাড়ে না। আজ এলাকার মেয়ে, কাল কোন বান্ধবীর আত্মীয়, আরেকদিন কোন পরিচিত লোকের আত্মীয়। নিজের রাখার জায়গা নেই তো রুমানার কাছে পাঠাও। বাস মিটে গেলে সব ঝামেলা। মাসের অর্ধেক দিন একজন না একজন গেস্ট থাকেই। আসে কয়েকদিন থেকে চাকুরি সংগ্রহ করে অন্যত্র মেচ নিয়ে চলে যায়। রুমানাও না করতে পারে না, দয়ার শরীর! রাহাত সরদার তাই সুযোগ পেলেই রুমে একবার ভুলকি মারে।
আজ রুামানার রুমে ভুলকি মারা বেড়ে গেছে, বরং কয়েকবার। গতকাল সন্ধ্যায় আসমা এসেছে চাকুরি করার জন্য। ওর বাড়ি পুটয়াখালি। দুপুরে কলতলায় পানি আনতে গিয়ে আসামাকে দেখে রাহাত সরদার। তুমি কে গো, রুমানার রুমের গেস্ট ? লোকটার এ তাকানো ভাল না লাগায় কথা শুনেও না শোনার ভান করে দ্রুত রুমে চলে আসে। পেছনে পেছনে রুমানার রুম পর্যন্ত এসে গেছে। বেশ খানিক সময় ধরে কথাও বলে গেছে।
পুটয়াখালির আন্ধারমানিক নদীর পাড়ে আসমাদের বাড়ি। বাবা লোকমান আলীর চার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে আসমা বড়। মাঠে কৃষি কাজ করে সব ছেলেমেয়েকে পড়াশোনায় করায়। আসমা এবার বিএ পরীক্ষা দিয়েছে, ভাল ছাত্রী। পড়াশোনা করবে বলে বিয়ে-সাদীও দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব এলেও রুমানার অনিচ্ছায় বিয়ে হয়নি। ও পড়াশোনা করবে, চাকুরি করবে। আবার দুএকজনের সাথে বিভিন্ন সময়ে বন্ধুর সম্পর্ক পর্যন্ত গড়ালেও প্রেম পর্যন্ত পৌছেনি। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাল লাগে না আসমার। চাকুরি করে বাবাকে একটু আয়েশ দেবে। ছোট্ট ভাইবোনগুলোকে ভাল করে লেখাপড়া করাবে। তখন না হয় নিজের মাস্টার্সটাও প্রাইভেটে শেরে নেবে। সাভারের আশুলিয়ায় চাচাত ভাইয়ের সাথে কথা বলে চাকুরির জন্য ঢাকায় চলে আসে। চাচাত ভাই লতিফ মিয়া আশুলিয়ায় একটি কারখানার লাইন চীফ। রুমানা লতিফ এর পরিচিত। আপাতত ঠিকানা হয়েছে রুমানায় বাসায়। তবে খরচ-খরচান দেয় লতিফ মিয়া।
বাসাটি ভোর থেকে লোকে ভরপুর থাকে। সকাল সাতটায় বাসা খালি হতে শুরু কওে, ন’টার মধ্যে পুরো বাসা খালি হয়ে যায়। তারপর বাড়ি জুড়ে নিরবতা নেমে আসে। নারীরা গার্মেন্টস কারখানাতে যায়। পুরুষরা হয় গার্মেন্টস কারখানায় না হয় রিকসা-ভ্যান চালাতে বা অন্য কোন কাজে বের হয়ে যায়। চারটের পর থেকে বাড়িতে লোকজন আসতে থাকে। পুরো বাড়িতে দুটি শিশু থাকে। বাকীদের হয় সন্তান নেই। দুয়েকজনের সন্তান থাকলেও গ্রামের বাড়িতে বাবা-মার কাছে রেখে এসেছে। সন্তান কাছে রাখা বাড়তি খরচ মেটানোর মত আয় অধিকাংশ শ্রমিকেরই নেই। ¯^ামী-স্ত্রী মিলে কারখানায় চাকুরি করলে বাড়িতে কিছু টাকা পাঠাতে। এ জন্য সন্তানকে বাবা-মার কাছে গ্রামে রেখে আসতে হয়। কিছু সঞ্চয়ও থাকে। সন্তান কাছে থাকলে এগুলো সম্ভব হয় না। তাই প্রায় সন্তানওয়ালা দম্পতি সন্তান গ্রামের বাড়িতেই রাখে। আর তাছাড়া অধিকাংশ শ্রমিকই সন্তান লালন-পালনের বাড়তি খরচ জোগাড় করতে পারবে কিনা-এ ভয়ে দেরিতে সন্তানের বাবা-মা হয়।
-না, এখন না। ভেতর থেকে বাইরে এমন শব্দ আসছে। আসমার কথা। ভেজানো দরজার কাছে এসেই চমকে উঠে বানু। নীচের দিকে তাকিয়ে আরও চমকে ওঠে, ওমা এতো পুরুষের স্যান্ডেল, ভেতরে পুরুষ কে। কে সে ? আসমা একা আছে! এখনো তো রুমানা ফেরেনি। ও কারখানা ছুটির পর বাইরে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আড্ডা দেয়, তারপর বাসায় ফেরে। আমিই বরং অন্যদিনের চেয়ে আগে এসেছি, পাঁচটায় ছুটি নিয়ে চলে এসেছি। ওভারটাইম করিনি। দরজাটা আস্তে করে সরিয়ে দিয়ে বানু নিশ্চিত হয়, ব্যাটা বাড়িওয়ালা।
-না ডাক্তারের কাছে যাওয়ার মত অসুন্থতা না। এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। রুমের মধ্যে এসে কদিন ধরে বসে আছি এ জন্য একটু মাথা ধরেছে। আসমা খাটের উপর বসে। অপর খাটে ল্যাটামেরে বসে থাকা রাহাত সর্দারকে উদ্দেশ্য করে আসমা এ সব কথা বলে। রাহাত সর্দার আসমার তাকিয়ে থাকে। আসমনার কথা শোনে, নাকি কি দেখছে বোঝা যাচ্ছিলো না। দুপুরে কলতলায় আসমাকে দেখে রাহাত সর্দারের বুকের মধ্যে ধড়-পড় শুরু করে। সালোয়ার কামিজের ফাঁকে পুরুষ্ট বুক, বলিষ্ট উরুর বেদের মেয়ে সিনেমার অঞ্জু ঘোষকে আবিস্কার। চোখের সামনে থেকে যেন যেতে চায় না। রুমে ঢুকে বানু।
-ওই যে আপু এসেছে, বলে আসমা। রাহাত সর্দারের সম্বিত ফিরে পাওয়ার অবস্থা।
-তুমি তাড়াতাড়ি চলে এলে, ভাল হলো-বানুকে উদ্দেশ্য করে বলে রাহাত সর্দার।
-তোমাদের গেস্ট অসুস্থ্য। ডাক্তারের বাড়ি যাওয়ার কথা বলছিলাম। তুমি এলে, ভালই হলো।
বানু কি বলবে বুঝতে পারে না। ভেতরে ভেতরে এক ধরনের ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। ওষুধ, ডাক্তার- রাহাত সর্দারের এ ধরনের কথা শুনে নিজেকের সামলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। আবারও এও ভাবে বাড়িওয়ালা গেস্ট নিয়ে আবার চিল্লা-পাল্লা শুরু করে দেয় কিনা। রুমানা ছাড়া অন্য কেউ এই ব্যাটার মুখে লাগাম দিতে পারে না।
-জি চাচা, আজ একটু তাড়াতাড়ি চলে এলাম। আসমা আপা আছে, তাকে সাথে একটু ঘুরবো বাইরে। কথা বলতে দু খাটের মাঝামাঝি স্থানে টেবিলে নিজের ব্যাগটা রাখে। চোখে মুখে একটু বিরুক্তিও ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে। কাপড় বদল করবে- ব্যাটা ওঠেনা, মনে মনে বলে বানু। এক রুমের মাঝে দুই দিকে দুটি সিঙ্গেল খাট। মাঝে দেওয়াল সংলগ্ন একটি টেবিল, দেয়ালে আয়না। সেখানে সাজ- গোঁজ করে। রুমে ঢুকতেই বাইরের দিকে এক খাটের পাশে খাওয়ার হাড়ি পাতিল রাখার একটি র‌্যাক। অপর খাটের পেছনে জামা কাপড় রাখার আলনা। আর খাটের নীচে দুজনের কয়েকটা ব্যাগ। রুমানা আর বানু এক সাথেই থাকে। ওর বাড়ি চুয়াডাঙ্গা জেলার সীমান্ত ঘেষা জীবননগর উপজেলায়। ১৭ বছর বছরে বিয়ে হয়েছিল। বছর না ঘুরতেই আসগর মিয়া গরুর রাখালি করে ভারত থেকে গরু আনতে গিয়ে সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। দুই বছর বাবার ঘরে থাকে। পরে আর বিয়ে-থা হয়নি। ঢাকায় চলে আসে কারখানায় চাকুরি করতে। এরপর গার্মেন্টস কারখানায় চাকুরির ৬ বছরের চার বছরই রুমানার সাথে থাকে।
আসমা এক খাটের মাঝখানে জড়ষড় হয়ে বসে আছে। যেন বাসর পরবর্তি দিনের আলোয় উদ্ভাসিত ¯^জন বেষ্টিত লাজ-লজ্যমাখা নতুন বউ; যেন শিশির ধোয়া দুর্বা ঘাস। অপর খাটে রাহাত সর্দার। বানু কোন ইঙ্গিতেই রাহাত সর্দারকে বোঝাতে পারছে না কাপড় বদলাবে। তার এখন চলে যাওয়া উচিত। সারাদিন মেশিনে কাজ করে শরীরও ঘামে দুর্ঘন্ধ ছড়াচ্ছে। নিজের কাছেই খারাপ লাগছে। উপরে ফ্যান চললেও শরীরে বাতাশ লাগে না। কি করবে বুঝতে পারে না। বাইরে গিয়ে বদলাবে তাও পারে না, লোকজন আসা শুরু করেছে। গণবাধরুম হওয়ায় বাধরুমেও কাপড় বদলাতে পারে না। লোকটাকে উঠে যেতেও বলতে পাওে না।
এই বয়সের দুটি মেয়ের সান্নিধ্য বয়স্ক মানুষটার যেন নেশা ধরে গেছে। একজন কলেজ পড়া, আরেকজন ¯^াস্থ্য সচেতন কর্মজীবি।
-নাহ, আর পারছি না। কাপড়ে শরীরটা যেন ছিড়ে যাচ্ছে। হায় ফেলে বানু। তারপর ওড়নাটা গুছিয়ে ভি-আকৃতির করে বুকের নিচে নামিয়ে দুই কাঁধের উপর তুলে পেছনে ছেড়ে দিয়ে খাটের ওপর বসে। বুকের ক্লিভটা বের হয়ে যায়। রাহাত সর্দারের জিহবা যেন লালা পড়া শুরু করে।
-চাচা, আপনি কি একটু আসবেন ! বানু আপু কাপড় বদলাবে। আসমা বাইরে যেতে বলে রাহাত সর্দারকে। বাড়িওয়ালা আসমার কথা প্রথমে বুঝতে পারে না। বানুও না। পরে বানু সম্বিত ফিরে পায়, ওকে তো যেতে বলছে।
-হ, মাঝে মাঝে আসবো। সিন্ধ হাসি হেসে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে আসমার দিকে তাকায়।
-চাচা, বলছিলাম 
কি, আপু সারাদিন কারখানায় কাজ করে ঘেমে বাসায় এসেছে। আপনি যদি একটু বাইরে যান, উনি কাপড় চেঞ্চ করবে।
-আ, হ। যাই। তোমরা থাকো বলে বের হয়ে যায় রাহাত সর্দার।
-তুমি এমন করে বলতে পারলে ? আমি তো চিন্তাই করতে পারিনি। আসলে তুমি না খুবই বুদ্ধিমান। এই লেখাপড়ার গুন, আসমার প্রতি কৃতজ্ঞতায় প্রকাশ করে বানু। দরজাটা ভেতর থেকে আটকিয়ে কাপড় বদল শুরু করে বানু।
-আপনাদের বাড়িওয়ালা লোকটা বোধ হয় ভাল না। তাই না?
-বাড়িওয়ালার আবার কি দেখছো, চাকুরি করতে গেলে আর খারাপ লোককে মোকাবেলা করতে হবে।
-বলেন কি? কারখানার সব পুরুষ কি খারাপ?
-আরে না। একজন, দুইজন থাকলেই হলো। শ্রমিকরা তো ভাই, বোন, বন্ধুর মত। দুএকজন কর্মকর্তা খারাপ হয়। এ সব খারাপ কর্মকর্তারা পরিবেশ খারাপ করে। আবার বায়ার, বায়িং হাউজের লোকজন দিয়েও পরিবেশ খারাপ করে। এতে মালিকের সায় থাকে। আবার কোন কোন মালিক নিজেই খারাপ।
-তারপর? উৎসাহ নিয়ে বানুর দিকে তাকিয়ে থাকে উত্তরের আসায়। কামিজটা রেখে সালোয়ারটা পা দিয়ে বের করে আলনার উপরে রাখে। হাটু পর্যন্ত ঢেকে থাকে কামিজে। তারপর অন্য একটি সালোয়ার পরে। তারপর কামিজটাও বদল করে। সঙ্গে সঙ্গে কথাও বলে। প্রতিদিনই এভাবে কাপড় বদলাতে হয়। রুমানা ও বানুর সম্পর্ক এতই কাছের হয়ে গেছে যে দুজন খুব সহজভাবে নেয়। নিজেদের আয় রোজগার ও সামর্থ এটা হতে বাধ্য করেছে। তিন, চার দিনে আসমার সাথেও এমন খোলা-মেলা হয়ে গেছে। গোশলখানায় গোসল করে কোনমতে কাপড় বদলিয়ে রুমে এসে অফিসের কাপড় পরে। এটা ব্যাসেলর নারী শ্রমিকের নিত্যদিনের সাথী। কেউ কম আয়ে কুলিয়ে ওঠতে না পারার কারণে একা রুম এক রুম ভাড়া নিতে পারে না, কেউ সাধ্য থাকার পরও নিঃসঙ্গতা কাটাতে এক বা একাধিক রুমমেট খুঁজে নেয়। আনন্দ ফুর্তি করে বাস করে।
কাপড় বদল করে রুমে থেকে বের হয়ে বানু।
-আপা বসেন, হাত মুখটা ধুয়ে আসি।
-আচ্ছা, বলে আসমা। আসমাও একটু নড়ে চড়ে বসে। মাঝখানটা থেকে খাটের এক পাশে আস।েমনের মাঝখানটাতে নানা প্রশ্ন বুঁদ বুঁদ করে। নিজের কখন একটি চাকুরি পাবে, সে চাকুরি কেমন হবে, বাড়িতে কত টাকা পাঠাবে। বাড়িতে বাবা খুব কষ্ট করে। সারাদিন পরিশ্রম করার পরও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। নামাজ শেষে আমাদের ভাইবোনদের জন্য দোয়া করে। আমরা যেন লেখাপড়া করে মানুষ হতে পারি। টাকা পাঠাতে পারলে বাবার কষ্ট দূর হবে। শান্তি করে নামাজ রোজা করবে।
বানু রুমে আসে, এ সময়টাতে কলতলায় লোক কম থাকে।
-সারাদিন রুমের মধ্যে, যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি আজ আগেই আসতে চেয়েছিলাম। সুপারভাইজারের অনুমতি পেতে দেরি হয়ে গেল। আলনা থেকে একটি গামছা নিয়ে মুখ মুঝতে মুছতে বলে বানু।
-জরুরি কাজ, ওভারটাইম করবো না। তারপরও কারখানা থেকে আসতে দেবে না। যেন সুপারভাইজার যা বলবে তাই।
-কেন অফিসে কাজ থাকে, কাজ শেষ করার আগে ছুটি নাও তো দিতে পারে?
-নারে পাগল। আসমার কাছে গিয়ে বসে বানু।
- আইনে আছে, নিয়মিত ডিউটি করার যদি ওভারটাইম করানো লাগে তাহলে শ্রমিকের সম্মতি নিয়ে ওভারটাইমের কাজ করাবে। এ জন্য নিয়মিত সময়ের জন্য প্রতি ঘন্টার যে পরিমান বেতন ওভারটাইমে তার দ্বিগুন হবে।
-ও আপনি আইনও জানেন।
-জানি কি আর অল্প সাধে। গার্মেন্টস মালিকরা পারে তো সারাদিন-রাত কাজ করিয়ে নেয়। শ্রমিকরা আন্দোলন, মিটিং, মিছিল করে বলেই তো শ্রমিকের উপর থেকে জুলুম কমেছে। মিটিং মিছিল না হলে জুলুম আরও থাকতো। রুমানা আপারা কত আন্দোলন করেছে। কয় বছর আগে যখন সারা দেশে গার্মেন্ট শ্রমিকরা আন্দোলন করেছে তখন কেউ শ্রমিকের সাথে পারেনি। মালিকরাও না পেরে রাস্তায় শুয়ে পড়ে প্রতিবাদ করেছিল।
বানুর কথা শুনে আসমার চোখ চিক চিক করে উঠে, অধির আগ্রহ নিয়ে শুনে। সন্ধ্যা এগিয়ে আসার সাথে সাথে রুমের বাইরের শব্দও বৃদ্ধি পায়। এ বাড়ির ভাড়াটে মানুষগুলো কর্মস্থল থেকে ফিরতে থাকে। হাক ডাক শোনা যায়। এ শব্দ রুমের মধ্যেও প্রতিধ্বনি হয়। আসমা বানুর কাছেকাছি এসে বসে।
- এখন আন্দোলন হয় না?
-হয় না আবার, হয়। কিন্তু মালিকরা চোখ খোলা রাখে। কোন শ্রমিক এক সাথে হয়ে কথা বলেছে তো সেই শ্রমিককের আর চাকুর নেই, কারখানা থেকে বের করে দেয়।
-বের করে দেয় মানে, প্রশ্ন করে আসমা।
-মানে ছাঁটাই করে।
-তারপর, জানতে চায় আসমা।
-তারপর শ্রমিকরাও কুকুরকে যোগ্য মুগুর দেয়। বেতন বোনাস বা অন্য কোন দাবি না মেনে পুলিশ বা ঝুট মাস্তান দিয়ে শ্রমিককে মার-ধর করলে শ্রমিকরা শ্রম আদালতে মামলা করে দেয়। বা এক জোট হয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয়, ভাংচুর করে। এতে বাধ্য হয়ে মালিকরা কথা শোনে।
-ঝুট মাস্তান আবার কি?
-ও আচ্ছা, হাসে বানু। তারপর আবার বলে, মালিকরা শ্রমিকদের দমানোর জন্য কিছু স্থানীয় লোককে পুষে রাখে। আর এর বিনিময়ে গার্মেন্টস কারখানার বিভিন্ন রকমের টুকরো কাপড় এই সব লোককের কাছে কম দামে বিক্রি করে। এই টুকরো কাপড়ের ব্যবসা করার জন্য একাধিক মাস্তান নিজেদের মধ্যে গন্ডগোল করে শক্তির জানান দেয়। যে জিতে সে ওই ব্যবসা পায়। এই সব লোক মালিকের যে কোন কাজে লাগে। শ্রমিকরা আন্দোলন করলে কারখানার বাইরে ও ম্যাচে, বাসায় গিয়ে মারধর করে আসে।
-পারে শ্রমিকের সাথে?
- শ্রমিকরা এক থাকলে তো মালিকরাই সোনার গাঁও হাসপাতলের সামনে শুয়ে পড়ে। এক না থাকলে তো গেটের সিকিউরটিই চাকুরি থেকে ছাঁটাই করে।
-ওই যাহ্! আপনাকে সঙ্গে করে বাইরে ঘোরার জন্য আগে আসলাম, কিন্তু আমিই বসে গল্প করছি। এ গল্প তো রোজই করি, চাকুরি শুরু করলে আবার তখন গল্প করারই সময় পাওয়া যাবে। বেড়ানোর সময় পাওয়া যাবে না। চলেন, বের হন।
আসমা সম্মতি সূচক ইঙ্গিত করে। দেওয়ালে ঝোলানো আয়নার সামনে দাঁড়ায়। চিরনিটা হাতে নেয়। চুলগুলো গুছিয়ে নেয়।
-বের হন। আসমাকে আয়নার কাছে যেতে ইঙ্গি করে বানু। তারপর দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। কয়েকমিনিট পর আসমাও বের হয়।
(অতপর)

CPB Condemns Atrocities on Rohingyas

Calls for Immediate steps towards a permanent solution of Rohingya problem 
President of the Communist Party of Bangladesh (CPB) Mujahidul Islam Selim and General Secretary Md. Shah Alam strongly condemned the Myanmar govt and army for committing genocide, arson and ruthless torture on Rohingyas in Rakhaine province through a statement to the press on 29th August. 
In the statement that the leaders said inhuman attacks on Rohingyas have been resorted to brutal torture. Millions of people have been plunged into a worst humanitarian catastrophe. Even though the Rohingya problem is an internal affair of Myanmar, but it has a seriously affected Bangladesh. Thousands of Rohingyas are taking shelter in Bangladesh to save their lives. It is the primary duty of everybody to treat them with humanitarian attitude. But this is putting a serious negative impact on the economy of Bangladesh and it will continue to do so unless a permanent solution to the problem is not brought about. At the same time, using the Rohingya problem some communal groups and local and foreign conspirators are trying to implement their evil plot. Unholy activities of these evil forces may bring about more serious consequences. Myanmar's government and its army are mainly responsible for this grave situation.
CPB leaders also said that the permanent solution to the Rohingya problem must be done by the Myanmar government itself. By accepting the truth that Rohingyas are citizens of Myanmar and in accordance with the recommendation of the Committee led by former UN General Secretary Kofi Anan, initiative should be taken to resolve the crisis. They said, it is necessary to organize strong UN initiative and to mobilings global public opinion in this regard. CPB leaders called upon Bangladesh government to take immediate diplomatic initiative and other necessary steps to resolve this crisis. They also called for protection of life and human rights of Rohingyas and to remain alert about the conspiracy of vested interest groups.

রবিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৭

বিজিএমইএ-এর কার্যালয় ঘেরাও

গাজীপুরের ডডি ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড কারখানার প্রায় সাড়ে ছয়শত শ্রমিকের বকেয়া পাওনা পরিশোধে চুক্তিভঙ্গের কারণে দেশের তৈরি পোশাক শিল্প কারখানার মালিক সমিতি বিজিএমইএ-এর কার্যালয় ঘেরাও করেছে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র। রোববার গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের দপ্তর সম্পাদক জয়নাল আবেদীন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা জানান।
জয়নাল আবেদীন জানান, গাজীপুরের ডডি ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড কারখানাটি গত ২৫ আগস্ট গাজীপুরের বড়বাড়ি থেকে চাঁনপাড়া বাসন সড়কে স্থানান্তর করা হয়। বকেয়া পাওনা পরিশোধের বিষয়ে মালিকপক্ষ তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে শ্রমিকদের অর্জিত ছুটির টাকা ও আসন্ন ঈদের বোনাস পরিশোধ না করে কারখানাটি স্থানান্তর করে। যার প্রতিবাদে গতকাল রোববার সকালে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের নেতৃত্বে প্রায় পাঁচ শতাধিক শ্রমিক বিজিএমইএ ভবন ঘেরাও করে। ঘেরাও সমাবেশ থেকে অবিলম্বে শ্রমিকদের প্রাপ্য অর্জিত ছুটির টাকা এবং ঈদ বোনাস পরিশোধ করার দাবি জানানো হয়। একইসঙ্গে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ঘেরাও অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়া হয়। গতকাল রোববার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঘেরাও কর্মসূচি অব্যাহত ছিল।
গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহ-সভাপতি শ্রমিকনেতা জিয়াউল কবির খোকন-এর সভাপতিত্বে এবং ডডি ফ্যাশন ওয়্যার লি. কারখানার শ্রমিকনেতা ইমাম হোসেনের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত ঘেরাও সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি শ্রমিকনেতা কাজী রুহুল আমিন, সাধারণ সম্পাদক শ্রমিকনেতা জলি তালুকদার, কেন্দ্রীয় নেতা সাদেকুর রহমান শামীম, জালাল হাওলাদার, কেএম মিন্টু, মঞ্জুর মঈন, জয়নাল আবেদীন, মোহাম্মদ শাজাহান, রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।
সমাবেশে নেতারা বলেন, মালিকপক্ষ শ্রমিকদের পাওনা বঞ্চিত করার জন্য প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। ঈদের ঠিক আগ মুহূর্তে তারা কারখানা স্থানান্তর করে শত শত শ্রমিককে বেকার করেছে। বছরের পর বছর যে শ্রমিকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মালিকের পুঁজি ও মুনাফার যোগান দিয়েছে আজ সেই শ্রমিকদের শূন্য হাতে বিদায় করার পাঁয়তারা চলছে। নেতারা বলেন, দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের যা পাওনা সেটা থেকে তাদের বঞ্চিত করা হলেও সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে। তারা অবিলম্বে শ্রমিকদের অর্জিত ছুটির পাওনা টাকা ও ঈদ বোনাস পরিশোধের দাবি আদায় না হলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা দেন।

শনিবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৭

ডানহাত ও বামহাত যদি পরস্পরের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হয় তা হলে দেহের সর্বনাশ অনিবার্য

লেখকঃ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি

ডানহাত ও বামহাত যদি পরস্পরের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হয় তা হলে দেহের সর্বনাশ অনিবার্য। বিচার বিভাগ এবং আইন ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে সম্পর্ক হলো রাষ্ট্রের ডানহাত-বামহাতের মতো। এদের মধ্যে বিবাদ চলতে থাকলে তা দেশের জন্য বিপজ্জনক। দেশ এখন তেমনই এক বিপদের মুখে। এ বিবাদকে যেভাবে তীব্র করে তোলা হচ্ছে তা গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে উঠেছে। সরকারের উচিত বিবাদে উস্কানি না দিয়ে এখনই তা বন্ধ করা।
দেশের শীর্ষ আদালতের একটি রায়কে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রধান বিচারপতি ও হাইকোর্টের আপিল বিভাগকে (সুপ্রিমকোর্ট) নিয়ে যেসব ভিত্তিহীন বৈরী প্রোপাগান্ডা, উত্তেজনাপূর্ণ কথাবার্তা ও উত্তপ্ত আচরণে লিপ্ত হয়েছে তা উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। কোর্টের এই রায়কে তারা তাদের মধ্যকার ‘গদির দ্বন্দ্বের’ বিষয়বস্তুতে পরিণত করেছে। এই রায়ের ফলে, ‘এই বুঝি তার গদি গেল’ ভেবে আওয়ামী লীগ সুপ্রিমকোর্টের বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধংদেহি আচরণ চালাচ্ছে। অন্যদিকে এই রায়ে তাদের ‘ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম হয়েছে’ ভেবে সরকারকে বরখাস্ত করার জন্য বিএনপি সুপ্রিমকোর্টের কাছে ‘আবদার’ করেছে। এভাবে দেশের ‘বিচার বিভাগের’ সঙ্গে ‘আইন বিভাগ’ ও ‘নির্বাহী বিভাগের’ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের এক নাজুক পরিস্থিতি জন্ম নিয়েছে। এই অবস্থা যে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক অগ্রগতির জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, সে বোধটুকুও এ দল দুটির লোপ পেয়েছে বলে আশঙ্কা হয়।
তাদের পরিকল্পনা ও পছন্দসই ‘রায়’ না দেওয়ায় তারা বিভিন্ন বানানো তথ্য ও ভুলভাবে উদ্ধৃত করাসহ নানা নোংরা পথে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার চরিত্র হননের প্রচেষ্টাও চালাচ্ছে এবং হুমকি-ধমকি দিয়ে তাকে নতি স্বীকার করাতে চাইছে। রায় বাতিলের জন্য বেঁধে দেওয়া সময় পার হয়ে যাওয়ায় তারা এখন প্রধান বিচারপতির অপসারণের এক দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে। আক্রমণকে ‘উইচ হান্টিং’-এর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট ঘেরাও করে তাদের দাবি আদায় করা হবে বলেও তারা হুমকি দিয়ে রেখেছে। এভাবে হুমকি দিয়ে পছন্দসই রায় আদায় করার প্রচেষ্টা হলো আইনের
শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সংবিধানের নির্লজ্জ বরখেলাপ। এটি হলো আদালতের বিরুদ্ধে
একটি বিদ্রোহ করার মতো ঘটনা। এ অবস্থায় ওৎপেতে থাকা ষড়যন্ত্রের শক্তি সুযোগ নিতে পারে, এমন আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়েছে।


দেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা আছে। তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউই তা কখনই বাস্তবায়ন করেনি। ক্ষমতায় থাকাকালে তারা উভয়ই বিচার বিভাগকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বে রাখার জন্য সব সময় সচেষ্ট থেকেছে। আর যখন তারা বিরোধী দলে থেকেছে তখনই কেবল তারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সপক্ষে মিথ্যা বুলি কপচেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় তারা কখনই বিশ্বস্ত ছিল না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি প্রভৃতি লুটেরা-বুর্জোয়ার স্বার্থরক্ষাকারী দলগুলো যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রদানে অক্ষম, চার দশকের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা সে কথাই প্রমাণ করছ বস্তুত এ হলো আমাদের দেশের প্রচলিত বুর্জোয়া রাজনীতির দেউলিয়াপনারই অভিপ্রকাশ ।                     সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা কার হাতে থাকবে, তা নিয়েই বিবাদ। এটি কি সংসদের হাতে থাকবে, নাকি তা ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের’ হাতে থাকবেÑ বিতর্ক তা নিয়ে। ’৭২-এর সংবিধানে এই ক্ষমতা ছিল সংসদের হাতে। বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে তার উদ্যোগেই, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল। পরে জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে তা ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের’ কাছে অর্পণ করেন। ২০১৪ সালে সুপ্রিমকোর্টের রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করা হলেও বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের’ হাতেই রেখে দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে তা আবার সংসদের কাছে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এই পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে মামলা করা হলে হাইকোর্ট সে বিষয়ে যে বিভক্ত রায় দেন, চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য তা সুপ্রিমকোর্টে আসে। ৭ জন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিমকোর্টের ফুল বেঞ্চ এ বিষয়ে শুনানি শেষে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে যে রায় দিয়েছেন, সেই রায় নিয়েই ক্ষমতাসীনরা প্রশ্ন তুলেছে ও বিতর্কে লিপ্ত হয়ে হুমকি-ধমকি দেওয়া শুরু করেছে।
আমি আইনবিদ নই, সংবিধান বিশেষজ্ঞ তো নই-ই। তথাপি রাজনীতির জ্ঞান থেকে সুপ্রিমকোর্টের এই রায় নিয়ে সামান্য দু-একটি বিষয় এখানে তুলে ধরব। আদালতের অন্যান্য সব রায়ের মতো ষোড়শ সংশোধনী সম্পর্কিত সুপ্রিমকোর্টের রায়েরও দুটি অংশ আছে। এর মধ্যে একটি হলো তার সিদ্ধান্তমূলক অংশ। এই সিদ্ধান্তাংশ হলো নির্দেশমূলক। রায়ের আরেকটি অংশ হলো আদালতের পর্যবেক্ষণ। কোন কোন বিবেচনার ভিত্তিতে আদালত তার সিদ্ধান্তে উপনীত হলো, পর্যবেক্ষণে তার বিবরণ বর্ণিত থাকে। সিদ্ধান্তমূলক অংশ মেনে চলা বাধ্যতামূলক। পর্যবেক্ষণাংশের সব কথা মেনে নেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। তা নিয়ে প্রকাশ্যে বিতর্ক করা যেতে পারে, প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। কিন্তু রায় প্রত্যাহার বা পরিবর্তন করার জন্য চাপ বা হুমকি দেওয়া কিংবা শিষ্টাচারবহির্ভূত হুমকিমূলক বিষোদ্গার করা একটি অপরাধ। অথচ ক্ষমতাসীন মহল এই অন্যায় ও বেআইনি কাজে লিপ্ত হয়েছে। এসব গর্হিত কর্মকা-ের মাত্রা তারা বাড়িয়েই চলছে। সরকারের এরূপ কর্মকা- তার আরেক দফা ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করার তাগিদ থেকেই পরিচালিত হচ্ছে বলে মানুষ মনে করে।
সুপ্রিমকোর্ট তার প্রদত্ত রায়ের সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতে গিয়ে জাতির যৌথ প্রজ্ঞা বা ‘কালেকটিভ উইসডম’, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও তার চেতনাধারা, সংবিধানের প্রস্তাবনা অধ্যায়ের গুরুত্ব, সেখানে ‘আমি’র বদলে ‘আমরা’ দিয়ে লেখা শুরু হওয়ার তাৎপর্য, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার গুরুত্ব, তা কেন সংবিধানের মূল কাঠামোগত ভিত্তির অংশ, জনগণই যে প্রজাতন্ত্রের ক্ষমতার মালিক, চূড়ান্ত সার্বভৌমত্ব যে একমাত্র জনগণের হাতেই ন্যস্ত, রাষ্ট্রের তিনটি মূল বিভাগের সার্বভৌম ক্ষমতার আপেক্ষিকতা এবং তাদের ক্ষমতার এখতিয়ার ও শক্তির ভারসাম্যমূলক আন্তঃসম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় রায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।
ক্ষমতাসীনরা রায়ের বিরোধিতা করার পেছনে তাদের যুক্তি উপস্থিত করার চেষ্টা করেছেন। তাদের যুক্তি হলো, অন্য সবার ক্ষেত্রে যেমন, তেমনই বিচারপতিদেরও জবাবদিহিতার একটি ব্যবস্থা থাকা উচিত। সেই জবাবদিহিতার উপযুক্ত স্থান হলো জাতীয় সংসদ। কারণ জাতীয় সংসদই হলো জনগণ দ্বারা নির্বাচিত সদস্যদের সংস্থা। সে কারণে সেটিই হলো সর্বোচ্চ সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী। তাই বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতেই ন্যস্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। তা ছাড়া ’৭২-এর সংবিধানে এই ব্যবস্থাই বহাল ছিল। তাই তদনুসারে পাস হওয়া ষোড়শ সংশোধনী বহাল রাখাই যুক্তিযুক্ত। তাদের প্রথম যুক্তির প্রসঙ্গে এ কথাটি তারা ভুলে গেছেন যে, সংবিধানমতে একমাত্র জনগণের সার্বভৌমত্বই হলো চূড়ান্ত। আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের ভারসাম্যপূর্ণ কাজের মাধ্যমেই তা তারা প্রয়োগ করতে পারে। কোনো একটি বিভাগ অন্যটির ঊর্ধ্বে স্থান নয়। অন্যদিকে এ কথাটিও তারা আড়াল করে রাখেন যে, বঙ্গবন্ধু নিজেই চতুর্থ সংশোধনী দ্বারা বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদ থেকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করেছিলেন। তাদের দ্বিতীয় যুক্তি প্রসঙ্গে এ কথা মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করার সময় বর্তমান ক্ষমতাসীনরাই রাষ্ট্রধর্ম প্রসঙ্গ, ৩৮ অনুচ্ছেদ ইত্যাদিসহ ’৭২-এর সংবিধানের কিছু কিছু অংশ নিজেরাই পরিবর্তন করেছিলেন।
ক্ষমতাসীনদের নানাবিধ যুক্তি নাকচ করে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরা বিস্তারিত আলোচনা, ব্যাখ্যা, দৃষ্টান্ত ও উদ্ধৃতি দিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ রচনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট যে যুক্তির ধারা তুলে ধরেছেন তা হলো অনেকটা এ রকমÑ (১) বাংলাদেশের সংবিধান একটি লিখিত সংবিধান হওয়ায় তার আক্ষরিক অনুসরণ বাধ্যতামূলক। (২) সংবিধানের শুরুতে লিপিবদ্ধ থাকা প্রস্তাবনাটি হলো সংবিধানের মূল ভিত্তি। এই মূল ভিত্তিকে অগ্রাহ্য করে সম্পাদিত কোনো সাংবিধানিক সংশোধনী বৈধ নয়। (৩) ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’Ñ এই মর্মে ৭ অনুচ্ছেদ মোতাবেক প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌম কর্তৃত্বের চূড়ান্ত অধিকারী হলো জনগণ। তার সেই সার্বভৌমত্ব কার্যকর হওয়ার কথা রাষ্ট্রের তিনটি পরস্পর পরিপূরক বিভাগ তথা আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব প্রয়োগসহ সংবিধানে বর্ণিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিধানসমূহ কার্যকর করার মাধ্যমে। (৪) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অলঙ্ঘনীয় এবং তা সংবিধানের মূল চরিত্র ও কাঠামোর অংশ। (৫) বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। কিন্তু সে ব্যবস্থা এমন হতে হবে যাতে করে তার দ্বারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কোনোক্রমে ক্ষুণœ না হয়। (৬) আমাদের দেশের সংসদীয় ইতিহাসে জনপ্রতিনিধিত্বশীলতার শর্ত পূরণের দিক থেকে অধিকাংশ সময়ে সংসদগুলো ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি ‘ক্ষমতালোভীরা দুবার (দুটি সামরিক সরকারের আমলে) আমাদের রাষ্ট্রকে ‘ব্যানানা রিপাবলিকে’ পরিণত করেছিল।... তারা নানারকম ধোঁকাবাজির আশ্রয় নিয়েছে। কখনো ভোটের নামে, কখনো জোরপূর্বক নির্বাচনের মাধ্যমে, কখনো নির্বাচন না করে।... এসব অগণতান্ত্রিক শাসনামলের নোংরা রাজনীতির চর্চা আমাদের সার্বিক রাজনীতির মারাত্মক ক্ষতি করেছে। Ñ[রায় থেকে উদ্ধৃতি]। (৭) সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বহাল থাকার কারণে জনপ্রতিনিধিরা তাদের নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের মতানুসারে অভিমত দেওয়ার বদলে দলের নির্দেশানুসারে অভিমত প্রদানে বাধ্য থাকেন। (৮) এসব কারণে বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা সংসদের হাতে থাকলে তা ক্ষমতাসীন দল ও তার প্রধান নেতার দ্বারা প্রভাবিত হবে। ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণœ হবে। (৯) তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণœ রেখেই তার জবাবদিহিতার জন্য ভিন্নতর (রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিপরিষদ, সংসদ ইত্যাদির ক্ষেত্রে যে ব্যবস্থা আছে তা থেকে ভিন্নতর) ব্যবস্থা করা আবশ্যক। সে ক্ষেত্রে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের’ কাছে জবাবদিহিতার এবং তার হাতে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা ন্যস্ত হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।
যুক্তির এই ধারাবাহিকতার আলোকে সুপ্রিমকোর্ট ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে তার চূড়ান্ত রায় প্রদান করেছে। সেই সঙ্গে বিচারকদের ‘কোড অব কনডাক্ট’ বা আচরণবিধিও সে অনুমোদন করেছে। এই রায়ের ফলে বিচার বিভাগের পক্ষে নির্বাহী ও আইন বিভাগের হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে বিচার বিভাগের স্বাধীন পদচারণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রসার ঘটানো সম্ভব হবে। ক্ষমতাসীনদের আপত্তি আসলে ঠিক এখানেই। কারণ তা তাদের আরেক দফা ক্ষমতায় থাকার পথে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারে।
ক্ষমতাসীনরা তুমুল হইচই তুলে অভিযোগ করে চলেছে যে, রায়ের পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাকে খাটো করে দেখিয়ে তার অবমাননা করা হয়েছে। পুরো রায়টি পাঠ করে আমি কিন্তু কোথাও এর বিন্দুমাত্র সত্যতা খুঁজে পেলাম না। বঙ্গবন্ধু যে ‘জাতির পিতা’ ও ‘তার নেতৃত্বেই যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে’ এসব কথা একাধিক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধ আখ্যায়িত করে সেখানে জনগণের ভূমিকা ও ‘ফাউন্ডিং ফাদার্সদের’ ভূমিকা বর্ণনা করা হয়েছে। ‘ফাউন্ডিং ফাদার্স’ আর ‘ফাদার অব দি নেশন’ এক অর্থ বহন করে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুধু ৯ মাসের ব্যাপার ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের কালপর্ব হলো দীর্ঘকালীন। সেই সুদীর্ঘ কালপর্বে বিভিন্ন ব্যক্তির ভূমিকার স্বীকৃতি দিলে তার দ্বারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব-ভূমিকাকে কোনোভাবেই খাটো করা হয়Ñ এমন ভাবা কোনোক্রমেই সঠিক নয়। ক্ষমতাসীনদের আরেকটি অভিযোগ হলো, পর্যবেক্ষণে জাতীয় সংসদ ও সাংসদদের মর্যাদা হরণ করে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বেশি কথা বলার প্রয়োজন হয় না। দেশের রাষ্ট্রপতি স্বয়ং সংসদ ও সাংসদদের সম্পর্কে যেসব মন্তব্য একাধিকবার করেছেন, পর্যবেক্ষণে সেসবের চেয়ে বরং কমই বলা হয়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের মূল দুটি অভিযোগই যুক্তিহীন।
সুপ্রিমকোর্টের এই রায়ের বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের কোনো ভিন্নমত থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনিভাবে ‘রিভিউ’ চাওয়ার সুযোগ আছে। সে পথ গ্রহণ না করে উচ্চ আদালত ও প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধংদেহি বাক্যবাণ প্রয়োগ, হুমকি প্রদান ও আচরণ করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অপরদিকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণের অন্যতম নায়ক বিএনপির পক্ষ থেকে রায়ে উল্লাস প্রকাশ করে সরকারকে ‘বরখাস্ত’ করার জন্য সুপ্রিমকোর্টের কাছে ‘আবদার’ করাও দুরভিসন্ধিমূলক। প্রকৃতভাবে এসবই হলো তাদের ‘ক্ষমতার খেলার’ অংশ।
ষোড়শ সংশোধনী সম্পর্কে সুপ্রিমকোর্টের রায় নিয়ে আরও অনেক কথা আলোচনার আছে। স্থানাভাবে সেগুলো এখানে যুক্ত করা গেল না। সুযোগ পেলে বারান্তরে লেখা যাবে। তবে দুশ্চিন্তা হিসেবে এখনো যা রয়ে গেল তা হলোÑ বিচার বিভাগ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এই ক্ষমতার খেলা দেশের জন্য বড় রকম বিপদ ডেকে আনতে পারে।

অবিলম্বে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও হয়রানি বন্ধসহ এশিয়া এনার্জি (জিসিএম) বহিষ্কার, ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করার দাবি করে ফুলবাড়ী দিবস পালন

আজ ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ী গণঅভূত্থান ও প্রতিরোধের ১১ বছর পূর্তিতে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির উদ্যোগে ঢাকা-ফুলবাড়ীসহ সারাদেশে ফুলবাড়ী দিবস পালিত হয়।
আজ সকাল ১০টায় ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জাতীয় কমিটিসহ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্সপার্টি, বাসদ (মার্কসবাদী) জাতীয় গণফ্রন্ট, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন, পরিবেশবাদী সংগঠন (বাপা), গ্রীণ ভয়েজসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন ফুলবাড়ী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। শ্রদ্ধাঞ্জলি শেষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বক্তব্য রাখেন জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও কেন্দ্রীয় নেতা বজলুর রশীদ ফিরোজ। এসময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ-এর কেন্দ্রীয় নেতা রাজেকুজ্জামান রতন, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার, বাসদ (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় নেতা আকম জহিরুল ইসলাম, গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা তাসলিমা আক্তার, জাতীয় গণফ্রন্টের কেন্দ্রীয় নেতা রজত হুদা প্রমুখ।
কেন্দ্রীয় কর্মসূচি হিসাবে সকাল ৯টায় ফুলবাড়ী শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানান জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন ফুলবাড়ী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা অর্পণ করেন। 
সকাল ১০টায় ফুলবাড়ী নিমতলী মোড়ে ফুলবাড়ী উপজেলা জাতীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত আহŸায়ক হামিদুল হকের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, কেন্দ্রীয় নেতা টিপু বিশ্বাস, মোশাররফ হোসেন নান্নু, শাহিন রহমান, আরিফুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম পল্টু, সৈয়দ মোসাদ্দেক হোসেন লাবু, আদিবাসী নেতা রবীন্দ্রনাথ সরেন প্রমুখ। 
সমাবেশে আহŸায়ক শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, অবিলম্বে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও হয়রানি বন্ধসহ এশিয়া এনার্জি (জিসিএম) বহিষ্কার, ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করার সরকারের প্রতি দাবি জানান। 
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, ফুলবাড়ীসহ ৬ থানার কয়লা দেখিয়ে বেআইনীভাবে লন্ডনের শেয়ারমার্কেটে তোলা বিপুল অর্থ জরিমানা হিসেবে আদায় করে এশিয়া এনার্জি (জিসিএম) কে চিরতরে বিহষ্কার করতে হবে। দালালদের বিচারসহ রক্তে লেখা ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবি জানান। ফুলবাড়ী, বিরামপুর, পার্বতীপুর, নবাবগঞ্জ, বড়–পুকুরিয়াসহ উত্তরবঙ্গ ধ্বংস করে উন্মুক্ত খনির চক্রান্ত বন্ধ করার দাবি জানান।
কর্মসূচি
* ফুলবাড়ী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আগামী ১১ অক্টোবর ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় ঘেরাও এবং প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান।
* ১৪ নভেম্বর দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় অভিমুখে মিছিল ও স্মারকলিপি প্রদান।

শুক্রবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৭

"এই সমাজ ভাঙিতেই হইব"

- স্বাক্ষাৎকারে কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডল   
উপমহাদেশের অন্যতম প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, স্বদেশি আন্দোলন করেছেন। ছেচল্লিশের ভয়াবহ দাঙ্গায় পাঁচ হাজার মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন। জ্যোতি বসুর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। ১৭ বছর জেল খাটা এই বিপ্লবী নেতার মুখোমুখি হয়েছেন ওমর শাহেদ। ছবি তুলেছেন কাকলী প্রধান
।।এই সমাজ ভাঙিতেই হইব।।
আপনার রাজনীতির শুরু কত বছর বয়সে?
কলকাতায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে ১০-১১ বছর বয়সে আমার কমিউনিস্ট জীবন শুরু। বাবার চাকরিসূত্রে তখন আমরা কলকাতায় নারিকেলডাঙা রেল কলোনিতে থাকতাম। বাবা রেলওয়ের টালি ক্লার্ক ছিলেন। কলোনির চারদিক ছোট প্রাচীর ঘেরা ছিল। বন্ধুবান্ধবরা সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রায়ই প্রাচীরের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে গল্পগুজব করতাম। তখন তো হিন্দু-মুসলমান প্রশ্ন ছিল না, সবাই অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। আমরা দেখতাম, মিছিল যাচ্ছে, মিছিলকারীরা নানা স্লোগান দিচ্ছে। স্লোগানগুলো ভালো লাগত। কমিউনিস্ট পার্টির মিছিল গেলে দেখতাম, ওদের স্লোগানগুলো অন্য পার্টির চেয়ে আলাদা। সেগুলো আরো ভালো লাগত। আমরা চার-পাঁচজন মিলে বলাবলি করতাম, চল তো মনুমেন্টের নিচে গিয়ে শুনি ওরা কী বলে? ওখানে ওরা আমাদের এ সমাজ ভাঙার কথা বলত।

কেন ভাঙতে হবে সে ব্যাখ্যা দিয়ে বলত, পৃথিবীতে দুটি শ্রেণিএকটি ধনী, অন্যটি গরিব। গরিবের সংখ্যাই বেশি। এরাই সব তৈরি করে; কিন্তু এদেরই খাবার জোটে না। আমি তো গরিব লোকের ছেলে, প্যান্টুলেনে তালি দিয়ে পরতে হয়। আমি বলতাম, কথাগুলো তো ঠিকই বলে। এদের রাজত্ব কবে হবে?
তখন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থা কেমন ছিল?
আমি কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম দিকের সদস্য। তখন বড়লোক, মধ্যবিত্ত, আমাদের মতো গরিবের ছেলেও পার্টিতে যেত। পার্টিতে যেসব জোতদার, জমিদার, তালুকদারের ছেলে-মেয়েরা আসতেন, তাঁরাও মহাত্যাগী ছিলেন। তাঁরা আজকের নেতাকর্মীর মতো ছিলেন না। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজাফ্ফর আহমদের কথাবার্তা, হাবভাব, চলাফেরা দেখে অভিভূত হয়ে যেতাম। মানুষ এত ভালো কী করে হয়? তিনি সবাইকে আপনিকরে বলতেন। তিনি কাউকে তুমিবলতে পারতেন না। ল্যাংটা ছেলেকেও আপনিবলতেন। একটি বিস্কুটও একলা খেতে পারতেন না। ভাগ করে খেতেন। মফস্বল থেকে কেউ পার্টি অফিসে এলে আপনার এলাকায় পার্টি কেমন আছে, পার্টি কেন শক্তিশালী হচ্ছে নাএসব কথা তাঁর ছিল না। তিনি বলতেন, ‘বউ ভালো আছে? আপনি ভালো আছেন? ছেলে-মেয়ে ভালো আছে? ওদের জামাকাপড় আছে তো? ঘরে খুঁটি আছে? বৈশাখী ঝড়ে চাল উড়ে যাবে না তো?’ এসব কথা এখন ভাবা যায়?
গান্ধী, নেহরু, আবুল কালাম আজাদ বক্তৃতায় কমিউনিস্টদের কথা কিছু বলতেন?
মহাত্মা গান্ধী, জওয়াহেরলাল নেহরুর সঙ্গে মওলানা আবুল কালাম আজাদের বক্তৃতার অনেক তফাত ছিল। গান্ধী, নেহরু মার্ক্সবাদ সম্পর্কে একটি শব্দও বলতেন না। তবে আবুল কালাম আজাদ তাঁর বক্তৃতায় যা-ই বলতেন না কেন, মার্ক্সবাদের কথা এক-আধবার উল্লেখ করতেন। নিশ্চয়ই মার্ক্সবাদ তাঁর পছন্দ ছিল।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি মনে আছে?
তখন কলকাতা থেকেই তো সব আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করা হতো। এ আন্দোলনের সব কথা তো মনে নেই। সে কী আজকের কথা? ৮৫ বছর আগের কথা (হাসি)। যাঁরা এই আন্দোলন করতেন, তাঁরা পোস্টার লাগাতে বললেই আমরা সব দলেরই পোস্টার লাগাতাম। তাঁরা হয়তো বলতেন, ধর্মতলায় পোস্টার লাগাবে। আমরা ধর্মতলার দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে বিপ্লবীদের সাহায্য করতাম। পুলিশ তাড়া করলে, কোনো বাড়ির মধ্যে গেলে, বাড়ির বউরাও তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে বলতেন, ‘এই খোকা কোথায় যাস? তোরা কারা?’ বলতাম, ‘আমরা স্বদেশি। ’ ‘ও পুলিশ তাড়া করেছে?’ ‘হ্যাঁ। ’ ‘ঢোক, ঢোক চৌকির নিচেবলে চৌকির নিচে ঢুকিয়ে তাঁরা চৌকির ওপর বসে থাকতেন।
বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমি সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়েছি। ১৯৪০ সালে রেলে আমার চাকরি হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আমার কাঁধে লেখা ছিল আইই (ইন্ডিয়ান ইঞ্জিনিয়ার্স)। মুম্বাই, মাদ্রাজসহ বিভিন্ন বন্দর থেকে যেসব কামান, বারুদের গাড়ি আসত, সেগুলো ট্রেনে আসামে পৌঁছে দিতাম। ট্রেনের ইঞ্জিনের বয়লারে কয়লা ভরতাম। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত যুদ্ধে সব রকমের সাহায্য করেছি। পার্টি থেকে তখন বলেছিল, কোনো রেস্ট পাওয়া যাবে না। বোমের গাড়ি, কামানের গাড়ি পৌঁছাতেই হবে। পৌঁছে দিয়েছি।
ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন কবে?
১৯৪০ সালে। আমাদের রেল শ্রমিকদের ইউনিয়নের নাম ছিল রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন। তখন টাকানয়, ‘আনিচালু ছিল। মাসে এক, দুই, চার পয়সা চাঁদা দিতাম। মার্ক্সবাদের ক্লাস করতাম। আমরা প্রশ্ন করতাম, তাঁরা ব্যাখ্যা করতেন। তখন বুঝলাম, কমিউনিস্ট পার্টি গরিব লোকের, যাঁরা উত্পাদন করেন তাঁদের পার্টি এবং তাঁরাই পৃথিবীর মালিক। আমি এখনো কমিউনিস্ট আছি এ কারণে যে এই পার্টি ছাড়া অন্য কোনো পার্টি দিয়ে বিপ্লব হবে না।
পার্টি করা কলোনির লোকেরা কিভাবে দেখতেন?
কলোনির লোকেরা ঠাট্টা করতেন, এরা বলে ব্রিটিশ খেদাবে! এরা বলে ধনী উচ্ছেদ করবে! কিন্তু লাল ঝাণ্ডা যে সাচ্চা লোকদের পার্টি এটাও তাঁরা বলতেন। তাঁরা জানতেন, এই পার্টিতে এমন সব সেলাক আছেন, যা অন্য কোনো পার্টিতে নেই। তবে মা-বাবা কিছু বলতেন না।
অনেক বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতার সান্নিধ্যে এসেছেন। 
কমরেড আবদুল হালিম পরে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে স্পিকার হয়েছিলেন। তিনি গরিবের ছেলে ছিলেন। সুকান্ত ভট্টাচার্য আমার খুব প্রিয় কবি। ওকে আমি খুব স্নেহ করতাম। সে পার্টি অফিসে আসত। খুব নম্র, ভদ্র, নিরীহ ছেলে ছিল। আমি খালি বলতাম, ‘তুমি বলে কবিতা লেখো? তুমি বলে কবি?’ সে মাথা ঝাঁকিয়ে, মুখ লজ্জায় বাঁকা করে ফেলত আর বলত, ‘না, না, আমি কোনো কবিতা লিখি না। ও মারা গেলে আমি খুব কেঁদেছিলাম। পিসি জোশি তখন কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি ছিলেন। বড় লোকের সন্তান হলেও তিনি পার্টিতে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। খোকা রায়, ইলা মিত্রের সঙ্গেও পার্টি করেছি। ইলা মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে হলেও জমিদারের বউ ছিল। সে একেবারে সাঁওতাল হয়ে থাকত, তারা তাকে দেবীমনে করত। সে এত সিম্পল ছিল যে ভাবা যায় না। মোহাম্মদ ফরহাদ খুব ডেডিকেটেড, পণ্ডিত লোক ছিল। রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি বীরেন দাশগুপ্ত খুব ভালো, সত্, অমায়িক লোক ছিলেন। রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জ্যোতি বসু।
তাঁর পক্ষে আপনি নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছিলেন। 
১৯৪৬ সালে পার্বতীপুরে পার্টির হয়ে আমি জ্যোতি বসুর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছিলাম। আমাদের বিপক্ষে মুসলিম লীগের হুমায়ূন কবীর দাঁড়িয়েছিলেন। নির্বাচনের দিন মুসলিম লীগওয়ালারা আমাদের প্ল্যাটফর্মেই উঠতে দিচ্ছিল না। লাল ঝাণ্ডার যত লোক ছিলাম, আমরা যাওয়ার পর মুসলিম লীগাররা তাড়া করে এলো। আমরাও রেডি হয়ে গিয়েছিলাম, মুসলিম লীগের গুণ্ডারা এলে মারামারি করব। শ্রমিকদের মারামারি তো ভদ্রলোকেরা কল্পনাও করতে পারবে না। পার্বতীপুরের রামরতন কট্টর কমিউনিস্ট বিহারি ছিল। আমি খুব ডানপিটে ছিলাম। আমরা ১৫-১৬ জন, আমার ও রামরতনের হাতে লোহার রড। এখনো আমার মাথায় দাগ আছে (দাগ দেখিয়ে)মাথায় লোহার রড দিয়ে বাড়ি মেরেছিল। আমরাও এলোপাতাড়ি মারামারি করে মুসলিম লীগওলাদের ধানের মাঠে ফেলে দিয়ে এলাম। জ্যোতিদা জিতেছিলেন। তিনি আমার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন। রাজনীতি শেখাতেন, মার্ক্সবাদ পড়াতেন। আমরা একসঙ্গে ওঠাবসা করতাম। তিনি খুব ভালো লোক ছিলেন।
রেলে কোন পদে যোগ দিয়েছিলেন?
খালাসি, বেতন ১৩ টাকা। ইঞ্জিনের ছাই, ময়লা ইঞ্জিনের সিমেন্টের কংক্রিটের গর্তে পড়ে থাকত। আমরা পাঁচ বা ১০ জন গর্তে নেমে শাবল দিয়ে ময়লাগুলো ওপরে তুলে দিতাম। ওপরে দাঁড়িয়ে অন্যরা সেগুলো ঝুড়ি ভর্তি করে খাদের মধ্যে ফেলত। খালাসি থেকে ফায়ারম্যান হলাম। তখন কাজ ছিল বয়লারে কয়লা ভরা। ১৯৪৯ সালে দেশের খাদ্য পরিস্থিতির চরম সংকটের সময় আমাদের কেনা চাল মিলিটারি ট্রেন থেকে নামিয়ে নিয়ে গেল। বললাম, চাল ফেরত না দিলে ধর্মঘট। এরপর তারা লিখিত দিয়েছিলরেলের কর্মচারীরা চাল আনা-নেওয়া করতে পারবে। কিন্তু আমাকে সাসপেন্ড করা হলো। পরে খুদের আন্দোলনে আমরা পাঁচ-ছয়জন আসাম মেইল ঠেকিয়ে দিলাম। আবার সাসপেন্ড করল। এত বড় নামকরা ট্রেন ঠেকিয়ে দেওয়ায় আমাদের নামে ওয়ারেন্টবেরোলো। আট মাস পালিয়ে থাকার পর ধরা পড়লাম। আমাদের জেলে নিয়ে গেল। আমার সঙ্গের খালাসি দেলোয়ারপরে রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছে। শুরু হলো জেলজীবন, চাকরি গেল।
পরে সংসার চালিয়েছেন কিভাবে?
সেলিনা বানু, রাজশাহীর মুসলিম লীগের একচ্ছত্র নেতা মাদার বকশ, মোক্তার আতাউর রহমানরা সাহায্য করতেন। পার্টির পাবনা জেলার সেক্রেটারি অমূল্য লাহিড়ীর অনেক জমিজমা ছিল। জমি বিক্রি করে তিনি পার্টি চালাতেন। এভাবে চলত।
ছেচল্লিশের দাঙ্গায় বীরের ভূমিকা পালন করেছিলেন। 
দাঙ্গার মধ্যে শিয়ালদহ থেকে রানাঘাটের উদ্দেশে ট্রেন ছাড়লাম। মানুষের ভীষণ চাপাচাপিতে ট্রেনের মধ্যেই পাঁচ-সাতটি ছেলে মারা গেল। তার মধ্যেই পাঁচ-সাতটি মেয়ে এসে উঠে পড়ল। ট্রেনের ড্রাইভার ছিল অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ভিভি। সে বলল, ‘এরা যে উঠল, যাবে কী করে?’ বললাম, ‘এরা তো জীবনের ভয়েই ইঞ্জিনরুমে উঠে পড়েছে, কিন্তু বয়লারের মহা আগুন তো দেখেনি। সে বলল, ‘নামাব কী করে?’ বললাম, ‘দেখি। ওদের বললাম, ‘যদি রাজি থাকো রানাঘাট পর্যন্ত উপুড় হয়ে থাকতে হবে। তারা বলল, ‘তুমি যেভাবে বলবে সেভাবে থাকব। আমরা কলকাতায় ফিরে যেতে পারব না। তারা উপুড় হয়ে থাকল। আমিও ইঞ্জিনে কয়লা দিতে থাকলাম। বয়লার যখন খুলেছি, মেয়েগুলো ঘামে স্নান করে ফেলেছে। তারা বলল, ‘আর কত দূর?’ বললাম, ‘এই তো ঘণ্টাখানেক। আমাদের কাছে মেসেজ ছিলকোনো জায়গায় দাঁড়াবে না। সব লাইন ক্লিয়ার, সোজা চলে যাবে। ড্রাইভার বলল, ‘মণ্ডল কত স্পিডে যাব?’ বললাম, ৪২। আমরা যাচ্ছি। ব্যারাকপুরে গাড়িতে বোম মারল। তারপর লাইনের মধ্যে লাল কাপড় দিল। লাল কাপড় মানে ডেঞ্জার। তাহলে আমরা দাঁড়াব, তারা দাঙ্গা করবে। ট্রেনের হুইসেল বাজছে, তাও তারা লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার বলল, ‘মণ্ডল এখন কী করবে?’ বললাম, ‘এরা ৫০০ আর আমার ট্রেনে পাঁচ হাজার মানুষ আছে। ৫০০ মারব, না পাঁচ হাজারকে বাঁচাব? ওদের ওপর দিয়েই যাব। ড্রাইভার পানির পাইপ খুলে দিল। হুসহুস শব্দ হচ্ছে। তাও রায়টওয়ালারা যায় না, মিছিল সরে না। তারা হাত তুলছে। তখন ড্রাইভার বলল, ‘এই স্পিডে যাবে?’ বললাম, ‘না, স্পিড আরো দুই বেল বাড়িয়ে দিব। ৪২-এ আসছিলাম, ৪৪ করে দিলাম। বয়লারে ডাবল কয়লা দিয়ে ইঞ্জিনের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিতারা অবাক হয়ে দেখছে, ট্রেন থামছে না। অনেকে এদিক-ওদিক লাফ দিল। তবে ভয়ংকর দাঙ্গাবাজরা লাইনের মধ্যেই থাকল। আমরা তাদের চষে, ডলে, হাড়-হাড্ডি গুঁড়ো করে চলে গেলাম। পরে ইঞ্জিনের বয়লারে মাংস লেগে থাকতে দেখেছি। তখন কত দাঙ্গাবাজ মারা গেছে, সে হদিস এখন পর্যন্ত হয়নি।
দেশভাগের পরে ঈশ্বরদী চলে এলেন কেন?
বাবা ঈশ্বরদীতে চাকরি করতেন। তিনি ওখানে বাড়ি বানিয়েছিলেন। তবে আমার পৈতৃক বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানায়। তখন আমি রেলে ফায়ারম্যান। কত মাইল গিয়েছি, কত মাইল এসেছি, তার ওপর বেতন নির্ভর করত। কখনো ৪০, কখনো মাসে ৫০ টাকা বেতন হতো। ঈশ্বরদীতে তো অনেক বিহারি আছে। তারা বুঝেছিল, আমরা না বুঝে পাকিস্তানে এসেছি। আমাদের না পাকিস্তানওলারা দেখছে, না ভারতীয়রা। এই লোকটি বিহারির পক্ষেও না, বাঙালির পক্ষেও না। লোকটি নিরপেক্ষ, সবার ভালো চায়। তাদের মধ্যে অনেকে পার্টি করত। ফলে রাজনীতি করতে অসুবিধা হয়নি।
সেখানে আপনার সহায়-সম্পদ আছে?
আমার নিজের কিছু নেই। তবে এখন মেয়েরা বাড়িঘর বানিয়েছে। আমার পাঁচ মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ে সালেহা বেগম মনার জামাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিল। তার নাম ইদ্রিস আলী। সে মারা গেছে। মেয়ে সাভারে বাড়ি বানিয়ে পাঁচ ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকে। মেজো মেয়ে আলেয়া বেগম পান্নার জামাই হাতেম আলী মাস্টার খুলনা জুট মিলে চাকরি করত। সে খুব জনপ্রিয় শ্রমিক নেতা ছিল। কমিউনিস্ট পার্টি করত। বন্দুকওয়ালাদের সঙ্গে বিপ্লব করতে গিয়েছিল। তাদের সবাইকে বলেছিলাম, ‘পাঁচ ইঞ্চি রিভলবার দিয়ে যারা মেশিনগানের মোকাবেলা করতে যায়, তারা পাগল। আবদুল হক খুব ত্যাগী কমিউনিস্ট ছিল। সে দেখল, এভাবে ঘরে বসে থেকে, বিপ্লবী কথা বলে বিপ্লব হবে না। মানুষের কাছে যেতে হবে। সে কলকাতা থেকে কিছু রিভলবার কিনে দল বানাল। পরে সেই লাইন বাদ দিয়ে হাতেম আলী মাস্টার আবার কমিউনিস্ট পার্টিতে এসেছে। দক্ষিণবঙ্গের পাটকলগুলোতে সব ট্রেড ইউনিয়ন সে করেছে। আমিও শ্রমিক নেতা ছিলাম। কিন্তু সে এত জনপ্রিয় ছিল যে তার ধারে-কাছে যেতে পারিনি। সে এত সহজ, সরল ছিল যে শ্রমিকদের কাছ থেকে মাস্টারউপাধি পেয়েছিল। এটি বাংলাদেশে খুব বিরল। সে মুসাবিদা খুব ভালো করত। ভালো দরখাস্ত লিখতে পারত। ১৯৯২ সালে অসুস্থ হয়ে সে খুলনার আড়াই শ বেডের হাসপাতালে মারা গেছে। সেই মেয়ের ঘরে ছয় নাতি, তিন নাতনি আছে। সেজো মেয়ে আফরোজা বেগম মীনার জামাই আহসান হাবিব লিংকন এরশাদের আমলে একবার জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য হয়েছিল। পরে কাজী জাফর গ্রুপে ছিল। এখন আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর দল করে। তারা কুষ্টিয়ায় থাকে। তাদের অনেক সহায়-সম্পত্তি আছে। এর পরের মেয়ে বিলকিস বেগম বিলুর স্বামী ফজলুর রহমান হান্টু একবার ঈশ্বরদী পৌরসভার কাউন্সিলর হয়েছিল। এখন ব্যবসা করে। তার এক ছেলে, এক মেয়ে। এর পরের মেয়ে আলোর স্বামী স্ট্রোকে মারা গেছে। সে আমার সঙ্গে থাকে। আমাকে সেজো মেয়ে আর ছোট মেয়ে দেখাশোনা করে। বাম রাজনীতি করে বলে মেয়েদের নেতাদের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছি। ৫০ বছর আগে তো প্রায় সবাই সত্ নেতা ছিল। তারাও সত্ নেতা ছিল। আমার একমাত্র ছেলে রবিউল আলম ক্যান্সারে মারা গেছে।
খুদবিরোধী আন্দোলনটি কিভাবে করেছিলেন? 
১৯৪৯ সালের এই আন্দোলন এক দিনে তৈরি হয়নি। জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে শ্রমিকরা এ আন্দোলনে এসেছেন। দক্ষিণবঙ্গের সীমান্ত যশোর থেকে ভারতের চিলাহাটির হলদেবাড়িপুরো এলাকায় আমি আন্দোলন অর্গানাইজ করেছিলাম। সে জন্য কাজে যেতাম না। বারবার সাসপেন্ড হতাম। আমি বলতাম, ‘তোমরা বলতে সাধের পাকিস্তান হলে, মুসলমানদের পাকিস্তান হলে, আল্লাহ চালাবে, ফেরেশতারা দেখবে, মানুষের সুখের সীমা থাকবে না; তো একচোটে খুদে নেমে গেলে? খুদ তো মুরগি খায়। এটা মানুষকে খাওয়াবে?’ খুদ রান্না করলে গন্ধ হতো। এসব কারণে শ্রমিকদের বউয়েরা ব্যাপক সাড়া দিয়েছিলেন। ফলে স্ট্রাইক হলো। আমাকে সাসপেন্ড করল। আট মাস লুকিয়ে থাকার পরে গ্রেপ্তার করে পাবনা জেলে নিয়ে গেল। জেলে গিয়ে দেখলাম, ঘানি টানায়। আমি বললাম, ‘ঘানি গরু ঘোরায়, মানুষ দিয়ে ঘোরানো যাবে না। আমি ঘানি ঘোরাতে পারব না। জেলে সরকারের দালাল গফুর বলল, ‘হারামজাদা শুয়োরের বাচ্চা, শালা, তুমি বড় নেতা হয়ে এসেছ? ওসব নেতা গফুরের কাছে চলবে না। ঘানি টানতেই হবে। যেই না সে কথাটি বলল, শালকাঠের খাটের ওপর বসে ছিলাম, পায়া তুলে গফুরের দিকে তেড়ে গেলাম। দু-তিনজন আমাকে ঠেকিয়ে বলল, ‘মারামারি করবেন না, আরো বিপদ হবে। গফুর ভয়ে ঘানিঘর থেকে দৌড়ে সিপাইদের কাছে গিয়ে বলল, ‘মণ্ডল আমাকে মারতে আসছে। সে ঘানি ঘুরাবে না। এর মধ্যে হুইসেল, পাগলা ঘণ্টা বেজে গেল। দুই-তিন শ সিপাই চারদিক থেকে আমাকে ঘিরে ফেলল। ঘিরেই যখন ফেলল, মনে হলো, শালার ঘানি ভেঙে দিই। খাটের পায়া দিয়ে ঘানিতে বাড়ি দিলাম। চায়না লোহার ঘানি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। পর পর তিনটি ঘানি ভেঙে ফেললাম। পরে সেলে নিয়ে গিয়ে আমাকে ন্যাংটা করে রাখল। যাতে কারো সঙ্গে মিশতে না পারি। ভাত দিল, খেলাম না। বললাম, আমার বিচার না হওয়া পর্যন্ত খাব না। পর পর তিন দিন না খেয়ে থাকলাম। ওরা মাঘ মাসের শীতে সেলের মধ্যে পানি ঢেলে দিল। আমি উলঙ্গ, শুয়ে আছি। এর মধ্যে কই, জসিম উদ্দিন কইবলে জেলা প্রশাসক এলেন। সেলের রেলিং ধরে দাঁড়ানো আমাকে দেখে তিনি খেপে বোম হয়ে বললেন, ‘জেলার সাহেব ওকে উলঙ্গ কে করেছে? কেন করলেন?’ আমি বললাম, ‘ডিসি সাহেব, আপনি ওখানে গেলে হবে না। আগে আমার কথা শুনবেন। তারপর খাব। তিনি বললেন, ‘সব কথা শুনব। আগে কাপড়চোপড় পরেন, খান। শিগগির তাঁর কাপড় নিয়ে আসো। তিন-চারজন মিলে জোরজবরদস্তি করে কাপড় পরাল। এরপর তিনি বললেন, ‘কী নালিশ?’ বললাম, ‘বন্দিদের দিয়ে ঘানি ঘোরানো যাবে না। সকালের ছোলা সিদ্ধে পোকা থাকে। সেটি খাওয়ানো চলবে না। চার ছটাক চালের ভাতে পেট ভরে না। ছয় ছটাক দিতে হবে। এই জমাদার আমাদের দুই হাঁটুর মধ্যে হাত ঢোকাতে বাধ্য করে কাঁধের নিচে ডাণ্ডা দিয়ে ঘুঘুর ফাঁদ বানিয়ে রাখে। এসব করা যাবে না। পরে সব বন্ধ হলো। তবে আমাকে রাজশাহী জেলে পাঠিয়ে দিল।
সেখানে খাপড়া ওয়ার্ডে গুলি চালানো বিলের সঙ্গে কী হয়েছিল?
খাপড়া ওয়ার্ডের শহীদরা তো সব মহা দেশপ্রেমিক। অতি সত্, ত্যাগী। না হলে জানালা, দরজা বন্ধ করতে গিয়ে ওভাবে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান জেল সুপার বিলের নির্দেশে চালানো গুলিতে কেউ অকাতরে গুলি খেয়ে মারা যায়? এ রকম উদাহরণ পৃথিবীতে নেই, বাংলাদেশেও নেই। জেলে নতুন কয়েদি এলে জমাদাররা বিলের কাছে নিয়ে গিয়ে তাকে সালাম করাত। আমি বললাম, ‘জমাদার, বিল জেলখানায় সাত কমিউনিস্টকে গুলি করে মেরেছে। আমি কিন্তু বিলকে সালাম করতে পারব না। তারা বলল, ‘করতেই হবে। আমাকে জোর করে নিয়ে গেল। বিল এসে আমি হাত তুলছি কি না সে অফিসরুম থেকে দেখল। সালাম দিলাম না। সে আমাকে ডাণ্ডাবেড়ি, হাত পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে রাখাসহ কত যে শাস্তি দিয়েছিল। তা-ও গলাতে পারেনি। পরে আমাকে রাজবন্দি ওয়ার্ডে নিল।
ফ্যামিলি অ্যালাউন্স কিভাবে আদায় করলেন?
একদিন দেখি, জেলের ভেতরে সাড়া পড়ে গেছে। আমাদের সেলগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে। দালানকোঠায় চুনকামের বহর, নতুন এক সেট পোশাক দেখে সন্দেহ হলো। খবর নিয়ে জানলাম, গভর্নর নুরুল আমিন ও মন্ত্রী আজিজ আহমদ খান আসছেন। তাঁরা রাজবন্দিদের সঙ্গে আলাপ করতে এলে আমরা ফ্যামিলি অ্যালাউন্সের দাবি তুললাম। বললাম, আমাদের বিনা বিচারে আটক রাখা হয়েছে। তাই এই সময় চলার জন্য পরিবারগুলোকে ফ্যামিলি অ্যালাউন্স দিতে হবে। আজিজ আহমদ খানকে আমি আলাদাভাবে এই দাবির কথা বললে তিনি বিবেচনা করবেন বলে আশ্বাস দিলেন। তাঁরা জানতেন, না হলে আমি গোলমাল করব। আমি তো সারা জীবন সব জায়গায় প্রতিবাদ করেছি। আজও, এখনো বিশ্বাস করি, মার্ক্সবাদ, মার্ক্সবাদের অঙ্ক সঠিক। আমি কাটারিভোগ তৈরি করব, সেটি আমার ছেলে-মেয়ে, আমি খেতে পারব না? আমার কপালে নেই? এ কথা আমি এখনো বিশ্বাস করি না। অতএব, এই ধনতান্ত্রিক সিস্টেম আর বরদাশত করা যাবে না। এই সমাজ আমাকে ভাঙিতেই হইবে। পরে বিনা বিচারে আটক বন্দিদের পরিবারগুলোকে ১৫০ টাকা করে ফ্যামিলি অ্যালাউন্স দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
জেল থেকে বেরিয়ে পাকিস্তানের যোগাযোগমন্ত্রীকে কিভাবে ঘেরাও করেছিলেন? 
মুসলিম লীগের মন্ত্রী আবদুর রব নিশতার সৈয়দপুরে রেল কারখানা দেখতে গিয়েছিলেন। আমরা শ্রমিকরাও গেলাম। তিনি বললেন, ‘কী ব্যাপার?’ কথাবার্তার পর বললেন, ‘এদের বহু চাহিদা, এখন কথা বলার সময় নেই। চলে যাব। এই কথা শুনে সামাদ নামের লাল ঝাণ্ডার এক শ্রমিক তাঁর রেলের কম্পাউন্ডে উঠে ট্রেন জোড়া লাগানোর আংটা কেটে দিল। পার্বতীপুর যাওয়ার জন্য যখন ইঞ্জিন চালু করল, গোটা ট্রেন পড়ে রইল। হৈহৈ শুরু হলো। কর্মকর্তারা মন্ত্রীকে বললেন, ‘আপনার ট্রেন শ্রমিকরা কেটে রেখেছে। কিভাবে যাবেন?’ তখন মন্ত্রী বললেন, ‘ঠিক আছে, শ্রমিকদের কথা শুনব। পরে আমাদের রেশনে খুদের বদলে চাল দেওয়া হলো।
১৯৫৪ সালে জেল খেটেছিলেন কেন?
আমাকে ৯২-এর ক-ধারায় গ্রেপ্তার করেছিল। রাজশাহী, ঢাকা জেলে ছিলাম। খুব কষ্টে কেটেছে। ঢাকা জেলে সত্যেন সেন, নগেন সরকার, শহীদুল্লাহ কায়সারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এসব লোকের সঙ্গে আমি জেল খেটেছি। তাঁদের কাছ থেকে শিখেছি। তাঁরা আমাদের পড়াতেন। সত্যেনদা, নগেনদা আমার গুরু। খুব সত্, খুব ভালো লোক ছিলেন। ঢাকা জেলের ২৬ নম্বর সেলেই তো সত্যেনদা উদীচীর জন্ম দিলেন। আমি রোজ বলতাম, ‘দাদা, এ দেশের মানুষ গান খুব পছন্দ করে। মুকুন্দ দাসের মতো একটি গানের দল না বানাতে পারলে এ দেশে বিপ্লব হবে না। রণেশদা (দাশগুপ্ত), সত্যেনদা বসে আলাপ করে এক দিন বললেন, ‘হ্যাঁ গানের দল হবে। কী নাম হবে?’ আমরা কত কী নাম বললাম। একদিন সকালে উঠে তাঁরা বললেন, নাম হবে উদীচী। মানে পূর্ব দিক থেকে আলোর উদয় হয়। জেল থেকে বেরোনোর পর তাঁরা দল তৈরি করলেন।
পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়ে গেলে কিভাবে ছিলেন?
নানা জায়গায় পালিয়ে ছিলাম। না খেয়ে থাকতে হতো। সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, ঈশ্বরদীর গ্রামে গ্রামে আজ এই বাড়ি, কাল ওই বাড়িতে থেকেছি। তখন মনি সিংদের সঙ্গে যোগাযোগ হতো।
জিয়াউর রহমানের আমলেও তো জেল খেটেছেন?
তার নীতি সমর্থন করিনি বলে দুই বছর জেল খাটাল। ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, কুষ্টিয়া জেলে ছিলাম। এরশাদও সামরিক শাসন সমর্থন করিনি বলে জেলে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পালিয়ে ছিলাম বলে ধরতে পারেনি।
মুক্তিযুদ্ধের জীবন?
আমরা তো পাকিস্তানের জন্মই স্বীকার করিনি। আমার স্ত্রী, ছেলে-মেয়েরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। এই কারণে যুদ্ধের সময় পুরো ঈশ্বরদীতে কোনো বাড়ি পোড়েনি অথচ আমার বাড়ি পুড়িয়ে খুঁটি পর্যন্ত তুলে নিয়ে গিয়েছিল। বাড়ির চিহ্নই ছিল না। পরে সেই জমি বিক্রি করে খেয়েছি। আমরা কুষ্টিয়া-পাবনা সেক্টরে গেরিলা বাহিনীতে কুষ্টিয়ার কমিউনিস্ট জাহিদ রুমীর অধীনে যুদ্ধ করেছি। আমাদের কাজ ছিলদেশের ভেতরে যাওয়া ও যুদ্ধের জন্য ছেলেদের জোগাড় করা, যারা সীমান্তের ভেতরে বউ, ছেলে-মেয়ে নিয়ে আছে, তাদের দেখভাল করা। ভারতে ট্রেনিং নেওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের দেশে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেওয়া। গ্রামগুলোতে আমাদের অনেক নিরাপদ ঘাঁটি ছিল। জলপাইগুড়ি, দিনহাটাসহ সব সীমান্তে আমি ঘুরে বেড়াতাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় গোটা ভারতের অর্ধেক চষে আমি, ইন্দ্রজিত্ গুপ্ত, রণেশ মিত্র, ইলা মিত্রের কাজই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অর্গানাইজ করা। কে কোথায় ট্রেনিং নিয়ে এসেছে, ক্যাম্পে জায়গা হচ্ছে কি না সব দেখাশোনা করা। আমার দুই মেয়েকে জ্যোতি বসু মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে কাজ দিয়েছিলেন। অথচ আমার মেয়েরা কেউ মুক্তিযোদ্ধার সনদ পায়নি।
কিভাবে চলেন?
মুক্তিযোদ্ধার ফান্ডে। আমি রাজনীতি করে টাকা-পয়সা বানাইনি। টাকা বানাতে পারতাম, বানানো জানি। কিন্তু মার্ক্সবাদ, শ্রেণি, শ্রেণিসংগ্রাম বিশ্বাস করি। আমি জানি, গরিবকে না মারলে বড়লোক হওয়া যায় না। সারা জীবন, এখনো এটি হাড়ে হাড়ে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিলিয়ে দেখেছি। তবে আমার এই রাজনীতির কারণে পরিবারের অনেক কষ্ট হয়েছে। ১৭ বছর জেল খেটেছি। তবু স্ত্রী সরেনি। স্ত্রী সাহায্য না করলে কারো বাপের ক্ষমতা নেই রাজনীতি করে।
ঢাকামুখী রাজনীতি করেননি কেন?
আমি এখন কমিউনিস্ট পার্টির উপদেষ্টা। যে কথা আমরা ঢাকায় বলি, সেটি যদি গ্রামে না নিয়ে যাই, আমতলা, বাঁশতলা, কাঁঠালগাছের নিচে, হাটে, ঘাটে, মাঠে, গ্রামের মানুষের কাছে না নিয়ে যাই, তাহলে কিভাবে হবে? সে জন্য ঢাকায় আসতে চাইনি। আমার কথা হলো, পার্টিকে গ্রামে নিতে হবে। এখন তারা যাচ্ছে।
এত ভালো বক্তৃতা কিভাবে দেন?
সিক্স পর্যন্ত পড়েছি। তবে মার্ক্সবাদ শুনে, পড়ে শিখেছি। তা ছাড়া মানুষের সঙ্গে মিশি। আমার বক্তৃতা গরিবরা বেশি শোনে। কারণ গরিব যে ভাষায় শুনতে চায়, সেই ভাষা আমি জানি। ওই জীবনযাপন করি, ওভাবে চলাফেরা করি।

সবচেয়ে প্রবীণ কমিউনিস্ট হিসেবে কোনো স্বপ্ন?
আমি তো ব্রিটিশ, সাধের পাকিস্তান, বাংলাদেশও দেখলাম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার দেখলাম। সব তো একই। পরিবর্তন তো দেখছি না। ব্রিটিশ, পাকিস্তান, বাংলাদেশওলাসবাই তো একই কথা বলে। ফলে স্বপ্ন একটাইসমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র হবেই। 
(২৫ আগস্ট, ২০১৭ দৈনিক কালেরকন্ঠ প্রকাশিত)