রোহিঙ্গা হিন্দু শরণার্থীদের দলটি প্রথম যেদিন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসে পৌঁছায় সেদিন তাদের অনেকেরই অভিজ্ঞতা পরদিন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়। তাদের ভাষ্য ছিল- মুখোশধারী লোকেরা এসে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে, নির্বিচারে খুন করেছে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় রাখাইনদের হুমকির প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলেন কেউ কেউ। এবং সকলেই বলেছিলেন-রোহিঙ্গা মুসলিমদের সাথে তাদের কোনো সংকট বা সংঘাত আগে-পরে হয়নি। তাদের এই ভাষ্য নিয়ে কারো মনে কোনো সন্দেহ হয়নি-রোহিঙ্গা মুসলিমদের সাথে একসাথেই এসেছিলেন তারা।
২০১২ সালের সংঘাতেও বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলো- ওইবার দুই হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হন। এবারেও ইতোমধ্যে মারা গেছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা। এই হত্যাকাণ্ড বা ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর চেয়ে তাদের সহযোগী বেসামরিক রাখাইনদের অংশগ্রহণ এবং ভূমিকা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি। এই পয়েন্টটা খুব একটা আলোচিত হচ্ছে না। ফলে পৃথিবীর মানুষ ভাবছে- রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযান শেষ করা গেলে রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা আপাতত ঠেকানো যাবে। এইটা একেবারেই ভুল। বরং জানা গেছে, কিছু কিছু জায়গায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এ্যাকশন কিছু রোহিঙ্গাদের জানে বাঁচিয়ে সীমান্ত অবধি আসতে সহযোগিতা করেছে। রোহিঙ্গা হিন্দুদের কারা খুন করেছে বা কারা তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে- সেই সত্য জানতে হলে উপরোক্ত ফ্যাক্টটা বোঝা জরুরি।
বিগত বছরগুলিতে বিশ্বব্যাপী অসংখ্য যুদ্ধ-সংঘাত আমরা দেখেছি। আফগানিস্তান থেকে শুরু করে ইরাক-লিবিয়া-সিরিয়া-গাজা; আমরা ছিলাম এসব যুদ্ধের টেলিভিশন ভোক্তা। একটা মর্টার শেল বা কামানের গোলা ছুঁড়ে দেয়া হল, আর তার পাশ থেকে উত্তেজনাকর পিটিসি দিচ্ছেন টিভি সাংবাদিক- এইটা গ্লোবাল টিভি মিডিয়ার সবচেয়ে কমন চেহারাগুলোর একটা। কিন্তু সব সংঘাতের ময়দানে প্রবেশাধিকার থাকলেও মিয়ানমারে প্রবেশাধিকার পায়নি আন্তর্জাতিক মিডিয়া। এর কারণ খুব স্পষ্ট। মিয়ানমার যা যা করছে আর যা যা বলছে তার মধ্যে ফারাক আছে। এই ফারাকটুকু পৃথিবীর মানুষকে তারা দেখতে দিতে চায় না। এর মধ্যেও গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক মিডিয়া মিয়ানমারের সরকারি নিয়ন্ত্রণে কিছু কিছু স্টোরি করেছে। সেগুলো যা যা পাওয়া যায় তার সবগুলোই আমি ইউটিউবে দেখেছি। সেগুলোতে বা এবারকার বিবিসির রিপোর্টটিতে, এই ইস্যুতে রাখাইন জনগোষ্ঠীর যারা যারা মন্তব্য করেছেন- সেগুলো শুনলেই ‘এথনিক ক্লিনজিং’ এর স্বরূপ কী তা বোঝা যাবে। তারা রোহিঙ্গা পরিচয়কে মিথ্যা কারসাজি মনে করে। তাদের মতে, এরা বাঙালি এবং তাদের পিতৃভূমি রাখাইন রাজ্যে এদের কোনো স্থান হবে না। এবং কথাগুলো বলার যে শারীরিক ভাষা- তাতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে এটা কোনো মুখের কথা নয়, রোহিঙ্গাদের এখান থেকে বিতাড়িত করার জন্য যা যা করতে হবে তার সবকিছুর প্রস্তুতি তারা নিয়েছে। এই উগ্র রাখাইন জেনারেশন সামরিক জান্তাদের ছায়াতলে বেড়ে উঠেছে- যে মুখস্ত বুলি আজ মিয়ানমার রাষ্ট্র, তাদের জেনারেলরা বা অং-সান-সু চি আউড়াচ্ছে; তা আগেই রাখাইনদের ঠোটস্থ করিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যদি ধরে নেই, রোহিঙ্গারা বৃহত্তর বাঙালি সংস্কৃতিজাত- তারপরেও সেই জনগোষ্ঠীকে সমূলে বিতাড়নের তত্ত্ব আসছে কেন? আরাকানের সাথে বাঙলার সম্পর্ক সুপ্রাচীন। সেই সম্পর্কে বাঙালির পক্ষ থেকে জোরাজুরির কোনো ইতিহাস নেই। যে জলদস্যুরা একদা দাস বানাতে বাঙলার মানুষদের ধরে ধরে নিয়ে গিয়েছিল- সেই জলদস্যুরা রাখাইনদেরই পূর্বপুরুষ। ১৪০৬ সালে আরাকানের ম্রাউক-উ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নরমিখলা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বাংলার তৎকালীন রাজধানী গৌড়ে পালিয়ে যান। গৌড়ের শাসক জালালুদ্দিন শাহ ৩০ হাজার সৈন্য পাঠিয়ে বর্মী রাজাকে হটিয়ে নরমিখলাকে পুনরায় ক্ষমতায় বসান। রাখাইন এবং অ-রাখাইন সকলেই দীর্ঘকাল ধরে আরাকান রাজ্যে বাস করে এসেছে। আজ তাহলে রাখাইনদের ইতিহাসে নতুন কোন উপলব্ধি রোহিঙ্গাদের বাঙালি বানিয়ে আরাকান (রাখাইন রাজ্য) থেকে বিতাড়িত করতে চাইছে। এর উত্তর কিছুটা মেলে ‘আল জাজিরার’ এক তথ্যচিত্রে জনৈক রাখাইন ইতিহাসবিদের মন্তব্যে। তিনি সাধারণ রাখাইনদের মত উগ্র স্বরে কিছু বলেননি- কিন্তু কথার সারমর্ম একই। তিনি বলতে চাইলেন- রাখাইনরা দীর্ঘকাল ধরে বঞ্চনার শিকার। আর এখন রাখাইন রাজ্যে অ-রাখাইনদের ভিন্ন সংস্কৃতির যে প্রবল উপস্থিতি তা রাখাইনদের জাতিগত অস্তিত্ব ও বিকাশের জন্য হুমকি। বাঙালি শব্দটি তিনি উচ্চারণ করেননি ঠিকই কিন্তু তার ইঙ্গিতও বাঙালিত্বের দিকেই ছিল। এই রাজনীতিটুকু জানা থাকলে সহজেই বোঝা যায়- রোহিঙ্গা হিন্দুদের কারা মেরেছে? মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দাবি অনুযায়ী এই গণকবর রোহিঙ্গা হিন্দুদের হলে তাদের কারা মেরেছে। রোহিঙ্গা হিন্দুরাও ওই বাঙালিত্বের ডকট্রিনেই পড়ে- তাদের এথনিসিটি মোটেও বর্মী বা রাখাইন নয়।
আলোচনাটা শুরু হয়েছিল রোহিঙ্গা হিন্দুদের প্রসঙ্গে। শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে এসে তাদের উপর আক্রমণ প্রসঙ্গে প্রথম যে ভাষ্যটি তারা দিয়েছিলেন, গোটা ঘটনা পরম্পরার পূর্বাপর সেটাকেই সমর্থন করে। কিন্তু প্রোপাগান্ডার রাজনীতি সক্রিয় হওয়ার পরে ভাষ্য বদলাতে লাগলো। কীভাবে এটা কাজ করেছে তার পর্যবেক্ষণ গতকাল নিজের ফেসবুকে দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আ আল মামুন। প্রথমে অখ্যাত কিছু নিউজ পোর্টালে অসমর্থিত সূত্রে চটকদার শিরোনামে নানান রকম খবর আসতে লাগলো। সেখানে রোহিঙ্গা হিন্দুদের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছিলো যে রোহিঙ্গা মুসলমানরাই তাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। খবরগুলো আপাদমস্তক শিরোনামসর্বস্ব, ভেতরে তেমন কিছুই ছিল না- এ ধরণের খবরগুলোর শিরোনামটাই সবাই পড়ে এবং যার যার প্রয়োজন অনুযায়ী ভাষ্য তৈরি করে। কমিউনিটি ব্লগগুলোকেও ব্যবহার করা হলো। ইস্টিশন ব্লগে একটি পোস্ট চোখে পড়েছিলো। লম্বা শিরোনামের একটি পোস্ট, যার সাথে ছয়টি ইউটিউবের ভিডিও লিংক সংযুক্ত করা ছিল। শিরোনামে ছিল যে রোহিঙ্গা হিন্দুদের মুখ থেকে শুনুন- কীভাবে রোহিঙ্গা মুসলিমরা তাদের নিপীড়ণ করেছে। আমি ছয়টি লিংকেই ক্লিক করে দেখলাম। ওখানে কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা হিন্দুদের ক্যাম্পের কিছু সাধারণ ফুটেজ ছাড়া কিছুই নেই। একাধিক রোহিঙ্গা হিন্দু নারী প্রথম দিনেই বলেছিলেন যে তারা মুসলিম নারীদের সাথে বোরখা পরে পালিয়ে আসেন। ওটাই প্রোপাগান্ডিস্টদের ভাষ্যে হয়ে যায়- জোর করে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করে বা ধর্মান্তরিত হওয়ার শর্তে তাদের পালিয়ে আসতে সাহায্য করা হয়। রোহিঙ্গারা জীবন বাঁচাতে কীভাবে ছুটে এসেছে তা আমরা দেখেছি। ওই অবস্থায়ও তারা হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করতে চাইছিলো- এটা ভাবতে হলে মাথায় মগজের বদলে আবর্জনা থাকতে হয়। জান বাঁচিয়ে বাংলাদেশের নিরাপদ পরিবেশে এসেও যে রোহিঙ্গা মুসলিমরা ইস্কনের খিচুড়ি খাচ্ছে- নিজের পোড়া ভিটেমাটি ও স্বজনের লাশ পেছনে ফেলে পালিয়ে আসার সময় সে রোহিঙ্গা হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করতে চাইছিল-এরচেয়ে কুৎসিত প্রোপাগান্ডা আর হয় না।
রাখাইন রাজ্যের সংঘাত সহিংসতার সাম্প্রতিক ঘটনাবলী অথবা গত কয়েক দশকের ইতিহাসে চোখ বোলালে স্পষ্টতই জাতিগত নির্মূলের কনসিকোয়েন্স ধরা পড়ে। এর সাথে ইসলামী জঙ্গিবাদ বা আরসার সম্পর্ক অনেক দূরবর্তী। এগুলো কেবল ঘটনার প্রতিক্রিয়া মাত্র। রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমারের হত্যা-জুলুম-উৎপাটনের অবসান না হলে এসব প্রতিক্রিয়া কোনো না কোনোভাবে হতেই থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিক্রিয়াগুলোকে ফোকাস করে মিয়ানমার তার হাতে ঘটতে থাকা বর্বরতম এক গণহত্যাকে আড়াল করতে চাইছে- এটা জেনে বুঝেও যারা মিয়ানমারের কুটনৈতিক কৌশলের অংশ হয়ে তাদেরই প্রোপাগান্ডার প্রচার করে যাচ্ছেন; তাদের স্বার্থ কী? স্বয়ং গোয়েবলসও যদি আজ বেঁচে থাকতেন- তাদের দেখে আশ্চর্য হতেন যারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সরবরাহ করা তথ্য সত্য মনে করে প্রচার করে যাচ্ছেন। হিন্দুদের গণকবর সংক্রান্ত হিন্দুস্তান টাইমসের খবরে পাবলিক কমেন্টগুলো পড়ে শিউরে উঠলাম- কত সহজে আজকাল মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে মানুষের মনে বিষ ঢেলে দেয়া যায়। নরেন্দ্র মোদীর মিয়ানমার নীতি ভারতে চ্যালেঞ্জের মুখে ছিল- এই এক প্রোপাগান্ডা সব চ্যালেঞ্জকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিল।
তারপরেও আমি আশাবাদী যে ভারত-বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ গণহত্যাকারী মায়ানমার রাষ্ট্র ও দুই দেশেই তাদের হয়ে খেলতে থাকা স্বার্থান্বেষীদের প্রোপাগান্ডা ছিন্ন করে সত্য দেখতে পাবেন- বর্বরতা এবং অসত্যের বিরুদ্ধে মানবঢাল গড়ে তুলবেন।
লেখকঃ বাকী বিল্লাহ, এক্টিভিস্ট ও লেখক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন