Biplobi Barta

শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

হেনা দাস: একজন বিপ্লবী, শিক্ষক ও আজীবন সংগ্রামী নারী



বাংলার নারী জাগরণে যে ক’জন নারী তাঁদের সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে বিশেষ অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হেনা দাস। তিনি ছিলেন শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার অগ্রনায়ক। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য নেত্রী। বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশনেরও অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি।
শুধু হেনা দাস বললে নামটি অপূর্ণ থেকে যায়। এই নামটির পূর্বে বিপ্লবী শব্দটি একান্তভাবে অপরিহার্য। ১৯২৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি হেনা দাস সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সতীশচন্দ্র দত্ত ছিলেন একজন স্বনামধন্য আইনজীবী। হেনা দাসের মা মনোরমা দত্ত ছিলেন চুনারুঘাট থানার নরপতি গ্রামের জমিদার জগত্‍চন্দ্র বিশ্বাসের বড়ো মেয়ে। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে হেনা দাস সর্বকনিষ্ঠ।
সিলেট সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণিতে ভর্তির মাধ্যমে হেনা দাস এর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই তিনি বিভিন্ন আলোচনা ও বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। মাঝে মাঝে বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাসও করেন। হাইস্কুল পার হবার আগেই হেনা দাস স্থানীয় বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। স্থানীয় অনেক রাজনীতিক ও গণ্যমান্য ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে হেনা দাস সাম্রাজ্যবাদের শাসন ও শোষণ সম্পর্কে ধারণা পান। বুঝতে পারেন দেশের জন্য কিছু করতে হবে। বিশেষ করে নারী সমাজের জন্য তিনি সব সময়ই কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করতেন। ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য ত্রিশ দশক ছিল বিক্ষোভ, আন্দোলন ও বিদ্রোহের সূচনাকাল। হেনা দাসের বাড়ি ছিল সিলেট শহরের কেন্দ্রস্থল পুরানলেন পাড়ায়। বাড়ির কাছে ঐতিহাসিক গোবিন্দ পার্ক ছিল মূলত সমাবেশের কেন্দ্র। ফলে তিনি কাছ থেকে শ্লোগান, মিছিল ও সভা-সমাবেশ দেখেছেন। দেখেছেন স্বদেশিদের ওপর বর্বর পুলিশি নির্যাতন। এসব তাঁর মনের গভীরে দাগ কেটেছিল। এভাবেই হেনা দাসের মনে ধীরে ধীরে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব জন্ম নেয়। ফলে কৈশোর থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি গার্লস গাইডে যোগ দেন। সভা-মিছিল, গার্লস গাইডের নানা কর্মতৎপরতায় যোগ দিতে গিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারেননি। তাই বলে থেমেও যাননি। ১৯৪০ সালে সরকারি অগ্রগামী বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ভর্তি হন সিলেট মহিলা কলেজে। এ সময় তার রাজনৈতিক তৎপরতায় যুক্ত হয় নতুন মাত্রা। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। হেনা দাস কলেজের সহপাঠীদের সঙ্গে পাড়ায় পাড়ায় জনরক্ষা কমিটি গঠনের কাজে অংশ নেন। ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রচারের পাশাপাশি পাড়া কমিটির মাধ্যমে আত্মরক্ষামূলক প্রশিক্ষক ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। এসব তৎপরতার মধ্যেই ১৯৪২ সালে তিনি সিলেট মহিলা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএ পাশ করেন। এরপর কয়েক বছর রাজনীতির জন্য লেখাপড়া বন্ধ থাকে। নানা রাজনৈতিক প্রতিকূলতা কাটিয়ে দীর্ঘদিন পর তিনি আবার পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি বিএ পাস করেন এবং ১৯৫৯ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে বিএড ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ১৯৬৫ সালে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এমএ প্রথমপর্ব এবং ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে চতুর্থ হয়ে স্নাতকত্তোর ডিগ্রি লাভ করেন।
নারী আন্দোলনের পাশাপাশি ‘গণনাট্য’ আন্দোলনের সাথেও যুক্ত ছিলেন হেনা দাস। এসময় সারা ভারতে ‘গণনাট্য সংঘ’ তার শাখা বিস্তার করেছিল। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের উদ্যোগে সিলেট শহরেও ‘সুরমা ভ্যালী কালচার স্কোয়াড’ নামে একটি ‘গণনাট্য সংঘ’ আত্মপ্রকাশ করেছিল। গণনাট্য আন্দোলন সংস্কৃতিকে রূপান্তরিত করেছিল সংগ্রামের এক বলিষ্ঠ হাতিয়ার হিসেবে। ওই নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক প্রচার গণমানুষের মধ্যে নতুন চেতনার বিকাশ ঘটায়। সাধারণ মানুষ দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ হয় এর মাধ্যমে। ১৯৪৬ সালের সংগ্রামের জোয়ারের মধ্যেই নেত্রকোণা জেলায় ‘নিখিল ভারত কৃষক সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে লক্ষাধিক সংগ্রামী জনতার সামনে ‘গণনাট্য সংঘ’র শিল্পী হিসেবে প্রথম ও শেষবারের মতো সঙ্গীত পরিবেশন করেন হেনা দাস। কারণ ১৯৪৮ সালের পর থেকে গোপণ জীবন শুরু হলে তাঁর গানের কন্ঠও স্তব্ধ হয়ে যায়।
কলেজে পড়ার সময়ই তিনি সেসময় নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তখন গোপণে তিনি পার্টির কাজ করতে থাকেন। পার্টির বিভিন্ন কাগজপত্র শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিলি করার কাজ করেছেন। এসব করতে করতেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পেয়ে যান। ১৯৪৫ সালে হেনা দাস মৌলভীবাজার জেলায় ভানুবিলে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গঠন করেন। এই সমিতি বিভিন্ন সভা ও আলোচনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নারী সমাজে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করে। ১৯৪৬ সালে সিলেট জেলায় ছাত্র আন্দোলনকে আরো জোরদার করার জন্য বিশেষ করে ছাত্র সমাজের মধ্যে ছাত্র ফেডারেশনকে প্রসারিত করার জন্য হেনা দাসকে আবার ছাত্র ফ্রন্টে নিয়ে আসা হয়। ১৯৪৭ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে সম্মেলনে যোগ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন তিনি। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন গড়ে তোলার প্রথম প্রয়াস গ্রহণ করা হয় ময়মনসিংহ জেলায় এবং সেখানেই হয় প্রথম সম্মেলন। হেনা দাস ওই সম্মেলনে পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ছাত্র ফেডারেশন থেকে শুরু করে সুরমা উপত্যকা গার্লস স্টুডেন্ট কমিটি, সুরমা উপত্যকা মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি, সিলেট জেলা গণনাট্য সংঘ, লেখক ও শিল্পী সংঘ, শিক্ষক সমিতি এবং মহিলা পরিষদে কাজ করেছেন তিনি।
হেনা দাস যখন পুরোপুরি রাজনীতিতে সক্রিয় এবং পার্টির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন, সে সময় তাঁর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি মেয়েকে বিয়ে করার অনুরোধ করেন। অসুস্থ বাবার অনুরোধ রাখতে তিনি বিয়ের জন্য রাজি হন। বিয়ে ঠিক হয় পার্টির সক্রিয় কর্মী কমরেড রোহিনী দাসের সাথে। তিনি ছিলেন সিলেট জেলা কৃষক আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা। রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকায় বর ও কনেকে গোপণ কলকাতায় চলে যেতে হয় এবং ১৯৪৮ সালের ২৮ জুন ঘরোয়াভাবে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে তাঁদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পর পার্টির নির্দেশে হেনা দাস ও রোহিনী দাস অনেকদিন আত্মগোপণ করে ছিলেন।
১৯৪৮-৪৯ সালে নানকার আন্দোলনে নানকার নারীদের সংগঠিত করেন হেনা দাস। তারপর তিনি চলে যান চা বাগানে। সেখানে কুলি রমণীর ছদ্মবেশে নারীদের ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলেন। চল্লিশের দশকে হেনা দাস আসামের কমিউনিস্ট প্রতিনিধি হিসেবে বোম্বে যান। সেখানে সর্বভারতীয় ছাত্র-কমিউনিস্টদের ২০ দিনব্যাপী এক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে যোগ দেন। তখন তিনিসহ মোট চারজন নারী প্রতিনিধি ওই কর্মসূচিতে যোগ দেন। অন্য তিনজন হলেন বাংলার প্রতিনিধি গীতা মুখার্জি, মারাঠি প্রতিনিধি প্রভা এবং বোম্বের প্রতিনিধি প্রেমা।
১৯৩৭ সালে সিলেটে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে প্রথম দেখা ও তার বক্তৃতা শোনা হেনা দাসের জন্য ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এছাড়া নানা সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে গিয়ে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সান্নিধ্যে আসেন, যা তার চলার পথ মসৃণ করে তোলে। তাদের মধ্যে পূর্বপাকিস্তানের ছাত্র ফেডারেশন সভাপতি মুনীর চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সার, যুঁইফুল রায়, মণি-কুন্তলা সেন, অজয় ভট্টাচার্য্য, বারীণ দত্ত, সুফিয়া কামাল, নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক অন্নদাশংকর ভট্টাচার্য্য, কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পি সি যোশী অন্যতম। 
বিয়ের পর স্বামীর সাথে অন্য দশজনের মতো সংসার করা হয়ে ওঠেনি হেনা দাসের। সংগ্রামী নারী হেনা দাসকে পার্টির গোপণ আস্তানায় বা বিশ্বস্ত কোনো কর্মীর বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ওই সময় তিনি সিলেটের ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। ভাষার দাবিতে ছাত্রদের মিছিল-মিটিং ও লিফলেট বিলিতেও তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। এছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে এই আন্দোলন সম্পর্কে সচেতন করে তুলেন। এরই মধ্যে ১৯৫২ সালে হেনা দাসের প্রথম মেয়ে বুলু জন্মগ্রহণ করে। বুলুকে নিয়ে এভাবে আত্মগোপণ করে থাকা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিল না। উপায়ান্তর না দেখে ১৯৫৬ সালে হেনা দাস চার বছরের মেয়ে বুলুকে নিয়ে কলকাতায় পিসীর বাড়িতে যান। কিন্তু সেখানেও তিনি স্থির হতে পারেননি। অবশেষে দীর্ঘ দশ বছরের আত্মগোপণীয়তা থেকে বেরিয়ে ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকার ‘গেণ্ডারিয়া মনিজা রহমান বালিকা বিদ্যালয়’ শিক্ষকতার চাকরি নেন। সে সময় তাঁর মাসিক বেতন ছিল ১১৫ টাকা। কিন্তু স্বামী রোহিনী দাস তখনো আত্মগোপণে। ছুটি পেলে বছরে দু'একবার হেনা দাস বুলুকে নিয়ে সিলেটে যেয়ে স্বামীর সাথে দেখা করতেন। বিয়ের ১৩ বছরের মাথায় হেনা দাস ১৯৬১ সালে নারায়ণগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয় এর প্রধান শিক্ষিকা পদে যোগদান করেন। ওই স্কুল থেকে তাঁর নামে একটি কোয়ার্টার বরাদ্দ করা হয়। এই কোয়ার্টারেই তিনি নিজস্ব সংসার গোছানোর সুযোগ পান। এরপর মহাখালী ওয়ারলেস স্টেশন স্কুলেও তিনি কিছুদিন প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন। 
১৯৬০-৬২ সালে সারা দেশে শিক্ষা আন্দোলন শুরু হলে তিনি শিক্ষক সমিতির আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। হেনা দাস ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেন। এসময় তাঁর কর্ম এলাকা ছিল প্রধানত নারায়ণগঞ্জ। এছাড়া ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠার পর তিনি পরিষদের নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব নেন। স্বাধীনতার পর এ সংগঠনের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি।
নারায়ণগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে থাকার সময় তাঁর স্বামী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং হেনা দাসের কোয়ার্টারে চলে আসেন। এই অসুস্থতার কারণে তাঁর স্বামী আর রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারেননি। ১৯৬৫ সালে হেনা দাসের দ্বিতীয় মেয়ে চম্পা জন্মগ্রহণ করে। হেনা দাসের স্বামী রোহিনী দাস সেই যে অসুস্থ হলেন আর সুস্থ হতে পারেননি। এজন্য তাঁকে ঘরেই থাকতে হতো, কোনো কাজে সক্রিয় হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। দীর্ঘ দিন তিনি অসুখে ভোগার পর ১৯৮৫ সালের শেষে তিনি আরো অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। ১৯৮৭ সালের ৩ জানুয়ারি রোহিনী দাস মারা যান। হেনা দাস মেয়েদের উচ্চ শিক্ষিত ও প্রগতিশীল সমাজের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বড় মেয়ে দীপা ইসলাম (বুলু) স্বনামধন্য গাইনোকোলোজিস্ট এবং ছোট মেয়ে চম্পা জামান কম্পিউটার সায়েন্সে ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে হেনা দাস শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন। তখন শিক্ষক সমিতির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এই সমিতির পক্ষ থেকে তিনি ভারতে গিয়ে দেশের পক্ষে কাজ করেন। বিদেশিদের আর্থিক সহায়তায় শিক্ষক সমিতি ৫০টি শরণার্থী শিবিরে শিশুদের জন্য বিদ্যালয় খুলে। হেনা দাস ওই বিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি তিনি স্বাধীন মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। আবার শুরু করেন শিক্ষকতা। 
১৯৭৮ সালে হেনা দাস বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। শিক্ষকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সব সময়ই তাকে পাওয়া গেছে সামনের সারিতে। ১৯৭৮ থেকে টানা ১৪ বছর তিনি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদে নেতৃত্ব দেন। তিনি ছিলেন ড. কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের অন্যতম সদস্য। 
১৯৮৬ সালে শিক্ষকদের চারটি দাবি আদায়ের জন্য আবার আন্দোলন শুরু করেন হেনা দাস। তত্‍কালীন স্বৈরচারী সরকার শিক্ষক ধর্মঘটকে বেআইনি ঘোষণা করলে তিনি ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। ১ মাস ৮ দিন তিনি চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দি থাকেন। সব বাধা উপেক্ষা করে অব্যাহতভাবে তিনি অধিকার আদায়ের আন্দোলন করে গিয়েছেন।
১৯৭৯ সালেও শিক্ষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে তাঁকে কারাবরণে যেতে হয়। এর আগেও ১৯৭৭ সালের ৫ মে ঢাকার বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির অফিস থেকে ৫৪ জন শিক্ষকসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। তিনদিন কারাগারে থাকার পর তিনি মুক্ত হন। কমিউনিস্ট পার্টি করার জন্য তাকে বার বার যেতে হয়েছে আত্মগোপণে। আত্মগোপণকালেও তিনি পার্টি গড়ে তোলার কাজ করেছেন। নারীপুরুষ নির্বিশেষে গণমানুষের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে আমৃত্যু ভূমিকা রেখেছেন কমরেড হেনা দাস।
মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলন- এমন অনেক সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন এই লড়াকু নেত্রী। প্রায় তিন যুগ শিক্ষকতার পর হেনা দাস ১৯৮৯ সালে শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
হেনা দাস ছিলেন মহিলা পরিষদের সভানেত্রী। কবি সুফিয়া কামাল মারা যাওয়ার পর ২০০০ সালে তিনি এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নারী ও শিক্ষক আন্দোলনের তার ভূমিকা ছিল অনন্য। রাষ্ট্রীয়ভাবে তিনি ‘রোকেয়া পদকে’ সম্মানিত হয়েছেন। এছাড়া সুনামগঞ্জ পৌরসভা, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ঢাকেশ্বরী মন্দির, নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট, আহমেদ শরীফ ট্রাস্টসহ তিনি বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মাননা পেয়েছেন। রাজশাহীর একটি প্রতিষ্ঠান হেনা দাসের ওপর একটি অডিওভিজুয়াল ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে। নারীপক্ষ ও নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা থেকে প্রকাশিত দুটি বই-এ হেনা দাসের সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রকাশিত হয়েছে।
হেনা দাস কেবল একজন সাহসী, সংগ্রামী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বই নন, তিনি একজন লেখিকাও বটে।। ইতিমধ্যে হেনা দাসের অর্ধডজন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলো হলো- ‘উজ্জ্বল স্মৃতি’, ‘শিক্ষা ও শিক্ষকতা জীবন’, ‘স্মৃতিময় দিনগুলো’, ‘নারী আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা’, ‘স্মৃতিময়-’৭১’ এবং ‘চার পুরুষের কাহিনী’। হেনা দাস তাঁর আত্মজীবনী লিখেছেন ‘চার পুরুষের কাহিনী’ শিরোনামের বইটিতে। এছাড়া বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে হেনা দাসের লেখা বিভিন্ন কলাম ও প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। এসব লেখা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রবন্ধ সংকলন’ শিরোনামে আরেকটি বই। সাহিত্য প্রকাশ এর মফিদুল হক ‘মাতৃমুক্তি পথিকৃত’ নামে তাঁর জীবনের উপর একটি বই প্রকাশ করেছেন।
২০০৯ সালের ২০ জুলাই হেনা দাস মারা যান, কিন্তু রেখে যান তাঁর বলিষ্ঠ সংগ্রামী জীবনের আদর্শ। নতুন প্রজন্ম তাঁরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করবে এটাই প্রত্যাশা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন