১৯১৭ সাল।
নভেম্বর মাস। রাশিয়ায় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পতন ঘটে রাজতন্ত্রের। প্রতিষ্ঠিত হয়
কৃষক-শ্রমিকের রাষ্ট্র। জনগণের হাতে আসে ক্ষমতা। সেই হিসাবে এ বছরের অক্টোবর মাসে
পূর্ণ হচ্ছে রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই বিপ্লবের সফলতা
সে সময় বিশ্বের সব স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর অভাবনীয় প্রভাব বিস্তার করেছিল। এমনকি
আলোচ্য বিপ্লব তৎকালীন পরাধীন ভারতবাসীর কাছেও দেখা দিয়েছিল আশার আলো হিসেবে। রুশ
বিপ্লব প্রভাবিত করেছিল কাজী নজরুল ইসলামকেও। কবির পরবর্তী জীবন-পরিক্রমা ও
সাহিত্যকর্মের দিকে নজর দিলে বিষয়টি বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে প্রশ্ন হলো, ১৯১৭ সালে রাশিয়ায়
যখন উড়ল সমাজতন্ত্রের লাল পতাকা, নজরুল সেটিকে কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন?
বইপত্র ও নজরুলের ঘনিষ্ঠজনদের স্মৃতিকথা মিলিয়ে দেখলে প্রশ্নটির একটা
সুরাহা মিলতে পারে। ১৯১৭ সালের শেষার্ধে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে করাচি চলে যান কাজী নজরুল
ইসলাম। সে সময় তিনি ছিলেন আঠারো-উনিশ বছরের এক টগবগে তরুণ। কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত
হয়ে ওঠার আগ অব্দি, অর্থাৎ ১৯২০-২১ সাল পর্যন্ত নজরুলের জীবনের অনেক বিষয় সম্পর্কেই
বস্তুনিষ্ঠ তথা খুব নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না—একেকজন একেক রকম বলেন। ফলে বিভ্রান্তির
অবকাশ থেকেই যায়। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে এটা জানা যায় যে সৈনিকজীবনে পল্টনে
অবস্থানকালেই রুশ বিপ্লবের সংবাদ পেয়েছিলেন তিনি।
বস্তুত, বিপ্লবের সংবাদে আপ্লুতই হয়ে উঠেছিলেন সেদিনের তরুণ নজরুল। তিনি কতটা আপ্লুত হয়েছিলেন, সেটি কবির পল্টনজীবনের সহযোদ্ধা জমাদার শম্ভু রায়ের বর্ণনায় উজ্জ্বল হয়ে আছে, ‘এদিন সন্ধ্যায় ১৯১৭ সালের শেষের দিকেই হবে, এখন ঠিক স্মরণে আনতে পারছি না, হয়তো সেটা শীতের শেষের দিকে। নজরুল তাঁর বন্ধুদের মধ্যে যাঁদের বিশ্বাস করতেন, তাঁদের এক সন্ধ্যায় খাবার নিমন্ত্রণ করে।...ঐ দিন যখন সন্ধ্যার পর তাঁর ঘরে আমি ও নজরুলের অন্যতম বন্ধু তাঁর অর্গান মাস্টার হাবিলদার নিত্যানন্দ দে প্রবেশ করলাম, তখন দেখলাম, অন্যান্য দিনের চেয়ে নজরুলের চোখে-মুখে একটা অন্যরকম জ্যোতি খেলে বেড়াচ্ছিল...তিনি [নিত্যানন্দ] অর্গানে একটা মার্চিং গৎ বাজানোর পর নজরুল সেই দিন যে গান গাইলেন ও প্রবন্ধ পড়লেন, তা থেকেই আমরা জানতে পারলাম যে রাশিয়ার জনগণ জারের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে। গানবাজনা-প্রবন্ধ পাঠের পর রুশ বিপ্লব সম্বন্ধে আলোচনা হয় এবং লালফৌজের দেশপ্রেম নিয়ে নজরুল খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন।’ রুশ বিপ্লবের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তির বহুমুখী আক্রমণ প্রতিহতের জন্য জনগণ ও কৃষক-শ্রমিকদের নিয়ে রাশিয়া গঠন করেছিল একটি সৈন্যদল, যাকে বলা হতো ‘লালফৌজ’। বিভিন্ন দেশের মুক্তিকামী মেহনতি মানুষ এবং বুদ্ধিজীবীরাও যোগ দিয়েছিলেন এই লালফৌজে। ভারতের প্রগতিবাদী রাজনীতিবীদ এম এন রায়ের লেখা ও রাশিয়ায় সংরক্ষিত নথিপত্র থেকে জানা যায়, এ সময় ভারত থেকেও অনেকে যোগ দিয়েছিলেন ওই লালফৌজে। কেবল তা-ই নয়, রাশিয়ায় বিপ্লব দমনের জন্য নিয়োগকৃত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ভারতীয় সেনাদল থেকে পালিয়েও অনেক ভারতীয় সৈনিক তখন যোগ দিয়েছিলেন এই বাহিনীতে। নজরুল এসব তথ্য জানতেন। তাঁর পল্টন থেকেও কয়েকজন সৈন্য পালিয়ে লালফৌজে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে পলাতকদের অনেকেই তাঁদের অভীষ্ঠ লালফৌজ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি, পেশোয়ারের বিভিন্ন জায়গায় ধরা পরেছিলেন তাঁরা। এ রকম এক সৈনিককে পল্টনে ফেরত নেওয়ার জন্য একবার পেশোয়ারে গিয়েছিলেন নজরুল। এ নিয়ে সৈনিক-পরবর্তী জীবনে কবির অন্যতম সুহৃদ ও ভারতের কমিউনিস্ট নেতা মুজাফ্ফর আহ্মদ লিখেছেন, ‘নজরুলের মুখে শুনেছি যে কোনো পলাতক সৈনিককে ধরার জন্যে তাকে (হয়তো সঙ্গে অন্য সৈনিকও ছিল) একবার বেলুচিস্তানের গুলিস্তান, বুস্তান ও চমন প্রভৃতি ইলাকায় যেতে হয়েছিল।’সেনাবাহিনীর কড়া বাধানিষেধ তথা সেন্সরশিপের ভেতরেও পল্টনে থাকাকালে নজরুল কীভাবে রুশ বিপ্লব ও লালফৌজের সংবাদ সংগ্রহ করতেন, তা বিস্ময়কর। শম্ভু রায়ও এ বিষয়ে কোনো আলোকপাত করতে পারেননি। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘আমাদের ব্যারাকের কর্তৃপক্ষের শ্যেন দৃষ্টি ছিল, যাতে আমরা বাইরে থেকে কোন রকম রাজনৈতিক খবর না পাই। সে জন্য পত্রপত্রিকা যা আসত তা পরীক্ষা করে আমাদের দেওয়া হত। তা সত্ত্বেও “বজ্রআটুনী ফসকা গেরো”র মত হওয়ার দরুন ওসব খবরাখবর কী করে জোগাড় করত সেই [নজরুল] জানে।’
রাশিয়ার বিপ্লব ও লালফৌজের লড়াই নজরুলকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও পল্টনের সহযোদ্ধাদের সঙ্গে এই সংবাদগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন তিনি। শম্ভু রায় আরও লিখেছেন, ‘নজরুলের আড্ডা থেকেই বাছাই করা কয়েকজনকে সে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সংবাদ দিত, যেমন আইরিশ বিদ্রোহ ও রুশদের কথা। আমরা কয়েক বন্ধু এসব বিষয় যেমন সাবধানতার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতাম নজরুল তার ভাবকে তেমন করে চেপে রাখতে পারত না। অবশ্য তার একটা পথ ছিল, গান ও কবিতার সাহায্য, সে গান গেয়ে ও কবিতা পড়ে তার ভাবকে ব্যক্ত করত। সৈন্যদের মধ্যে এসব নিয়ে কেউ বিশেষ মাথা ঘামাত না।’জীবনের প্রথমার্ধ থেকই নজরুল ছিলেন স্বাধীনচেতা। রুশ বিপ্লবের আগে থেকেই তাঁর বিশ্বাস ছিল বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত হবে দেশের স্বাধীনতা। কবির স্কুলজীবনের বন্ধু সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন, ‘নজরুল যুদ্ধবিদ্যা শিখে এসে ভারতবর্ষে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী গঠন করবে, তারপর দেশ থেকে ইংরেজ তাড়াবে-তার এই গোপন মতলবের কথা আমাকে সে বলেছিল একদিন।’
শিয়ারশোল স্কুলে নজরুলের শিক্ষক ছিলেন নিবারণচন্দ্র ঘটক। বিপ্লবী দল ‘যুগান্তর’-এর সদস্য ছিলেন তিনি; এবং দলের হয়ে বিপ্লবের জন্য কর্মী সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে কর্মীদের দীক্ষাও দিতেন। এই নিবারণ ঘটকের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন নজরুল। কিন্তু ১৯১৭ সালের জানুয়ারি মাসে বিপ্লবী দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন নিবারণ, বিচারে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয় তাঁর। নিবারণ ঘটক আটক হওয়ার পর দলের অন্য কর্মীদের সনাক্ত করার জন্য গোপনে তদন্ত চালায় স্কুল কর্তৃপক্ষ। তখন নিবারণের ঘনিষ্ঠ ছাত্র হিসেবে নজরুল ছিলেন স্কুল কর্তৃপক্ষের সন্দেহের তালিকায়। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবু প্রাথমিকভাবে তাঁকে সন্দেহ করা হয় এবং তাঁর ছাত্রবৃত্তি কয়েক মাসের জন্য স্থগিত রাখা হয়। যুগান্তর কর্মী ও নজরুলের জীবনীকার প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়ের ভাষ্যে, ‘আমি দুজনেরই [নিবারণ ও নজরুল] কাছের মানুষ হিসাবে এটা বুঝেছিলাম যে নজরুল যুগান্তর দলের কর্মী ছিলেন কিন্তু কাজ করবার মুখেই নিবারণ ঘটক হয়ে গেলেন গিরিফতার।’ পরে নজরুল নিজেও মুজফ্ফর আহমদের কাছে স্বীকার করেছিলেন, নিবারণ ঘটকের মতবাদে একসময় দারুণভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি।এক্ষণে নিশ্চয় এটুকু অনুমান করা দুঃসাধ্য হবে না যে সেই ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে সেই সময় করাচিতে সেনাবাহিনীর ভেতরে ও বাইরে বিপ্লবীদের একটা দল তৎপর ছিল, যাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল নজরুলের; এবং সেনাবাহিনীর এই বিপ্লবী গোষ্ঠীর মাধ্যমেই নিয়মিতভাবে বিপ্লবের সংবাদ সংগ্রহ করতেন নজরুল। অধিকন্তু তৎকালের অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা ও সেনা সেন্সরশিপের কারণে বাংলাদেশ থেকে সংবাদ ও বইপত্র সরাসরি নজরুল পর্যন্ত পৌঁছা ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। বাঙালি পল্টনের সৈনিক ও স্বদেশি আন্দোলনের বিভিন্ন বিপ্লবীর লেখা থেকে জানা যায়, প্রথম মহাযুদ্ধকালে বাঙালি পল্টনসহ বেশ কিছু ভারতীয় সেনা ইউনিটে পরিকল্পিতভাবে অনুপ্রেবেশ ঘটেছিল বিপ্লবীদের। হতে পারে নজরুল নিজেও এ ধরনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভালো ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়ে যোগ দিয়েছিলেন পল্টনে। তবে এটি কেবলই অনুমানমাত্র, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা কষ্টসাধ্যই বটে।
কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মের দিকে তাকালেও রুশ বিপ্লবের প্রভাব লক্ষ করা যায় বেশ ভালোভাবে। এখানে স্বল্প পরিসরে তাঁর একেবারে প্রথম দিকের দুটি রচনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এর মধ্যে প্রথমটি গল্প, দ্বিতীয়টি কবিতা—‘ব্যথার দান’ কবির প্রথম দিকে লেখা গল্প। রুশ বিপ্লবের মাত্র দুই বছর পর ১৯১৯ সালে পল্টনে বসে তিনি লেখেন গল্পটি। এর প্রধান দুই চরিত্র—দারা ও সয়ফুল মুলক—এদের ভারত থেকে লালফৌজে যোগ দেওয়া সৈনিক হিসেবে দেখিয়েছিলেন তিনি। যেমন, গল্পে সয়ফুল মুলকের গলায় শোনা যায়, ‘ঘুরতে ঘুরতে শেষে এই লালফৌজে যোগ দিলুম। এ পরদেশীকে তাদের দলে আসতে দেখে তারা খুব উৎফুল্ল হয়েছে। মনে করছে, এদের এই মহান নিঃস্বার্থ ইচ্ছা বিশ্বের অন্তরে অন্তরে শক্তি সঞ্চয় করছে। আমায় আদর ক’রে এদের দলে নিয়ে এরা বুঝিয়ে দিলে যে কত মহাপ্রাণতা আর পবিত্র নিঃস্বার্থপরতা প্রণোদিত হয়ে তারা উৎপীড়িত বিশ্ববাসীর পক্ষ নিয়ে অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, এবং আমিও সেই মহান ব্যক্তি সঙ্ঘের একজন।’ উল্লেখ্য, ‘ব্যথার দান’ গল্পে ‘লালফৌজ’ শব্দটি ঝুঁকিপূর্ণ মনে হওয়ায় প্রকাশকালে তা পাল্টে দেওয়া হয়েছিল। ১৯২০ সালে পল্টন থেকে ফিরে এলেন নজরুল। ১৯২২ সালে রুশ বিপ্লবকে ভারতে আহ্বান করে লিখলেন বিখ্যাত ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতা। আর এই কবিতায় রুশ বিপ্লবকে তুলনা করা হলো ‘প্রলয়’ শব্দের সঙ্গে। এই কবিতার ‘আসছে এবার অনাগত প্রলয়-নেশার নৃত্য-পাগল, /সিন্ধু-পারের সিংহ-দ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল।’—এই দুই পঙ্তিতে উন্মোচিত হয়েছে রুশ িবপ্লবের স্বরূপ।
আজীবন রুশ বিপ্লবের আদর্শকে নিজের সৃষ্টি ও কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত করেছেন নজরুল ইসলাম। তাঁর বিভিন্ন রচনা, পত্রিকা সম্পাদনা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে রুশ বিপ্লবের প্রভাব লক্ষ করা গেছে বিচিত্র মাত্রায়। সবশেষে দুটি তথ্য দিয়ে এ লেখার ইতি টানব: ভারতে রুশ বিপ্লবের প্রকাশ্য ধারক ও বাহক কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন নজরুল। অন্যদিকে রাশিয়ার জনগণও বাংলাদেশের এই কবিকে ‘বিপ্লবী-প্রলেতারীয়-রোমান্টিক’ কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
বস্তুত, বিপ্লবের সংবাদে আপ্লুতই হয়ে উঠেছিলেন সেদিনের তরুণ নজরুল। তিনি কতটা আপ্লুত হয়েছিলেন, সেটি কবির পল্টনজীবনের সহযোদ্ধা জমাদার শম্ভু রায়ের বর্ণনায় উজ্জ্বল হয়ে আছে, ‘এদিন সন্ধ্যায় ১৯১৭ সালের শেষের দিকেই হবে, এখন ঠিক স্মরণে আনতে পারছি না, হয়তো সেটা শীতের শেষের দিকে। নজরুল তাঁর বন্ধুদের মধ্যে যাঁদের বিশ্বাস করতেন, তাঁদের এক সন্ধ্যায় খাবার নিমন্ত্রণ করে।...ঐ দিন যখন সন্ধ্যার পর তাঁর ঘরে আমি ও নজরুলের অন্যতম বন্ধু তাঁর অর্গান মাস্টার হাবিলদার নিত্যানন্দ দে প্রবেশ করলাম, তখন দেখলাম, অন্যান্য দিনের চেয়ে নজরুলের চোখে-মুখে একটা অন্যরকম জ্যোতি খেলে বেড়াচ্ছিল...তিনি [নিত্যানন্দ] অর্গানে একটা মার্চিং গৎ বাজানোর পর নজরুল সেই দিন যে গান গাইলেন ও প্রবন্ধ পড়লেন, তা থেকেই আমরা জানতে পারলাম যে রাশিয়ার জনগণ জারের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে। গানবাজনা-প্রবন্ধ পাঠের পর রুশ বিপ্লব সম্বন্ধে আলোচনা হয় এবং লালফৌজের দেশপ্রেম নিয়ে নজরুল খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন।’ রুশ বিপ্লবের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তির বহুমুখী আক্রমণ প্রতিহতের জন্য জনগণ ও কৃষক-শ্রমিকদের নিয়ে রাশিয়া গঠন করেছিল একটি সৈন্যদল, যাকে বলা হতো ‘লালফৌজ’। বিভিন্ন দেশের মুক্তিকামী মেহনতি মানুষ এবং বুদ্ধিজীবীরাও যোগ দিয়েছিলেন এই লালফৌজে। ভারতের প্রগতিবাদী রাজনীতিবীদ এম এন রায়ের লেখা ও রাশিয়ায় সংরক্ষিত নথিপত্র থেকে জানা যায়, এ সময় ভারত থেকেও অনেকে যোগ দিয়েছিলেন ওই লালফৌজে। কেবল তা-ই নয়, রাশিয়ায় বিপ্লব দমনের জন্য নিয়োগকৃত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ভারতীয় সেনাদল থেকে পালিয়েও অনেক ভারতীয় সৈনিক তখন যোগ দিয়েছিলেন এই বাহিনীতে। নজরুল এসব তথ্য জানতেন। তাঁর পল্টন থেকেও কয়েকজন সৈন্য পালিয়ে লালফৌজে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে পলাতকদের অনেকেই তাঁদের অভীষ্ঠ লালফৌজ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি, পেশোয়ারের বিভিন্ন জায়গায় ধরা পরেছিলেন তাঁরা। এ রকম এক সৈনিককে পল্টনে ফেরত নেওয়ার জন্য একবার পেশোয়ারে গিয়েছিলেন নজরুল। এ নিয়ে সৈনিক-পরবর্তী জীবনে কবির অন্যতম সুহৃদ ও ভারতের কমিউনিস্ট নেতা মুজাফ্ফর আহ্মদ লিখেছেন, ‘নজরুলের মুখে শুনেছি যে কোনো পলাতক সৈনিককে ধরার জন্যে তাকে (হয়তো সঙ্গে অন্য সৈনিকও ছিল) একবার বেলুচিস্তানের গুলিস্তান, বুস্তান ও চমন প্রভৃতি ইলাকায় যেতে হয়েছিল।’সেনাবাহিনীর কড়া বাধানিষেধ তথা সেন্সরশিপের ভেতরেও পল্টনে থাকাকালে নজরুল কীভাবে রুশ বিপ্লব ও লালফৌজের সংবাদ সংগ্রহ করতেন, তা বিস্ময়কর। শম্ভু রায়ও এ বিষয়ে কোনো আলোকপাত করতে পারেননি। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘আমাদের ব্যারাকের কর্তৃপক্ষের শ্যেন দৃষ্টি ছিল, যাতে আমরা বাইরে থেকে কোন রকম রাজনৈতিক খবর না পাই। সে জন্য পত্রপত্রিকা যা আসত তা পরীক্ষা করে আমাদের দেওয়া হত। তা সত্ত্বেও “বজ্রআটুনী ফসকা গেরো”র মত হওয়ার দরুন ওসব খবরাখবর কী করে জোগাড় করত সেই [নজরুল] জানে।’
রাশিয়ার বিপ্লব ও লালফৌজের লড়াই নজরুলকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও পল্টনের সহযোদ্ধাদের সঙ্গে এই সংবাদগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন তিনি। শম্ভু রায় আরও লিখেছেন, ‘নজরুলের আড্ডা থেকেই বাছাই করা কয়েকজনকে সে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সংবাদ দিত, যেমন আইরিশ বিদ্রোহ ও রুশদের কথা। আমরা কয়েক বন্ধু এসব বিষয় যেমন সাবধানতার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতাম নজরুল তার ভাবকে তেমন করে চেপে রাখতে পারত না। অবশ্য তার একটা পথ ছিল, গান ও কবিতার সাহায্য, সে গান গেয়ে ও কবিতা পড়ে তার ভাবকে ব্যক্ত করত। সৈন্যদের মধ্যে এসব নিয়ে কেউ বিশেষ মাথা ঘামাত না।’জীবনের প্রথমার্ধ থেকই নজরুল ছিলেন স্বাধীনচেতা। রুশ বিপ্লবের আগে থেকেই তাঁর বিশ্বাস ছিল বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত হবে দেশের স্বাধীনতা। কবির স্কুলজীবনের বন্ধু সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন, ‘নজরুল যুদ্ধবিদ্যা শিখে এসে ভারতবর্ষে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী গঠন করবে, তারপর দেশ থেকে ইংরেজ তাড়াবে-তার এই গোপন মতলবের কথা আমাকে সে বলেছিল একদিন।’
শিয়ারশোল স্কুলে নজরুলের শিক্ষক ছিলেন নিবারণচন্দ্র ঘটক। বিপ্লবী দল ‘যুগান্তর’-এর সদস্য ছিলেন তিনি; এবং দলের হয়ে বিপ্লবের জন্য কর্মী সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে কর্মীদের দীক্ষাও দিতেন। এই নিবারণ ঘটকের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন নজরুল। কিন্তু ১৯১৭ সালের জানুয়ারি মাসে বিপ্লবী দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন নিবারণ, বিচারে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয় তাঁর। নিবারণ ঘটক আটক হওয়ার পর দলের অন্য কর্মীদের সনাক্ত করার জন্য গোপনে তদন্ত চালায় স্কুল কর্তৃপক্ষ। তখন নিবারণের ঘনিষ্ঠ ছাত্র হিসেবে নজরুল ছিলেন স্কুল কর্তৃপক্ষের সন্দেহের তালিকায়। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবু প্রাথমিকভাবে তাঁকে সন্দেহ করা হয় এবং তাঁর ছাত্রবৃত্তি কয়েক মাসের জন্য স্থগিত রাখা হয়। যুগান্তর কর্মী ও নজরুলের জীবনীকার প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়ের ভাষ্যে, ‘আমি দুজনেরই [নিবারণ ও নজরুল] কাছের মানুষ হিসাবে এটা বুঝেছিলাম যে নজরুল যুগান্তর দলের কর্মী ছিলেন কিন্তু কাজ করবার মুখেই নিবারণ ঘটক হয়ে গেলেন গিরিফতার।’ পরে নজরুল নিজেও মুজফ্ফর আহমদের কাছে স্বীকার করেছিলেন, নিবারণ ঘটকের মতবাদে একসময় দারুণভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি।এক্ষণে নিশ্চয় এটুকু অনুমান করা দুঃসাধ্য হবে না যে সেই ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে সেই সময় করাচিতে সেনাবাহিনীর ভেতরে ও বাইরে বিপ্লবীদের একটা দল তৎপর ছিল, যাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল নজরুলের; এবং সেনাবাহিনীর এই বিপ্লবী গোষ্ঠীর মাধ্যমেই নিয়মিতভাবে বিপ্লবের সংবাদ সংগ্রহ করতেন নজরুল। অধিকন্তু তৎকালের অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা ও সেনা সেন্সরশিপের কারণে বাংলাদেশ থেকে সংবাদ ও বইপত্র সরাসরি নজরুল পর্যন্ত পৌঁছা ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। বাঙালি পল্টনের সৈনিক ও স্বদেশি আন্দোলনের বিভিন্ন বিপ্লবীর লেখা থেকে জানা যায়, প্রথম মহাযুদ্ধকালে বাঙালি পল্টনসহ বেশ কিছু ভারতীয় সেনা ইউনিটে পরিকল্পিতভাবে অনুপ্রেবেশ ঘটেছিল বিপ্লবীদের। হতে পারে নজরুল নিজেও এ ধরনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভালো ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়ে যোগ দিয়েছিলেন পল্টনে। তবে এটি কেবলই অনুমানমাত্র, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা কষ্টসাধ্যই বটে।
কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মের দিকে তাকালেও রুশ বিপ্লবের প্রভাব লক্ষ করা যায় বেশ ভালোভাবে। এখানে স্বল্প পরিসরে তাঁর একেবারে প্রথম দিকের দুটি রচনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এর মধ্যে প্রথমটি গল্প, দ্বিতীয়টি কবিতা—‘ব্যথার দান’ কবির প্রথম দিকে লেখা গল্প। রুশ বিপ্লবের মাত্র দুই বছর পর ১৯১৯ সালে পল্টনে বসে তিনি লেখেন গল্পটি। এর প্রধান দুই চরিত্র—দারা ও সয়ফুল মুলক—এদের ভারত থেকে লালফৌজে যোগ দেওয়া সৈনিক হিসেবে দেখিয়েছিলেন তিনি। যেমন, গল্পে সয়ফুল মুলকের গলায় শোনা যায়, ‘ঘুরতে ঘুরতে শেষে এই লালফৌজে যোগ দিলুম। এ পরদেশীকে তাদের দলে আসতে দেখে তারা খুব উৎফুল্ল হয়েছে। মনে করছে, এদের এই মহান নিঃস্বার্থ ইচ্ছা বিশ্বের অন্তরে অন্তরে শক্তি সঞ্চয় করছে। আমায় আদর ক’রে এদের দলে নিয়ে এরা বুঝিয়ে দিলে যে কত মহাপ্রাণতা আর পবিত্র নিঃস্বার্থপরতা প্রণোদিত হয়ে তারা উৎপীড়িত বিশ্ববাসীর পক্ষ নিয়ে অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, এবং আমিও সেই মহান ব্যক্তি সঙ্ঘের একজন।’ উল্লেখ্য, ‘ব্যথার দান’ গল্পে ‘লালফৌজ’ শব্দটি ঝুঁকিপূর্ণ মনে হওয়ায় প্রকাশকালে তা পাল্টে দেওয়া হয়েছিল। ১৯২০ সালে পল্টন থেকে ফিরে এলেন নজরুল। ১৯২২ সালে রুশ বিপ্লবকে ভারতে আহ্বান করে লিখলেন বিখ্যাত ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতা। আর এই কবিতায় রুশ বিপ্লবকে তুলনা করা হলো ‘প্রলয়’ শব্দের সঙ্গে। এই কবিতার ‘আসছে এবার অনাগত প্রলয়-নেশার নৃত্য-পাগল, /সিন্ধু-পারের সিংহ-দ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল।’—এই দুই পঙ্তিতে উন্মোচিত হয়েছে রুশ িবপ্লবের স্বরূপ।
আজীবন রুশ বিপ্লবের আদর্শকে নিজের সৃষ্টি ও কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত করেছেন নজরুল ইসলাম। তাঁর বিভিন্ন রচনা, পত্রিকা সম্পাদনা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে রুশ বিপ্লবের প্রভাব লক্ষ করা গেছে বিচিত্র মাত্রায়। সবশেষে দুটি তথ্য দিয়ে এ লেখার ইতি টানব: ভারতে রুশ বিপ্লবের প্রকাশ্য ধারক ও বাহক কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন নজরুল। অন্যদিকে রাশিয়ার জনগণও বাংলাদেশের এই কবিকে ‘বিপ্লবী-প্রলেতারীয়-রোমান্টিক’ কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
(লেখাটি ২৫ আগস্ট প্রথম আলোতে প্রকাশিত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন