মিয়ানমারের রাখাইনে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে রোহিঙ্গাদের ওপর শুরু হওয়া সহিংসতার পেছনে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত দুই কারণই রয়েছে বলে মনে করছেন রুশ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, রাখাইনে ভূ-রাজনৈতিক বহুমাত্রিক সংকটের কারণেই এ সমস্যা দেখা দিয়েছে।
রাশিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের দ্য সেন্টার ফর সাউথইস্ট এশিয়ার পরিচালক দিমিত্রি মস্কোভ রাশিয়ার সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন আরটি’কে দেওয়া এক সাক্ষাকারে বলেছেন, রাখাইনে বুদ্ধমতালম্বী ও মুসলমানদের মধ্যে শুরু হওয়া সংখাতের পেছনে বহির্বিশ্বের কিছু খেলুড়ে সরাসরি ইন্ধন জুগিয়েছে।
রুশ সংবাদমাধ্যম স্পুটনিকের রোহিঙ্গা সংকট সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
তিন কারণে এ সংঘাত হচ্ছে বলে মনে করেন দিমিত্রি মস্কোভ। প্রথমত, এটি চীনের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র; কারণ আরাকানে চীনের অনেক বড় বিনিয়োগ রয়েছে। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় মুসলমান চরমপন্থীদেরকে উস্কে দেওয়ার একটি ষড়যন্ত্র। তৃতীয়ত, আসিয়ানভুক্ত জোটের মধ্যে বিরোধ (মিয়ানমার ও মুসলিম শাসিত ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মধ্যে) বাধানোর একটি প্রচেষ্টা।
মস্কোভের ভাষ্য, দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করার জন্য বাইরের শক্তি কাজ করছে। বিশেষত সমুদ্র তীরবর্তী রাখাইন রাজ্যের হাইড্রোকার্বনের (তেল-গ্যাস জ্বালানি) বিশাল ভাণ্ডার এর অন্যতম কারণ।
তিনি আরো বলেন, সেখানে এমনিতেই বিশাল একটি গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে। তার ওপর আবার তেল এ রাজ্যকে আরো মূল্যবান করে তুলেছে।
২০০৪ সালে রাখাইনে জ্বালানি সম্পদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর মিয়ানমার চীনের মনোযোগ আকর্ষণ করে। আর সেই সূত্রধরেই ২০১৩ সালের মধ্যে চীন দেশটির ইউনান প্রদেশের কুনমিং শহর থেকে মিয়ানমারের কুওকফিও বন্দর পর্যন্ত পাইপলাইন তৈরি করে। পাইপলাইনটি মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা থেকে অপরিশোধিত তেল আনতেও সাহায্য করছে। যে পাইপলাইন দিয়ে মিয়ানমারের সমুদ্রতীরবর্তী এলাকা থেকে হাইডোকার্বনও স্থানান্তরিত হচ্ছে। চীন-মিয়ানমারের এ প্রকল্পের অধীনে পাইপলাইনটি তৈরি করার সময় ২০১১-১২ সালের দিকে প্রায় এক লক্ষ রোহিঙ্গা রক্তপাত থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়।
রাশিয়ার পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটির স্টাটিজেন্সি স্টাডিজের ডেপুটি ডিরেক্টর দিমিত্রি ইগোরচেনকভের মতে, এটি একটি কাকতালীয় ঘটনা। তবে রোহিঙ্গা সঙ্কটের পেছনে কিছু অভ্যন্তরীণ কারণ রয়েছে, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বহিরাগত কোনো দেশের দ্বারাও অনুপ্রাণিত হতে পারে।
মিয়ানমারের অস্থিতিশীলতা চীনের জ্বালানি প্রকল্পে প্রভাব পড়বে এবং এই ফাঁকে অন্য কোনো দেশ এই সুযোগ নিতে পারে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিবেশী দেশ উত্তর কোরিয়ার মধ্যে চলমান সংকটের কারণে বেইজিং শীঘ্রই বিপদে পড়তে পারে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি মনে করেন, হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন বিনিয়োগকারী জর্জ সরোসের অর্থায়নে পরিচালিত কয়েকটি সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত বার্মা টাস্কফোর্স ২০১৩ সাল থেকে সক্রিয়ভাবে মিয়ানমারে কাজ করছে। অবশ্য মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জর্জ সরোস হস্তক্ষেপ করছেন আরও আগে থেকে। মিয়ানমারে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পট পরিবর্তনের জন্য অন্য দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয় বাড়াতে ২০০৩ সালে একটি মার্কিন টাস্কফোর্স গ্রুপের সঙ্গে যোগ দেন জর্জ সরোস।
দ্য কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশন্স (সিএফআর) এর ২০০৩ সালের নথির বরাত দিয়ে স্পুটনিক জানায়, ‘বার্মা : টাইম ফর চেঞ্জ’ শিরোনামের ওই নথিতে ওই টাস্কফোর্স গ্রুপ গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। সেখানে জোর দিয়ে বলা হয়েছিল, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা ছাড়া গণতন্ত্র টিকতে পারে না।’ আরটিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইন্সটিটিউট ফর স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ অ্যান্ড প্রোগনোসিস অ্যাট দ্য পিপল’স ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি অব রাশিয়া এর উপ পরিচালক দিমিত্রি এগোরচেনকভ বলেন, ‘যখন জর্জ সরোস এদেশে আসেন অথবা ওই দেশে যান ... তখন তিনি ধর্মীয়, জাতিগত কিংবা সামাজিক বৈপরীত্য খুঁজতে থাকেন এবং এগুলো থেকে যেকোনও একটিকে বেছে নেন কিংবা এগুলোর মিশ্রণ তৈরি করেন এবং তাদেরকে উষ্ণ করে তোলার চেষ্টা করেন।
অন্যদিকে মোসিয়াকভের মতে, বিশ্বের কিছু প্রতিষ্ঠিত অর্থনীতির দেশ আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ উত্তেজনায় মদদ দিয়ে সেইসব দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লাগাম টেনে ধরতে চায়। আঞ্চলিক সংঘাতকে উসকে দিয়ে সার্বভৌমত্বের দেশগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং চাপ তৈরি করতে চায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন