লেখকঃ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সভাপতিঃ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষানীতি নিয়ে খোলামেলা কথাবার্তা, আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক আমাদের দেশে সেভাবে হয় না বললেই চলে। দেশের পররাষ্ট্রনীতি ও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এ দেশের সম্পর্ক নিয়েও খোলামেলা আলোচনার ক্ষেত্রেও রাখঢাক করে চলার প্রবণতা মজ্জাগত হয়ে আছে। এমনকি পার্লামেন্টেও এসব বিষয় নিয়ে পরিপূর্ণ স্বচ্ছতাসম্পন্ন আলোচনা তেমন একটা হয় না। কেবল বাজেট অধিবেশনে, নিছক আইন রক্ষার জন্য যেটুকু আনুষ্ঠানিক আলোচনা না করলেই নয়, সেটুকুই শুধু করা হয়ে থাকে।
এ রকম হওয়াটার পক্ষে যুক্তি হিসেবে সাধারণত বলা হয়ে থাকে, প্রতিরক্ষা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা জাতীয় নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু আমেরিকা, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে সে দেশের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়েই শুধু নয়, তাদের নেওয়া বিভিন্ন সামরিক পদক্ষেপ নিয়েও খোলামেলা উত্তপ্ত তর্ক-বিতর্ক হরহামেশাই হচ্ছে। ‘স্পর্শকাতরতার’ কারণে সে তর্ক-বিতর্ক বন্ধ করে রাখা হয় না।
এ কথা হয়তো ঠিক যে, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতির অনেক বিষয় ‘স্পর্শকাতর’ বিধায় তার সবকিছু নিয়ে জনগণের মাঝে একেবারে ষোলোআনা খোলামেলা আলোচনায় অসুবিধা থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের বা পার্লামেন্টারি কমিটির রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনায় অসুবিধা থাকার তো কোনো কারণ থাকতে পারে না। পার্লামেন্ট সদস্যদের মধ্যে তো নিশ্চয়ই বিদেশের চর নেই। সে রকম থাকলে তো সে এক ভয়ঙ্কর বিপদের কথা! এসব কথা বাদ দিলেও এ কথা অন্তত নিশ্চিত বলা যায় যে, একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় দেশের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিভাগের কাজকর্ম নিয়ে আলোচনার নিয়ম-নীতি কী হওয়া বাঞ্ছনীয়, নিদেনপক্ষে সে বিষয় নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনায় কোনো অসুবিধা থাকার কারণ তো একেবারেই থাকতে পারে না।
দেশের সংবিধানে বিদেশের সঙ্গে গোপনে কোনো চুক্তি করার সুযোগ রাখা হয়নি। সংবিধানের ১৪৫(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিদেশের সহিত সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন; তবে শর্ত থাকে যে, জাতীয় নিরাপত্তার সহিত সংশ্লিষ্ট অনুরূপ কোনো চুক্তি কেবলমাত্র সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করা হইবে।’
সংবিধানে এরূপ স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও সে নির্দেশনাকে অগ্রাহ্য করে বিদেশের সঙ্গে নানা চুক্তি, বিশেষত প্রতিরক্ষাবিষয়ক, গোয়েন্দা তৎপরতাবিষয়ক, সামরিক জোটে যোগদানবিষয়ক চুক্তি সম্পাদন করা ও এসব বিষয়ে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে কোন আইন ও অধিকারবলে?
সংবিধানে এরূপ স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও সে নির্দেশনাকে অগ্রাহ্য করে বিদেশের সঙ্গে নানা চুক্তি, বিশেষত প্রতিরক্ষাবিষয়ক, গোয়েন্দা তৎপরতাবিষয়ক, সামরিক জোটে যোগদানবিষয়ক চুক্তি সম্পাদন করা ও এসব বিষয়ে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে কোন আইন ও অধিকারবলে?
গত ২৫ আগস্ট সৌদি আরবের উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আল আইশ তার ঢাকা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব জানিয়েছেন, সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা জোরদার করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে কথা হয়েছে। সৌদি উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানান, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চায়। প্রধানমন্ত্রী সেই সৌদি আহ্বানে সাড়া দেবেন বলে জানিয়েছেন। সৌদি আরবকে বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধুরাষ্ট্র উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ে সৌদি আরব একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।’ জানতে ইচ্ছে করছে, এরূপ অভিমত প্রকাশের সময় কি প্রধানমন্ত্রীর মনে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে সৌদি আরবের ভূমিকার কথা একবারও উদয় হয়নি?
১-২ মাস আগে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের মাধ্যমে দেশবাসী জানতে পেরেছিল, সৌদি আরবের নেতৃত্বে গঠিত সামরিক জোটের একটি সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ ধরনের সামরিক জোটে যোগ দেওয়ার বিষয়ে ভালো-মন্দ বিচার করার আগে যে প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবে বিস্ময় জাগায় তা হলো, কোনো সামরিক জোটে যোগদানের মতো এরকম একটি গুরুতর বিষয়ে দেশে কোনোরকম আলোচনা ছাড়াই এবং এমনকি সে সম্পর্কে ন্যূনতম আভাস-ইঙ্গিত ছাড়াই, এত সংগোপনে এরূপ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে গেল কেন ও কীভাবে? সামরিক জোটে যোগদান করাটি কোনোভাবেই হালকা কোনো বিষয় নয়। বাংলাদেশ আগাগোড়াই একটি জোটনিরপেক্ষ দেশ। বিশ্বের জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সমর্থন নিয়ে এ দেশ মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হতে পেরেছিল। পাকিস্তান আমলে জোটনিরপেক্ষতার নীতির সপক্ষে বহু সংগ্রাম হয়েছিল। স্বাধীনতার পর স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছিল, বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ থাকবে। ৪৫ বছর ধরে সেই অঙ্গীকার বজায় রেখে বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষতার একটি সুদৃঢ় ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে। কাউকে না জানিয়ে সেই গৌরবময় ঐতিহ্যকে সংগোপনে পরিত্যাগ করে সৌদি আরবের সঙ্গে সামরিক জোট গঠনের অধিকার সরকারকে কে দিল?
মধ্যপ্রাচ্যে এখন সৌদি আরব ও ইরানকে ঘিরে পরস্পরবিরোধী দুটি শিবির দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত। বিভিন্ন দেশে তারা ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ পরিচালনা করছে। মধ্যপ্রাচ্যের এরূপ জটিল সংঘাতময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পক্ষে কোনো একটি শিবিরে অবস্থান নেওয়াটি কি তার জাতীয় স্বার্থে অনুকূল হয়েছে? নাকি তার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের আগুন বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার বিপদ সৃষ্টি হলো? সেই সৌদি আরব ইয়েমেনে আগ্রাসন ও গণহত্যা চালাচ্ছে। ইসরায়েলের সঙ্গে তার মিতালির খবর এখন প্রকাশ হয়ে পড়েছে। এই সৌদি আবরই তালেবান, আল কায়েদা, আইএস ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক ‘টেররিস্ট’ বাহিনী গঠনে অর্থ-অস্ত্র সরবরাহ ও অন্যান্য ষড়যন্ত্রমূলক পথে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। সৌদি আরব ও ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামরিক-রণনৈতিক পরিকল্পনার প্রধান বরকন্দাজের ভূমিকায় নিয়োজিত।
সৌদি আরব একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শুধু বিরোধিতাই করেনি, পাকিস্তান ও তার হানাদার বাহিনীকে সে অর্থ-অস্ত্র দিয়ে মদদ দিয়েছিল। স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশে ষড়যন্ত্র, অন্তর্ঘাত ইত্যাদিকে সে ক্রমাগত উসকে দিয়েছিল। এখনো সে কাজে সে লিপ্ত রয়েছে। জামায়াত-শিবির, জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম প্রভৃতি উগ্র সাম্প্রদায়িক দল ও ‘টেররিস্ট’ বাহিনীর প্রধান অর্থ জোগানের কাজ যে সৌদি আরব থেকেই হচ্ছে সে কথা বহু দিন থেকেই ওপেন সিক্রেট। সেই সৌদি আরবের সঙ্গে সামরিক জোট গঠন করাটি কি ‘খাল কেটে কুমির আনার’ মতো আত্মঘাতী পদক্ষেপ নয়? এ পথে যাওয়াটা সরকারের উচিত হয়েছে কি? কিংবা সে পথে যাওয়ার অধিকার সে রাখে কি? সৌদি আরবের অর্থে কেনা অস্ত্র-গুলি-বোমায় যে ৩০ লাখ মানুষ একাত্তরে শহীদ হয়েছিলেন, সৌদি নেতৃত্বে গঠিত সামরিক জোটে যোগদান কি তাদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করার মতো কাজ নয়? সে কথা কি সরকারের মনে একবারও উদয় হয়নি?
সৌদি উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ঢাকা সফরের ৪ দিন যেতে না যেতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) জন কেরি ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ১০ ঘণ্টার এক ঝটিকা সফর করে গেলেন। দু’দিনের ভারত সফরের পথে ক্ষণিকের যাত্রাবিরতির মতো এ সফরকালে তিনি প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে গেছেন। তার ঢাকায় পা রাখার আগেই ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত জানিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারিত্বকে আরও জোরদার করে দু’দেশের সম্পর্ক নতুন পর্যায়ে নেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ যেন বিশ্বে স্ট্র্র্যাটেজিক ভূমিকা পালন করতে পারে, সেই বার্তা ঢাকাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য জন কেরি ঢাকায় আসছেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ব্রিফিংয়ে জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার দীর্ঘমেয়াদি ও বিস্তৃত সম্পর্ক আরও জোরদারের বিষয়ের পাশাপাশি গণতন্ত্র, উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও মানবাধিকার বিষয়ের ওপরও জন কেরি জোর দেবেন। পৃথকভাবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ও কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে এসব বিষয়ে জন কেরির কী কথা হয়েছে তার সবকিছু জানার সুযোগ আমাদের নেই। হয়তো অনেক ‘স্পর্শকাতর’ বিষয়ে কথাবার্তা হয়েছে। মিডিয়া ব্রিফিংয়ে যতটুকু তারা জানতে পেরেছে কেবল সেটুকুই আমরা জানতে পেরেছি।
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে থাকবে ও বিশেষজ্ঞ সহায়তা দেবে বলে জানানো হয়েছে। এই বিশেষজ্ঞ সহায়তার কতটা সামরিক চরিত্রের হবে, সে কথা অবশ্য জানানো হয়নি। একদিকে সৌদি আরবের সঙ্গে সামরিক জোটে যোগদান, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ধিত সামরিক ‘সহায়তা’ দেশকে বিশ্ব রাজনীতির সেই অক্ষশক্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যাদের বিরুদ্ধে একাত্তরে যুদ্ধ করে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের দেশ স্বাধীন করতে হয়েছিল। যুক্তি দেওয়া হতে পারে যে, একাত্তরের বিশ্বপরিস্থিতি তো এখন আর নেই। কিন্তু কথা হলো, তা না থাকার অর্থ কি এই যে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের চরিত্র অর্জন করেছিল তা পরিত্যাগ করতে হবে? যদি তাই করা হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারার কথা বলে জনগণকে প্রতারিত করার কী অর্থ থাকতে পারে?
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ সহায়তা নেওয়াটি চূড়ান্ত বিচারে হলো চরম আত্মঘাতী। তালেবান, আল কায়েদা, আইএস ইত্যাদি সন্ত্রাসী জঙ্গি বাহিনী সৃষ্টির পেছনে যে যুক্তরাষ্ট্রের হাত ছিল তা এখন সর্বজনবিদিত। এসব জঙ্গিবাদী অপশক্তি সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হলোÑ ‘সর্প হয়ে দংশন করো, ওঝা হয়ে ঝাড়ো।’ জন কেরির সফরের আসল লক্ষ্য কী ছিল সে সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি হয় যদি আমরা তার দু’দিনের ভারত সফরের ফলাফলের প্রতি দৃষ্টি দিই। ভারত সফরকালে জন কেরি গুরুত্বের সঙ্গে ‘দক্ষিণ চিন সাগরে শান্তি রক্ষায়’ ভারতের বর্ধিত ভূমিকার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে উভয় দেশ পরস্পরের সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে এই মর্মে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। ‘চিনকে ঠেকাও’ যে জন কেরির দক্ষিণ এশিয়া সফরের মূল লক্ষ্য ছিল সে কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে।
বাংলাদেশকে ‘গণচিনবিরোধী’ মেরুকরণে শামিল করার লক্ষ্য থেকে জন কেরি মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা সম্পর্কে পিঠ চাপড়ানো কিছু কথাবার্তা বলেছেন। তাতে আওয়ামী শিবিরে আহাদের শেষ নেই। কিন্তু জন কেরির কথার গূঢ় অর্থ রয়েছে। বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের দর্শনার্থী বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘... এখন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পথে তারই কন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে...।’ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পথ হলো সমাজতন্ত্র, জোটনিরপেক্ষতা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, ‘দরকার হলে ১০০ বছর ঘাস খেয়ে থাকব তবুও শর্তযুক্ত ঋণ নেব না’, ‘বিশ্ব আজ শোষক ও শোষিত এই দুই ভাগে বিভক্ত, আমি শোষিতের পক্ষে’ ইত্যাদি। এ দেশ যখন এই পথ ধরে চলছিল তখন যুক্তরাষ্ট্র তা থেকে দেশকে বিচ্যুত করতে মরিয়া হয়ে ষড়যন্ত্র করেছিল। এমনকি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে অনেক কথা রয়েছে। তাই হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেওয়া বঙ্গবন্ধুর দ-প্রাপ্ত আসামিকে এ দেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধটিকে জন কেরি ধামাচাপা দেওয়ার পথ নিয়েছেন।
তবে এ ক্ষেত্রে যেটি সবচেয়ে গুরুতর বিষয় তা হলো, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পথ’ বলে জন কেরি যে পথটিকে সার্টিফিকেট দিয়ে গেলেন তা প্রকৃতপক্ষে হলো ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পথের’ সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। এখন দেশ যে পথ ধরে চলছে তা হলো সমাজতন্ত্রের বদলে বাজার অর্থনীতি ও পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের কাছে আত্মসমর্পণ, জোটনিরপেক্ষতার বদলে সৌদি নেতৃত্বে সামরিক জোটে যোগদান, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার বদলে সাম্রাজ্যবাদের পদলেহন, বিশ্বের শোষিত মানুষের পক্ষে দাঁড়ানোর বদলে শোষকদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ ইত্যাদি। জন কেরির কথায় এটিই নাকি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পথ। যদি তাই হবে তবে মোশতাক, জিয়া, এরশাদের পথ কোনটাকে বলব? ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পথের’ চরিত্রকেও যুক্তরাষ্ট্রীয়করণ করে তার বিপরীত ধারার পথকে সে জায়গায় প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা তিনি করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই তাদের কাজ শেষ হয়নি। তারা এখন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পথের প্রকৃত মর্মকথাকেও হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব দৃঢ়তর হওয়ায় যারা আজ আহাদে আত্মহারা তাদের এ কথাটি মনে রাখা উচিত যে, ‘আমেরিকা যার বন্ধু, তার আর কোনো শত্রুর প্রয়োজন হয় না।’
আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে এমন ডিগবাজি দেওয়ার ঘটনা আগেও ঘটেছিল। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর ‘৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হয়ে গেছে’ বলে ঘোষণা দিয়ে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি পরিত্যাগ করেছিলেন এবং ‘জিরো প্লাস জিরো ইজ ইকুয়াল টু জিরো’ তত্ত্ব দিয়ে জোটনিরপেক্ষতার নীতির কবর দিয়ে সেন্টো, সিয়াটো, পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি ইত্যাদি সামরিক জোটে দেশকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। আওয়ামী লীগ এখন কতটা ‘সোহরাওয়ার্দীপন্থি’ আর কতটা ‘বঙ্গবন্ধুপন্থি’ সে প্রশ্নের জবাব খুঁজে দেখার চেষ্টা সংশ্লিষ্ট সবারই করা উচিত নয় কি?
প্রকাশ : (০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন