পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িকীকরণ, গুরুত্বপূর্ণ ও প্রগতিশীল লেখকদের লেখা বাদ দেয়াসহ নানা অসঙ্গতির প্রতিবাদসহ কয়েক দফা দাবিতে আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর মহান শিক্ষা দিবসে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামনে অবস্থান ও সমাবেশ কর্মসূচি পালন করবে প্রগতিশীল বিভিন্ন ছাত্র, যুব, নারী, শিশুকিশোর, পেশাজীবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের যুথবদ্ধ মঞ্চ- জাতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতি রক্ষা আন্দোলন। গত ১০ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’র টিচার্স লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। জাতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতি রক্ষা আন্দোলন-এর যুগ্ম আহবায়ক কামাল লোহানীর সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আন্দোলন-এর সদস্য সচিব ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি ইমরান হাবিব রুমন।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, জীবন ও জগত সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন, দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও সমকালীন বিশ্বের ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে অবগত, দেশপ্রেমিক, দক্ষ ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন একটি জনগোষ্ঠী গড়ে তোলাই শিক্ষার লক্ষ্য। আর এ লক্ষ্যে পোঁছানোর মূল সোপান হচ্ছে পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি। কিন্ত, এবছর মৌলবাদী গোষ্ঠীর কাছে নতি স্বীকার করে পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় ও লৈঙ্গিক বৈষম্যমূলক নানা বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গণতন্ত্রমনা-প্রগতিশীল লেখকদের গুরুত্বপূর্ণ লেখা বাদ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও এই পাঠ্যবইগুলোতে ছাপার ভুল, বাক্য গঠনে ভুল, তথ্য বিকৃতি, বানান ভুলসহ নিম্নমানের ছাপা ও নিম্নমানের উপকরণ বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। এই ভুলগুলো বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। এর প্রতিবাদে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক-বুদ্ধিজীবী মহলসহ প্রগতিশীল সকল সংগঠনসমূহ ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন করেছে যা এখনও অব্যাহত আছে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হল, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পাঠ্যপুস্তক বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট কেউ এর দায় স্বীকার করেনি, প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করা এবং আগামী বছরের পাঠ্যপুস্তকে কি হবে সেটা নিয়ে স্পষ্ট কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সমাধানের উপায় না খুঁজে একে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে বিষয়টি আড়াল করার চেষ্টা করছে।
লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, একটা জাতিকে ধর্মান্ধ, কুপমণ্ডুক করে গড়ে তুলতে, ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-জাতি ইত্যাদি ভেদাভেদ তৈরিতে যে ধরনের সিলেবাস প্রয়োজন, হেফাজতে ইসলামি বা জামাতে ইসলামি বা আওয়ামী ওলামা লীগ যে ধরনের সিলেবাসের দাবি করে মুক্তিযুদ্ধের চ্যাম্পিয়ন বলে দাবিদার দল আওয়ামী লীগ সেই কাজটিই করেছে। যা সংবিধানের শিক্ষা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিপন্থি। যে লেখাগুলোর মধ্যে সাহিত্যরস আছে, যে লেখাগুলো অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ শেখায়, দেশপ্রেম শেখায়, যুক্তিবাদী বা বিজ্ঞানমনষ্ক হতে শেখায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে সে লেখাগুলো বাদ দেয়া হয়েছে। যেন বাংলা সাহিত্যের বইকেও ধর্ম বই বানাতে ঐকান্তিক চেষ্টা। ফলে রচনাশৈলী, বিষয়বস্তু বাদ দিয়ে রচনাকারের ধর্মপরিচয়ই প্রধান হয়ে উঠেছে। বাদ দেয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, উপেন্দ্রকিশোর রায়, লালন শাহ, রণেশ দাসগুপ্ত, হুমায়ুন আজাদসহ বিখ্যাত লেখকদের লেখা। যার মধ্য দিয়ে সরকার মৌলবাদীদের অযৌক্তিক দাবির কাছে আত্মসমর্পন করে কোটি কোটি শিক্ষার্থীর চেতনা বিকাশে প্রতিকূল ভূমিকা পালন করছে।
ইমরান হাবিব রুমন আরো বলেন, সাম্প্রদায়িক ও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতের প্রণীত পাঠ্যপুস্তকের প্রতিবাদে এবং শিক্ষা-সংস্কৃতির উপর সাম্প্রদায়িক-পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এদেশে প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী-অভিভাবকসহ ছাত্র-যুব-নারী-সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ দীর্ঘদিন থেকে লড়াই সংগ্রাম করে আসছে। এই লড়াইগুলোকে একত্রিত করে আরো শক্তিশালী ও কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. অজয় রায় এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীকে যুগ্ম আহবায়ক করে ‘জাতীয় শিক্ষা সংস্কৃতি রক্ষা আন্দোলন’ নামে ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ গড়ে তোলা হয়েছে। আগামীতে জাতীয় কনভেনশনের মাধ্যমে আন্দোলন ও সাংগঠনিক রূপরেখা সবার সামনে তুলে ধরা হবে।
আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামনে অবস্থান ও সমাবেশে শিক্ষক-শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী-অভিভাবকসহ ছাত্র-যুব-নারী-সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখবেন জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, শিক্ষা ও সংস্কৃতি রক্ষা আন্দোলন-এর অন্যান্য দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে সাম্প্রদায়িক ও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রণীত পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করে, প্রগতিশীল গণতন্ত্রমনা লেখকদের লেখাগুলো যুক্ত করে মানসম্মত, চিত্তাকর্ষ পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা; সার্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, একই ধারার গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা; শিক্ষার সকল স্তরে বেসরকারীকরণ-বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করা; চারু ও কারুশিক্ষা বন্ধের ষড়যন্ত্র বন্ধ কর। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে মূল বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা এবং অবিলম্বে ডাকসুসহ ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা।
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন-এর সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উদীচী’র সভাপতি ড. সফিউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হাফিজ আদনান রিয়াদ, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী শম্পা বসু, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি জি এম জিলানী শুভ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি নাঈমা খালেদ মনিকা, বিপ্লবী ছাত্র শৈত্রীর যুগ্ম আহবায়ক ইকবাল কবীর, ছাত্র ঐক্য ফোরামের যুগ্ম আহবায়ক সরকার আল ইমরান, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন প্রিন্স, স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আমিনুল আকরাম এবং সংস্কৃতি কর্মী জয়ন্ত জীবন উপস্থিত ছিলেন...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন