লেখক: হাসান তারিক চৌধুরী, সদস্য,কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
আইরিশ
কবি Francis Duggan এর লেখা শ্যাভেজ’কে নিবেদিত একটি কবিতার কিছু অংশ দিয়ে শুরু করছি।
ÔVeneyuelaÕs late President may he rest in peace From the
pains of killer cancer death gave him release Not one without human flaws but
in some ways quite rare For the poor of his Country Hugo Chavey did care His
mind Hugo Chavey was always willing to speak In the face of greater power not
known to be weak Such a person as he was respect does command Why maû
Veneyuelans loved him not hard to understand Hugo Chavey as a saint will never
be canonized But as a friend of the poor of his Country he will always be recognized
And though in life he did make his friends and he did make his foes With most
leaders this is hwo it is one would have to suppose’
এই কবিতাটির ভেতর দিয়েই আমরা বুঝতে পারি আজকের ভেনিজুয়েলার
বামপন্থি সরকার আসলে কার বন্ধু। আর কারাই বা তার প্রতিপক্ষ। ভেনিজুয়েলায় আজ যে
সংকট সৃষ্টি হয়েছে তাকে বুঝতে হলে দেশটির বামপন্থি সরকারের ক্ষমতায় আসার সংক্ষিপ্ত
ইতিহাসটি জানতে হবে। অনেকেই হয়তো জানেন,
নয়া শতকের নয়া সমাজতন্ত্রের জাগরণী ডাক
দিয়ে ১৯৯৮ সালে বিপ্লবী হুগো শ্যাভেজ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভেনিজুয়েলার রাষ্ট্রপতি
নির্বাচিত হয়েছিলেন। ডাক দিয়েছিলেন বামপন্থি ‘বলিভারিয়ান বিপ্লবের’। যে বিপ্লবের চারটি মূল লক্ষ্য ছিলো। সেগুলো হচ্ছে- ১।
জনগণতন্ত্র, ২। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা,
৩। জাতীয় রাজস্বের ন্যায়সংগত বণ্টন এবং
৪। রাজনৈতিক দুর্নীতির অবসান। এসব লক্ষ্যকে সামনে রেখেই তিনি প্রথমে ফিফথ রিপাবলিক
আন্দোলন এবং পরে ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টি গঠন করেন। এ দলটি আজ দেশটির ক্ষমতায়।
তেলের পয়সায় শিক্ষা, আবাসন ও স্বাস্থ্য অধিকারকে দেশের মেহনতি মানুষের দুয়ারে
পৌঁছে দিয়ে শ্যাভেজ দেখিয়েছিলেন প্রকৃত উন্নয়ন কাকে বলে। শুরু থেকেই মার্কিন
সাম্রাজ্যবাদ দেশটির প্রতিক্রিয়াশীল মহলের সাহায্যে এ বাম সরকারকে উৎখাত করতে
চেয়েছে। এমনকি সামরিক অভ্যুত্থান উস্কে দিয়ে শ্যাভেজকে ২০০২ সালে ক্ষমতা থেকে
সরিয়েও দিয়েছিল। কিন্তু জনতা পাল্টা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মাত্র দুদিনের মাথায়
শ্যাভেজকে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছিলো। এরপর ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত
তাকে ক্ষমতায় রেখেছিল। কিন্তু ২০১৩ সালের মার্চ মাসে দুরারোগ্য ক্যান্সার তাকে
দুনিয়া থেকে কেড়ে নেয়। এরপর তাঁরই সহকর্মী নিকলাস মাদুরো রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার
গ্রহণ করেন। শ্যাভেজ রাষ্ট্রপতি হয়ে ১৯৯৯ সালেই একটি জনগণতান্ত্রিক সংবিধান
রচনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেসময়কার পার্লামেন্টে এ নিয়ে উদ্যোগও নিয়েছিলেন।
কিন্তু তিনি নানা কারনে সে কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। এখন নিকোলাস মাদুরোর
নেতৃত্বাধীন সরকার তাদের প্রয়াত নেতার সে অসমাপ্ত কর্তব্য সম্পাদন করতে যাওয়ায়
বিরোধী ডানপন্থিরা বলছে, মাদুরো একজন স্বৈরশাসক। তিনি নিজের হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত
করতেই নাকি নয়া সংবিধান রচনা করতে যাচ্ছেন। মাদুরো যে সাংবিধানিক সভা অথবা
কন্সটিটুয়েন্ট এসেম্বলির মাধ্যমে এটি করতে চাইছেন সে নির্বাচনকেও বিরোধীরা এখন
অবৈধ বলছে। অথচ, তারাই এ নির্বাচনে বিরাট অঙ্কের অর্থ ঢেলেছে। কিন্তু আশানুরূপ
ফললাভ করতে পারেনি। এর আগেও মাদুরোকে উৎখাতের জন্য গণভোট দাবি করেছিলো। সে ভোটে
মাদুরো পেয়েছিলেন ৫০.৬১% এবং বিরোধীদের প্রার্থী হেনরিক ক্যাপ্রিলেস পেয়েছিলেন
৪৯.১২%। সে নির্বাচনে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-সহ নানাবিধ এজেন্সি ডানপন্থি
প্রতিক্রিয়াশীলদের জেতানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর তারা শুরু করে দেশজুড়ে
নাশকতার কাজ। কারণ এ ডানপন্থিরা হলো,
দেশটির ধনী শ্রেণির প্রতিনিধি। বিভিন্ন
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার দেয়া তথ্যমতে,
সে সময় আন্তর্জাতিক বাজারে আচমকা
দরপতনের কারণে ভেনিজুয়েলার তেলরাজস্ব নির্ভর জাতীয় অর্থনীতি কার্যতঃ শুয়ে পড়ে। ফলে
প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ১৩০ মার্কিন ডলার থেকে নেমে দাঁড়ায় মাত্র ৪০ ডলারে। মূলতঃ
মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাত ও অন্যান্য কারণে বিশ্ব বাজারে তেলের চাহিদা কমে যায়।
যার উপর ভেনিজুয়েলার ক্ষমতাসীন বামপন্থি দলটির কোনও হাত নেই। কিন্তু তেলের ব্যবসা
থেকে আয় কমে গেলে তেলরাজস্ব নির্ভর এই দেশটির জাতীয় অর্থনীতি কিভাবে চলবে? তার কোনো কার্যকর
প্রস্তুতি ক্ষমতাসীন বামপন্থিদের ছিলো না। অপরদিকে ময়দা, চিনি, কফি, সবজি, ওষুধসহ
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহের চেইনে নিকট অতীতে দেখা দিয়েছিলো চরম সঙ্কট।
তাছাড়া শিল্প অবকাঠামোগত ক্ষেত্রেও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ঘটেনি। যার ফলে, একদিকে যেমন
দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক রকম বেড়ে যায় আবার অপরদিকে সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন
কল কারখানাতে শুরু হয় গণ লে-অফ। কমতে থাকে জিডিপি’র হার। এসব ঘটনা সাধারণ ভোটারদের মনে সৃষ্টি করেছিলো চরম
ক্ষোভ। যাকে সুবিধামত কাজে লাগায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র হেনরিক
ক্যাপ্রিলেস’র নেতৃত্বাধীন ডানপন্থি জোট। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ভেনিজুয়েলার খাদ্যসহ
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহের চেইনের ব্যবসার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ‘পোলার কর্প’ নামের একটি কোম্পানির
হাতে। দেশটির বিশিষ্ট ধনকুবের লরেন্জো মেনদোযা হলেন এর মালিক। যিনি শুরু থেকেই
হুগো শ্যাভেজ এর রাজনীতির চরম বিরোধী এবং মার্কিনের বেশ ঘনিষ্ঠ। অভিযোগ আছে, এবারের নির্বাচনের
আগে এই ধনকুবের লরেন্জো খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহের চেইনে
কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করেন। যাতে করে জন বিক্ষোভ তীব্রতর হয়। মার্কিন স্টেট
ডিপার্টমেন্টের পরিকল্পনা অনুযায়ী এ নির্বাচনে বামপন্থি শক্তিকে ক্ষমতা থেকে
হটানোর জন্য ঢালা হয় কাড়ি কাড়ি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের এই আগ্রহের আসল কারণ হল ভেনিজুয়েলার
তেলসম্পদ। ভেনিজুয়েলার তেলের প্রায় ৭৫ শতাংশের ক্রেতা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ঘরের কাছে এরকম তেলের জোগান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কতটা লোভনীয় তা ব্যাখা করা
নিষ্প্রয়োজন। এছাড়াও ভেনিজুয়েলার আবাসন ব্যবসার বড় অংশের মালিক হলেন মার্কিনপন্থি
জোটের প্রধান নেতা, দেশটির মিরান্দা প্রদেশের গভর্নর হেনরিক ক্যাপ্রিলেস’র বাবা। আর মা হলেন
মিডিয়া জগতের মালিক। ১৯৭২ সালে ইহুদি মা-বাবার ঘরে জন্ম নেয়া ক্যাপ্রিলেস নিজে
চর্চা করেন ক্যাথলিক খ্রিষ্টধর্ম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে
ছাত্র থাকাকালীনই মার্কিন রাজনীতিকদের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন বাম বিরোধী ক্যাপ্রিলেস। সে
একই নাশকতা একই রাজনৈতিক শক্তি এখনো পরিচালনা করছে। এরাই সাংসদদের দায়মুক্তির
সুবিধা অপব্যবহার করে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল,
তখন ভেনিজুয়েলার সুপ্রিম কোর্ট ডিক্রি
জারি করে পার্লামেন্টকে স্থগিত করে পরিস্থিতি সামাল দেয়। তখন বিচার বিভাগের
স্বাধীনতার ধ্বজাধারী পশ্চিমা মিডিয়া বিচার বিভাগকে বামদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট বলে
গালাগাল দেয়। গত ৩০ জুলাই এর নির্বাচনে বামপন্থি দল জয়ী হলে ক্যাপ্রিলেস একে
একধরনের ‘ক্যু’ বলে আখ্যা দেয়। ১৯ আগস্ট ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকা এ খবর জানিয়েছে।
ক্যাপ্রিলেসরা যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মজুদদারি করে সংকট তৈরি করে তখন বাম
সরকার কলম্বিয়ার সীমান্ত খুলে দিয়ে জনতাকে সেখান থেকে বাজার সদাই করতে বলে। এই
দৃশ্যে প্রতিক্রিয়াশীলরা সীমান্ত অরক্ষিত বলে চেঁচাতে থাকে। মিশ্র অর্থনীতির এ
দেশটির জাতীয় রাজস্বের অর্ধেকই আসে তেল রপ্তানি থেকে। জিডিপিতে কৃষির অবদান মাত্র
৩%। ফলে বুঝাই যাচ্ছে, খাদ্যদ্রব্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি দেশটিতে কতটা সহজ। আজ
মার্কিন মদদে সেসব সংকটেরই জন্ম দেয়া হচ্ছে। শ্যাভেজের সময় থেকেই মার্কিন প্রশাসন
পরিকল্পিতভাবে ভেনিজুয়েলার শহরগুলোতে সহিংসতা উস্কে দিয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ানোয়
ভূমিকা রেখেছে এবং দফায় দফায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে
চলেছে। এরকম একটি পটভূমিকে ব্যবহার করে তথাকথিত গণতন্ত্র রপ্তানির
নামে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন এখন ভেনিজুয়েলার বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ
আরোপের কথা বলেছে। মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি মাইক পেন্স,
পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসন এবং জাতীয়
নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল ম্যাক মাস্টার বলেছেন,
ভেনিজুয়েলায় সামরিক হামলাসহ সব অপশনই
তারা প্রস্তুত রেখেছেন। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর বামপন্থি মহলে এক নবায়িত
আশাবাদের জায়গা তৈরি করেছিলো লাতিন আমেরিকার বামপন্থি রাজনীতি। যান্ত্রিক ও একঘেয়ে
বামপন্থার মডেলের বদলে তারা দেখিয়েছিল এক প্রাণবন্ত ও সৃজনশীল বামপন্থি রাজনৈতিক
পথ। যে কারণে পুঁজিবাদী পরাশক্তির নানা আঘাতের পরও বামপন্থি কিউবার স্বগৌরবে
দাঁড়িয়ে থাকা এবং ভেনিজুয়েলার ‘বলিভারিয়ান বিপ্লব’
আজও আন্তর্জাতিক দুনিয়ার মানুষকে আকৃষ্ট
করে। ভেনিজুয়েলার বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এরকম এক ভয়ানক
আগ্রাসী থাবার এই মুহূর্তে বিশ্বের বামপন্থি সমাজের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের
বামপন্থিরা নীরব বসে থাকতে পারে না। তাই আজ বিশ্বজুড়ে ভেনিজুয়েলা সংহতি দিবসের অংশ
হিসেবে বাংলাদেশের জনগণও ভেনিজুয়েলার মেহনতি মানুষের প্রতি এবং সেখানকার বামপন্থি
সরকারের প্রতি জোরদার সংহতি প্রকাশ করছে। আসুন আমরা সাম্রাজ্যবাদের প্রতিটি
পদক্ষেপকে নিজেদের নজরদারির মধ্যে রাখি,
জনতাকে সচেতন ও সংগঠিত করি। আসুন, বিজয় না হওয়া পর্যন্ত
লড়াইয়ের মধ্যেই থাকি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন