Biplobi Barta

বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

চাপ বাড়াতে জাতিসংঘকে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের আহ্বান। অবরোধসহ নানা সুপারিশ



রাখাইনে মানবাধিকার সুরক্ষায় ব্যর্থতার অভিযোগে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির শাখারভ পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়া উচিত কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা।
সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাপ ক্রমশ বাড়ছে। নিউইয়র্কে গত বুধবারের বৈঠকের পর নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি ও জাতিসংঘে ইথিওপিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি তেকেদা আলেমু রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে উন্মুক্ত অধিবেশনের পর এই আভাস দিয়েছেন।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অতীতে কাজ করেছেন এবং এখন কাজ করছেন এমন বেশ কয়েকজন কূটনীতিক নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির বিবৃতিকে চলমান পরিস্থিতিতে বিশেষ অগ্রগতি বলে মনে করছেন। বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদের দুই স্থায়ী সদস্য রাশিয়া ও চীন এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের পক্ষে রয়েছে। এই অবস্থায় নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতি রোহিঙ্গা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের দাবির জোরালো ভিত্তি দিচ্ছে।
নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতিকে বাংলাদেশ কীভাবে দেখছে, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা চাইছিলাম, নিরাপত্তা পরিষদ এই পরিস্থিতিতে একটা অবস্থান তুলে ধরুক। সেদিক থেকে এই বিবৃতি আমরা সময়োপযোগী ও জোরালো বলে মনে করি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী দুই সপ্তাহে নিউইয়র্কে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হবে। এসব আলোচনায় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া 
বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ জোর দেবে। বিশেষ করে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির অনুরোধে কফি আনান ফাউন্ডেশন রাখাইন রাজ্যের আর্থসামাজিক উন্নয়নে একটি কমিশন গঠন করে। সংক্ষেপে আনান কমিশননামে ওই কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে প্রাধান্য থাকবে বাংলাদেশের। কমিশনের সুপারিশে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
লন্ডনের একটি কূটনৈতিক সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে ১৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন। ওই আলোচনায় অংশ নিতে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। রোহিঙ্গা বিষয়টি নিউইয়র্কের সামনে নিয়ে এসেছেন জাতিসংঘে যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি।
মস্কোর একটি কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, সের্গেই লাভরভ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠকের অনুরোধ জানিয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব স্বাভাবিকভাবে দ্বিপক্ষীয় অন্য বিষয়গুলোর সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুটি তাঁদের আলোচনায় গুরুত্ব পাবে।
বাংলাদেশের এক রাষ্ট্রদূতের মতে, রোহিঙ্গা প্রসঙ্গটি নিরাপত্তা পরিষদে তুলতে স্থায়ী সদস্য চীনের বাধা আছে। মিয়ানমারের দাবি, রাশিয়া ও চীন তাদের পক্ষে আছে। এ পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা পরিষদের এ ধরনের বিবৃতি আসাটা কিছুটা অপ্রত্যাশিত। তাই এ পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদের এই অবস্থানকে ভালোই বলা যায়। কারণ, এতে মিয়ানমারের ভূমিকার সমালোচনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে। এটি পরবর্তী ধাপগুলোতে বাংলাদেশকে সমর্থন পেতে সহায়তা করবে।
রাষ্ট্রদূতের মতে, চীনের সমর্থন পুরোপুরি না পেলেও মিয়ানমারের দিকে ঝুঁকে থাকা অবস্থান থেকে সরিয়ে দেশটিকে নিরপেক্ষ করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আর কাছের প্রতিবেশী ভারতকে বোঝাতে হবে, নিঃশর্তভাবে সব ধরনের সহযোগিতা বাংলাদেশ দিয়ে আসছে। ভবিষ্যতেও দেবে। এই অবস্থায় বাংলাদেশকে ভারতের সমর্থন দেওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ, দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন আর মানবাধিকারকর্মীদের সমালোচনায় আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমার চাপে পড়েছে। সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানে এই চাপ অব্যাহত রাখার কোনো বিকল্প নেই।
ভারতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) জ্যেষ্ঠ ফেলো জয়িতা ভট্টাচার্যের মতে, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সমাধান হওয়া জরুরি। গত রাতে নয়াদিল্লি থেকে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এ ধরনের সমস্যা বহুপক্ষীয় ফোরামে আলোচনা হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের মতো সংস্থাকে আদর্শ বিবেচনা করা যায়।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাব
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট মিয়ানমারের সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীকে অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ এবং তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া বন্ধ করতে বলছে।
গতকাল ইউরোপীয় পার্লামেন্টে এক বিতর্ক শেষে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইউরোপিয়ান কমিশনকে মিয়ানমার সরকারের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘন ঠেকাতে চাপ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাবে অবরোধ আরোপের বিষয়টি বিবেচনার কথা বলা হয়েছে।
মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত রাখার জন্য ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বিশ্বের কৃতী নাগরিকদের শাখারভ পুরস্কার দিয়ে থাকে। শাখারভ পুরস্কারপ্রাপ্ত অং সান সু চিকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়, এই পুরস্কার তাঁকেই দেওয়া হয় যিনি মানবাধিকার সমুন্নত রাখবেন, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেবে এবং আন্তর্জাতিক আইনকে সম্মান জানাবে। পুরস্কারপ্রাপ্ত কেউ এই আদর্শগুলো লঙ্ঘন করলে তাঁর পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়া যায় কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা।
গতকালের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ইইউর সদস্যরা ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের জন্য তৈরি এবং মিয়ানমার যেসব বাণিজ্য-সুবিধা পেয়ে থাকে, সেটি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে।
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট তাদের প্রস্তাবে মিয়ানমার সরকার, বিশেষ করে অং সান সু চিকে সব ধরনের জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতাকে নিন্দা জানানোর আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সীমান্তে স্থলমাইন সরিয়ে ফেলার আহ্বান জানানো হয়েছে। কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়ে প্রস্তাবে দুঃখ প্রকাশ করে বলা হয়, ২০১৫ সালের ১৮ মে অং সান সু চির রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র বলেছিলেন, মিয়ানমারের সরকারের উচিত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়া। এরপর থেকেই রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতির নাটকীয়ভাবে অবনতি হয়েছে।
রাখাইনে সহিংসতা বন্ধে এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানে চীনসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানো হয়। আসিয়ান ও আঞ্চলিক সরকারগুলো যেন মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করে, সব বেসামরিক মানুষকে সুরক্ষা দেয় এবং শরণার্থীদের সহায়তা দেয়, সেই আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট।
জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনীরুজ্জামান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহতার কারণে দেরিতে হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সমস্যার বাস্তবতা বুঝতে পারছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মনোযোগ কিন্তু বেশি দিন থাকে না। কাজেই দেরি না করে পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে সমস্যা সমাধানে আমাদের জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে।তিনি আরও বলেন, ‘এ মুহূর্তে বৈশ্বিক যোগাযোগ বাড়াতে আমাদের একটি শক্তিশালী ও আগ্রাসী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কৌশল নিয়ে এগোনো উচিত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন