রাজনীতি নিয়ে আলোচনা উঠলে মানুষের কাছ থেকে হরহামেশাই একথা শুনতে হয় যে, রাজনীতির নামে আজকাল দেশে যা চলছে তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একধরনের ‘ধান্দাবাজি’ ছাড়া অন্য কিছু নয়। রাজনীতির এই চলমান রুগ্নতার অবসান দরকার। রাজনীতিতে দরকার ‘পরিবর্তন’। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, সেই পরিবর্তন কোন্ শক্তির হাত দিয়ে সম্ভব? সে প্রসঙ্গ থেকেই চলে আসে চলতি রাজনীতির তথাকথিত মূলধারার বাইরে ‘বিকল্প’ শক্তির উত্থানের বিষয়টি। কিন্তু ‘বিকল্প’ সম্পর্কে একেক জনের বুঝ একেক রকম। তাই, যে বিষয়টি ভালোভাবে বুঝে নেয়া প্রয়োজন তা হলো, যে ‘বিকল্প’ বিষয়টি আসলে কী?
দেশে বর্তমানে জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনে ক্ষমতায় যাওয়ার বাস্তব সম্ভাবনাপূর্ণ শক্তিশালী দল হিসেবে রয়েছে দু’টি দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এদের মধ্যে একটি দল ক্ষমতায় থাকলে অপরটি তাকে ‘প্রতিস্থাপন’ করে ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাব্য শক্তি হিসেবে সবসময় বিদ্যমান থাকে। জাতীয় পার্টিকে গৃহপালিত বিরোধী দল বানিয়েও এর হেরফের ঘটানো যায়নি। তাহলে কি বলতে হবে এই দু’টি দলই হলো একটি অপরটির বিকল্প? না, তা বলাটা সঠিক হবে না। কারণ, ‘প্রতিস্থাপকের’ যোগ্যতাসম্পন্ন হিসেবে অবস্থানকারী শক্তি হলেই তাকে ‘বিকল্প’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—এই দুটি দলের মধ্যে, অন্য নানা ক্ষেত্রে যতো পার্থক্যই থাকুক, অর্থনৈতিক-সামাজিক দর্শন ও শ্রেণি চরিত্রের বিচারে মোটা দাগে এ দল দু’টি হলো ‘সমমনা’। তাই তারা পরস্পর পরস্পরের প্রকৃত বিকল্প হিসেবে দাবি করতে পারে না। তারা উভয়েই উভয়ের, কারো মতে উত্কৃষ্ট আর কারো মতে নিকৃষ্ট, ‘নব-সংস্করণ’ মাত্র। ‘বিকল্প’ আর ‘নব সংস্করণ’ এক জিনিস নয়। একটি বিশেষ দল যে নীতিতে দেশ চালিয়েছে, আরেকটি দল তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে সেই নীতিরই কিছুটা হেরফের, উন্নতি-অবনতি, সংযোজন-বিয়োজন করে শাসন চরিত্রের নতুন একটি সংস্করণের সূচনা করতে পারে মাত্র। কিন্তু তার দ্বারা দেশকে ‘বিকল্প’ শাসনের ধারায় পরিচালনা করা বোঝায় না।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা দুই প্রধান মেরুকরণের বাইরে ‘এ টু জেড’ অন্য সব দল মিলে দ্বি-দলীয় মেরুকরণের পাল্টা শক্তি-সমাবেশ গড়ে তোলাটাকে কেউ কেউ ‘বিকল্প’ বলে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু এটিও ‘বিকল্প’ নয়। কারণ কোনো শক্তি সমাবেশ যদি বিএনপি-আওয়ামী লীগের ক্ষমতার মিউজিক্যাল চেয়ারের চক্র ভেঙে ক্ষমতায় এসে মূলত একই নীতি-দর্শনকে ভিত্তি করে শাসন কাজ পরিচালনা করে তাহলে সেটিকে কোনোভাবেই প্রকৃত বিকল্প বলা যেতে পারে না। ‘বিকল্প’ না বলে এটিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-কেন্দ্রিক শক্তি সমাবেশের বাইরে ‘তৃতীয় শক্তি’ নামে আখ্যায়িত করা যেতে পারে মাত্র। ‘তৃতীয় শক্তি’ হলেই তা ‘বিকল্প’ হবে, এমন কথা মোটেও সত্য নয়। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, ‘বিকল্প’ বলতে আমরা তবে কী বুঝব?
আজ রাজনীতি নিয়ে মানুষের একটি প্রধান প্রশ্ন হলো,—‘দেশ বদল হয়, সরকার বদল হয়, অথচ সাধারণ মানুষের কপাল বদল হয় না কেন?’ এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে হলে দেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। ইতিহাস একথাই প্রমাণ দেয় যে, সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা ও দেশের সার্বিক ভাল-মন্দের বিষয়গুলো শেষ বিচারে নির্ভর করে প্রচলিত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ওপর। পুরনোদিনের ‘ব্যবস্থার’ প্রগতিশীল-গণমুখীন মৌলিক দিক-পরিবর্তন ছাড়া শুধু দেশ বদল বা গদি বদলের মাধ্যমে, কিম্বা কেবল শাসন পদ্ধতির নব-সংস্করণ সম্পন্ন করে, সাধারণ মানুষের অবস্থার উন্নতি ঘটানো যাবে না। প্রকৃত ‘বিকল্প’ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ‘ব্যবস্থা’ বদলের এই মৌলিক কর্তব্যটি একটি কেন্দ্রিক ও অপরিহার্য উপাদান।
আমাদের দেশ বহুদিন ধরে (এমনকি বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলেও) ‘অবাধ পুঁজিবাদ ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির’ নীতি-দর্শন ও ব্যবস্থার ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে। পঁচাত্তরের পর বিগত ৪১ বছর ধরে খুনি মোশতাকের দ্বারা সূচিত এই ব্যবস্থার ভিত্তিতেই দেশ চালিয়েছে জিয়া, সাত্তার, এরশাদ, খালেদা, হাসিনা, খালেদা-নিজামী, ফখরুদ্দীন প্রমুখের নেতৃত্বাধীন পর্যায়ক্রমিক সরকারগুলো। এই ‘ব্যবস্থার’ কাঠামোর মধ্যে দেশকে আবদ্ধ রেখে অনেক ঊনিশ-বিশই করা হয়েছে, অনেক সংস্কার সাধন করা হয়েছে, নব-নব সংস্করণের আবির্ভাব ঘটিয়ে গদি বদলের পর্ব সম্পন্ন করা হয়েছে,—কিন্তু সাধারণ মানুষের অবস্থার মৌলিক কোনো উন্নতি তার দ্বারা সাধন করা যায়নি। এই ব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হিসেবে উপরতলার সীমাহীন লুটপাট, উপরভাসা ‘উন্নয়নের’ কিছু চাকচিক্য ও তৃণমূলের পনের আনা মানুষের জন্য চুঁইয়ে পড়া ছিটেফোঁটা অগ্রগতি ছাড়া সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতি-নৈতিকতা প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই সমস্যা-সংকট ও অবক্ষয়-অধোগতির ধারা দশকের পর দশক ধরে ক্রমাগতই শুধু গভীরতরই হয়েছে।
এই অবস্থা থেকে যদি দেশকে উদ্ধার করতে হয় তাহলে, এই পরিস্থিতি উদ্ভবের জন্য যে নীতি-ব্যবস্থা দায়ী তা পরিবর্তন করতে হবে। এই ব্যবস্থার অব্যাহত অনুসরণ কিম্বা তার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উন্নতি সাধনের চেষ্টার দ্বারা সে কাজ হবে না। দেশ ও দেশের রাজনীতিকে তার বিদ্যমান রুগ্নতা থেকে উদ্ধার করতে হলে যে ‘নীতি-ব্যবস্থা’ অবক্ষয়-অধোগতির উত্স তা পরিবর্তন করে তার জায়গায় ‘বিকল্প নীতি-ব্যবস্থা’ প্রবর্তন ও অনুসরণ করতে হবে। এটি একটি র্যাডিক্যাল কাজ। বিকল্প গড়ার গোটা বিষয়টি তাই সামগ্রিকভাবে ‘ব্যবস্থা’ বদলে ফেলার একটি র্যাডিক্যাল কর্তব্যকে নির্দেশ করে।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব যেমন অলীক, অলীক যেমন কিনা সোনার পাথরবাটি—ঠিক তেমনি ‘সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর লুটেরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা’ এরূপ বহাল রেখে দেশ ও দেশের আপামর জনগণের জীবনে মৌলিক ধরনের অগ্রগতি সাধন ও প্রগতির ধারায় দেশের অগ্রযাত্রা আশা করাটিও হবে অলীক স্বপ্নবিলাস মাত্র। আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে গত আড়াই দশকে কয়েকবার ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। মাঝে দু’বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারও রাজত্ব করেছে। পঁচাত্তরের পর জিয়া ও এরশাদের সামরিক সরকারও ক্ষমতায় থেকেছে। কিন্তু আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মূল নীতি ও দর্শন কখনই পরিবর্তিত হয়নি। গদি বদলের মধ্য দিয়ে ‘আপদ’ দূর হয়েছে, তো এসে হাজির হয়েছে ‘বিপদ’। ‘বিপদ’ বিদায় হয়ে এসেছে ‘আপদ’। দেশ ও জনগণ ‘ফুটন্ত কড়াই’ থেকে ‘জ্বলন্ত উনুনে’ কিংবা ‘জ্বলন্ত উনুন’ থেকে ‘ফুটন্ত কড়াইয়ে’ নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এই চক্র থেকে দেশকে বের করে আনার কর্তব্যই ‘বিকল্প’ গড়ার সংগ্রামের প্রকৃত লক্ষ্য বলে গণ্য হতে পারে।
বহু যুগ ধরে দেশ পরিচালিত হচ্ছে লুটেরা পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ নির্ভরতার ‘মন্দ পথে’। এ ধারায় চলতে থাকলে ‘মন্দের ভালো’ খুঁজে বেড়ানো ছাড়া জনগণের আর বেশি কিছু পাওয়ার থাকবে না। সত্যিকার ‘ভালো’ পরিস্থিতিতে উত্তরণ করতে হলে পুঁজিবাদের ‘মন্দ পথ’ পরিত্যাগ করে দেশকে তার গণ্ডির বাইরে নিয়ে আসতে হবে। বামপন্থা তথা সমাজতন্ত্র অভিমুখীনতার পথ গ্রহণই প্রকৃত বিকল্পের ধারায় দেশের উত্তরণ নিশ্চিত করতে পারে। সেজন্য অন্য কোনো পথ আজ খোলা নেই।
কিছু বিষয়ে পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও (এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সে পার্থক্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও), রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বিকল্প ধারা, গণফোরাম এবং এমনকি জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি দলগুলোর স্পষ্ট অবস্থান হলো প্রচলিত আর্থ-সামাজিক ‘নীতি-ব্যবস্থাকে’ টিকিয়ে রেখে দেশ পরিচালনার স্বপক্ষে। সুশীল সমাজ বলে দাবিদারদের মধ্যে অধিকাংশের অবস্থানও অনুরূপ। সেই অর্থে এসব দল ও শক্তিকে ‘সমমনা’ বলে চিহ্নিত করাটি অশুদ্ধ নয়।
কিছু বিষয়ে পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও (এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সে পার্থক্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও), রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বিকল্প ধারা, গণফোরাম এবং এমনকি জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি দলগুলোর স্পষ্ট অবস্থান হলো প্রচলিত আর্থ-সামাজিক ‘নীতি-ব্যবস্থাকে’ টিকিয়ে রেখে দেশ পরিচালনার স্বপক্ষে। সুশীল সমাজ বলে দাবিদারদের মধ্যে অধিকাংশের অবস্থানও অনুরূপ। সেই অর্থে এসব দল ও শক্তিকে ‘সমমনা’ বলে চিহ্নিত করাটি অশুদ্ধ নয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এসব দল যদি ‘সমমনা’ হয় তাহলে তাদের মধ্যে সুতীব্র দ্বন্দ্ব-সংঘাত সতত বিরাজমান কেন? এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত এতোটাই তীব্র যে তা দেশকে নৈরাজ্যের অন্ধকারে নিক্ষেপ করে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। ‘সমমনা’ হলেও এসব দল ও শক্তি এরূপ পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়ার কারণ হলো—যে ‘নীতি-ব্যবস্থাকে’ তারা সকলেই অনুসরণ করে থাকে, ‘নৈরাজ্য’ হলো তার অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য। এই ব্যবস্থার ভিত্তি হলো লুটপাট। লুটেরাদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে অনিবার্য দ্বন্দ্ব-সংঘাত হলো এই চরম নৈরাজ্যমূলক হানাহানির বৈষয়িক উত্স।
প্রকৃত ‘বিকল্পের’ থাকতে হবে তিনটি অত্যাবশ্যক উপাদান। এক. বিকল্প শ্রেণিগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাত্ সমাজ ও রাজনীতিতে মেহনতি মানুষের আধিপত্য বা নেতৃত্বমূলক ভূমিকা নিশ্চিত করা। দুই. বিকল্প কর্মসূচি হাজির করা। অর্থাত্ দেশ বর্তমানে যে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা বিষয়ক, শিল্প বিষয়ক ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে পথ ধরে চলছে তা থেকে স্বতন্ত্র প্রগতিশীল চরিত্রের বিকল্প কর্মসূচিকে জনগণের মাঝে জনপ্রিয় করে তোলা। তিন. জনগণের সক্রিয় সমর্থনের ভিত্তিতে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে এই বিকল্প কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য উপযোগী বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি-সমাবেশ গড়ে তোলা। সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ বিকল্প প্রতিষ্ঠার এই কাজে সমবেত হবে। তবে, নিজ নিজ শ্রেণিগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই, তাদের ভূমিকার ক্ষেত্রেও থাকবে নানা তারতম্য। তাদের মধ্যে যেমন থাকবে দৃঢ়-একাগ্র শক্তি, তেমনি থাকবে নানা মাত্রার দোদুল্যমান শক্তিও। তবে সাফল্য লাভ করতে হলে সম্ভাব্য সব শক্তিকে একটি র্যাডিক্যাল জাতীয় ঐক্যের ধারায় সমবেত ও ঐক্যবদ্ধ করাটা জরুরি। একইভাবে জরুরি হলো গোটা শক্তি সমাবেশের মধ্যে একটি কেন্দ্রিক একনিষ্ঠ চালিকাশক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত করা। আমাদের দেশের বিদ্যমান বাস্তবতা আজ এমনই যে, রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে এই উদ্যোগী চালিকাশক্তির ভূমিকাটি দেশের কমিউনিস্ট ও বাম-প্রগতিশীলদের গ্রহণ করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। আর সেই সাথে, সামাজিক শ্রেণি হিসেবে এই ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুরসহ শহর ও গ্রামের মেহনতি মানুষ, র্যাডিক্যাল বুদ্ধিজীবী প্রভৃতিদের।
চলতি ‘ব্যবস্থার’ কাছে গা ভাসিয়ে দিয়ে, কিম্বা এই ‘ব্যবস্থার’ সুবিধাভোগী ও প্রমোটার তথাকথিত ‘বড় দল’ দু’টির কোনো একটির কাঁধে ভর দিয়ে চলার বা তার সাথে মৈত্রী করার পথ গ্রহণ দ্বারা, বিকল্প গড়ার পথে এগিয়ে যাওয়া যাবে না। এ ধরনের কৌশল গ্রহণ করাটি বর্তমান ‘ব্যবস্থাকে’ আরো দীর্ঘস্থায়ী করবে এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা (status quo) বজায় রাখার কাজে শাসক-শোষক শ্রেণিকে সহায়তা করবে মাত্র। তথাকথিত মূলধারার বুর্জোয়া দল দুটির কোনো একটির সাথে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে তাদের অনুসৃত ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করা যাবে না। বরং যারা যুক্ত হবে তারাই উল্টো কথিত বড় দলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়বে। সাম্প্রতিক সময়কালে এটিই সকলের অভিজ্ঞতা।
শাসকগোষ্ঠী গুরুতর সংকটের সম্মুখীন হলে তা থেকে পরিত্রাণের জন্য ‘সিভিল সোসাইটির’ শাসন, বিগত তত্ত্বাবধায়ক মার্কা সেনাসমর্থিত নির্দলীয় সরকারের শাসন, জাতীয় সমঝোতার সরকারের শাসন, এমনকি সরাসরি সামরিক শাসন প্রভৃতি বিভিন্ন রূপের ‘দক্ষিণপন্থি বিকল্পের’ নানা ফর্মূলা নিয়ে হাজির হয়ে থাকে। ‘ওয়ান ইলেভেনের পরিকল্পনাকারীরা এখনো সক্রিয়। সেই এজেন্ডা এখনো তারা বহাল রেখেছে’,—এই হুঁশিয়ারি এসেছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী উভয়ের কাছ থেকে। এরূপ কিছু ঘটানো হলে তাতে দেশের সমস্যা-সংকট দূর হবে না, বরং নতুন সংকট জন্ম নিবে। বারবার আমরা সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা পেয়েছি। কিন্তু ‘ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না, এটাই ইতিহাসের বড় শিক্ষা’। তাই তৃতীয় শক্তির নামে নানা ষড়যন্ত্রের খেলার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাছাড়া, দ্বিদলীয় মেরুকরণভিত্তিক শাসন কাঠামোর দেউলিয়াপনা ও ব্যর্থতার সুযোগে যদি সাম্প্রদায়িক জঙ্গি ফ্যাসিস্ট শক্তি অল্প সময়ের জন্যও ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয় তাহলে অবস্থা আরো ভয়াবহ হয়ে পড়বে।
এসব আশঙ্কা থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র পথ হলো দেশকে একটি ‘বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প ধারায়’ পরিচালনার ব্যবস্থা করা। সে কাজ সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজন একটি গণভিত্তি সম্পন্ন, দক্ষ, যোগ্য বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি সমাবেশ গড়ে তোলা। জন সমর্থনের দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে এই শক্তি-সমাবেশকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে হবে এবং সেই সরকারের নেতৃত্বে বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য এটিই একমাত্র পথ। পরিস্থিতি বর্তমানে এমন যে, দেশ বাঁচাতে হলে, এরূপ একটি ‘বিকল্পের’ কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন