কমিউনিস্টদের পার্টি কেমন হবে? কী রকম হবে এ পার্টির রূপরেখা?
কমরেড রতন সেন
বিপ্লবী কর্মতৎপরতার পার্টি
মনীষী কার্ল-মার্কস বলেছেন, দার্শনিকগণ নানাভাবে দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু কাজের কাজটি হলো দুনিয়াকে পাল্টে দেওয়া, বদলে দেওয়া। তাই কথা না বাড়িয়ে বলা যায় যে, সমাজের বিপ্লবী রূপান্তর সাধনের হাতিয়ার হলো কমিউনিস্ট পার্টি। তবে এ ব্যাপারে কিছু বক্তব্য উপস্থিত করা প্রয়োজন। কমিউনিস্ট ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের কাছে সংস্কার, আপস-সমঝোতা এসবের মূল্য কি নেই? এ জাতীয় কর্মতৎপরতাকে কি পার্টি আত্মনিয়োগ করে না, করবে না? রোজলুকসেমবুর্গ তার বই ‘সামাজিক সংস্কার না বিপ্লব’-এ লিখেছেন, “সোস্যাল ডেমোক্র্যাসির কাছে সামাজিক সংস্কারের জন্য, এমনকি প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যেও, মেহনতী জনতার অবস্থা উন্নত করার জন্য প্রতিদিনকার বাস্তব সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের জন্য সংগ্রাম সম্ভবত: একমাত্র উপায় যার সাহায্যে প্রলেতারিয়েতেরশ্রেণি-সংগ্রাম পরিচালনা করা যায় ও চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল ও মজুরি দাসত্বের উচ্ছেদ সাধন করা সম্ভাব হয়। সোস্যাল ডেমোক্র্যাসির দৃষ্টিকোণ থেকে (যাকে আমরা মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ বলতে পারি- লেখক) সামাজিক সংস্কার ও সামাজিক বিপ্লবের মধ্যে একটা অচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। সোস্যাল ডেমোক্র্যাসির কাছে সামাজিক সংস্কারের জন্য সংগ্রাম হচ্ছে পন্থা আর সমাজ বিপ্লব হচ্ছে লক্ষ্য।” সংস্কার বা অর্ন্তবর্তীকালীন পর্যায়ের পর্বগুলো অতিক্রম না করে জগতে কোনো বিপ্লবই, মেহনতীদের সামাজিক বিপ্লবসহ, সম্পন্ন হয়নি। বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ সম্পন্ন এ ঐতিহাসিক সত্যকে যা দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া থেকে কখনই বিযুক্ত নয়, অনুসরণ করে চলছে। তাই ‘বিপ্লবী কর্মতৎপরতার পার্টি’- এ কথার মধ্যে সে সত্যই অবস্থান করে যে, আমরা সংস্কারের জন্য যখন লড়াই করছি তখন বিপ্লবের লক্ষ্যেই করছি এবং করতে হবে।
‘আপস’ ও ‘সমাঝোতা’র প্রশ্নেও একটু বলা ভালো। ব্ল্যাঙ্কুইস্ট কমিউনার্ডদের মেনিফেস্টোতে লেখা হলো: আমরা কমিউনিস্ট, কেননা আমরা কোনো অন্তর্বর্তী স্টেশনে না থেমে কোনো আপস না করেই লক্ষ্য অর্জন করতে চাই। অন্যথায় বিজয়ের দিনই মাত্র স্থগিত থেকে যাবে এবং দাসত্বের কাল দীর্ঘায়িত হবে। এ প্রসঙ্গে এঙ্গেলস লিখলেন, জার্মান কমিউনিস্টরাই প্রকৃত কমিউনিস্ট, কেননা, ইতিহাসের বিকাশ পথে সৃষ্ট সকল আপস ও অন্তর্বর্তী ‘স্টেশন’কে কার্যকর করার মাধ্যমে যে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌছাতে হবে, তা তারা উপলব্ধি করে অনুসরণ করে চলেছেন।
প্রসঙ্গত: লেনিনের কোনো কোনো উক্তি উদ্ধৃত করা সঙ্গত হবে। তিনি লিখেছেন:“প্রতিটি শ্রমিক, যার ধর্মঘট সংগ্রামের অভিজ্ঞতা আছে, সে জানে যে নিকৃষ্ট শোষকের সঙ্গেও ‘আপস’ করতে হয়।” গণসংগ্রামের প্রকৃত অবস্থা এবং বিরাজমান শ্রেণিবৈরিতার ক্রমবিকশিত গভীরতা এসব থেকে শ্রমিকশ্রেণির উপলব্ধি হয়, কোনটা আপস বিষয়গত কারণে মেনে নিতে হয়, আবার কোনটাইবা বিশ্বাসঘাকতার কারণে মাথা নত করে মেনে নিতে হয়। লেনিন লিখেছেন:“রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমস্যাবলীর উদ্ভব ঘটে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরকে নিয়ে, বিভিন্ন শ্রেণির ও পার্টির জটিল ও কঠিন সম্পর্ককে কেন্দ্র করে।” বাস্তবসম্মত আপস চিহ্নিত করা এসব ক্ষেত্রে বেশ প্রজ্ঞাশীলতার কাজ। এখানেই রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন যোগ্যতার পরিচয় রাখতে হবে।
একই সঙ্গে আসছে অন্যান্য দলের সঙ্গে আপস- সমঝোতা-ম্যানুভারের প্রশ্নটি। জার্মান ‘বামেরা’ এটা জোরের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে দেন। জবাবে লেনিন লিখলেন: তাহলে বলশেভিজমকেও প্রত্যাখ্যান করতে হবে। কেননা, বলশেভিজমের সমগ্র ইতিহাসের অক্টোবর বিপ্লবের আগে এবং পরে, অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে যখন কৌশল ও আপস করে চলতে হয়েছে। বিপ্লবী আন্দোলনের স্বার্থের দোদুল্যমান কিংবা সাময়িক হলেও সম্ভাব্য মিত্রদের সঙ্গে সমঝোতা করে না চলা, এমনকি শত্রু মহলের মধ্যকার স্বার্থের দ্বন্দ্বকে (ক্ষণিকের জন্য হলেও) কাজে না লাগানো একেবারেই মুর্খামি। যারা এ সবকিছু বুঝতে পারেন না, তারা মার্কসবাদের সামান্যটুকুও বোঝেন না। বিশেষ সময়কাল ধরে বিশেষ বিশেষ বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যারা কার্যক্ষেত্রে উত্থিত প্রায়োগিক সত্যকে কাজে লাগান না, তারা বিপ্লবী শ্রেণিকে তারশ্রেণি-সংগ্রামে সাহায্য করার লক্ষ্যে কিছুই শেখেনি।
যা হোক, এখন আমরা প্রারম্ভিক কথাতে ফিরে গিয়ে বলি- পার্টিতে শুধু তারাই সদস্য হিসাবে থাকতে পারেন যাদেরকে আমরা সক্রিয় সদস্য বলেই আখ্যা দিতে পারি। সাম্যবাদীদের জীবনে ‘শ্রম’ একটি আবশ্যিক উপাদান, তাই সাম্যবাদী পার্টির সদস্যদের জীবনধারা আর বিপ্লবের স্বার্থে কাজ করাটা হলো এক ও অভিন্ন বিষয়। বুর্জোয়া ও পেটি-বুর্জোয়া পার্টিসমূহে অর্থের জোরে পার্টিতে উচ্চপদ দখল ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করা সম্ভব। কেননা বুর্জোয়া সমাজে এবং দর্শনে ‘অর্থ’ এক ‘প্রচ- সামাজিক শক্তি”। বস্তুগত কারণেই কমিউনিস্টদের পার্টিতে এর কোন স্থান নেই। অন্যদিকে,মার্কসবাদ-লেনিনবাদে বিশ্বাস করা, দেশের কমিউনিস্ট পার্টির নীতি ও কর্মসূচিতে আস্থা জ্ঞাপন করাটাই পার্টির সদস্য হওয়া বা থাকার পক্ষে মোটেই যথেষ্ট নয়। সমাজ বিপ্লবের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে প্রতিদিনকার কাজে আত্মনিয়োগ করা একজন কমিউনিস্টের জন্য আবশ্যিক।
লেনিন বলেছেন, “পেশাদার বিপ্লবীদের” কথা। আক্ষরিক অর্থে এধরনের বিপ্লবী হওয়া সকলের পক্ষে, বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে, সম্ভব হবে না। তেমন কোনো পরিকল্পনা করাও হবে ভ্রান্তিজনক। তবে, পার্টির সম্ভাব্য সকল স্তরে একদল পেশাদার বিপ্লবীর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য হবেন তারা যারা কল-কারখানাতে, ক্ষেতে-খামারে, অফিস-আদালতে কর্মরত এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত। এদেরকে বলা হয় ‘আংশিক সময়ের কর্মী’ বা ‘পার্ট-টাইমার’। আংশিক সময়ের কর্মী হলেও এরা হলেন পার্টির ‘গণসমাহার’ বা মাস ফোঁর্স;অনেকদিক থেকেই এরা হলেন পার্টির নির্ধারক শক্তি। পেশাদার বিপ্লবীরা পার্টির অভ্যন্তরে কোনো ‘অভিজাত গোষ্ঠী’ নয়। অন্যদিকে, আংশিক কর্মীদের ক্ষেত্রেও বিপ্লবী মতাদর্শ, ত্যাগ-তিতিক্ষা, পার্টির প্রতি আনুগত্য এবং বিপ্লবীশৃঙ্খলা মেনে চলা প্রভৃতি লেনিনবাদী নীতিমালার প্রতি বিশ্বস্ততার ক্ষেত্রে কোনো আংশিক-তত্ত্ব নেই। কমিউনিস্ট পার্টি হলো সমাজ ও বিপ্লব সচেতন সক্রিয় ও অগ্রগামী যোদ্ধাদের পার্টি। আংশিক সময়ের কর্মী হলেও সকল কমিউনিস্টেরএ আত্মোপলবিদ্ধ থাকতে হবে যে তিনি বিপ্লবের জন্য উৎসর্গীকৃত; বিপ্লবের প্রয়োজন পার্টির আহ্বানে যেকোনো সময় নিজেকে বিলিয়ে দেবার মানসিকতা তার থাকতে হবে।
পার্টির শ্রমিকশ্রেণির অগ্রবাহিনী
‘কমিউনিস্ট পার্টি হলো শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী নেতৃত্ব এবং এ অর্থেই পার্টি হলো শ্রমিকশ্রেণির ভ্যানগার্ড বা অগ্রবাহিনী। ট্রেড ইউনিয়ন এবং এ ধরনের অন্যান্য সামাজিক সংগঠন প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যেই জীবিকা অর্জনের অধিকতর সুযোগ-সুবিধার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। কিন্তু শ্রমিক ও শ্রমজীবীদের মুক্তি এভাবে অর্জন করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য ও শোষণের গোটা শৃঙ্খলকে ছিন্ন করা।
এজন্য শ্রমিকশ্রেণিকে অন্য সকল শ্রেণি ও স্তরের মেহনতী মানুষদের সংগ্রামে এগিয়ে যেতে হবে এবং পরিণতিতে নেতৃত্ব দিতে হবে। বলা বাহুল্য এ কাজে প্রয়োজন রাজনৈতিক ও আদর্শগত দিক থেকেশিক্ষিত সুসংবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল এক বাহিনীর। এই হলো অগ্রবাহিনী; কমিউনিস্ট পার্টি হলো এরকম একটি অগ্রবাহিনী। ১৯০২ সালে পার্টি গঠনের লড়াইয়ের সময়ে লেনিন বলেন: আমাদের একালে যে পার্টি প্রকৃতই জাতি-জোড়া রাজনৈতিক মুখোশ খোলা অভিযান সংগঠিত করতে সক্ষম হবে, সে পার্টিই মাত্র বিপ্লবী শক্তিসমূহের অগ্রবাহিনী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। নিজেদেরকে অগ্রবাহিনী বলে আখ্যায়িত করা তখনই যথার্থ হবে যখন আমরা আমাদের কাজের মাধ্যমে অপরাপর অ-শ্রমিক বাহিনীগুলোকে নিয়ে গ্রহণ করতে পারব যে আমরা সত্য সত্যই অগ্রবাহিনী হিসাবে কাজ করে চলেছি।
সামাজিক গঠনের সংজ্ঞাতে কমিউনিস্ট পার্টি মূখ্যত:হলো শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী প্রতিনিধিত্বকারী দল। কিন্তু রাজনৈতিক-সামাজিক প্রক্রিয়া বিকাশের দিকে নজর ফেরালে বলতে হয় যে, কমিউনিস্টরা অন্যান্য সামাজিক শ্রেণিস্তর গ্রুপের কাছে তাদের দুয়ার বন্ধ করে রাখেনা। পক্ষান্তরে, এদের সবচাইতে রাজনীতিসচেতন অংশকে পার্টির দিকে আকৃষ্ট করতে, পার্টিতে অন্তর্ভুক্ত করতে সর্বদা সচেষ্ট থাকে। পশ্চাৎপদ দেশের জন্য এটা বিশেষভাবেই সত্য। অবশ্য সর্বদাই প্রধানত: শ্রমিকশ্রেণির সচেতন কর্মীদের টেনে এনে পার্টি র্যাঙ্কস্্ বৃদ্ধিতে কমিউনিস্টদের তৎপর থাকতে হবে। এশিয়া ও আফ্রিকার প্রায় প্রতিটি দেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে কৃষক ও শহুরে মধ্যবিত্ত স্তরের কর্মীরাই হলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ দুই অঞ্চলের জনসমাজের সামাজিক গঠন-প্রকৃতির সঙ্গে এটা হলো সঙ্গতিসম্পন্ন বা লজিক্যাল। তাই ইচ্ছে করলেই শ্রমিকশ্রেণির খাস কর্মী প্রচুর সংখ্যাতে রাতারাতি গড়ে উঠবে না। অন্যপক্ষে, জীবনের তাগিদই শ্রমিকশ্রেনীকে আর্থ-সামাজিক এবং প্রক্রিয়াগত সূচনার মাধ্যমে, রাজনৈতিক সংগ্রামে বার বার টেনে টেনে আনবে। বিদ্যমান পার্টির নেতৃস্থানীয় কর্মীদের কর্তব্য হবে শ্রমিকশ্রেণির শ্রেষ্ঠ সন্তান-সন্ততিদেরকে পার্টিতে শামিল করার জন্য সচেতনভাবে প্রয়াসী হওয়া এবং থাকা।
জগৎ জুড়ে, তৃতীয় বিশ্বে এবং বাংলাদেশেও গণ-রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ (মাঝে-মধ্যে কোথাও কোথাও ভাটার টান সত্ত্বেও) বৃদ্ধি পাচ্ছে, ব্যাপ্তিতে এবং চরিত্রগত দিক থেকেও। কী প্রয়োজন? সামাজিক প্রক্রিয়ার সারবস্তুও গতিময়তা বুঝতে সক্ষমসুসংগঠিত, আদর্শগতভাবে সুসজ্জিত এবং পরীক্ষিত শক্তির; সে শক্তিও এমন হবে- যে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে, সংগ্রামের পথ দেখতে ও বাছাই করতে সক্ষম, যে এ সবকিছুকে একটা নির্দিষ্ট কর্মসূচিতে রূপদানে সক্ষম, যে এই প্রোগ্রামের ভিত্তিতে ব্যাপক জনগণকে উদ্দীপ্ত করতে এবং তাদেরকে সামাজিক প্রগতির ব্যানারের নিচে সমাবেশ করতে সক্ষম। লেনিন বলেছেন:“সামাজিক আন্দোলনের স্রোতগুলো যতই বিস্তৃত হতে থাকে, ততই প্রয়োজন করে এমন একটি শক্তিশালী সোস্যাল ডেমোক্রাটিক সংগঠনের, যেটি এসব স্রোতের নতুন নতুন উৎসমুখ খুলে দিতে পারে।” বাংলাদেশের কমিউনিস্ট ও মার্কসবাদী-লেনিনবাদীদের জন্য লেনিনের এ বক্তব্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
সামাজিক আন্দোলনের স্রোতসমূহের নতুন নতুন উৎসমুখ খুলে দেবার জন্য একটি যোগ্য সোস্যাল ডেমোক্র্যটিক পার্টি অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছিলেন লেনিন। সারসংক্ষেপে একেই আবার তিনি বলেছেন যে আমাদের প্রয়োজন একটি বিপ্লবীদের সংগঠন, তাহলেই আমরা রাশিয়াকে পাল্টে দেব। তত্ত্বও প্রয়োগের নিবিড় সম্পর্কযুক্ত অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে লেনিন সাফল্যের সঙ্গেই গড়ে তুলেছিলেন বিপ্লবীদের পার্টি বলশেভিক পার্টি, যার নেতৃত্বে মহান অক্টোবর বিপ্লব অবশ্যই সামগ্রিকভাবে পশ্চাৎপদ ওই বিশাল দেশটিকে পাল্টে দিয়েছে।
বিপ্লবী তত্ত্ব ও ভাবাদর্শে পরিচালিত পার্টি
যোগ্য ও শক্তিশালী পার্টি বলতে আমরা কি বুঝব? শুধু কর্মতৎপরতার, এমনকি বিপ্লবী কর্মতৎপরতার (যদি তাকে বিপ্লবী বলে আদৌ আখ্যায়িত করা যায়) পার্টিকেই যোগ্যও শক্তিশালী বলা চলে না। একই সঙ্গে নিছক সংখ্যাবৃদ্ধি দিয়েও পার্টিকে শক্তিশালী বলে গণ্য করা চলে না। লেনিন যখন বলেন যে বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া কখনোই কোনো বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে না, তখন তিনি কমিউনিস্ট তথা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মতাদর্শের গুরুত্বের কথাই তুলে ধরেন। সমাজকে বদলাতে হলে বিদ্যমান সমাজের মতাদর্শগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা জরুরী এবং তা করার জন্য বিকল্প অগ্রসরমান মার্কসবাদী মতাদর্শে সুশিক্ষিত পার্টিরই প্রয়োজন। এ রকম পার্টিইমাত্র শ্রমজীবীদের এবং সমাজবিপ্লবের ভ্যানগার্ডের কর্তব্য পালন করতে সক্ষম। এক্ষেত্রে আমরা স্মরণে রাখি লেনিনের বক্তব্য: “সবচাইতে প্রাগ্রসর তত্ত্বে পরিচালিত একটি পার্টিই মাত্র অগ্রগামী যোদ্ধাদের ভূমিকা পালন করতে পারে।”
মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির সামগ্রিকতার জন্য কী কী প্রয়োজন? লেনিন বলেছেন: (ক) পার্টির একটি প্রোগাম; (খ) তার ট্যাকটিক্স এবং (গ) বিদ্যমান পর্বে প্রাধান্য বিস্তারী আদর্শগত ও রাজনৈতিক ধারার সঠিক মূল্যায়ন ও উপলদ্ধি। তিনি আরো বলেন যে প্রচলিত ও ‘সক্রিয়’ ভাবাদর্শ ও রাজনৈতিক ধারাগুলোর যদি সঠিক মোকাবেলার ব্যবস্থা না হয় তাহলে কর্মসূচি (রণনীতি) ও রণকৌশল মৃত সিদ্ধান্তে (ঈষধঁংবং) অধঃপতিত হয়ে যেতে পারে। কিন্তু পার্টি নিজেই যদি অগ্রসর মান আদর্শে দীক্ষিত হয়ে না ওঠে তাহলে সব সংগ্রামই প-শ্রমে পরিণত হতে পারে। কমিউনিস্ট পার্টি আকাশ থেকে পড়ে না; আর জন্মেই কেউ কমিউনিস্ট হয় না। হাজার বছর ধরে চলে আসা শ্রেণি ও শোষণভিত্তিক সমাজের বিজাতীয় মতাদর্শগুলোর আবর্জনা মিশ্রিত “আঁতুড় ঘরেই” তো কমিউনিস্টদের জন্ম। একদিনের জন্যও (লাল কার্ড পেলেও) এটা ভুলে যাওয়া চলে না। এক বছরে, এক মাসে, এমনকি একদিনের মধ্যেই মেহনতীরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারে। কয়েক মাসের মধ্যেই সমাজতন্ত্র নির্মাণকাজ শুরু হয়ে যেতে পারে। কয়েক দশকের মধ্যেই সমাজতন্ত্রের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভিত মোটামুটিভাবে তৈরি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ‘অদৃশ্য শত্রু’ অর্থাৎ বিজাতীয় ভাবদর্শ শত বছরেও নিঃশেষিত হয়ে যায় না। অধিকুন্তু একটি সমাজতান্ত্রিক দেশে যদি সমাজতন্ত্র বিনির্মাণে এবং কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা ও কর্মকা-ের পরিচালনাতে, বিচ্যুতি, বিকৃতি ঘটতে থাকে। তবে তো কথাই নেই। উগ্র জাতীয়তাবাদ ও স্বাদেশিকতায়, সংকীর্ণ স্বার্থবোধে সমাজতান্ত্রিক ও আন্তর্জাতিকতাবাদ ও মানবিকতাবাদ, এমনকি সাধারণ কা-জ্ঞান ও যুক্তিগ্রাহ্য মনোভাব (যা একদিন বিপ্লবী বুর্জোয়ারাই প্রচলন করেছিল) এসব পর্যন্ত আঘাত খেতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বাল্টিক প্রজাতন্ত্রগুলো, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, জর্জিয়া প্রভৃতি ক্ষেত্রে এসবের কোনো-না-কোনো দিকের প্রকট প্রকাশ ঘটেছে।
বহুবিধ আর্থ-সামাজিক কাঠামো বিশিষ্ট পশ্চাৎপদ এই বাংলাদেশ বৈচিত্রপূর্ণ ভাবাদর্শের শাখা-প্রশাখাতে ভরা। এরই মাঝে আমরা লড়াই করেছি কমিউনিস্টদের পার্টি গঠনে। বলতে গেলে, আমাদের পার্টিগঠন-প্রক্রিয়ার প্রাথমিক পর্যায়ও অতিক্রম করে উঠতে পারেনি- যদিও এ পার্টিকে এক জটিল ও অসংখ্য বিরোধপূর্ণ বাস্তবতার মধ্যে কাজ করে যেতে হচ্ছে এবং হবে (আন্তর্জাতিক অবস্থার কথা উল্লিখিত হলো না)। সুতরাং মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্ব ও মতাদর্শকে জানা-বোঝা-রপ্ত করার কর্তব্যে শৈথিল্য প্রদর্শনের কোন অবকাশ নেই। তবে, মনে রাখা উচিত যে মুখে নয়, বাস্তব কাজের পরীক্ষার মাধ্যমেই আদর্শের লড়াই চলে এবং একজন কমিউনিস্টের আদর্শের মান ও পরিচয় মেলে।
গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা পার্টির মৌলিকত্ব
পার্টি সংগঠনের অন্যতম মৌল নীতি হলো গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা। যে প্রথার মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টি সকল সদস্যের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারিত হয়ে থাকে, যে-ধারার মাধ্যমে পার্টি তার সকল কার্যকলাপ পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত করে থাকে, এক কথায় তাকেই আমরা গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা বলতে পারি।
গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা শব্দটি থেকেই বোঝা যায় যে দুটি পদ্ধতির একত্র সমন্বয় হলো গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা। উভয় বৈশিষ্ট্যের রয়েছে অপরিসীম গুরুত্ব। পার্টির দ্বান্দ্বিক বিকাশে উভয় বৈশিষ্ট্যকে সমভাবে ক্রীয়াশীল রাখা অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই যে কার্যক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্যের কোনো না কোনোটি পার্টির কার্যকলাপে কোনো-না-কোনো সময় প্রাধান্য বিস্তার করে ফেলে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর প্রায় প্রতিটি দেশেই চলেছে ‘গ্লাসনস্ত’ বা গণতন্ত্রায়ন। খোলামেলা মত প্রকাশ ও বিনিময় এবং তার মধ্য দিয়ে সমন্বয় সাধন, অবশ্যই জোড়াতালি নয়, এভাবেই সত্যকে জানা, বোঝা এবং প্রকৃত সত্যে উপনীত হওয়ার কার্যপদ্ধতি অনুসৃত হচ্ছে।
‘প্লুরালিজম’ শব্দটি অর্থাৎ ‘বহুত্ব’ অতীতে মার্কসবাদীদের কাছে এরকম আতংকেরবিষয় হিসাবে গণ্য হয়ে এসেছে। variety is the spices of life, অর্থাৎ বৈচিত্রই জীবনের মশলা; পার্টি জীবনের বিকাশ ও সমৃদ্ধির জন্য, পার্টির দক্ষতা ও কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য,পার্টির ক্যাডারদের পার্টির কাজে সম্পৃক্ত করতে, ক্যাডারদের বাস্তব থেকে আহৃত জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধির উপর পার্টিকে দাঁড় করাতে এবং পার্টিকে জনগণের অধিক থেকে অধিকতর নৈকট্যে নিয়ে যেতে পার্টির অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা আমাদের জন্য অতীব প্রয়োজন। কেন্দ্রিকতার অপপ্রয়োগে প্রকাশ পায় আমলাতান্ত্রিকতা, হুকুম বা নির্দেশ দিয়ে কাজ চালানো। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি যখন গঠন প্রক্রিয়ার প্রাথমিক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় অতিক্রম করছে তখন ‘কমান্ড-মেথড’; আমলাতান্ত্রিকতা ইত্যাকার লেনিনবাদবিরোধী ত্রুটিগুলো যাতে পার্টিতে শিকড় গেঁড়ে বসতে না পারে সেজন্য পার্টিকে, পার্টি নেতৃত্বকে বিশেষ করে, সচেতনভাবে সচেষ্ট থাকতে হবে।
সঙ্গেসঙ্গে এ বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে যে ‘বহু-বক্তব্যের’ প্রকাশের উৎস মুখ খুলে দেওয়া, অর্থাৎ পার্টির অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং গণতান্ত্রিক ধারার প্রবর্তন করার অর্থ হবে- পার্টিতে কর্মীদের ঐক্য, নেতা ও কর্মীদের কমরেডসুলভ মৈত্রী ও ঐক্য গড়ে তোলা; এভাবে পার্টির অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠা পাবে লেনিনবাদী পার্টিজীবন। ‘গণতন্ত্রের জন্য গণতন্ত্র’ কিংবা ‘নিয়ম রক্ষার’ বিষয় এটা নয়। পার্টি ‘ডিবেটিং ক্লাবে’ পরিণত হতে পারে না। গণতন্ত্রের নামে ‘যার মতো সে’ নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলাও মেনে নেওয়া যাবে না। ব্যাখ্যা নিস্প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার যে পার্টির অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা স্বতঃস্ফূর্ততার কাছে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এটা অবশ্যই হবে পরিকল্পিত ও পরিচালিত এবং সেজন্যই প্রয়োজন কেন্দ্রিকতা। আমাদের মতো দেশের জটিল রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবেশের মধ্যে পার্টি গঠনের যে প্রক্রিয়া আমরা সংগঠিত করছি, তাতে পরিকল্পনাহীনতা ও পরিচালনহীনতার কোনো সুযোগ নেই। পরিকল্পনার অর্থ ছক কাটা নয়; পরিকল্পনার অর্থ মূলত: হলো স্বতঃস্ফূর্ততা এড়িয়ে চলা। পার্টি গঠনের প্রক্রিয়া হলো বিপ্লবী ও সৃজনশীল প্রক্রিয়া, যা গণকার্যকলাপের কাছ থেকে তার ‘খাদ্য’ জোগাড় করে থাকে।
বৈপ্লবিকশৃঙ্খলা পার্টির বুনিয়াদ
বৈপ্লবিকশৃঙ্খলাবোধ কমিউনিস্ট পার্টির অমূল্য সম্পদ। কমরেড লেনিন বলেছেন: “আমি মনে করি এটা এখন সর্বজন স্বীকৃত যে বলশেভিকগণ আড়াই বছর কেন আড়াই মাসও ক্ষমতা হাতে রাখতে পারতো না যদি না পার্টির ভেতরে থাকত কঠোর লৌহদৃঢ়শৃঙ্খলা।” আমাদের সকল প্রচেষ্টার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো সমাজ বিপ্লব গড়া ও সফল করা। পার্টি যদি হয় ঢিলেঢালা, সদস্যরা হন স্বকীয় খেয়ালখুশীর অধীন, ইউনিটগুলো হয় ‘স্বায়ত্বশাসিত’ তবে সে পার্টি তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব কখনোই পালন করতে সক্ষম হবে না। লক্ষ্যে-কর্মে-অনুশীলনে-শৃঙ্খলায় ঐক্য কমিউনিস্ট পার্টির আবশ্যিক সারবস্তু।
পার্টির গঠনতন্ত্রে গণতন্ত্রের বিধি অনুযায়ী সকল সদস্যের জন্যই কতগুলো অধিকার স্বীকৃত আছে। কিন্তু অধিকার ভোগের নৈতিকতা তখনই মিলবে যখন গঠনতন্ত্রে বর্ণিতপ্রতিটি কমিউনিস্টের জন্য নির্ধারিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে তিনি সচেষ্ট থাকেন। যৌথ চিন্তা, যৌথ আলোচনা ও যৌথ জ্ঞানের সমন্বিতরূপ হিসাবে প্রকাশ পায় পার্টির সিদ্ধান্ত। বিনা শর্তে এ সিদ্ধান্ত মানতে হয় সকলকে, নেতা ও কর্মীকে। পার্টিতেশৃঙ্খলাবিধি-বিধান নেতা ও কর্মী নির্বিশেষে সকলের জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য।
কমিউনিস্ট পার্টি তার সদস্যদের কাছ থেকে অন্ধ-আনুগত্য কামনা করে না, করতে পারে না। প্রতিটি কমরেডের স্বকীয় উদ্যোগ বিকশিত করে তোলাই পার্টি নেতৃত্বের কর্তব্য। প্রসঙ্গতই কমরেড লেনিনের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হলো। তিনি বলেছেন, “সর্বহারা পার্টির (অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির- লেখক)শৃঙ্খলা কীভাবে সুরক্ষিত হবে, কীভাবে পরীক্ষিত হবে, কীভাবে নবশক্তি লাভ করবে? লাভ করবে প্রথমত: প্রলেতারীয় ভ্যানগার্ডদেরশ্রেণি-সচেতনতা এবং বিপ্লবের প্রতি আসক্তি দিয়ে, তাদের দৃঢ় সকল্পতা, আত্মত্যাগ ও শৌর্য দিয়ে। দ্বিতীয়ত: ব্যাপক শ্রমজীবী জনগণের সাথে তাদের সংযোগ ও গভীর নৈকট্য বজায় রাখার দক্ষতা দিয়ে। তৃতীয়ত: তাদের রণনীতি ও কৌশলের সঠিকতা দিয়ে। এগুলো ছাড়া বিপ্লবী পার্টির অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা আনয়ন সম্ভব নয়। এসব প্রয়োজনাবলী কিন্তু অততাড়াতাড়ি গড়ে ওঠে না, সুদীর্ঘকালীন প্রচেষ্টা এবং কষ্টার্জিত অভিজ্ঞতার পথেই মাত্র তাদের প্রকাশ ঘটে থাকে।”
সমালোচনা-আত্ম-সমালোচনা পার্টির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য
সমালোচনা-আত্ম-সমালোচনা হলো কমিউনিস্ট পার্টির নিজস্ব সম্পদ, যা অন্যান্য পার্টি থেকে আমাদেরকে পৃথক বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট করে তোলে। বর্তমানে সমাজতান্ত্রিক ও অসমাজতান্ত্রিক প্রায় প্রতিটি দেশে সোভিয়েত ইউনিয়নেরপেরেস্ত্রোইকা ও গ্লাসনস্ত এরই সাক্ষ্য বহন করছে। এ পদ্ধতি দিয়েই পার্টি তার অভ্যন্তরে এবং কমিউনিস্ট আন্দোলন তার গতিপথের, আর সমাজবাদী দেশসমূহ তাদের সমাজবিনির্মাণের গলদ ও দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করে, বিদূরিত করে। কমিউনিস্টের শিক্ষা, উদ্যোগ, সৃজনশীলতা, আদর্শবাদিতাÑ সবকিছুকে ত্রুটিমুক্ত ও বিকশিত করে তোলার মুখ্য পদ্ধতি এটাই। এ হলো বিপ্লবী পার্টির ক্রমবিকাশের ও নবায়নের বিপ্লবী অস্ত্র।
সমালোচনা-আত্ম-সমালোচনালক্ষ্যবিহীন কোন পদ্ধতি নয়। প্রতিটি সদস্যকে আদর্শ কমিউনিস্ট হিসাবে গড়ে তোলা, কমিউনিস্টদের পার্টিকে তত্ত্ব ও প্রয়োগে অধিক থেকে অধিকতর কর্মক্ষম করে তোলা এর লক্ষ্য। আমাদের এমন এক পার্টি গড়ে তোল কর্তব্য যা লেনিনের এ উক্তি স্বরণে রাখবেÑ “প্রত্যেককে অবশ্যই নিজের মগজকে কাজে লাগাতে হবে এবং প্রতিটি সুনির্দিষ্ট ব্যাপারে নিজের দায়িত্ব খুঁজে বের করতে সক্ষম হতে হবে।
জনগণের সাথে পার্টির সম্পর্ক
জনগণই ইতিহাস সৃষ্টি করে থাকেন। সমাজের বৈষয়িক মূল্যগুলোই মাত্র যে তারা সৃষ্টি করেন তা নয়। এ মূল্যগুলো সমাজ-মানুষের কল্যাণে লাগাতে, সমাজকে ঢেলে সাজাতে জনগণের সংগ্রামই চূড়ান্ত ভূমিকা পালন করে থাকে। কমিউনিস্ট পার্টি জনগণের, বিশেষ করে শ্রমজীবী জনগণের শক্তি-সামর্থ ও সৃজনশীল ক্ষমতার উপর নির্ভর করেই তার সংগঠনকে গড়ে তোলে। শ্রমিকশ্রেণি ও সাধারণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ, অবিচ্ছেদ্য ও প্রাণবন্ত সংযোগ ব্যতিরেকে পার্টি তার নেতৃত্বের ভূমিকা অর্জন ও পালন কখনোই করতে পারে না।
বোধগম্য কারণেই কমিউনিস্ট পার্টি জনগণের, এমনকি তার শ্রেণির সংখ্যালঘুদের নিয়েই গঠিত হয়। কিন্তু লেনিন বলেছেন: “এ সংখ্যালঘুরা যদি প্রকৃতই শ্রেণিসচেতন হন, যদি জনগণকে নেতৃত্ব ও পরিচালিত করতে সক্ষম হন, সমসাময়িক সকল প্রশ্নের জবাব দিতে উপযোগী হন, তাহলেই এদেরকে সঠিক অর্থে একটি পার্টি বলে আখ্যায়িত করা যায়।”
শ্রমজীবী জনগণ তথা সমগ্র জাতির স্বার্থে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি প্রাত্যহিক সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের সমস্যাবলীর সম্ভাব্য সর্বোত্তম সমাধান পার্টিকে খুঁজে বের করতে হয়। একাজে সফলতার অন্যতম চাবিকাঠি হলো জনগণের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক। এ পার্টিকে তাই এমনভাবে কাজ করতে হয় যাতে জনগণ উপলদ্ধি করতে পারে যে এ পার্টি তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টিদানকারী এক উল্লেখযোগ্য শক্তি এবং এটা এমন এক শক্তি যা তাদের বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক পূর্ণ মুক্তির লড়াইতে নেতৃত্বদানে উপযোগী। অনেক কিছুর সাথে এ বিষয়টি মনে রাখা উচিত যে জনগণের কাছে পৌঁছাবার ব্যাপারে পার্টির ক্ষমতার উপর আমাদের নীতি ও কর্মসূচির সাফল্য অনেকাংশে নির্ভরশীল।
উপসংহার
যে বিপ্লব প্রয়োজনবোধে নিজেকে রূপান্তরিত করতে এবং নবায়ন করতে পারে না, পারে না সময়ের সঙ্গে‘তাল মিলিয়ে’ চলতে, সে বিপ্লব বিপদের মুখোমুখি হবেই। কমিউনিস্টপার্টি সম্পর্কে একই কথা বলা যায়। সমকালে কমিউনিস্টদের যেসব দায়িত্বপালন করতে হবে তার পরিধি বেড়েছে, চরিত্রও বদলেছে। বিশ্বজনীন মুক্তি, গণতন্ত্র ও প্রগতির প্রক্রিয়াতে নানা শ্রেণি ও স্তরের জনগণের ভূমিকা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ নিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। মনীষী কার্ল-মার্কস মন্তব্য করেছিলেন: “ঐতিহাসিক অ্যাকশনের নিখুঁতীভবনের সাথে সাথে জনগণের অংশগ্রহণেরব্যপকতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে”।লেনিন এই প্রতিপাদ্য বিষয়কে মার্কসবাদের অন্যতম তাৎপর্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসাবে গণ্য করেন। বর্তমানের বাস্তবতায় এটি অনেক বেশি সত্য। তাই পরিস্থিতি এমন এক কমিউনিস্ট পার্টি দাবি করছে যে পার্টি তার ভূমিকা ও ক্রিয়াকলাপে বর্ধিত মান-এর সাক্ষ্যরাখবে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ২৭তম কংগ্রেস থেকে বলা হয়েছে- “বিপ্লবী পার্টিগুলোর শক্তি এই সত্যে নিহিত যে তারা শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও আকাক্সক্ষাসমূহ দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে, তারা বুর্জোয়া সমাজ সৃষ্ট সংকট পরিস্থিতিতে থেকে মুক্তিলাভের পথনির্দেশ করে, তারা শোষণমূলক সমাজের প্রকৃত নির্দেশনা দেয়, এবং আশায় ভরা প্রস্তাবনায় একালের সকল মৌল প্রশ্নের উত্তর যোগায়। তারা তাদের দেশগুলোর জাতীয় স্বার্থের সত্যিকার প্রবক্তা এবং সবচাইতে সুদৃঢ় রক্ষক।”
কমিউনিস্ট পার্টি “নতুন ধরনের পার্টি”, “লেনিনিস্ট টাইপের পার্টি”- আমরা আমাদের পার্টিকে এ ধরনের একটি পার্টি হিসেবেই গড়ে তুলতে চাই। এ অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। একজন সমাজবিজ্ঞানীর লেখার কিছু অংশের উদ্ধৃতি দিয়ে এ প্রবন্ধ শেষ করছি, “ইতিহাস হাজার হাজার আদর্শগত ও রাজনৈতিক আন্দোলন ও দল সংগঠনের কথা জেনেছে। নিয়মানুযায়ী তার প্রতিটি কোন-না-কোনো যুগবাসময়-কাল ধরে থেকেছে। সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে কোনো-না-কোনো মতবাদ ও সংগঠন একে অন্যের স্থানে আত্মপ্রকাশ করেছে। মানবজাতির রেকর্ডে তাদের অল্প কয়েকটিই উল্লেখযোগ্য কিছু লক্ষন রেখে গেছে। তাছাড়া, তাদের কোনোটাই মৌলিক সামাজিক পরিবর্তন আনতে অবদান তেমন রাখতে পারেনি। এই সাধারণ বৈশিষ্টের একমাত্র ব্যতিক্রম হলো কমিউনিস্ট আন্দোলন ও কমিউনিস্ট সংগঠন।” সাফল্য এবং পাশাপাশি ব্যর্থতা সত্বেও, ইতিহাস থেকে সত্য মুছে যায়নি এবং যাবেও না।
(লেখাটি বিপ্লবীদের কথা থেকে নেওয়া)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন