টেকনাফ শহরে প্রবেশ করার মুখে নাফ নদীর অনিন্দ্য সৌন্দর্য চোখে পড়ার মতো। কিন্তু সেই মনোমুগ্ধকর নাফ নদীর ওপারে এখন আগুন জ্বলছে।
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে (এক সময় যেটি ছিল আরাকান রাজ্য) বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চলছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও রাষ্ট্রযন্ত্রের শিউরে ওঠার মতো বর্বর হামলা। রোহিঙ্গাদের ওপর গুলি চালানো হচ্ছে, তাদের ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। রোহিঙ্গারা প্রাণভয়ে নিজেদের বাড়িঘরসহ সর্বস্ব পরিত্যাগ করে যে যেভাবে ও যে পথে পারে বাংলাদেশে প্রবেশ করে চলেছে। রাইফেলের গুলিতে, পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে, সমুদ্র ও নদী পার হতে গিয়ে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারাচ্ছে অগণিত নারী-শিশুসহ অসহায় মানুষ। সীমান্তের এপারে এসে তারা আশ্রয়ের জন্য পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে। পথচলা আশ্রয়হীন রোহিঙ্গাদের ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, ভীত-বিহ্বল চেহারা দেখে কোনো মানুষেরই চোখে পানি না এসে পারে না। এই অসহায় শরণার্থীরা সংখ্যায় লাখ-লাখ। এ চিত্র যেন অনেকটাই কোটি বাঙালির ভারতে আশ্রয়প্রার্থী শরণার্থী-জীবনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। শরণার্থীদের আশ্রয়হীন অমানবিক অবস্থার কথা সবচেয়ে বেশি করে মনে থাকার কথা যে বাঙালিদের, তারাই আজ রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দাতা।
রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত হওয়ার ঘটনা আজই প্রথম ঘটছে না। আগেও অনেকবার, প্রায় একই কায়দায়, মিয়ানমার সরকার এমনতরো ঘটনা ঘটিয়েছে। রোহিঙ্গারা প্রাণভয়ে বারবার আশ্রয়ের জন্য সবচেয়ে কাছের সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সরকারের সাম্প্রতিক হামলা ‘জাতিগত নিধন’ (বঃযহরপ পষবধহংরহম) ও ‘গণহত্যার’ (মবহড়পরফব) পর্যায়ে পড়ে। ‘টেকস্ট বুকের’ দক্ষতায় আক্রমণ চালানো হয়েছে। এই বর্বর গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের ফল বাংলাদেশের ওপরে এসে আঘাত করেছে। সৃষ্টি হয়েছে এক নিদারুণ মানবিক বিপর্যয়। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ তার মানবিক দায়িত্ব পালন থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারে না। সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে ও এপার থেকে গুলি চলিয়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আগমন বন্ধের চেষ্টা সে করতে পারে না। কারণ সেটি হবে তার নিজস্ব মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত নৈতিকতার বরখেলাপ।
বাংলাদেশ সরকার শেষ পর্যন্ত মানবিক দায়িত্ব পালন থেকে নিজেকে ‘নিরাপদ দূরত্বে’ সরিয়ে রাখেনি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, এই মানবিক বিপর্যয়ের শুরুর কয়েক দিন সরকার এক্ষেত্রে দোনমনা করেছে। এমনকি রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করা শুরু করার কয়েক দিন পরেও সরকার ‘গর্বের’ সঙ্গে প্রচার করেছে যে, “আমরা এ পর্যন্ত ১০ হাজার রোহিঙ্গার ‘অনুপ্রবেশ’ প্রতিরোধ করে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে পেরেছি”। মানবিক কর্তব্য পালনে এহেন দোনমনা ও সিদ্ধান্তহীনতা কোনো যুক্তিতেই মেনে নেওয়া যায় না। এক্ষেত্রে শুরু থেকেই নীতিনিষ্ঠ অবস্থান নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়াই সরকারের উচিত ছিল। প্রতিটি রোহিঙ্গা শরণার্থীর নাম নিখুঁতভাবে নিবন্ধিত করে তাদের উপযুক্ত স্থানে আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য প্রথম মুহূর্ত থেকেই কাজ শুরু করা উচিত ছিল। এ কাজে সেনাবাহিনীসহ বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবকদের কাজে লাগানো উচিত ছিল। এদিকে, বিএনপি বিষয়টিকে ‘দলীয় রাজনৈতিক পুঁজি’ সঞ্চয়ের একটি উপাদান হিসেবে কাজে লাগানোর জন্য এমনভাবে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছিল যে, তার প্রভাবে সরকারও ‘পাছে না আবার বিএনপি সুবিধা নিয়ে নেয়’ এ কথা চিন্তা করে এ বিষয়ে নীতিবোধের ভিত্তিতে অবস্থান গ্রহণে দ্বিধান্বিত হয়েছিল।
দেশের ভেতরে ‘মূল ধারার’ বলে কথিত ‘বড়’ রাজনৈতিক দলগুলো রোহিঙ্গাদের ওপর নেমে আসা মানবিক বিপর্যয় সম্পর্কে কোনো নৈতিক অবস্থান যেমন নিতে পারেনি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তেমনই ঘটেছে। যেমন কিনা বাংলাদেশ প্রথম কয়েক দিনের দোনমনা কাটিয়ে উদারভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রবেশ করতে দেওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর জন্য বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করে বিবৃতি দিয়েছে। তার এই প্রশংসা যে নীতিবোধের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে নয় তার প্রমাণ হলো, বিদেশিদের আগমন ঠেকানোর জন্য মেক্সিকোর ‘বর্ডারে’ দেয়াল নির্মাণসহ ‘বহিরাগত’ উচ্ছেদ ও তাদের আগমন ঠেকানোর জন্য বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্টের গৃহীত সাম্প্রতিক নানা পদক্ষেপ।
এদিকে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের চোখের পানি ফেলা ও তার স্ত্রীর ঘটা করে রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিদর্শন করে গণহত্যার নিন্দা করাটি যে প্রবঞ্চনাপূর্ণ তার প্রমাণ হলো, এই ‘দরদি’ তুরস্ক কর্তৃক কুর্দিদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা ও শরণার্থীদের তুরস্কে প্রবেশে বাধা প্রদানের ঘটনা। এক্ষেত্রে তুরস্কের ভূমিকার নীতিবোধের ভিত্তিও প্রশ্নবিদ্ধ।
সৌদি আরবসহ ‘মুসলিম উম্মার’ দেশগুলোর দ্বিমুখী অবস্থানও বেশ লক্ষণীয়। মানবিক প্রশ্নে নৈতিক অবস্থান তারা গ্রহণ করেনি। প্রথমাবস্থায় তারা কেউ-কেউ একতরফাভাবে ‘জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত মিয়ানমার সরকারের’ সঙ্গে সংহতি জানিয়েছে। কিংবা বেশিরভাগই রোহিঙ্গা গণহত্যার অসংখ্য নিদর্শন প্রচারিত হওয়া সত্ত্বেও সে বিষয়ে নীরব থেকেছে। অবশেষে মুখ খুলতে বাধ্য হওয়ার পর তারা এখন এটিকে ‘মানবিক ইস্যু’ হিসেবে তুলে ধরার বদলে মুসলমানদের একটি ‘ধর্মীয় ইস্যু’ হিসেবে সামনে আনতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তিও ‘দেশ থেকে বৌদ্ধদের বিতাড়িত করে রোহিঙ্গাদের আনো’, ‘মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জিহাদি যুদ্ধ শুরু কর’ - ইত্যাদি আওয়াজ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। সাম্প্রদায়িক সংঘাতের পরিস্থিতি উসকে দেওয়ার জন্য তারা চেষ্টা করছে। সাম্প্রদায়িকতা হলো মিয়ানমার সরকারের গণহত্যার নীতির সমগোত্রীয় মতবাদ এবং তা হলো সমানভাবে অমানবিক। রোহিঙ্গা সমস্যা কোনো ‘ধর্ম সম্পৃক্ত’ সমস্যা নয়। এটি প্রধানত একটি জাতিগত সমস্যা, যার মূলে রয়েছে দেশি-বিদেশি বৃহৎ লুটেরাদের অর্থনৈতিক লুণ্ঠনের সুযোগকে কেন্দ্র করে জন্ম নেওয়া স্বার্থের বিষয়।
রোহিঙ্গা সমস্যা বর্তমানে একটি মানবিক বিপর্যয়ের সমস্যা হিসেবে অভিব্যক্ত হলেও এর সঙ্গে জড়িত আছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক নানা স্বার্থের ঘাত-প্রতিঘাতের বিষয়গুলো। এখানেও নৈতিক অবস্থানের উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বিশেষভাবে অবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা হলো ভারতের মোদি সরকারের অবস্থান। সরকারিভাবে প্রদত্ত বিবৃতির মাধ্যমে এবং নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সফরে গিয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকারের পদক্ষেপের সঙ্গে ভারতের একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যা ও প্রায় ৩-৪ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে টুঁ শব্দটি তারা করেনি। অথচ ভারত আমাদের ‘ঘনিষ্ঠতম’ বন্ধুদেশ হিসেবে পরিচিত। নীতিবোধের কোনো প্রমাণ এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই না। একই কথা প্রযোজ্য আরেক বন্ধু দেশ চীন সম্পর্কেও। তারা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও মিয়ানমার সরকার অসন্তুষ্ট হতে পারে সেই বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও অত্যাচার সম্পর্কে নিশ্চুপ রয়েছে। ভারত ও চীন - এই দুপক্ষের মধ্যে যে রেষারেষি রয়েছে, সে ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ‘স্ট্র্যাটেজিক’ গুরুত্ব হিসেবে নিয়ে উভয় দেশই তাকে খুশি রাখার জন্য গণহত্যার বিরোধিতা করার নৈতিক অবস্থানকে জলাঞ্জলি দিতে দ্বিধা করেনি।
ভারতের সরকার মানবিক সমস্যার প্রশ্নে নৈতিক অবস্থান পরিত্যাগ করলেও সেদেশের প্রগতিশীল শক্তি, বিশেষত সিপিআই, সিপিআই (এম) ইত্যাদি দল রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকারের সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা করেছে। তারা রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছে। তারা নৈতিক অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ায়নি।
আসলে বিশ্ববাসীর সাধারণ অবস্থান মানবিক বিবেচনাকে সাধারণভাবে ধারণ করে থাকে। সে কথা ভালোভাবে হিসাবে নিয়ে মিয়ানমার সরকার আগেভাগেই মিথ্যা প্রচারের আশ্রয় নিয়েছে। ২৫ আগস্ট ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা) কর্তৃক এক সঙ্গে ৩০টি পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ করার ঘটনাকে সামনে এনে, তার বিরুদ্ধে সেদেশের সেনাবাহিনী জঙ্গিবিরোধী পদক্ষেপ নিয়েছে বলে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক ‘প্রোপাগান্ডা’ চালিয়েছে। এভাবে তারা তাদের গণহত্যার বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার বা তার যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করেছে। সেক্ষেত্রে তারা কিছুটা সফলও হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও যদি শুরুতেই জোরের সঙ্গে গণহত্যা ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের করুণ ট্র্যাজেডির চিত্র তুলে ধরা হতো তা হলে এ কথা বিশ্ববাসী সহজেই বুঝতে পারত যে, মিয়ানমার সরকার যা করেছে তা মোটেও জঙ্গি দমনের উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে না। সব কিছুই করা হচ্ছে ‘জাতিগত নিধন’ চালিয়ে রাখাইন প্রদেশকে রোহিঙ্গামুক্ত করার জন্য। যদি জঙ্গি দমনের প্রশ্নও বিবেচনা করা হয়, তা হলেও জঙ্গি দমনের উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর ‘কালেকটিভ পানিশমেন্ট’ বা ঢালাও শাস্তি প্রয়োগ করা মানবিকতার লঙ্ঘন তো বটেই, তা আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়বিচারের ন্যূনতম নীতিমালারও পরিপন্থী।
রাখাইন প্রদেশে তেল-গ্যাসসহ বড় বড় অর্থনৈতিক প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য তোড়জোড় চলছে। সেখানে বড় বাণিজ্যিক এলাকা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য আছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সেখানে বিনিয়োগ করার উদ্দেশ্যে লালায়িত সে জন্য তারা সেখানকার বিস্তৃত এলাকাজুড়ে নিয়ন্ত্রণ চায়। এই বাণিজ্যিক স্বার্থে রাখাইন প্রদেশকে রোহিঙ্গামুক্ত করার জন্য রচিত সুপরিকল্পিত ব্লুপ্রিন্ট অনুসারেই মিয়ানমার সরকার ২৫ আগস্ট তার এই অপরাধমূলক বর্বর অভিযান চালিয়েছে বলে অনেক বিশ্লেষকের অভিমত। একটি বিশেষ লক্ষণীয় ঘটনা হলো, দীর্ঘদিনের এই রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথরেখা সুপারিশ করার জন্য জাতিসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন ২৪ আগস্ট তার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সে সুপারিশে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই ‘আনান কমিশনের’ রিপোর্ট বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার আগেই, রিপোর্ট প্রকাশের রাতেই ৩০টি ফাঁড়ির ওপর ‘আরসা’র সশস্ত্র বাহিনী আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণ যে ‘আনান কমিশনের’ সুপারিশ বানচাল করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল, এমন মনে করাটি খুবই স্বাভাবিক। এবং সেটি যে মিয়ানমার সরকারও করে থাকতে পারে তেমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
রোহিঙ্গা সমস্যাটি পুরনো। সেখানে কী ঘটছে তার খবরাখবর রাখার ক্ষেত্রে সরকার যথেষ্ট যত্নবান ছিল না। মিয়ানমার সরকার তার সুপরিকল্পিত প্রচারণামূলক ও কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমসহ অনেক দেশের সমর্থন আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের সরকার সেক্ষেত্রে দুর্বলতা দেখিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে দ্রুত প্রতিনিধি পাঠিয়ে তাদের কাছে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন সংগঠিত করা যেত। এমনকি ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশি মিশনগুলোর প্রতিনিধিদের ডেকে এনে ব্রিফিং করার কাজটি করতেও সে ১৫-১৬ দিন সময় পার করে দিয়েছে। সরকারি মহলের অনেকের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক সহযোগিতা প্রদানের নীতিবোধের চেয়ে নেত্রীর নোবেল প্রাইজ পাওয়ার প্রতি আগ্রহ বেশি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
রোহিঙ্গা সমস্যাকে কেন্দ্র করে বর্তমানে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যখন বাংলাদেশকে বিশ্বের অনেক শক্তির মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে সফলতার জন্য বাংলাদেশের জনগণকে এক চিন্তায় এক সঙ্গে দাঁড়ানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বাদ দিয়ে, দেশের সব রাজনৈতিক শক্তিকে নিয়ে এক সঙ্গে বসে এ বিষয়ে গোটা জাতির পক্ষ থেকে এক কণ্ঠে অবস্থান ঘোষণা করা দরকার। তেমন উদ্যোগ সরকার নিতে পারত।
রোহিঙ্গা সমস্যা এখন এমন এক মানবিক বিপর্যয়ের পরিস্থিতিতে পরিণত হয়েছে যা দেশের ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের জরুরি মনোযোগ দাবি করে। কিন্তু এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান ব্যতীত এই মানবিক বিপর্যয়ের পরিস্থিতি নিরসন সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে এই সমস্যার আশু মানবিক দিকটি ছাড়াও তার মূল পটভূমির দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এর বহুমাত্রিক উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক, ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার, বহুজাতিক পুঁজি ও আন্তর্জাতিক করপোরেট পুঁজির স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইত্যাদি আরও কিছু মৌলিক বিষয়।
সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য মিয়ানমারকে এ কথা মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে যে, রোহিঙ্গা সমস্যাটি একান্তভাবেই মিয়ানমারের নিজস্ব সমস্যা। সে সমস্যা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে ‘রপ্তানি’ করা মেনে নেওয়া যায় না। মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে এ কথা মেনে নিতে যে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক এবং মিয়ানমারেই তাদের নিরাপদ বসবাসের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদ অথবা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির যে কোনো রকম ষড়যন্ত্রের খেলা প্রতিরোধ করতে হবে। এই মূল অবস্থানের পক্ষে আন্তর্জাতিক সাম্প্রদায়কে সংগঠিত ও সোচ্চার করতে হবে। এ কাজে উদ্যোগী ও অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে, এই সমস্যার কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া দেশ, বাংলাদেশকে।
এ জন্য শত মতপার্থক্য সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক শক্তি বাদে (কারণ তারা এই সমস্যা জিইয়ে রাখার ক্ষেত্রে অন্যতম ইন্ধনদাতা) দেশের সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও জনশক্তিকে এক হয়ে দাঁড়াতে হবে। এজন্য উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। সরকার দৃঢ়তার সঙ্গে সেই পথে আগাতে সম্মত আছে কি?
লেখকঃ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
Post-editorial written by Mujahidul Islam Selim published in the 17th. September 2017 issue of Daily Amader Shomoy.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন