২০১৪ সাল, আমার জীবনে ভগৎ সিংয়ের আবির্ভাব। যে মানুষটির নামও তখন শুনি নি। শহীদ মিনার বসে আছি, সাথে এক বড় ভাই। তিনিই আলোচনার ফাঁকে ভগৎ সিংকে নিয়ে আলোচনা উঠালেন। আমি বিস্ময়াভিভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম- ভগৎ সিং কে? তুমি ভগৎ সিংয়ের নাম জানো না? না, জানি না তো! তিনিই শুনালেন ভগৎ সিংয়ের জীবন-দর্শন। বললেন, ‘বিপ্লবীদের কথা প্রকাশনা’ থেকে ‘ভগৎ সিংয়ের জবানবন্দি’ বই প্রকাশ হয়েছে, কিনতে পারো।
বইটি কিনে পড়া শুরু করলাম। নিজের অজ্ঞতাকে ধিক্কার দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ পেলাম না। যতই পড়ছি, ততই অবাক হচ্ছি। এই মানুষগুলো সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, কতটা অজ্ঞ- অথচ কতটা জ্ঞানী মনে করি নিজেকে! মাত্র ২৪ বছরের একজন মানুষ- ভগৎ সিং। ধর্ম, রাজনীতি, আস্তিক, নাস্তিক, বস্তুবাদকে কতটা বাস্তবিক দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করেছেন! বইটি দু’তিনবার পড়লাম। এছাড়াও ভগৎ সিংকে নিয়ে লিখিত আরো বেশ কয়েকটি বই পড়া শুরু করলাম। যেমন: ‘আমাদের ভগৎ’, স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা’, ভগৎ সিংয়ের জেল ডায়েরি ও কেন আমি নাস্তিক। ভগৎ সিংয়ের লেখা- ‘কেন আমি নাস্তিক’ বইটি পড়ে রীতিমতো অবাক হলাম। একজন মানুষ কতটা জ্ঞানী হলে- এত সুন্দর-সাবলীলভাবে নাস্তিক-আস্তিকের ব্যাখ্যা দিতে পারেন। আমাদের বর্তমান নাস্তিক সমাজ বইটি পড়ে ফেলতে পারেন। আস্তিক-নাস্তিকতার ব্যাখ্যা ১৯২৬ সালেই ভগৎ সিং দিয়ে গেছেন। আর এখন আমরা কতটা হীন জায়গা থেকে আত্মম্ভরীতা দেখাই! বইগুলো পড়ার পর থেকেই ইতিহাসের ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের জীবন-কর্ম-দর্শন পড়ার আগ্রহ বেড়ে গেল।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে হাজার হাজার বিপ্লবী প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। পরোক্ষভাবেও যুক্ত ছিলেন অসংখ্য সংগ্রামী মানুষ। এই বিপ্লববাদী আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শত শত ছাত্র-তরুণ-যুবকরা যুক্ত ছিলেন। এঁদের মধ্যে হাতেগোনা চার-পাঁচজনের নাম ও কিছু কিছু ইতিহাস আমরা জানি। এই অজানার বাইরে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই বললেই চলে।
২০১৪ সাল নাগাদ এতটুকু জানাশোনাই ছিল আমার। কিন্তু এরপরে ‘বিপ্লবীদের কথা প্রকাশনা’ থেকে ‘শত বিপ্লবীদের কথা’ নামে একটি বই সংগ্রহ করি। বইটি দেখেই হতবাক হয়েছিলাম যে, ‘শত বিপ্লবীদের কথা’ এতে কাদের জীবনী রয়েছে? বইটি উল্টিয়ে ভালো করে দেখলাম- সূচিপত্র। ভূমিকা দেখে আরও অবাক হলাম- শত জন বিপ্লবীই আমাদের উপমহাদেশের। তার মধ্যে আবার বাঙালি বিপ্লবীর সংখ্যাই বেশি। যাই হোক, শত বিপ্লবীদের কথা বইটি পড়ার আগে আমার পূর্বসূরী লড়াকুদের সম্পর্কে জ্ঞান খুবই সামান্য ছিল- যা উপরে উল্লেখ করেছি। সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম, তিতুমীর, ইলা মিত্র, প্রীতিলতা সামান্য হলেও জানতাম- কিন্তু এর বাহিরে, শত শত জনের নাম পর্যন্ত জানতাম না। এই বইটির ভূমিকাতে আরও লেখা ছিল যে, পরবর্তীতে এই শত বিপ্লবীদের জীবনী নিয়ে ধারাবাহিকভাবে বই প্রকাশ হবে। এখন অপেক্ষায় আছি ‘শত বিপ্লবীদের কথা’ দ্বিতীয় খণ্ড কখন বের হবে!
ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ইতিহাসের প্রত্যেকটি লড়াই-সংগ্রামে লড়াকুদের অবদান। আমরা অনেকেই ইতিহাসের লড়াকুদের জানি না, জানতে চাই না। এক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীসমাজ অনেকাংশে পিছিয়ে রয়েছে। আমরা আমাদের পূর্বসূরীর ইতিহাস জানি না বললেই চলে। একটি উদাহরণ টানছি, ‘ভারত উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে’র- ইতিহাসই কতটা জানি আমরা! ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই বা কতটা জানি!
জন্ম থেকে মৃত্যু, এই চলার পথটির নামই জীবন। কিন্তু সব জীবন অর্থবহ হয় না। সবার জীবন নিয়ে জীবনী হয় না, তাই ইতিহাস তাদের ধরেও রাখে না। ইতিহাস ধরে রাখে শুধু তাদেরই, যারা হয়ে উঠেন বিশিষ্ট ও অনন্য-অসাধারণ জীবনের অধিকারী। যে জীবনকে সবাই শ্রদ্ধা করে। আবার অনেকে অনুকরণ-অনুসরণ করার চেষ্টা করে। এমন জীবন শুধু জন্মসূত্রে পাওয়া যায় না, এটা অর্জন করতে হয়, তৈরি করতে হয় কঠোর শ্রম, গভীর নিষ্ঠা ও আত্মত্যাগ দিয়ে। এর জন্য তৈরি কোনো পথ নেই, পথ তৈরি করে এগোতে হয়। সেক্ষেত্রে প্রেরণা হয়ে পথ দেখায় এক মহৎ জীবনবোধ, আদর্শবোধ ও দেশপ্রেম। দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার মহান আদর্শে দীক্ষিত এমনি কিছু মুক্তি-পাগল মানুষ ‘জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য’ করে সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কাফেলায়। যে কাফেলায় শামিল হয়েছিলেন বিপ্লবী ভগৎ সিং।
অগ্নিযুগের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা থেকেই ঢাকার অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর পার্টি, চট্টগ্রামের দি ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স, মালামার বিপ্লবীদল, কলকাতার অনুশীলন সমিতি, মেদিনীপুর বিপ্লবী দল, বিপ্লবী কমিউনিস্ট সংগঠন, স্বরাজ পার্টিসহ অন্যান্য বিপ্লবী দল স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এসব দলের অসংখ্য বিপ্লবী সদস্যরা ভারত মাতার স্বাধীনতার জন্য জীবন বলিদানের মন্ত্র সানন্দে গ্রহণ করেন এবং তাদের মধ্যে অনেকেই ফাঁসিমঞ্চে জীবন উৎসর্গ করেন। বিপ্লবী ভগৎ সিং এই জীবন উৎসর্গকারীদের একজন।
আজকের তরুণ প্রজন্ম কতটুকু জানে সেই সমস্ত বিপ্লবীদের সম্পর্কে, যারা জীবন দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা এনেছিলেন!
‘যে মানুষ প্রগতির পক্ষে তাকে পুরোনো বিশ্বাসের প্রত্যেকটি বিষয়কেই চ্যালেঞ্জ করতে হবে। যথেষ্ট যুক্তিতর্ক ও বিচার-বিবেচনার পর যদি কেউ কোনো তত্ত্ব বা দর্শনে বিশ্বাস স্থাপন করে, তবে তার বিশ্বাসকে স্বাগত জানাতে হয়। তার চিন্তাভাবনা ভুল বা বিভ্রান্তিকর হতে পারে। কিন্তু তা শোধরানোর সুযোগ আছে, কারণ সে পরিচালিত হয় বিচারবুদ্ধির দ্বারা, অন্ধবিশ্বাসের দ্বারা নয়। বিশ্বাস ও অন্ধবিশ্বাস বিপজ্জনক, তা মস্তিষ্ককে অকেজো করে দেয়, মানুষকে প্রতিক্রিয়াশীল বানিয়ে তোলে।’ -ভগৎ সিং
ভগৎ সিংয়ের এই বিখ্যাত উক্তিটি যেদিন থেকে মাথায় ঢুকে গেছে, সেদিন থেকেই বুঝতে পারছি- প্রগতিশীলতা কি, দর্শন কি? কতটা সহজ-সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ‘বিশ্বাস ও অন্ধবিশ্বাস বিপজ্জনক’ এই কথাগুলো পড়ার পর অবশ্যই নাস্তিকতা নিয়ে আর আলোচনার অপেক্ষা রাখে না, আমি নাস্তিক তার প্রমাণ দেওয়ার জন্য রাস্তায় নামতে হয় না?
ভগৎ সিং পার্টি বলতে কি বোঝায় এবং কোন ধরনের পার্টি চাই - এ সব বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন-
“লেনিনের অতি প্রিয় যে জিনিসটা সেই প্রফেশনাল বিপ্লবীদেরই আমাদের প্রয়োজন- এঁরা হচ্ছেন সর্বক্ষণের কর্মী, বিপ্লব ছাড়া এঁদের জীবনের আর কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা কাজ নেই। পার্টিতে সংগঠিত এরকম কর্মী সংখ্যা যতো বেশি ততো বেশি করে তোমাদের সাফল্যের সম্ভাবনা বাড়বে।”
“সুসংবদ্ধভাবে অগ্রসর হলে যেটা তোমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেটা হলো একটা পার্টি, যাতে থাকবে উপরে আলোচিত ধরনের কর্মীদল যাদের লক্ষ্য ও পথ সম্বন্ধে থাকবে স্বচ্ছ চিন্তাধারা, কর্মক্ষেত্রে যথাযথ উদ্যোগ আর দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। পার্টিতে থাকবে লৌহদৃঢ় শৃঙ্খলা। এই পার্টিকে যে গোপন পার্টি হতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। জনগণের মধ্যে প্রচারের কর্মসূচী নিয়ে পার্টিকে কাজ শুরু করতে হবে।... কৃষক ও শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য, তাদের সক্রিয় সমর্থন লাভের জন্য এই প্রচারকার্য একান্ত প্রয়োজনীয়। পার্টির নাম হবে কমিউনিস্ট পার্টি। রাজনৈতিক কর্মীদের এই পার্টি, কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ এই পার্টিই অন্যান্য সব আন্দোলন পরিচালনা করবে...।” - ভগৎ সিং
সেই ১৯২৬ সালে তিনি পার্টি, রাজনীতি, সংগঠনের ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন। কৃষক ও শ্রমিকদের পার্টি গড়ে তোলার কথা বলেছেন। শৃঙ্খলা, আদর্শ, দর্শন, চিন্তা, লক্ষ্যের কথা সুস্পষ্টভাবে লিখনীর মাধ্যমে জানিয়ে গেছেন- আমাদের প্রজন্মকে। কিন্তু আমরা কতটা জানি, এই ইতিহাস!
ভগৎ সিং বলেছিলেন, 'বিপ্লব মানে রক্তক্ষয়ী হানাহানি নয়। বিপ্লবের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কোনো প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসা মেটাবারও সম্পর্ক নেই। বিপ্লবের অর্থে বোমা বা পিস্তলের চর্চাও বোঝায় না। ‘বিপ্লব’ বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা যা কিনা জ্বলন্তরূপে অন্যায়ের কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেই ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন।’
ভগৎ সিং, একটি নাম- একজন বিপ্লবীর নাম। তিনি জন্মেছিলেন ১৯০৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। পশ্চিম পাঞ্জাবের লায়লাপুর জেলার বংগা গ্রামে। একসময় পাঞ্জাবের ওই অঞ্চলে জলের অভাবে চাষ-আবাদ কিছুই হত না। উনিশ শতকের শেষদিকে মধ্য পাঞ্জাবের বেশ কিছু লোক উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে এসে প্রচুর পরিশ্রম করে খাল কেটে চাষবাস শুরু করেন। ভগৎ সিংয়ের পূর্বপুরুষ ছিলেন এদের দলে। এরা ছিলেন দুঃসাহসী, কঠোর পরিশ্রমী আর স্বাধীন চিন্তার মানুষ। এদের বলা হত জাঠ।
ভগৎ সিংয়ের প্রাথমিক পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর স্কুলে পড়ার পালা। কিন্তু ভগৎ সিং তার সমবয়সী ছেলেদের মত লাহোরের খালসা হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন নি। কারণ এই স্কুলে লেখাপড়া করলে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য দেখাতে হয়। যে কারণে তার ঠাকুরদাদা তাঁকে এখানে পড়াশুনা করাতে রাজি ছিলেন না। তিনি ভগৎ সিংকে অন্য একটি স্কুলে পড়াশুনা করানোর সিদ্ধান্ত নেন। তারপর ভগৎ সিংয়ের বাবা তাঁকে আর্যসমাজি বিদ্যালয় দয়ানন্দ অ্যাংলো-বৈদিক স্কুলে ভর্তি করেন।
এই স্কুলে পড়াশুনাকালে হঠাৎ একদিন দুপুর বেলা ভগৎ সিংকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। স্কুলের সবাই বাড়ি ফিরেছে, কিন্তু ভগৎ সিংকে কোথাও পাওয়া গেল না। সে তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। বয়স মাত্র ১২ বছর। সবাই তাকে খুঁজতে বেরোল। ওদিকে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, আতঙ্কে সবাই ছুটাছুটি করছেন। স্কুলে খবর নিয়ে জানা গেল ভগৎ সিং যথারীতি ক্লাস করেছে; তারপর কোথায় গেছে কেউ জানে না। অনেক রাতে ভগৎ সিংয়ের দেখা মিলল। হাতে জালিয়ানওয়ালাবাগের শত শহীদের রক্ত মাখা মাটি। স্কুল থেকে বেরিয়ে শুনেছে সেই মর্মান্তিক ঘটনা, তারপর বাসে করে ৪০/৫০ মাইল দূরে অমৃতসরে ছুটে গেছে সে, সেখানকার ত্রাস ও দুর্যোগের পরিবেশ উপেক্ষা করে কুড়িয়ে এনেছে সে রক্তরঞ্জিত মাটি। এই মাটি তার কাছে সোনার চেয়েও খাঁটি। এ মাটি বিদ্রোহের প্রতীক।
গান্ধীজী ১৯২১ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের মাধ্যমে বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করলেন। বিপ্লবীদেরকে অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত হতে বললেন। তিনি বিপ্লবীদের জানালেন অসহযোগ আন্দোলন করে এক বছরের মধ্যে স্বরাজ এনে দিবেন। যদি না পারেন তাহলে বিপ্লবীরা আবার সশস্ত্র সংগ্রামে সামিল হলে তার বলার মতো কিছু থাকবে না। গান্ধীজীর অনুরোধে বিপ্লবীরা সাময়িকভাবে সম্মত হন। এসময় কিশোর ভগৎ সিং অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত হন। তিনি নিজ এলাকাতে অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি সহপাঠীদের সাথে নিয়ে বিলাতী কাপড় জোগাড় করে মহানন্দে পোড়াতে শুরু করেন। তখন তার বয়স মাত্র ১৪ বছর। ওই বয়স থেকে তিনি ইউরোপীয় বিপ্লবী আন্দোলনের উপর পড়াশোনা করেন এবং শেষ পর্যন্ত মার্ক্সবাদে আকৃষ্ট হন। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে তিনি একদিন ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ঘৃণা প্রকাশ করার জন্য তার সরকারি স্কুল বই ও স্কুল ইউনিফর্ম পুড়িয়ে ফেলেন।
এক বছরের মধ্যে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এতে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ যুক্ত হয়। ১৯২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর জেলার চৌরীচেরা গ্রামে কৃষকদের শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন হটিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশ জনতার উপর গুলি চালায়। এতে কয়েকজন কৃষক মারা যায়। ফলে বিক্ষুব্ধ জনতা থানা ঘেরাও করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। থানার ভিতর ২২ জন পুলিশ পুড়ে মারা যায়। এতদিন ধরে ব্রিটিশ প্রসাশন যে পরিমাণে ভারতের স্বাধীনতাকামী জনগণের উপর অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে সে তুলনায় এটি কিছুই নয়, একটি বিক্ষিপ্ত দুঃখজনক ঘটনা। তবু গান্ধীজী এই ঘটনার কারণে অসহযোগ আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ান।
অসহযোগ আন্দোলন থেমে যাওয়ার পর ভগৎ সিং ‘শিখ গুরুদ্বার’ সংস্কারের কাজে যুক্ত হন। শিখ ধর্মের নানা অনুষ্ঠান যেখানে পালিত হয়, সেই মন্দিরকে বলে গুরুদ্বার। এইসব গুরুদ্বারে যে আয় হত তার প্রায় বড়ো অংশটাই পুরোহিতেরা নিজেদের ব্যক্তিগত বিলাসে ব্যয় করতেন। গুরুদ্বার সংস্কার আন্দোলনের নেতারা বললেন, তা হবে না। নির্বাচিত প্রতিনিধি দল গঠন করতে হবে। তারাই আয়-ব্যায়ের হিসাব রাখবেন। এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে ভগৎ সিং বড়ো বড়ো চুল রাখলেন, কোমরে ঝোলালেন শিখ ধর্মের নিয়ম অনুসারে কৃপাণ নামে তলোয়ারের চেয়ে ছোট একটা অস্ত্র, মাথায় পড়লেন বড়ো কালো পাগড়ি। সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে ভগৎ সিং তার ‘কেন আমি নাস্তিক?’ বইয়ে লিখছেন, ‘সেই সময়ে আমি লম্বা লম্বা চুল রাখতে থাকি। কিন্তু শিখ বা অন্য কোন ধর্মের পৌরাণিক কাহিনী বা মতবাদে আমি আস্থা রাখতে পারিনি। তবু ঈশ্বরে আমার খুব বিশ্বাস ছিল।’
মেট্রিক পাশ করার পর ভগৎ সিং ন্যাশনাল কলেজে (স্বদেশি বিদ্যালয়) ভর্তি হন। এই কলেজে ভগৎ সিং দুজন বিশিষ্ট অধ্যাপকের কাছে পড়াশুনার সুযোগ পান। অধ্যাপক পরমানন্দের কাছে শুনলেন ইতিহাসের কত জানা-অজানা কাহিনী। শুনলেন আন্দামান জেলে বন্দী বীর দেশপ্রেমিকদের কথা। অধ্যাপক নিজেই এই আন্দামানে বহুদিন বন্দী জীবন কাটিয়েছেন।
অধ্যাপক জয়চন্দ্র বিদ্যালঙ্কারের কাছে শুনলেন বিশ্ব-ইতিহাস নিয়ে আলোচনা। তখন থেকে ভগৎ সিং বুঝতে পারলেন, ভারতের স্বাধীনতা তখনই আসবে যখন এদেশের মানুষের একটা বড়ো অংশ সচেতন হবে। আর তার জন্য চাই বিশেষ শিক্ষা আর বিশাল কর্মকাণ্ড। ভগৎ সিং এই কলেজে পড়াশুনাকালীন সময়ে আজীবন সংগ্রামের সাথী রূপে শুকদেব, যশপাল এবং ভগবতীচরণ ভোলার মত কয়েকজন অসম সাহসী তরুণকে সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়ে যান।
ভগৎ সিং খুব মনোযোগী ও পরিশ্রমী ছাত্র ছিলেন। যে বিষয় বুঝতে পারতেন না তা বুঝার জন্য বার বার ভালো করে চেষ্টা করতেন। ইতিহাস ও রাজনীতি বিষয়ক পড়াশুনার প্রতি তার আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি। সহপাঠীদেরকে নিয়ে পাঠচক্র করতেন। সবাইকে নিয়ে দেশ-বিদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাস পড়তেন। পড়লেন ইতালির দেশপ্রেমিক ম্যাৎসিনি ও গ্যারিবল্ডি অস্ট্রিয়ার শাসককে উৎখাত করে ইতালিকে স্বাধীনতার ইতিহাস, আয়ার্যান্ডের বিপ্লবী ইমন-ডি-ভ্যালেরার লেখা ‘আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম’ ও রুশ বিপ্লবী ক্রোপটকিনের ঘটনাবহুল জীবনের নানা দিক। আরো পড়লেন ভলতেয়ার আর রুশোর আগুনঝরানো রচনাবলী। পড়াশুনার সাথে সাথে ভগৎ সিং লাহোরের ন্যাশনাল ড্রামাটিক ক্লাবের সভ্য হয়ে যুবকদের মধ্যে স্বদেশপ্রেম জাগিয়ে তোলার জন্য একে একে অভিনয় করলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত, রাণা প্রতাপ, ভারত দুর্দশা। এসব নাটকের খল-চরিত্রে বিদেশি শাসকের অন্যায়-অত্যাচারের রূপরেখা ফুটে উঠত। এইভাবে মঞ্চে সফল একাধিক নাটকের মাধ্যমে কলেজের ছাত্র সমাজের মধ্যে বিদ্রোহের উদ্দীপনা নিয়ে এলেন তিনি।
১৯২৩ সালে ভগৎ সিং বি. এ ক্লাসে ভর্তি হন। কিছুদিন পর বাড়ি থেকে বিয়ে করার জন্য বার বার চাপ আসতে থাকে। কিন্তু ভগৎ সিং বিয়ে করতে রাজি নন। তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করার। তাই লাহোরের বিপ্লবী নেতা শচীন সান্যালের পরামর্শে ভগৎ সিং কানপুরের বিপ্লবী গণেশ শঙ্করের কাছে চলে যান। গণেশ শঙ্করের ‘প্রতাপ প্রেস’ ছিল উত্তরপ্রদেশের বিপ্লবীদের মিলন কেন্দ্র। গণেশ শঙ্করের মাধ্যমে এখানে বসে ভগৎ সিং বিপ্লবী পথের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন। ছুঁড়ে ফেলেন উচ্চ শিক্ষার ডিগ্রি লাভের মোহকে। উপেক্ষা করলেন বাবার সুখী পরিবারের নিরাপদ জীবন, ফিরেও তাকালেন না গৃহকোণের দিকে। দুনিয়ার সব ছন্নছাড়া বাঁধনহারা মুক্তিকামী মানুষের মিছিলে এক হয়ে গেলেন তিনি। যুক্ত হলেন ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান এসোসিয়েশন’-এ। তারপর থেকেই শুরু হয় তার সশস্ত্র বিপ্লবী জীবনের পথচলা।
১৯২৪ সালে ভারত উপমহাদেশব্যাপী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং সর্বত্র সংগঠিত হয় সশস্ত্র বিপ্লববাদী সংগঠন। চট্টগ্রামে রেলওয়ে ডাকাতি, বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক ডাকাতি ও বিপ্লববাদীদের সশস্ত্র কার্যকলাপের কারণে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে ব্রিটিশ ‘১ নম্বর বেঙ্গল অর্ডিনান্স’ নামে এক জরুরি আইন পাশ করে। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল ‘রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য সন্দেহভাজনদের বিনা বিচারে আটক রাখা’।
১৯২৫ সালের ৯ আগস্ট। উত্তরপ্রদেশের কাকোরী রেল স্টেশন দিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ সরকারি টাকা নিয়ে যাচ্ছিল। যখন ট্রেন কাকোরী স্টেশনে থামলো তখন ট্রেনে ডাকাত পড়েছে খবর ছড়িয়ে পড়ল। সবাই আতঙ্কিত। এমন সময় হঠাৎ ১৪/১৫ সশস্ত্র লোকের মধ্যে একজন বললেন, আপনাদের কোনো ভয় নেই। আপনাদের কিছু নিতে আসিনি। এই গাড়িতে করে ইংরেজ আমাদের দেশের টাকা লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল। আমরা সেই টাকা উদ্ধার করে দেশের কাজের জন্য নিয়ে গেলাম।
এরপর ব্রিটিশ শুরু করল ‘কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলা’। এই মামলাকে কেন্দ্র করে পুলিশ উত্তরপ্রদেশের নেতৃত্বস্থানীয় ৪৪ জনকে গ্রেফতার করে। মামলায় রাজেন লাহিড়ী, ঠাকুর রোশন সেন, আসফাকুল্লা খান এবং রামপ্রসাদ বিসমিল্লা-এর ফাঁসি হয় ও গণেশ শঙ্কর, শচীন সান্যালসহ ১৪ জনকে আন্দামান পাঠানো হয়।
১৯২৮ সালের ৮-৯ সেপ্টেম্বর ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান এসোসিয়েশন’-এর ব্যানারে সমগ্র ভারতের বিভিন্ন বিপ্লবীদের নিয়ে দিল্লীতে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভার সভাপতিত্ব করেন ভগৎ সিং। ওই সমাবেশে তিনি বললেন, ‘অবশ্যই আমাদের প্রথম লক্ষ্য দেশকে স্বাধীন করা। কিন্তু মূল লক্ষ্য হল ভারতে শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সমাজতান্ত্রিক ভারতবর্ষই আমাদের স্বপ্ন। বিপ্লবের চেতনা নিয়ে আমরা সেই পথে এগিয়ে যাব’। এই সভায় ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান এসোসিয়েশন’ নাম পরিবর্তন করে ‘হিন্দুস্থান সোসালিস্ট রিপাবলিকান এসোসিয়েশন’ করা হয়।
ওই বছর স্যার জন সাইমনের অধীনে ব্রিটিশ সরকার একটি কমিশন গঠন করে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর রিপোর্ট প্রদানের জন্য সেটিকে ভারতে প্রেরণ করে। কিন্তু কমিশনে কোনো ভারতীয় না থাকায় ভারতের সকল রাজনৈতিক দল তা প্রত্যাখ্যান করে এবং সারা দেশে এটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ গড়ে উঠে। যার ধারাবাহকিতায় ১৯২৮ সালের ৩০ অক্টোবর লাহোরে লালা লাজপৎ রায়ের নেতৃত্বে একটি নীরব অহিংস পথযাত্রার উপর পুলিশ লাঠি চার্জ করে। এসময় লালা লাজপৎ রায় পুলিশের নৃশংস লাঠি চার্জের শিকার হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং একপর্যায়ে মারা যান। ভগৎ সিং এই পথযাত্রায় ছিলেন। তিনি এ ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। বিপ্লবী ভগৎ সিং, রাজগুরু, সুখদেব ও জয় গোপাল একত্রে মিলিত হয়ে ওই ঘটনার নেতৃত্বদানকারী পুলিশ প্রধান স্কটকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। জয় গোপালকে দায়িত্ব দেয়া হয় স্কটকে সনাক্ত করে ভগৎ সিং-কে গুলি করার সংকেত প্রদানের জন্য। জয় গোপাল ডেপুটি পুলিশ সুপারিটেন্ডেন্ট জন পি. সন্ডার্সকে দেখে পুলিশ প্রধান স্কটকে ভেবে ভগৎ সিং-কে গুলি করার সংকেত দেন। ফলশ্রুতিতে জন পি. সন্ডার্স গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। সামান্য ভুলের কারণে বেঁচে যান পুলিশ প্রধান স্কট। ভগত সিং পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য আত্মগোপনে চলে যান। পুলিশ যাতে তাঁকে চিনতে না পারে সেজন্য তিনি চুল-দাড়ি কেটে ফেলেন। কিছু দিন পর তিনি কলকাতায় চলে আসেন। এখানে এসে বাংলার বিপ্লবী যতীন দাসের আশ্রয়ে একটি হোস্টেলে উঠলেন। খুব সতর্কতার সাথে বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করে পার্টির কাজ অব্যাহত রাখলেন।
‘১৯২৬ সালের শেষাশেষি আমার স্থির বিশ্বাস হল যে, সর্বশক্তিমান এমন কোনো সত্ত্বার অস্তিত্ব নেই যাঁর হাতে রয়েছে এই বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি, চালনা ও নিয়ন্ত্রণের ভার। এইভাবেই স্পষ্টতই আমি একজন স্বঘোষিত নাস্তিক বনে গেলাম।'
‘ভাববাদকে বিদায় দিলাম। অন্ধ বিশ্বাস থেকে নিজেকে মুক্ত করলাম। বস্তুবাদী ভাবনা আদর্শ হয়ে দাঁড়াল।’
'ঈশ্বর বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সমাজকে প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ প্রতিরোধ বা যুদ্ধ ঘোষণা করে যেতে হবে। সেই সঙ্গে পুতুল পূজা বা ধর্মীয় সংকীর্ণতার বিরুদ্ধেও লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’
‘ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস, তাঁর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করাকে আমি অত্যন্ত স্বার্থপর ও হীন কাজ বলে মনে করি।’
- ভগৎ সিং
ফাঁসির আগের দিন অর্থাৎ ২২শে মার্চ দ্বিতীয় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার আসামীরা ভগৎ সিং-এর নিকট গোপনে ছোট্ট একখানা চিরকুট পাঠিয়ে জানতে চান, তিনি কি বেঁচে থাকতে চান? ভগৎ সিং-এর ফাঁসির সেলের কাছেও ওয়ার্ডেই ঐ বন্দীরা তখন থাকতেন। কিন্তু ভগৎ সিং সুস্পষ্টভাবে সেদিন তাঁর বেচে থাকার জবাব দিয়েছিলেন- তিনি বলেছিলেন আমি আত্মিক ভাবে মরে গেলেও, মানুষের মাঝে বেঁচে থাকব যুগ-যুগান্তর। কতটা আত্মবিশ্বাসী হলে কেউ এরকম উত্তর দিতে পারেন?
ভগৎ সিংকে যখন নাস্তিক বলে আখ্যা দিয়েছিলেন, তখন তিনি বলেন- ‘কোথায় আপনাদের ঈশ্বর? তিনি কি করছেন? মানবজাতির এই সব দুঃখ-দুর্দশা দেখে তিনি কি উল্লাস বোধ করছেন? তাহলে তিনি তো এক ‘নীরো’ বা ‘চেঙ্গিস’! তিনি নিপাত যান। তাঁর বিনিপাত হোক'।
'আপনারা কি জানতে চান এই জগতের উদ্ভব ও মানুষের সৃষ্টি হলো কি করে? বেশ, ঠিক আছে, বলছি। এ বিষয়ে চার্লস ডারউইন কিছু সন্ধানী আলো নিক্ষেপ করেছেন। তাঁর বই পড়ুন। সেই সঙ্গে সোহং স্বামীর 'কমন সেন্স' বইটাও পড়ুন। এই বই দুটোতে আপনাদের প্রশ্নের অনেকখানি জবাব মিলতে পারে'।
এই কোটেশনগুলো দেওয়ার পিছনে একটাই কারণ একটা মানুষ তাঁর জীবন-দর্শন সম্পর্কে কতটা উদাসীন থাকলে- এভাবে তর্কে জড়াতে পারেন!
ফাঁসির চিরকুট হাতে পেয়ে ভগৎ সিং মিটিমিটি হেসে বলছিলেন- ‘আপনারা ভাগ্যবান, আমার মতো দেশপ্রেমিকের গলায় ফাঁসি দড়ি পড়াতে পারছেন।’
‘আমি জানি যে-মুহূর্তে ফাঁসির দড়ি আমার গলায় এঁটে বসবে, পায়ের তলা থেকে পাটাতন সরিয়ে নেওয়া হবে, সেই হবে আমার জীবনের অন্তিম মুহূর্ত, আমার জীবনের সর্বশেষ ক্ষণ। ‘আমি’ বা সংক্ষেপে (দার্শনিক পরিভাষায়) আমার ‘আত্মা’- সেখানেই চিরতরে শেষ হয়ে যাবে। সব শেষ! আর কিছু নেই। এক অতি সংক্ষিপ্ত সংগ্রামী জীবনের কীর্তিহীন, গৌরবহীন, মাহাত্ম্যহীন পরিসমাপ্তি! যদি এইভাবে সাহসের সঙ্গে মেনে নিতে পারি- তবে সেটিই হবে আমার জীবনের সর্বোত্তম পুরস্কার।
'সব শেষ। ইহলোকে বা ‘পরলোকে’ পুরস্কৃত হবো এমন কোনো স্বার্থগত বাসনা বা অভিসন্ধি নেই। নিতান্ত নিঃস্বার্থভাবে আমি আমার দেশের মুক্তির জন্যে আমার এই জীবন উৎসর্গ করে গেলাম, কারণ, এ ছাড়া আমার আর কিছু দেবার ছিল না'।
'যেদিন আমরা দেখে যাবো যে, এক বৃহৎ সংখ্যক নরনারী এই মনোভাব নিয়ে দলে দলে মানব জাতির সেবায় এগিয়ে আসছে, নিপীড়িত ও দুর্গত মানবাত্মার মুক্তি ছাড়া যাদের জীবনের অন্য কোনো কাজ থাকবে না, সেদিনই আমার মতো মানুষের জীবনদান সার্থক হবে। শুরু হবে সত্যিকার মুক্তির দিন। মৃত্যুর পর ‘স্বর্গে’ গিয়ে বা ‘পরের জন্মে’ রাজা হতে নয়, ইহলোকে কোনো পুরস্কার লাভের জন্যেও নয়, নির্যাতনকারী যত শোষক দস্যুদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানাতে অনুপ্রাণিত হয়েই এবং সেইসঙ্গে সমগ্র মানবজাতির স্কন্ধ থেকে দাসত্বের জোয়াল ঝেড়ে ফেলে দিতেই এবং স্বাধীনতা ও শান্তির পথ নির্মাণ করতেই তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত আত্মধ্বংসী পথে নিজেদের মহৎ প্রাণ বলিদান করে গেছেন- এবং এই পথটাই হলো গৌরবময় জীবনের পথ। এই মহৎ কাজের যে গৌরব ও মাহাত্ম্য তাকে কি শুধু ‘অহঙ্কার’ বলে খাটো করা যায়? তার কোনো অপব্যাখ্যা হয় কি? এই ধরনের ঘৃণ্য বিশেষণ যদি কেউ ব্যবহার করেন, তবে বলবো যে হয় তিনি নির্বোধ, নয়তো শয়তান'।
'এই মহান আত্মত্যাগের মধ্যে যে অনুভূতির প্রগাঢ়তা, যে ভাবার্দ্রতা, যে উদ্দীপনা, যে মহত্ত্ব ও বিশালতা আছে তা অনুধাবন করতে না পারার জন্য আসুন, সে মানুষকে ক্ষমা করা যাক। কারণ তার হৃদয় মৃত ধ্বংস্তূপের মতো, তার চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ, ভিন্নতর কোনো স্বার্থের আবরণে তার হৃদয় চাপা পড়ে আছে'।
'আত্মবিশ্বাসকে প্রায়শ আত্মম্ভরিতা বলে ভুল করা হয়। এটা যেমন দুঃখজনক, তেমনি শোচনীয়। কিন্তু কিছু করার নেই!’
ভগৎ সিং এভাবেই ফাঁসির মঞ্চে উঠার আগে সাহস জুগিয়েছিলেন- হাজার-হাজার, তরুণ জনতাকে। যার ধারাবাহিকতায় জীবন দিয়েছিলেন, হাজারো তরুণ। স্বাধীন হয়েছিল ভারতমাতা।
সাধারণত ফাঁসি দেওয়া হয় ভোররাত্রে। কিন্তু না, কাউকে বিশ্বাস নেই। তখন যে একটা হাঙ্গামা শুরু হয়ে যাবে না তার ঠিক কি! তাই ভোররাত্রের পরিবর্তে সময় ঠিক করা হয়েছে সন্ধ্যার পর। আনুষ্ঠানিকভাবে বন্দীদের খবর জানানো হল বিকেল পাঁচটায়। প্রস্তুত হওয়া। আর মাত্র আড়াই ঘণ্টা বাকি।
ভগৎ সিংকে জানিয়ে দেওয়া হলো, আর মাত্র আড়াই ঘণ্টা বাকি, আপনাদের তিনজনের কোনো ইচ্ছা থাকলে প্রকাশ করতে পারেন।
ভগৎ সিং বললেন, আড়াই ঘণ্টা কেন! এখনই নিয়ে চলো না! আমরা তো প্রস্তুত হয়েই আছি!
ফাঁসিতে ঝুলবার আগে পর্যন্ত ভগৎ সিং পড়ছিলেন ‘লেনিনের জীবনী’। এই সময় জেলের অফিসারের ডাক এল..
জেল অফিসার: সরদারজী, ফাঁসি লাগানো কা হক্ম আ গয়া হ্যায়। আপ তৈয়ার হো যাইয়ে।
ভগৎ সিং-এর ডান-হাতে বইটা ছিল। বাঁ-হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দিলে বললেন..
দাঁড়ান। একজন বিপ্লবীর সঙ্গে আর একজন বিপ্লবীর সাক্ষাৎকার চলছে।
থমকে দাঁড়ালেন অফিসার। কিছুটা পড়ার পর বইটা রেখে ভগৎ সিং তেজোদীপ্ত ভঙ্গিতে খাড়া হয়ে দাঁড়ালেন।
ভগৎ সিং বললেন, চলুন...
সন্ধ্যা সাতটা বেজে বাইশ মিনিটে তিনজন মিছিল করে যাত্রা শুরু করলেন ফাঁসির মঞ্চের দিকে। ডাইনে রাজগুরু, মাঝে ভগৎ সিং, বাঁয়ে শুকদেব। সবার কণ্ঠে একই ধ্বনি- ইনকিলাব জিন্দাবাদ। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।
সেই চরম মুহূর্তেও কিন্তু একটু পরিহাস করার লোভ সংরবণ করতে পারলেন না ভগৎ সিং! ডেপুটি কমিশনারকে লক্ষ্য করে সহাস্যে বললেন...
ভগৎ সিং বললেন, ইউ আর ভেরি লাকি
ডেপুটি কমিশনার হয়ে বললেন, এর মানে?
ভগৎ সিং হাসোজ্জ্বল মুখে বললেন, আজ তুমি দেখতে পাবে, ভারতের বিপ্লবীরা আদর্শের জন্য কিভাবে হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করতে পারে।
হাসি মুখেই মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন তিনজন। ফাঁসির মঞ্চে ভগৎ, শুকদেব, রাজগুরুর দীপ্ত শ্লোগান-
‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’
‘সাম্রাজ্যবাদ কা নাশ হো।’
১৯৩০ সালের ৭ অক্টোবর। তিন ব্রিটিশ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত এক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুকে অপরাধী সাব্যস্ত করেন এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় প্রদান করে। ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ সন্ধ্যা ৭ টায় এই তিন বিপ্লবীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
লেখকঃ লাবণী মণ্ডল, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট