Biplobi Barta

শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

চালের দাম ও শ্রেণিবৈষম্য


চাল, বিশেষত মোটা চালের দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়ায় খেটে খাওয়া মানুষের এখন ‘ভাত আনতে ফতুর হওয়ার’ অবস্থা। তাদের মাথায় বজ্রপাত! এ অবস্থায় সরকারের যা ভাবসাব তা দেখে মনে হয় সরকার হয়তো ভাবছে, কোনোভাবে ২-৩টি মাস পার করে দিতে পারলেই বর্তমান সংকট পার করে দেওয়া যাবে, অবস্থা চালের দাম স্বাভাবিক হয়ে আসবে এবং চালের উচ্চমূল্যজনিত ‘বিড়ম্বনা’ আর থাকবে না। এ কথা হয়তো ঠিক যে, সংকট ২-৩ মাস পর এমন প্রকট আকারে আর থাকবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সবকিছুই কি আগের অবস্থায় পুরোপুরি ফিরে আসবে? অন্য অনেক কিছু আগের অবস্থায় ফিরে এলেও চালের দামের এহেন উল্লম্ফন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে সম্পদের বণ্টনের ক্ষেত্রে অধিকতর বৈষম্যমূলক যে নতুন বিন্যাসের জন্ম দেবে, তা কিন্তু থেকেই যাবে। সমাজে শ্রেণিগত বৈষম্য আরও প্রকট রূপ নিয়ে স্থায়িত্ব পাবে। এ ঘটনাই ঘটে চলেছে সর্বদা। এভাবেই চালের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে বৈষম্যের মাত্রা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
আমার অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়ের রাজনৈতিক জীবনে আমি হরেকরকম স্লোগান উচ্চারণ করেছি ও উচ্চারিত হতে শুনেছি। এর ভেতরে একবার দেশ বদল হয়েছে, বহুবার সরকার বদল হয়েছে, অসংখ্যবার পরিস্থিতি বদল হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বদল হয়েছে অনেক স্লোগাণ। কিন্তু কিছু কিছু স্লোগান এখনো পুরোপুরি বহাল আছে। যেমন কিনা - ‘চাল-ডাল-তেলের দাম কমাতে হবে’, ‘অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা চাই, বাঁচার মতো বাঁচতে চাই’, ‘কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না’ ইত্যাদি। ভাত-কাপড়ের দাবিতে আরও কতদিন যে এ ধরনের স্লোগান দিয়ে যেতে হবে, বলতে পারব না।
আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থানের আগে ‘চাল-ডাল-তেলের দাম কমাতে হবে - এই স্লোগানটি আরও সুনির্দিষ্ট রূপ ধারণ করে ‘বিশ টাকা মণ দরে চাল চাই, দশ টাকা মণ দরে গম চাই’ - এই আওয়াজ পরিগ্রহ করেছিল। আমরা তখন গলা ফাটিয়ে এই স্লোগানে রাজপথকে প্রকম্পিত করতাম। বর্তমানে ২০ টাকায় এক মণ তো দূরের কথা তার শতভাগের একভাগ চালও কিনতে পাওয়া যায় না। চালের দাম বছর-বছর বেড়েই চলেছে। গত ১ বছরে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ, যার মধ্যে গত ১ মাসেই বেড়েছে ১৮ শতাংশ। খোলাবাজারে মোটা চালের দাম এখন কেজিপ্রতি ৫০ টাকার কাছাকাছি। অর্থাৎ আইয়ুব আমলের তুলনায় বর্তমানে চালের দাম ১০০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
যুক্তি দেখানো হতে পারে যে, মানুষের আয়ও তো এ সময়কালে অনেক বেড়েছে। এ কথা ঠিক! তবে প্রশ্ন হলো, কার আয় কতটা বেড়েছে? এ কথা মিথ্যা নয় যে, দেশের একশ্রেণির হাতেগোনা কিছু মানুষের আয় কেবল ৫০-৬০ গুণ নয়, তা লক্ষ-কোটি গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু চালের মূল্যবৃদ্ধির এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অধিকাংশ দেশবাসীর আয় বাড়েনি। পঞ্চাশ বছর আগে একজন অদক্ষ মাটি কাটার কামলার দৈনিক মজুরি ছিল আড়াই টাকা (মাসে ৭৫ টাকা)। সে ক্ষেত্রে বর্তমানে একজন আধাদক্ষ গার্মেন্ট শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি সেই তুলনায় মাত্র ৫০ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে মাসে সাড়ে তিন-চার হাজার টাকা। দেশের অধিকাংশ মানুষের আয়ের পরিমাণ অনেকটা এ রকমই। অতি সরল হিসাব এ কথাই বলে যে, গত ৫০ বছরে চালের দাম যদি ১০০ গুণ বেড়ে থাকে, আর আয় যদি বৃদ্ধি পেয়ে থাকে মাত্র ৫০ গুণ, তা হলে এ সময়কালের মধ্যে সাধারণ মানুষের চাল কেনার ক্ষমতা ৫০ শতাংশ কমেছে।
চালসহ কৃষিপণ্যের উৎপাদক হলো দেশের কৃষক। কিন্তু খুচরা ক্রেতার কাছে সরাসরি তাদের উৎপন্ন ফসল তারা বিক্রি করতে পারে না। কৃষকরা উৎপাদক হলেও তারা বাজারের প্রধান বিক্রেতা নয়। খুচরা দোকানদাররাও প্রধান বিক্রেতা নয়। মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া-কারবারিরা ‘প্রধান বিক্রেতার’ আসন দখল করে নিয়েছে। তারা উৎপাদনকারী না হয়েও ‘বিক্রেতাদের’ অশুভ সিন্ডিকেট গঠন করে কৃষক ও ক্রেতাসাধারণ উভয়ের কাছ থেকেই সুবিধা উঠিয়ে নিচ্ছে। এরাই বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করে। অগণিত ক্রেতাসাধারণের ওপর তারাই উচ্চমূল্যের বোঝা চাপিয়ে রাতারাতি বিপুল মুনাফা কামিয়ে নেয়। এই বোঝা বইবার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের না থাকায়, এর ফলে তাদের ওপর নেমে আসে সর্বনাশ!
চাল যেমন একটি পণ্য, মানুষের ‘শ্রমশক্তিও’ তেমনই একটি পণ্য। এ দেশের প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার চরিত্র এমনই যে, অধিকাংশ মানুষ যা বিক্রি করে সেই ‘শ্রমশক্তির’ দাম একটু-একটু করে বাড়লেও তা যে পরিমাণে বাড়ে তার চেয়ে লাফিয়ে-লাফিয়ে কয়েক ধাপ বেশি পরিমাণে বাড়ে সাধারণ মানুষ যা কিনে খায় তথা চালসহ সেসব পণ্যের দাম। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এটিই হলো একটি অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য।
বাজারে ‘শ্রমশক্তি’ ছাড়া অগণিত নানারকম পণ্য আছে। এসবের যে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে জনগণের আর্থিক বোঝা কমবেশি বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর মধ্যে যে পণ্যের পেছনে অধিকাংশ মানুষের আয়ের বৃহত্তর অংশ ব্যয় হয়, তার দাম বাড়লে এই আর্থিক বোঝা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়। অধিকাংশ মানুষ যে পণ্য কেনার জন্য তার আয়ের বৃহত্তম অংশ খরচ করে - সে পণ্যটি হলো মানুষের খাদ্যসামগ্রী। বাঙালির ক্ষেত্রে তা বিশেষভাবে হলো চাল। অন্যান্য পণ্যের তুলনায় চালের মূল্য যতটা বেশি পরিমাণে বাড়ে, তার বোঝা তত বেশি পরিমাণে অন্যান্য শ্রেণির মানুষের তুলনায় সাধারণ মেহনতি জনগণের কাঁধে অর্পিত হয়। এর ফলে যারা দরিদ্র তাদের আপেক্ষিক দারিদ্র্য আরও বৃদ্ধি পায়। সমাজে ধনবৈষম্য, শ্রেণিবৈষম্য আরও প্রসারিত হয়। এমনটাই বছর-বছর ধরে এ দেশে ঘটে চলেছে। বর্তমান পরিস্থিতিও তার ব্যতিক্রম নয়।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা যায়, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের আয়ের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ ব্যয় হয় চালের পেছনে। মফস্বলের একজন ভ্যানচালক দৈনিক যা আয় করে তা থেকে প্রথমেই তাকে পরিবারের জন্য ২ কেজি চাল কিনে নিতে হয়। বর্তমানে এই ২ কেজি মোটা চালের দাম ১০০ টাকায় উঠে গেছে। চাল কেনার পর তার হাতে অবশিষ্ট থাকা টাকা দিয়ে তাকে তেল-লবণ-সবজি ইত্যাদি কিনতে গিয়ে বেসামাল হয়ে পড়তে হয়। সংসারের অন্যান্য গৃহস্থালি খরচ, চিকিৎসা-শিক্ষা ব্যয় ইত্যাদির কথা না হয় বাদই দিলাম। দেশের ৪০ লাখ গার্মেন্ট শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও তাদের স্বল্প আয়ের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ চাল কেনার পেছনেই খরচ হয়ে যায়। অথচ যাদের আয় বেশি, তারা সবচেয়ে উঁচু মানের চাল কিনে খেলেও সে জন্য তাদের তাদের আয়ের ১০-১৫ শতাংশের বেশি খরচ করতে হয় না (বাসার কাজের লোক, দারোয়ান প্রমুখের জন্য চাল কেনার খরচসহ)। কোটিপতিদের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ যে আরও নগণ্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে চালের মূল্যবৃদ্ধির চাপ অবস্থাপন্নদের তুলনায় জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, অর্থাৎ সমাজের দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের ওপর বহুগুণ বেশি চেপে বসে। এই চাপ পরিহার করার কোনো উপায় তাদের নেই। কারণ বেঁচে থাকার জন্য আগে খাদ্যের ব্যবস্থা করে নিয়ে তার পর অন্য খরচের কথা আসে। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত বাঙালির ভালো-মন্দ এখনো তাই চালের দামের ওপর একান্তভাবে নির্ভর করে।
এ প্রসঙ্গে বহুদিন আগের, আশির দশকের একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমি তখন ক্ষেতমজুর সমিতির সাধারণ সম্পাদক। আশ্বিন-কার্তিকের মঙ্গার কারণে বাজারে চাল তখন দুর্মূল্য। ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য টেস্ট রিলিফ, ওয়ার্কস প্রোগ্রাম, কাবিখা প্রভৃতি প্রকল্পের কাজ বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি করার দাবি নিয়ে আমরা তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রীর কাছে ডেপুটিশন নিয়ে গিয়েছিলাম। মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়ও আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন। অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে আমি মন্ত্রীকে বললাম, ‘মানুষের পেটে এখন ভাত নেই। অনাহারে থাকতে হচ্ছে। কচু-ঘেচু খেয়ে তাদের দিন কাটাতে হচ্ছে...।’ কচু-ঘেচুর কথা তার কানে ঢুকতেই সচিব মহোদয় উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘এটা তো ভালো কথা! কচু তো ভালো জিনিস, তাতে প্রচুর আয়রন আছে।’ কিংবা সেই বিশ্বখ্যাত ঘটনাটির কথাই মনে করুন না কেন? ফরাসি বিপ্লবের আগে রাজপ্রাসাদের জানালা থেকে প্যারিসের রাজপথে ক্ষুধার্ত মানুষের ক্রোধান্বিত বিশাল মিছিল দেখে রানি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এরা চিৎকার করে কী চাচ্ছে?’ তার অনুচররা জবাব দিয়েছিল, ‘দেশে রুটির অভাব। তাই এরা রুটির জন্য চিৎকার করছে।’ রানি পাল্টা উক্তি করেছিলেন, ‘রুটি নেই তাতে তারা ক্রদ্ধ কেন? রুটির অভাব ঘটে থাকলেও ওরা তো কেক খেলেই পারে।’ কচু-ঘেচু অথবা কেক নিয়ে সচিব মহোদয় বা রানির এসব উক্তিতে যত নির্মম রসিকতাই থাকুন না কেন, বড় সত্য হলো এই যে, বাঙালির চাই ভাত। দিন আনি-দিন খাই ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসীর জন্য চালের দামের সঙ্গে তাদের বেঁচে থাকার প্রশ্ন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়ে আছে।
বিভিন্ন হিসাব থেকে দেখা যায়, গত এক বছরে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ। গত বছর মুদ্রাস্ফীতির হার যেখানে ছিল ৭.৩ শতাংশ সেখানে শুধু চালের মূল্যবৃদ্ধি এককভাবেই ৫০ শতাংশ হওয়ার ঘটনায় এ কথা প্রমাণিত হয় যে, মুদ্রাস্ফীতির প্রধান চাপ পতিত হয়েছে দরিদ্র-মধ্যবিত্ত মানুষের ওপর। চাল ছাড়া অন্যান্য বেশিরভাগ পণ্যের দাম, বিশেষত বিত্তবানরা যেসব জিনিসপত্র কেনার পেছনে তাদের আয়ের সিংহভাগ খরচ করে তার দাম বেড়েছে ৭.৩ শতাংশের চেয়ে অনেক কম। যেমন কিনা সোনার দাম বেড়েছে ২.৫৯ শতাংশ হারে, যা গত কয়েকদিনে এখন উল্টো আরও কমতে শুরু করেছে। বাজারদর বৃদ্ধির এই বিভাজিত (differentiated) হারের কারণে সমাজে গত এক বছরে ধনবৈষম্য-শ্রেণিবৈষম্য ক্রমাগত আরও বেড়ে যাচ্ছে। যে ব্যবস্থায় দেশের অর্থনীতি পরিচালিত হচ্ছে তাতে মূল্যবৃদ্ধির এই বিভাজিত হার অব্যাহতই থাকবে এবং এর ফলে গরিব আরও গরিব হওয়া আর ধনী আরও ধনী হওয়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকবে - এটিই স্বাভাবিক।
শুধু আয়ের পার্থক্যের বিষয়টিই নয়, শ্রেণিভেদে কে কোন মানের চাল খায় সেটিও শ্রেণিবৈষম্য বৃদ্ধির উৎস হয়ে ওঠে। বাজারে বিভিন্ন মানের চাল পাওয়া যায়। একেক মানের চালের দাম একেকরকম। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গরিব মানুষরা যেসব নিম্নমানের মোটা চাল খায় সেসবের মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় উচ্চবিত্তরা যেসব উন্নত মানের চাল খায় সেসবের দাম বৃদ্ধির পরিমাণ অনেকটাই কম। চালের মূল্যবৃদ্ধির চাপ ‘হজম’ করার ক্ষমতা উচ্চবিত্তদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্যই ‘বাজারের’ এহেন উদার ‘কনসেশন’ বিস্ময়কর মনে হতে পারে। কিন্তু এরই নাম পুঁজিবাদী বাজার! এটিই হলো পুঁজিবাদের ‘অসম বিকাশ তত্ত্বের’ মূর্ত একটি দৃষ্টান্ত।
কয়েক বছর আগে প্রস্তুত করা কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ৫ বছরের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গরিব মানুষ যে মোটা চাল খায় তার ক্ষেত্রে বার্ষিক গড় মূল্যবৃদ্ধির হার হলো ১৬ শতাংশ, মাঝারি মানের চালের ক্ষেত্রে তা ১১.৩ শতাংশ এবং উন্নত মানের সরু চালের ক্ষেত্রে তা ১৩.৫ শতাংশ। গত এক বছরে এবং সাম্প্রতিক সময়ে এই বিপরীতমুখী বৈষম্য আরও বেড়েছে।
চালের বাজার নিয়ে এই সামগ্রিক ‘চালবাজির’ অবসান ঘটানো প্রয়োজন। এ জন্য যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা আবশ্যক সেগুলো হলো - সারা দেশে শক্তিশালী দক্ষ দুর্নীতিমুক্ত ‘গণবণ্টন ব্যবস্থা’ চালু করা, গরিব নাগরিকদের জন্য স্থায়ী রেশনিং ব্যবস্থা প্রবর্তন, টিসিবিকে প্রকৃতই সচল ও শক্তিশালী করা, কসকোর দোকান চালু করা, উৎপাদক-সমবায় ও ক্রেতা-সমবায় গড়ে তুলে তাদের মধ্যে ‘ডাইরেক্ট টু ডাইরেক্ট’ অর্থাৎ সরাসরি বিপণন কার্যক্রম গড়ে তোলা, ন্যায্যমূল্যের সরকারি দোকান খোলা, সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর বাফার স্টক গড়ে তোলা ইত্যাদি। কিন্তু তা করার জন্য ‘পুঁজিবাদী অবাধ বাজার অর্থনীতি’র ভ্রান্ত ও ক্ষতিকর পথ পরিত্যাগ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারা ও রাষ্ট্রীয় চার নীতির পথে দেশকে ফিরিয়ে আনতে হবে। সমাজতন্ত্র অভিমুখিন অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করতে হবে।
বর্তমান সরকার সে পথ গ্রহণ না করে উল্টো পথে হাঁটছে। তাই চালসহ নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সেই শক্তিকেই ক্ষমতায় আনতে হবে, যে এই উল্টো পথের বদলে মুক্তিযুদ্ধের ধারার সোজা পথ ধরে চলবে।

লেখকঃ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি


 Post-editorial written by Mujahidul Islam Selim published in the 1st. October issue of Daily Amader Shomoy.

বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

নারী শ্রমিকের কান্না ও পুরুষতন্ত্র

সময়টা বেশি দিন আগের নয়। এইতো ২০১১ সালের ঘটনা। পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী আমি। সারাদিন সাংগঠনিক কাজ শেষে রাতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের সাথে রাত্রিযাপন। তাদের জীবন-সংগ্রাম সম্পর্কে জানাবুঝার চেষ্টা। একেক দিন একেক শ্রমিকের বাসায় রাত্রিযাপন। ভোর ছটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত তাদের ব্যস্ত জীবন। তাদের সাথে গল্প করার মতো সময় নেই। তাই বেছে নিই বিকল্প পথ। ভোরে উঠে হাঁটতে হাঁটতে তাদের সাথে গার্মেন্টেস যাওয়া, দুপুরে খাবার সময় গার্মেন্টেসের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ গল্প করা। নিতান্তই গল্প, তাদের কাছ থেকে তাদেরই কথা শোনা। তাদেরই জীবন-যাপন জেনে নেওয়ার চেষ্টা মাত্র। এইভাবেই চলছিল ‘বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলনে’র কাজ। 
শ্রমিকদের সাথে সম্পর্কটা বেশ জমেই উঠেছিল। একদিন কোনো কারণে তাদের কাছে যেতে না পারলেই ‘আফা’ কই, কেন আসেন নি? এইসব প্রশ্নের জবাব দিতেই হতো। এটা ছিল ভয়াবহ অনুভূতি। 
শ্রমিকদের ভালোবাসা, তাদের আন্তরিকতা, তাদের শ্রদ্ধা ধীরে ধীরে আমাকে একজন পরিপূর্ণ সংগঠক হিসেবে গড়ে তুলেছিল। 
এই কথাগুলো বলার পিছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে! গার্মেন্টস শ্রমিকদের মাঝে কাজ করার পাশাপাশি আমার আরো কিছু সাংগঠনিক কাজ করতে হতো। মূল কাজটা ছিল- গার্মেন্টস শ্রমিকদের মাঝে সংগঠন গড়ে তোলা। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবারের রাত। রাত দশটা। চারজন নারী শ্রমিক একটি বাসা নিয়ে থাকেন। আমিও ওদের সঙ্গী হই মাঝেমধ্যেই। সেদিনও তাদের সঙ্গী। নানান খোশগল্প, কারো প্রেম কাহিনী, কারো বাবা, মায়ের গল্প। আমিও বেশ মনোযোগী শ্রোতা।
সেদিন রাতেই আমার পুনর্জন্ম হয়। আমি নিজেকে পড়ি, শিখি। চারজনই বিবাহিত শ্রমিক। চারজনেরই বিয়ে হয়েছিল। গার্মেন্টসে চাকরি করা অবস্থায় স্ব স্ব পছন্দে বিয়ে করেন। কারো সংসারই একবছরের বেশি টিকেনি। সম্পা নামের শ্রমিকটির একটি সন্তানও রয়েছে। সম্পার দুচোখের কান্নায় আমি বুঝতে পেরেছিলাম- পুরুষতন্ত্র। কতটা নির্মম! এই ব্যবস্থাপনা! কতটা বর্বর, আমাদের এই পুঁজিবাদী, ভোগবাদী ব্যবস্থা! 
শুনুন, সম্পা ছেলেটিকে ভালোবেসে বিয়ে করার পর থেকেই নির্যাতিত, নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, অবহেলিত ছিলেন। শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে। সম্পার স্বামীও শ্রমিক ছিলেন- গার্মেন্টস শ্রমিক। সম্পার ভাষ্যমতে, তার স্বামী ছিল শারীরিকভাবে অক্ষম। এই অক্ষমতাকে কোনোভাবেই স্বীকার করতেন না। বরং সম্পার পুরো শরীর কামড়িয়ে দাগ বসিয়ে দিতেন। ওটাই তার পুরুষত্ব। রাতের পর রাত তার এই পুরুষত্বের শিকার হতেন সম্পা। এই অসহনীয় নির্যাতনকে কোনোভাবেই নিতে পারেননি সম্পা। স্তন, নাভি, যৌনাঙ্গ কামড়িয়ে রক্তাক্ত করে দিতেন। পরের দিন বিছানা থেকে উঠে তার গার্মেন্টেসে যাওয়ার মতো অবস্থা থাকতো না। কিন্তু বাধ্য ছিলেন সম্পা। তার যে শ্রম বিক্রি করতেই হবে, যেতেই হবে ওই মৃত্যুকূপে। সম্পার পাশে ছিল না কেউ-ই।
এমনি অবস্থায় সম্পার গর্ভে সন্তান আসে। যে সন্তানটিকে ঘিরে ছিল সম্পার জীবনে নির্মম অভিজ্ঞতা। তার স্বামী সন্তানটিকে নষ্ট করার জন্য রাতদিন চাপ দিতেই থাকেন। এই অসহনীয়, অভাবনীয় নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও এই সংসারটিকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল তার। কিন্তু যখন, তার মাতৃত্বকে শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছিল- তখনই ঘুরে দাঁড়ায়, শক্তভাবে, দৃঢ়ভাবে। সম্পা গার্মেন্টেসের যাওয়ার কথা বলে অচেনা পথে পাড়ি জমায়। সম্পা আর ফিরে যায় নি- ওই নরপিচাশের কাছে। সম্পার দুচোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছিল সেদিন। ‘আমি ভালো আছি আফা, আমি খুব ভালো আছি, আমি পুরুষদের থু থু দেই, দরকার নেই পুরুষের, প্রয়োজনে নিজের শরীরে নুন লাগাবো, তবুও পুরুষের কাছে যাবো না।’ পুরুষের প্রতি সম্পার এই ক্ষোভটাকে আপনি কিভাবে দেখবেন? আমি কিন্তু নেগেটিভভাবে নিতে পারছি না- কারণ সম্পা পুরুষতন্ত্র বুঝে না, পুঁজিবাদ বুঝে না, ভোগবাদ বুঝে না, সংস্কৃতি বুঝে না। তার বোঝ ওই পুরুষরা খারাপ। পুরুষ মানুষই খারাপ। না হলে, কেন আমাকে রাতের পর রাত কামড়াতো, কেন আমাকে যৌন সুখের বদলে যৌনাঙ্গ কামড়িয়ে ধরতো? যৌক্তিকতা আছে কিন্তু! সম্পা শুধু তার জীবনটাকেই বুঝে, জীবনসংগ্রামের যুদ্ধকে বুঝে। সম্পা, সেদিন বলেছিল- ‘আফা বহুত নারী এই অবস্থার শিকার কিন্তু বলে না, তাদের কিসের জানি ভয়! প্রেস্টিজবোধ, আমারও তা ছিল। কিন্তু এই বোধকে লাথি মেরেছিলাম, সমাজের মুখে চুনকালি মেখেছিলাম। তাতে আমার পাপ হয়েছে। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন না এটুকুও জানি। কিন্তু আমার সন্তানের জন্য আমি এটা করেছি।’ দেখুন, সম্পার সৎ মনোভাবকে। বুঝুন তার সরল অনুভূতিকে! সম্পা জীবনসংগ্রামে জয়ী। তার সন্তানটি আজ তার অবলম্বন।
এটি এক সম্পার গল্প। এরকম লক্ষ সম্পারা আজ পদদলিত। পুরুষতন্ত্রের কালোছায়ায় নিমজ্জিত। পুরুষতন্ত্রের ভয়াল আঘাতে জর্জরিত তাদের জীবন। কিন্তু এই যে, পুরুষতন্ত্রের ভয়াবহতা, নির্মমতা। এটা কিন্তু একদিনে জন্ম নেয় নি। সেই যে আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে দাস সমাজে রূপান্তরিত হলো- সেদিনই পুরুষতন্ত্র চেপে বসলো। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পুরুষতন্ত্রের কালোছায়া। যার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত পুঁজিবাদের ভয়াল আগ্রাসন। দাস সমাজে পুঁজির যে বিকাশ, সেই বিকাশই নারীকে অধস্তন করে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল। নারীরা তারপর আর এই ভয়ালতা থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারেনি। 
যারা নারীবাদী শ্লোগান তুলেন বা নারীবাদের মধ্যদিয়েই সকল কিছুর সমাধান খুঁজেন তাদের বলছি পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলুন, আওয়াজ তুলুন। কেননা, পুঁজিবাদের ওই ভয়ালথাবা থেকে আপনি/আমি/আমরা কেউ-ই রক্ষা পাবো না/পাচ্ছি না। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় কোনোভাবেই ‘নারীমুক্তি’ সম্ভব না। পুঁজিবাদ নারীকে পণ্য বানিয়ে রেখেছে, আমাদের নারীসমাজই সাময়িক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে এই পণ্যকে লুফে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এই যে, বাধ্য হওয়াটাকে ঠেকাতে হবে। চিন্তাশক্তিকে মনুষ্য চিন্তাশক্তির শামিল করতে হবে। অর্থনৈতিক মুক্তির সাথে নারীদের চিন্তার মুক্তিটা জরুরি। একজন নারী সমাজের সবচেয়ে উচ্চপদস্থ হয়েও পুরুষতন্ত্রের ভয়ালথাবার শিকার হন/হচ্ছেন। কেননা, তার চিন্তাটা ওই পুরুষতন্ত্রেই ধারক-বাহক। শুনতে খুব তিতে শোনা গেলেও, নারীরা পুরুষতন্ত্রকে সন্তানেরই মতো লালন-পালন করছেন বা করতে বাধ্য হচ্ছেন। এটা জেনে হোক বা না বুঝে হোক। এই ধারণ করার মানসিকতাকে সচেতনভাবেই পরিত্যাগ করতে হবে। এই সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে দেখাতে হবে নারীও মানুষ। নারী সমাজকে পরিচালিত করতে পারে, নারী এই পুঁজিবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলতে পারে। ইতিহাসের দিকে তাকালে কিন্তু আমরা এর সত্যতা পেয়ে যাবো। নারী সমাজের অগ্রাধিকার ভূমিকাটা আজ এই মুহূর্তে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 
এই সকল অন্যায়, বৈষম্য, নির্যাতন, নিপীড়ন সকল কিছুর মূলে পুঁজিবাদী সমাজের ভয়াল আগ্রাসন। এই আগ্রাসন থেকে রক্ষা পেতে হলে সকল জাতিগোষ্ঠির একটি সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি। এই নারীমুক্তিও সকল মানবমুক্তির সাথে জড়িত। সকল আন্দোলন-সংগ্রামই শ্রেণিসংগ্রামের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং, আন্দোলন সংগ্রামের মূল হাতিয়ার হোক শ্রেণীবৈষম্য।
জয় হোক মানবতার।
লেখক: লাবণী মণ্ডল, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট

ভগৎ সিং এর জীবনদর্শন


 
২০১৪ সাল, আমার জীবনে ভগৎ সিংয়ের আবির্ভাব। যে মানুষটির নামও তখন শুনি নি। শহীদ মিনার বসে আছি, সাথে এক বড় ভাই। তিনিই আলোচনার ফাঁকে ভগৎ সিংকে নিয়ে আলোচনা উঠালেন। আমি বিস্ময়াভিভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম- ভগৎ সিং কে? তুমি ভগৎ সিংয়ের নাম জানো না? না, জানি না তো! তিনিই শুনালেন ভগৎ সিংয়ের জীবন-দর্শন। বললেন, ‘বিপ্লবীদের কথা প্রকাশনা’ থেকে ‘ভগৎ সিংয়ের জবানবন্দি’ বই প্রকাশ হয়েছে, কিনতে পারো। 

বইটি কিনে পড়া শুরু করলাম। নিজের অজ্ঞতাকে ধিক্কার দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ পেলাম না। যতই পড়ছি, ততই অবাক হচ্ছি। এই মানুষগুলো সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, কতটা অজ্ঞ- অথচ কতটা জ্ঞানী মনে করি নিজেকে! মাত্র ২৪ বছরের একজন মানুষ- ভগৎ সিং। ধর্ম, রাজনীতি, আস্তিক, নাস্তিক, বস্তুবাদকে কতটা বাস্তবিক দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করেছেন! বইটি দু’তিনবার পড়লাম। এছাড়াও ভগৎ সিংকে নিয়ে লিখিত আরো বেশ কয়েকটি বই পড়া শুরু করলাম। যেমন: ‘আমাদের ভগৎ’, স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা’, ভগৎ সিংয়ের জেল ডায়েরি ও কেন আমি নাস্তিক। ভগৎ সিংয়ের লেখা- ‘কেন আমি নাস্তিক’ বইটি পড়ে রীতিমতো অবাক হলাম। একজন মানুষ কতটা জ্ঞানী হলে- এত সুন্দর-সাবলীলভাবে নাস্তিক-আস্তিকের ব্যাখ্যা দিতে পারেন। আমাদের বর্তমান নাস্তিক সমাজ বইটি পড়ে ফেলতে পারেন। আস্তিক-নাস্তিকতার ব্যাখ্যা ১৯২৬ সালেই ভগৎ সিং দিয়ে গেছেন। আর এখন আমরা কতটা হীন জায়গা থেকে আত্মম্ভরীতা দেখাই! বইগুলো পড়ার পর থেকেই ইতিহাসের ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের জীবন-কর্ম-দর্শন পড়ার আগ্রহ বেড়ে গেল। 
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে হাজার হাজার বিপ্লবী প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। পরোক্ষভাবেও যুক্ত ছিলেন অসংখ্য সংগ্রামী মানুষ। এই বিপ্লববাদী আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শত শত ছাত্র-তরুণ-যুবকরা যুক্ত ছিলেন। এঁদের মধ্যে হাতেগোনা চার-পাঁচজনের নাম ও কিছু কিছু ইতিহাস আমরা জানি। এই অজানার বাইরে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই বললেই চলে। 
২০১৪ সাল নাগাদ এতটুকু জানাশোনাই ছিল আমার। কিন্তু এরপরে ‘বিপ্লবীদের কথা প্রকাশনা’ থেকে ‘শত বিপ্লবীদের কথা’ নামে একটি বই সংগ্রহ করি। বইটি দেখেই হতবাক হয়েছিলাম যে, ‘শত বিপ্লবীদের কথা’ এতে কাদের জীবনী রয়েছে? বইটি উল্টিয়ে ভালো করে দেখলাম- সূচিপত্র। ভূমিকা দেখে আরও অবাক হলাম- শত জন বিপ্লবীই আমাদের উপমহাদেশের। তার মধ্যে আবার বাঙালি বিপ্লবীর সংখ্যাই বেশি। যাই হোক, শত বিপ্লবীদের কথা বইটি পড়ার আগে আমার পূর্বসূরী লড়াকুদের সম্পর্কে জ্ঞান খুবই সামান্য ছিল- যা উপরে উল্লেখ করেছি। সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম, তিতুমীর, ইলা মিত্র, প্রীতিলতা সামান্য হলেও জানতাম- কিন্তু এর বাহিরে, শত শত জনের নাম পর্যন্ত জানতাম না। এই বইটির ভূমিকাতে আরও লেখা ছিল যে, পরবর্তীতে এই শত বিপ্লবীদের জীবনী নিয়ে ধারাবাহিকভাবে বই প্রকাশ হবে। এখন অপেক্ষায় আছি ‘শত বিপ্লবীদের কথা’ দ্বিতীয় খণ্ড কখন বের হবে!
ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ইতিহাসের প্রত্যেকটি লড়াই-সংগ্রামে লড়াকুদের অবদান। আমরা অনেকেই ইতিহাসের লড়াকুদের জানি না, জানতে চাই না। এক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীসমাজ অনেকাংশে পিছিয়ে রয়েছে। আমরা আমাদের পূর্বসূরীর ইতিহাস জানি না বললেই চলে। একটি উদাহরণ টানছি, ‘ভারত উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে’র- ইতিহাসই কতটা জানি আমরা! ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই বা কতটা জানি! 
জন্ম থেকে মৃত্যু, এই চলার পথটির নামই জীবন। কিন্তু সব জীবন অর্থবহ হয় না। সবার জীবন নিয়ে জীবনী হয় না, তাই ইতিহাস তাদের ধরেও রাখে না। ইতিহাস ধরে রাখে শুধু তাদেরই, যারা হয়ে উঠেন বিশিষ্ট ও অনন্য-অসাধারণ জীবনের অধিকারী। যে জীবনকে সবাই শ্রদ্ধা করে। আবার অনেকে অনুকরণ-অনুসরণ করার চেষ্টা করে। এমন জীবন শুধু জন্মসূত্রে পাওয়া যায় না, এটা অর্জন করতে হয়, তৈরি করতে হয় কঠোর শ্রম, গভীর নিষ্ঠা ও আত্মত্যাগ দিয়ে। এর জন্য তৈরি কোনো পথ নেই, পথ তৈরি করে এগোতে হয়। সেক্ষেত্রে প্রেরণা হয়ে পথ দেখায় এক মহৎ জীবনবোধ, আদর্শবোধ ও দেশপ্রেম। দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার মহান আদর্শে দীক্ষিত এমনি কিছু মুক্তি-পাগল মানুষ ‘জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য’ করে সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কাফেলায়। যে কাফেলায় শামিল হয়েছিলেন বিপ্লবী ভগৎ সিং।
অগ্নিযুগের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা থেকেই ঢাকার অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর পার্টি, চট্টগ্রামের দি ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স, মালামার বিপ্লবীদল, কলকাতার অনুশীলন সমিতি, মেদিনীপুর বিপ্লবী দল, বিপ্লবী কমিউনিস্ট সংগঠন, স্বরাজ পার্টিসহ অন্যান্য বিপ্লবী দল স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এসব দলের অসংখ্য বিপ্লবী সদস্যরা ভারত মাতার স্বাধীনতার জন্য জীবন বলিদানের মন্ত্র সানন্দে গ্রহণ করেন এবং তাদের মধ্যে অনেকেই ফাঁসিমঞ্চে জীবন উৎসর্গ করেন। বিপ্লবী ভগৎ সিং এই জীবন উৎসর্গকারীদের একজন।
আজকের তরুণ প্রজন্ম কতটুকু জানে সেই সমস্ত বিপ্লবীদের সম্পর্কে, যারা জীবন দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা এনেছিলেন! 
‘যে মানুষ প্রগতির পক্ষে তাকে পুরোনো বিশ্বাসের প্রত্যেকটি বিষয়কেই চ্যালেঞ্জ করতে হবে। যথেষ্ট যুক্তিতর্ক ও বিচার-বিবেচনার পর যদি কেউ কোনো তত্ত্ব বা দর্শনে বিশ্বাস স্থাপন করে, তবে তার বিশ্বাসকে স্বাগত জানাতে হয়। তার চিন্তাভাবনা ভুল বা বিভ্রান্তিকর হতে পারে। কিন্তু তা শোধরানোর সুযোগ আছে, কারণ সে পরিচালিত হয় বিচারবুদ্ধির দ্বারা, অন্ধবিশ্বাসের দ্বারা নয়। বিশ্বাস ও অন্ধবিশ্বাস বিপজ্জনক, তা মস্তিষ্ককে অকেজো করে দেয়, মানুষকে প্রতিক্রিয়াশীল বানিয়ে তোলে।’ -ভগৎ সিং
ভগৎ সিংয়ের এই বিখ্যাত উক্তিটি যেদিন থেকে মাথায় ঢুকে গেছে, সেদিন থেকেই বুঝতে পারছি- প্রগতিশীলতা কি, দর্শন কি? কতটা সহজ-সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ‘বিশ্বাস ও অন্ধবিশ্বাস বিপজ্জনক’ এই কথাগুলো পড়ার পর অবশ্যই নাস্তিকতা নিয়ে আর আলোচনার অপেক্ষা রাখে না, আমি নাস্তিক তার প্রমাণ দেওয়ার জন্য রাস্তায় নামতে হয় না?
ভগৎ সিং পার্টি বলতে কি বোঝায় এবং কোন ধরনের পার্টি চাই - এ সব বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন-
“লেনিনের অতি প্রিয় যে জিনিসটা সেই প্রফেশনাল বিপ্লবীদেরই আমাদের প্রয়োজন- এঁরা হচ্ছেন সর্বক্ষণের কর্মী, বিপ্লব ছাড়া এঁদের জীবনের আর কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা কাজ নেই। পার্টিতে সংগঠিত এরকম কর্মী সংখ্যা যতো বেশি ততো বেশি করে তোমাদের সাফল্যের সম্ভাবনা বাড়বে।”
“সুসংবদ্ধভাবে অগ্রসর হলে যেটা তোমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেটা হলো একটা পার্টি, যাতে থাকবে উপরে আলোচিত ধরনের কর্মীদল যাদের লক্ষ্য ও পথ সম্বন্ধে থাকবে স্বচ্ছ চিন্তাধারা, কর্মক্ষেত্রে যথাযথ উদ্যোগ আর দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। পার্টিতে থাকবে লৌহদৃঢ় শৃঙ্খলা। এই পার্টিকে যে গোপন পার্টি হতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। জনগণের মধ্যে প্রচারের কর্মসূচী নিয়ে পার্টিকে কাজ শুরু করতে হবে।... কৃষক ও শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য, তাদের সক্রিয় সমর্থন লাভের জন্য এই প্রচারকার্য একান্ত প্রয়োজনীয়। পার্টির নাম হবে কমিউনিস্ট পার্টি। রাজনৈতিক কর্মীদের এই পার্টি, কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ এই পার্টিই অন্যান্য সব আন্দোলন পরিচালনা করবে...।” - ভগৎ সিং
সেই ১৯২৬ সালে তিনি পার্টি, রাজনীতি, সংগঠনের ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন। কৃষক ও শ্রমিকদের পার্টি গড়ে তোলার কথা বলেছেন। শৃঙ্খলা, আদর্শ, দর্শন, চিন্তা, লক্ষ্যের কথা সুস্পষ্টভাবে লিখনীর মাধ্যমে জানিয়ে গেছেন- আমাদের প্রজন্মকে। কিন্তু আমরা কতটা জানি, এই ইতিহাস!
ভগৎ সিং বলেছিলেন, 'বিপ্লব মানে রক্তক্ষয়ী হানাহানি নয়। বিপ্লবের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কোনো প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসা মেটাবারও সম্পর্ক নেই। বিপ্লবের অর্থে বোমা বা পিস্তলের চর্চাও বোঝায় না। ‘বিপ্লব’ বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা যা কিনা জ্বলন্তরূপে অন্যায়ের কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেই ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন।’
ভগৎ সিং, একটি নাম- একজন বিপ্লবীর নাম। তিনি জন্মেছিলেন ১৯০৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। পশ্চিম পাঞ্জাবের লায়লাপুর জেলার বংগা গ্রামে। একসময় পাঞ্জাবের ওই অঞ্চলে জলের অভাবে চাষ-আবাদ কিছুই হত না। উনিশ শতকের শেষদিকে মধ্য পাঞ্জাবের বেশ কিছু লোক উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে এসে প্রচুর পরিশ্রম করে খাল কেটে চাষবাস শুরু করেন। ভগৎ সিংয়ের পূর্বপুরুষ ছিলেন এদের দলে। এরা ছিলেন দুঃসাহসী, কঠোর পরিশ্রমী আর স্বাধীন চিন্তার মানুষ। এদের বলা হত জাঠ।
ভগৎ সিংয়ের প্রাথমিক পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর স্কুলে পড়ার পালা। কিন্তু ভগৎ সিং তার সমবয়সী ছেলেদের মত লাহোরের খালসা হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন নি। কারণ এই স্কুলে লেখাপড়া করলে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য দেখাতে হয়। যে কারণে তার ঠাকুরদাদা তাঁকে এখানে পড়াশুনা করাতে রাজি ছিলেন না। তিনি ভগৎ সিংকে অন্য একটি স্কুলে পড়াশুনা করানোর সিদ্ধান্ত নেন। তারপর ভগৎ সিংয়ের বাবা তাঁকে আর্যসমাজি বিদ্যালয় দয়ানন্দ অ্যাংলো-বৈদিক স্কুলে ভর্তি করেন।
এই স্কুলে পড়াশুনাকালে হঠাৎ একদিন দুপুর বেলা ভগৎ সিংকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। স্কুলের সবাই বাড়ি ফিরেছে, কিন্তু ভগৎ সিংকে কোথাও পাওয়া গেল না। সে তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। বয়স মাত্র ১২ বছর। সবাই তাকে খুঁজতে বেরোল। ওদিকে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, আতঙ্কে সবাই ছুটাছুটি করছেন। স্কুলে খবর নিয়ে জানা গেল ভগৎ সিং যথারীতি ক্লাস করেছে; তারপর কোথায় গেছে কেউ জানে না। অনেক রাতে ভগৎ সিংয়ের দেখা মিলল। হাতে জালিয়ানওয়ালাবাগের শত শহীদের রক্ত মাখা মাটি। স্কুল থেকে বেরিয়ে শুনেছে সেই মর্মান্তিক ঘটনা, তারপর বাসে করে ৪০/৫০ মাইল দূরে অমৃতসরে ছুটে গেছে সে, সেখানকার ত্রাস ও দুর্যোগের পরিবেশ উপেক্ষা করে কুড়িয়ে এনেছে সে রক্তরঞ্জিত মাটি। এই মাটি তার কাছে সোনার চেয়েও খাঁটি। এ মাটি বিদ্রোহের প্রতীক।
গান্ধীজী ১৯২১ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের মাধ্যমে বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করলেন। বিপ্লবীদেরকে অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত হতে বললেন। তিনি বিপ্লবীদের জানালেন অসহযোগ আন্দোলন করে এক বছরের মধ্যে স্বরাজ এনে দিবেন। যদি না পারেন তাহলে বিপ্লবীরা আবার সশস্ত্র সংগ্রামে সামিল হলে তার বলার মতো কিছু থাকবে না। গান্ধীজীর অনুরোধে বিপ্লবীরা সাময়িকভাবে সম্মত হন। এসময় কিশোর ভগৎ সিং অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত হন। তিনি নিজ এলাকাতে অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি সহপাঠীদের সাথে নিয়ে বিলাতী কাপড় জোগাড় করে মহানন্দে পোড়াতে শুরু করেন। তখন তার বয়স মাত্র ১৪ বছর। ওই বয়স থেকে তিনি ইউরোপীয় বিপ্লবী আন্দোলনের উপর পড়াশোনা করেন এবং শেষ পর্যন্ত মার্ক্সবাদে আকৃষ্ট হন। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে তিনি একদিন ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ঘৃণা প্রকাশ করার জন্য তার সরকারি স্কুল বই ও স্কুল ইউনিফর্ম পুড়িয়ে ফেলেন।
এক বছরের মধ্যে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এতে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ যুক্ত হয়। ১৯২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর জেলার চৌরীচেরা গ্রামে কৃষকদের শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন হটিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশ জনতার উপর গুলি চালায়। এতে কয়েকজন কৃষক মারা যায়। ফলে বিক্ষুব্ধ জনতা থানা ঘেরাও করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। থানার ভিতর ২২ জন পুলিশ পুড়ে মারা যায়। এতদিন ধরে ব্রিটিশ প্রসাশন যে পরিমাণে ভারতের স্বাধীনতাকামী জনগণের উপর অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে সে তুলনায় এটি কিছুই নয়, একটি বিক্ষিপ্ত দুঃখজনক ঘটনা। তবু গান্ধীজী এই ঘটনার কারণে অসহযোগ আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ান।
অসহযোগ আন্দোলন থেমে যাওয়ার পর ভগৎ সিং ‘শিখ গুরুদ্বার’ সংস্কারের কাজে যুক্ত হন। শিখ ধর্মের নানা অনুষ্ঠান যেখানে পালিত হয়, সেই মন্দিরকে বলে গুরুদ্বার। এইসব গুরুদ্বারে যে আয় হত তার প্রায় বড়ো অংশটাই পুরোহিতেরা নিজেদের ব্যক্তিগত বিলাসে ব্যয় করতেন। গুরুদ্বার সংস্কার আন্দোলনের নেতারা বললেন, তা হবে না। নির্বাচিত প্রতিনিধি দল গঠন করতে হবে। তারাই আয়-ব্যায়ের হিসাব রাখবেন। এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে ভগৎ সিং বড়ো বড়ো চুল রাখলেন, কোমরে ঝোলালেন শিখ ধর্মের নিয়ম অনুসারে কৃপাণ নামে তলোয়ারের চেয়ে ছোট একটা অস্ত্র, মাথায় পড়লেন বড়ো কালো পাগড়ি। সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে ভগৎ সিং তার ‘কেন আমি নাস্তিক?’ বইয়ে লিখছেন, ‘সেই সময়ে আমি লম্বা লম্বা চুল রাখতে থাকি। কিন্তু শিখ বা অন্য কোন ধর্মের পৌরাণিক কাহিনী বা মতবাদে আমি আস্থা রাখতে পারিনি। তবু ঈশ্বরে আমার খুব বিশ্বাস ছিল।’
মেট্রিক পাশ করার পর ভগৎ সিং ন্যাশনাল কলেজে (স্বদেশি বিদ্যালয়) ভর্তি হন। এই কলেজে ভগৎ সিং দুজন বিশিষ্ট অধ্যাপকের কাছে পড়াশুনার সুযোগ পান। অধ্যাপক পরমানন্দের কাছে শুনলেন ইতিহাসের কত জানা-অজানা কাহিনী। শুনলেন আন্দামান জেলে বন্দী বীর দেশপ্রেমিকদের কথা। অধ্যাপক নিজেই এই আন্দামানে বহুদিন বন্দী জীবন কাটিয়েছেন।
অধ্যাপক জয়চন্দ্র বিদ্যালঙ্কারের কাছে শুনলেন বিশ্ব-ইতিহাস নিয়ে আলোচনা। তখন থেকে ভগৎ সিং বুঝতে পারলেন, ভারতের স্বাধীনতা তখনই আসবে যখন এদেশের মানুষের একটা বড়ো অংশ সচেতন হবে। আর তার জন্য চাই বিশেষ শিক্ষা আর বিশাল কর্মকাণ্ড। ভগৎ সিং এই কলেজে পড়াশুনাকালীন সময়ে আজীবন সংগ্রামের সাথী রূপে শুকদেব, যশপাল এবং ভগবতীচরণ ভোলার মত কয়েকজন অসম সাহসী তরুণকে সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়ে যান।
ভগৎ সিং খুব মনোযোগী ও পরিশ্রমী ছাত্র ছিলেন। যে বিষয় বুঝতে পারতেন না তা বুঝার জন্য বার বার ভালো করে চেষ্টা করতেন। ইতিহাস ও রাজনীতি বিষয়ক পড়াশুনার প্রতি তার আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি। সহপাঠীদেরকে নিয়ে পাঠচক্র করতেন। সবাইকে নিয়ে দেশ-বিদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাস পড়তেন। পড়লেন ইতালির দেশপ্রেমিক ম্যাৎসিনি ও গ্যারিবল্ডি অস্ট্রিয়ার শাসককে উৎখাত করে ইতালিকে স্বাধীনতার ইতিহাস, আয়ার‌্যান্ডের বিপ্লবী ইমন-ডি-ভ্যালেরার লেখা ‘আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম’ ও রুশ বিপ্লবী ক্রোপটকিনের ঘটনাবহুল জীবনের নানা দিক। আরো পড়লেন ভলতেয়ার আর রুশোর আগুনঝরানো রচনাবলী। পড়াশুনার সাথে সাথে ভগৎ সিং লাহোরের ন্যাশনাল ড্রামাটিক ক্লাবের সভ্য হয়ে যুবকদের মধ্যে স্বদেশপ্রেম জাগিয়ে তোলার জন্য একে একে অভিনয় করলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত, রাণা প্রতাপ, ভারত দুর্দশা। এসব নাটকের খল-চরিত্রে বিদেশি শাসকের অন্যায়-অত্যাচারের রূপরেখা ফুটে উঠত। এইভাবে মঞ্চে সফল একাধিক নাটকের মাধ্যমে কলেজের ছাত্র সমাজের মধ্যে বিদ্রোহের উদ্দীপনা নিয়ে এলেন তিনি।
১৯২৩ সালে ভগৎ সিং বি. এ ক্লাসে ভর্তি হন। কিছুদিন পর বাড়ি থেকে বিয়ে করার জন্য বার বার চাপ আসতে থাকে। কিন্তু ভগৎ সিং বিয়ে করতে রাজি নন। তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করার। তাই লাহোরের বিপ্লবী নেতা শচীন সান্যালের পরামর্শে ভগৎ সিং কানপুরের বিপ্লবী গণেশ শঙ্করের কাছে চলে যান। গণেশ শঙ্করের ‘প্রতাপ প্রেস’ ছিল উত্তরপ্রদেশের বিপ্লবীদের মিলন কেন্দ্র। গণেশ শঙ্করের মাধ্যমে এখানে বসে ভগৎ সিং বিপ্লবী পথের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন। ছুঁড়ে ফেলেন উচ্চ শিক্ষার ডিগ্রি লাভের মোহকে। উপেক্ষা করলেন বাবার সুখী পরিবারের নিরাপদ জীবন, ফিরেও তাকালেন না গৃহকোণের দিকে। দুনিয়ার সব ছন্নছাড়া বাঁধনহারা মুক্তিকামী মানুষের মিছিলে এক হয়ে গেলেন তিনি। যুক্ত হলেন ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান এসোসিয়েশন’-এ। তারপর থেকেই শুরু হয় তার সশস্ত্র বিপ্লবী জীবনের পথচলা।
১৯২৪ সালে ভারত উপমহাদেশব্যাপী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং সর্বত্র সংগঠিত হয় সশস্ত্র বিপ্লববাদী সংগঠন। চট্টগ্রামে রেলওয়ে ডাকাতি, বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক ডাকাতি ও বিপ্লববাদীদের সশস্ত্র কার্যকলাপের কারণে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে ব্রিটিশ ‘১ নম্বর বেঙ্গল অর্ডিনান্স’ নামে এক জরুরি আইন পাশ করে। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল ‘রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য সন্দেহভাজনদের বিনা বিচারে আটক রাখা’।
১৯২৫ সালের ৯ আগস্ট। উত্তরপ্রদেশের কাকোরী রেল স্টেশন দিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ সরকারি টাকা নিয়ে যাচ্ছিল। যখন ট্রেন কাকোরী স্টেশনে থামলো তখন ট্রেনে ডাকাত পড়েছে খবর ছড়িয়ে পড়ল। সবাই আতঙ্কিত। এমন সময় হঠাৎ ১৪/১৫ সশস্ত্র লোকের মধ্যে একজন বললেন, আপনাদের কোনো ভয় নেই। আপনাদের কিছু নিতে আসিনি। এই গাড়িতে করে ইংরেজ আমাদের দেশের টাকা লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল। আমরা সেই টাকা উদ্ধার করে দেশের কাজের জন্য নিয়ে গেলাম।
এরপর ব্রিটিশ শুরু করল ‘কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলা’। এই মামলাকে কেন্দ্র করে পুলিশ উত্তরপ্রদেশের নেতৃত্বস্থানীয় ৪৪ জনকে গ্রেফতার করে। মামলায় রাজেন লাহিড়ী, ঠাকুর রোশন সেন, আসফাকুল্লা খান এবং রামপ্রসাদ বিসমিল্লা-এর ফাঁসি হয় ও গণেশ শঙ্কর, শচীন সান্যালসহ ১৪ জনকে আন্দামান পাঠানো হয়।
১৯২৮ সালের ৮-৯ সেপ্টেম্বর ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান এসোসিয়েশন’-এর ব্যানারে সমগ্র ভারতের বিভিন্ন বিপ্লবীদের নিয়ে দিল্লীতে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভার সভাপতিত্ব করেন ভগৎ সিং। ওই সমাবেশে তিনি বললেন, ‘অবশ্যই আমাদের প্রথম লক্ষ্য দেশকে স্বাধীন করা। কিন্তু মূল লক্ষ্য হল ভারতে শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সমাজতান্ত্রিক ভারতবর্ষই আমাদের স্বপ্ন। বিপ্লবের চেতনা নিয়ে আমরা সেই পথে এগিয়ে যাব’। এই সভায় ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান এসোসিয়েশন’ নাম পরিবর্তন করে ‘হিন্দুস্থান সোসালিস্ট রিপাবলিকান এসোসিয়েশন’ করা হয়।
ওই বছর স্যার জন সাইমনের অধীনে ব্রিটিশ সরকার একটি কমিশন গঠন করে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর রিপোর্ট প্রদানের জন্য সেটিকে ভারতে প্রেরণ করে। কিন্তু কমিশনে কোনো ভারতীয় না থাকায় ভারতের সকল রাজনৈতিক দল তা প্রত্যাখ্যান করে এবং সারা দেশে এটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ গড়ে উঠে। যার ধারাবাহকিতায় ১৯২৮ সালের ৩০ অক্টোবর লাহোরে লালা লাজপৎ রায়ের নেতৃত্বে একটি নীরব অহিংস পথযাত্রার উপর পুলিশ লাঠি চার্জ করে। এসময় লালা লাজপৎ রায় পুলিশের নৃশংস লাঠি চার্জের শিকার হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং একপর্যায়ে মারা যান। ভগৎ সিং এই পথযাত্রায় ছিলেন। তিনি এ ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। বিপ্লবী ভগৎ সিং, রাজগুরু, সুখদেব ও জয় গোপাল একত্রে মিলিত হয়ে ওই ঘটনার নেতৃত্বদানকারী পুলিশ প্রধান স্কটকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। জয় গোপালকে দায়িত্ব দেয়া হয় স্কটকে সনাক্ত করে ভগৎ সিং-কে গুলি করার সংকেত প্রদানের জন্য। জয় গোপাল ডেপুটি পুলিশ সুপারিটেন্ডেন্ট জন পি. সন্ডার্সকে দেখে পুলিশ প্রধান স্কটকে ভেবে ভগৎ সিং-কে গুলি করার সংকেত দেন। ফলশ্রুতিতে জন পি. সন্ডার্স গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। সামান্য ভুলের কারণে বেঁচে যান পুলিশ প্রধান স্কট। ভগত সিং পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য আত্মগোপনে চলে যান। পুলিশ যাতে তাঁকে চিনতে না পারে সেজন্য তিনি চুল-দাড়ি কেটে ফেলেন। কিছু দিন পর তিনি কলকাতায় চলে আসেন। এখানে এসে বাংলার বিপ্লবী যতীন দাসের আশ্রয়ে একটি হোস্টেলে উঠলেন। খুব সতর্কতার সাথে বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করে পার্টির কাজ অব্যাহত রাখলেন।
‘১৯২৬ সালের শেষাশেষি আমার স্থির বিশ্বাস হল যে, সর্বশক্তিমান এমন কোনো সত্ত্বার অস্তিত্ব নেই যাঁর হাতে রয়েছে এই বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি, চালনা ও নিয়ন্ত্রণের ভার। এইভাবেই স্পষ্টতই আমি একজন স্বঘোষিত নাস্তিক বনে গেলাম।'
‘ভাববাদকে বিদায় দিলাম। অন্ধ বিশ্বাস থেকে নিজেকে মুক্ত করলাম। বস্তুবাদী ভাবনা আদর্শ হয়ে দাঁড়াল।’
'ঈশ্বর বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সমাজকে প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ প্রতিরোধ বা যুদ্ধ ঘোষণা করে যেতে হবে। সেই সঙ্গে পুতুল পূজা বা ধর্মীয় সংকীর্ণতার বিরুদ্ধেও লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’
‘ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস, তাঁর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করাকে আমি অত্যন্ত স্বার্থপর ও হীন কাজ বলে মনে করি।’
- ভগৎ সিং
ফাঁসির আগের দিন অর্থাৎ ২২শে মার্চ দ্বিতীয় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার আসামীরা ভগৎ সিং-এর নিকট গোপনে ছোট্ট একখানা চিরকুট পাঠিয়ে জানতে চান, তিনি কি বেঁচে থাকতে চান? ভগৎ সিং-এর ফাঁসির সেলের কাছেও ওয়ার্ডেই ঐ বন্দীরা তখন থাকতেন। কিন্তু ভগৎ সিং সুস্পষ্টভাবে সেদিন তাঁর বেচে থাকার জবাব দিয়েছিলেন- তিনি বলেছিলেন আমি আত্মিক ভাবে মরে গেলেও, মানুষের মাঝে বেঁচে থাকব যুগ-যুগান্তর। কতটা আত্মবিশ্বাসী হলে কেউ এরকম উত্তর দিতে পারেন?
ভগৎ সিংকে যখন নাস্তিক বলে আখ্যা দিয়েছিলেন, তখন তিনি বলেন- ‘কোথায় আপনাদের ঈশ্বর? তিনি কি করছেন? মানবজাতির এই সব দুঃখ-দুর্দশা দেখে তিনি কি উল্লাস বোধ করছেন? তাহলে তিনি তো এক ‘নীরো’ বা ‘চেঙ্গিস’! তিনি নিপাত যান। তাঁর বিনিপাত হোক'।
'আপনারা কি জানতে চান এই জগতের উদ্ভব ও মানুষের সৃষ্টি হলো কি করে? বেশ, ঠিক আছে, বলছি। এ বিষয়ে চার্লস ডারউইন কিছু সন্ধানী আলো নিক্ষেপ করেছেন। তাঁর বই পড়ুন। সেই সঙ্গে সোহং স্বামীর 'কমন সেন্স' বইটাও পড়ুন। এই বই দুটোতে আপনাদের প্রশ্নের অনেকখানি জবাব মিলতে পারে'। 
এই কোটেশনগুলো দেওয়ার পিছনে একটাই কারণ একটা মানুষ তাঁর জীবন-দর্শন সম্পর্কে কতটা উদাসীন থাকলে- এভাবে তর্কে জড়াতে পারেন!
 
ফাঁসির চিরকুট হাতে পেয়ে ভগৎ সিং মিটিমিটি হেসে বলছিলেন- ‘আপনারা ভাগ্যবান, আমার মতো দেশপ্রেমিকের গলায় ফাঁসি দড়ি পড়াতে পারছেন।’
‘আমি জানি যে-মুহূর্তে ফাঁসির দড়ি আমার গলায় এঁটে বসবে, পায়ের তলা থেকে পাটাতন সরিয়ে নেওয়া হবে, সেই হবে আমার জীবনের অন্তিম মুহূর্ত, আমার জীবনের সর্বশেষ ক্ষণ। ‘আমি’ বা সংক্ষেপে (দার্শনিক পরিভাষায়) আমার ‘আত্মা’- সেখানেই চিরতরে শেষ হয়ে যাবে। সব শেষ! আর কিছু নেই। এক অতি সংক্ষিপ্ত সংগ্রামী জীবনের কীর্তিহীন, গৌরবহীন, মাহাত্ম্যহীন পরিসমাপ্তি! যদি এইভাবে সাহসের সঙ্গে মেনে নিতে পারি- তবে সেটিই হবে আমার জীবনের সর্বোত্তম পুরস্কার।
'সব শেষ। ইহলোকে বা ‘পরলোকে’ পুরস্কৃত হবো এমন কোনো স্বার্থগত বাসনা বা অভিসন্ধি নেই। নিতান্ত নিঃস্বার্থভাবে আমি আমার দেশের মুক্তির জন্যে আমার এই জীবন উৎসর্গ করে গেলাম, কারণ, এ ছাড়া আমার আর কিছু দেবার ছিল না'।
'যেদিন আমরা দেখে যাবো যে, এক বৃহৎ সংখ্যক নরনারী এই মনোভাব নিয়ে দলে দলে মানব জাতির সেবায় এগিয়ে আসছে, নিপীড়িত ও দুর্গত মানবাত্মার মুক্তি ছাড়া যাদের জীবনের অন্য কোনো কাজ থাকবে না, সেদিনই আমার মতো মানুষের জীবনদান সার্থক হবে। শুরু হবে সত্যিকার মুক্তির দিন। মৃত্যুর পর ‘স্বর্গে’ গিয়ে বা ‘পরের জন্মে’ রাজা হতে নয়, ইহলোকে কোনো পুরস্কার লাভের জন্যেও নয়, নির্যাতনকারী যত শোষক দস্যুদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানাতে অনুপ্রাণিত হয়েই এবং সেইসঙ্গে সমগ্র মানবজাতির স্কন্ধ থেকে দাসত্বের জোয়াল ঝেড়ে ফেলে দিতেই এবং স্বাধীনতা ও শান্তির পথ নির্মাণ করতেই তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত আত্মধ্বংসী পথে নিজেদের মহৎ প্রাণ বলিদান করে গেছেন- এবং এই পথটাই হলো গৌরবময় জীবনের পথ। এই মহৎ কাজের যে গৌরব ও মাহাত্ম্য তাকে কি শুধু ‘অহঙ্কার’ বলে খাটো করা যায়? তার কোনো অপব্যাখ্যা হয় কি? এই ধরনের ঘৃণ্য বিশেষণ যদি কেউ ব্যবহার করেন, তবে বলবো যে হয় তিনি নির্বোধ, নয়তো শয়তান'।
'এই মহান আত্মত্যাগের মধ্যে যে অনুভূতির প্রগাঢ়তা, যে ভাবার্দ্রতা, যে উদ্দীপনা, যে মহত্ত্ব ও বিশালতা আছে তা অনুধাবন করতে না পারার জন্য আসুন, সে মানুষকে ক্ষমা করা যাক। কারণ তার হৃদয় মৃত ধ্বংস্তূপের মতো, তার চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ, ভিন্নতর কোনো স্বার্থের আবরণে তার হৃদয় চাপা পড়ে আছে'।
'আত্মবিশ্বাসকে প্রায়শ আত্মম্ভরিতা বলে ভুল করা হয়। এটা যেমন দুঃখজনক, তেমনি শোচনীয়। কিন্তু কিছু করার নেই!’
ভগৎ সিং এভাবেই ফাঁসির মঞ্চে উঠার আগে সাহস জুগিয়েছিলেন- হাজার-হাজার, তরুণ জনতাকে। যার ধারাবাহিকতায় জীবন দিয়েছিলেন, হাজারো তরুণ। স্বাধীন হয়েছিল ভারতমাতা। 
সাধারণত ফাঁসি দেওয়া হয় ভোররাত্রে। কিন্তু না, কাউকে বিশ্বাস নেই। তখন যে একটা হাঙ্গামা শুরু হয়ে যাবে না তার ঠিক কি! তাই ভোররাত্রের পরিবর্তে সময় ঠিক করা হয়েছে সন্ধ্যার পর। আনুষ্ঠানিকভাবে বন্দীদের খবর জানানো হল বিকেল পাঁচটায়। প্রস্তুত হওয়া। আর মাত্র আড়াই ঘণ্টা বাকি।
ভগৎ সিংকে জানিয়ে দেওয়া হলো, আর মাত্র আড়াই ঘণ্টা বাকি, আপনাদের তিনজনের কোনো ইচ্ছা থাকলে প্রকাশ করতে পারেন।
ভগৎ সিং বললেন, আড়াই ঘণ্টা কেন! এখনই নিয়ে চলো না! আমরা তো প্রস্তুত হয়েই আছি!
ফাঁসিতে ঝুলবার আগে পর্যন্ত ভগৎ সিং পড়ছিলেন ‘লেনিনের জীবনী’। এই সময় জেলের অফিসারের ডাক এল..
জেল অফিসার: সরদারজী, ফাঁসি লাগানো কা হক্ম আ গয়া হ্যায়। আপ তৈয়ার হো যাইয়ে।
ভগৎ সিং-এর ডান-হাতে বইটা ছিল। বাঁ-হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দিলে বললেন..
দাঁড়ান। একজন বিপ্লবীর সঙ্গে আর একজন বিপ্লবীর সাক্ষাৎকার চলছে।
থমকে দাঁড়ালেন অফিসার। কিছুটা পড়ার পর বইটা রেখে ভগৎ সিং তেজোদীপ্ত ভঙ্গিতে খাড়া হয়ে দাঁড়ালেন।
ভগৎ সিং বললেন, চলুন...
সন্ধ্যা সাতটা বেজে বাইশ মিনিটে তিনজন মিছিল করে যাত্রা শুরু করলেন ফাঁসির মঞ্চের দিকে। ডাইনে রাজগুরু, মাঝে ভগৎ সিং, বাঁয়ে শুকদেব। সবার কণ্ঠে একই ধ্বনি- ইনকিলাব জিন্দাবাদ। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।
সেই চরম মুহূর্তেও কিন্তু একটু পরিহাস করার লোভ সংরবণ করতে পারলেন না ভগৎ সিং! ডেপুটি কমিশনারকে লক্ষ্য করে সহাস্যে বললেন...
ভগৎ সিং বললেন, ইউ আর ভেরি লাকি
ডেপুটি কমিশনার হয়ে বললেন, এর মানে?
ভগৎ সিং হাসোজ্জ্বল মুখে বললেন, আজ তুমি দেখতে পাবে, ভারতের বিপ্লবীরা আদর্শের জন্য কিভাবে হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করতে পারে।
হাসি মুখেই মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন তিনজন। ফাঁসির মঞ্চে ভগৎ, শুকদেব, রাজগুরুর দীপ্ত শ্লোগান-
‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’
‘সাম্রাজ্যবাদ কা নাশ হো।’
১৯৩০ সালের ৭ অক্টোবর। তিন ব্রিটিশ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত এক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুকে অপরাধী সাব্যস্ত করেন এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় প্রদান করে। ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ সন্ধ্যা ৭ টায় এই তিন বিপ্লবীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

লেখকঃ লাবণী মণ্ডল, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট

বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

চাল সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিন, চালের মূল্য কমান এক পয়সাও বর্ধিত বিদ্যুৎ বিল জনগণ দিবে না-বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে সরকারের প্রতি বামপন্থি নেতৃবৃন্দ


 
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ বিকাল সাড়ে চারটায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে চালের দাম বৃদ্ধি এবং বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির চক্রান্তের বিরুদ্ধে সিপিবি-বাসদ, বাম মোর্চার আহ‚ত দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশের কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে নেতৃবৃন্দ উপরোক্ত মন্তব্য করেন। আজকের বিক্ষোভ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সিপিবি’র সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ আলম, বাসদরে কেন্দ্রীয় নেতা বজলুর রশীদ ফিরোজ,গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ (মার্কসবাদী)’র কেন্দ্রীয় নেতা মানস নন্দী, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ-এর নেতা খালেকুজ্জামান লিপন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহবায়ক হামিদুল হক। সভা পরিচালনা করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য অনিরুদ্ধ দাশ অঞ্জন।
নেতৃবৃন্দ বিবৃতিতে বলেন, একদিকে খাদ্যমন্ত্রী বলছেন চালের মজুতে কোনো সংকট নেই, অন্যদিকে ওএমএস-এ চালের দাম ১৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা করা হয়েছে। ক্রয়ের পরিমাণ ৫ কেজি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। অনভ্যস্ত মানুষকে আতপ চাল কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। আতপ চাল পেয়ে গরীব মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মানুষের এই বিপর্যয়ের সময় তাদেরকে এ ধরনের পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া অসহায় জনগণের প্রতি সরকারে উপহাস মাত্র। 
নেতৃবৃন্দ বলেন, খাদ্যমন্ত্রীর সাথে চাল ব্যবসায়ীদের বৈঠকে ব্যবসায়ীরা মন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছেন চালের বর্ধিত দাম হ্রাস পাবে। এতে বোঝা যাচ্ছে চালের দাম নির্ধারণের চাবিকাঠি রয়েছে ব্যবসায়ীদের হাতে। চালকলের মালিকরা এবং পাইকারী ব্যবসায়ীরা যোগসাজশে চালের দামবৃদ্ধি ঘটিয়েছে। এদের সহযোগিতা করেছে দুর্নীতিবাজ আমলাচক্র ও ক্ষমতাসীন অসৎ রাজনীতিবিদরা। চালকল মালিক-ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনীতিবিদদের অসৎ সিন্ডিকেট চালের দাম বাড়িয়ে দেশের মানুষের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। চালের দাম কমানোর নামে চাল আমাদনীকারকদের ‘শূন্য’ মার্জিনে এলসি খোলার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে নির্দেশ প্রদান করেছে সরকার এবং চাল আমাদনীতে বাজেটে ঘোষিত শুল্ক হ্রাস করে ২% নির্ধারণ করেছে। এতে মুনাফা বেড়েছে চাল আমদানীকারকদের। কিন্তু বাজারে চালের দাম হ্রাস পায়নি। জনগণকে বর্ধিত দামেই চাল কিনতে হচ্ছে। 
নেতৃবৃন্দ বলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল ১০ টাকা কেজিতে জনগণকে চাল সরবরাহ করবে। বাস্তবতা হচ্ছে জনগণকে লাইনে দাঁড়িয়ে ট্রাক থেকে ৩০ টাকা কেজিতে আতপ চাল কিনতে হচ্ছে। 
চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতায় ক্ষোভ প্রকাশ করে নেতৃবৃন্দ বলেন, সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়ার পরিবর্তে সিন্ডিকেটকে প্রশ্রয় দিচ্ছে সরকার। কৃত্রিমভাবে চালের দাম বৃদ্ধির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তারা সরকারের প্রতি আহবান জানান। সেই সাথে কোন দুষ্টচক্র যাতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নিয়ে কারসাজি করতে না পারে সেজন্য চালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার এবং সরকারি সংস্থা টিসিবিকে মূখ্য ভূমিকা নেয়ার দাবি জানান।
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির চক্রান্ত প্রতিরোধের আহবান জানিয়ে নেতৃবৃন্দ বলেন, বিইআরসি’র গণশুনানীতে আমাদরে ও ক্যাবের প্রতিনিধিবৃন্দ হিসাব করে দেখিয়ে দিয়েছেন বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট ১ টাকা ২৬ পয়সা কমানো যায়। আমাদের বক্তব্যে কর্ণপাত না করে বিইআরসি পিডিবি’র প্রস্তাব পাইকারী প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৮৭ পয়সা সংশোধন করে পাইকারী প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৫৭ পয়সা বৃদ্ধির পক্ষে মত দিয়েছে। সাত দিনব্যাপী গণশুনানীতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবনাও বিবেচনায় নিবে বিইআরসি। 
নেতৃবৃন্দ বলেন, বিইআরসি’র গণশুনানী গণপ্রতারণায় পর্যবসিত হয়েছে। বিইআরসি দাম পরিস্থিতি মূল্যায়নের পরিবর্তে দাম বৃদ্ধির জন্যই গণশুনানী আহবান করে। এই শুনানী লোক দেখানো এবং প্রতারণাপূর্ণ। নেতৃবৃন্দ দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারাকে ব্যাপক লুটপাট ও দুর্নীতির আর্থিক দায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র আখ্যায়িত করে বলেন, বিদ্যুতের দাম এক পয়সাও বৃদ্ধি করা যাবে না। যদি বৃদ্ধি করা হয় তবে হরতাল, অবরোধসহ কঠোর কর্মসূচির মাধ্যমে তা প্রতিহত করা হবে। 
সরকারের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিকে নাকচ করে দিয়ে নেতৃবৃন্দ বলেন, এই সরকার বিনা ভোটের সরকার, এই সরকার ভাতে মারার সরকার। 
সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।

মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

‘নব-সংস্করণ’ নয়, প্রয়োজন ‘বিকল্প’


রাজনীতি নিয়ে আলোচনা উঠলে মানুষের কাছ থেকে হরহামেশাই একথা শুনতে হয় যে, রাজনীতির নামে আজকাল দেশে যা চলছে তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একধরনের ‘ধান্দাবাজি’ ছাড়া অন্য কিছু নয়। রাজনীতির এই চলমান রুগ্নতার অবসান দরকার। রাজনীতিতে দরকার ‘পরিবর্তন’। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, সেই পরিবর্তন কোন্ শক্তির হাত দিয়ে সম্ভব? সে প্রসঙ্গ থেকেই চলে আসে চলতি রাজনীতির তথাকথিত মূলধারার বাইরে ‘বিকল্প’ শক্তির উত্থানের বিষয়টি। কিন্তু ‘বিকল্প’ সম্পর্কে একেক জনের বুঝ একেক রকম। তাই, যে বিষয়টি ভালোভাবে বুঝে নেয়া প্রয়োজন তা হলো, যে ‘বিকল্প’ বিষয়টি আসলে কী?
দেশে বর্তমানে জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনে ক্ষমতায় যাওয়ার বাস্তব সম্ভাবনাপূর্ণ শক্তিশালী দল হিসেবে রয়েছে দু’টি দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এদের মধ্যে একটি দল ক্ষমতায় থাকলে অপরটি তাকে ‘প্রতিস্থাপন’ করে ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাব্য শক্তি হিসেবে সবসময় বিদ্যমান থাকে। জাতীয় পার্টিকে গৃহপালিত বিরোধী দল বানিয়েও এর হেরফের ঘটানো যায়নি। তাহলে কি বলতে হবে এই দু’টি দলই হলো একটি অপরটির বিকল্প? না, তা বলাটা সঠিক হবে না। কারণ, ‘প্রতিস্থাপকের’ যোগ্যতাসম্পন্ন হিসেবে অবস্থানকারী শক্তি হলেই তাকে ‘বিকল্প’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—এই দুটি দলের মধ্যে, অন্য নানা ক্ষেত্রে যতো পার্থক্যই থাকুক, অর্থনৈতিক-সামাজিক দর্শন ও শ্রেণি চরিত্রের বিচারে মোটা দাগে এ দল দু’টি হলো ‘সমমনা’। তাই তারা পরস্পর পরস্পরের প্রকৃত বিকল্প হিসেবে দাবি করতে পারে না। তারা উভয়েই উভয়ের, কারো মতে উত্কৃষ্ট আর কারো মতে নিকৃষ্ট, ‘নব-সংস্করণ’ মাত্র। ‘বিকল্প’ আর ‘নব সংস্করণ’ এক জিনিস নয়। একটি বিশেষ দল যে নীতিতে দেশ চালিয়েছে, আরেকটি দল তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে সেই নীতিরই কিছুটা হেরফের, উন্নতি-অবনতি, সংযোজন-বিয়োজন করে শাসন চরিত্রের নতুন একটি সংস্করণের সূচনা করতে পারে মাত্র। কিন্তু তার দ্বারা দেশকে ‘বিকল্প’ শাসনের ধারায় পরিচালনা করা বোঝায় না।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা দুই প্রধান মেরুকরণের বাইরে ‘এ টু জেড’ অন্য সব দল মিলে দ্বি-দলীয় মেরুকরণের পাল্টা শক্তি-সমাবেশ গড়ে তোলাটাকে কেউ কেউ ‘বিকল্প’ বলে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু এটিও ‘বিকল্প’ নয়। কারণ কোনো শক্তি সমাবেশ যদি বিএনপি-আওয়ামী লীগের ক্ষমতার মিউজিক্যাল চেয়ারের চক্র ভেঙে ক্ষমতায় এসে মূলত একই নীতি-দর্শনকে ভিত্তি করে শাসন কাজ পরিচালনা করে তাহলে সেটিকে কোনোভাবেই প্রকৃত বিকল্প বলা যেতে পারে না। ‘বিকল্প’ না বলে এটিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-কেন্দ্রিক শক্তি সমাবেশের বাইরে ‘তৃতীয় শক্তি’ নামে আখ্যায়িত করা যেতে পারে মাত্র। ‘তৃতীয় শক্তি’ হলেই তা ‘বিকল্প’ হবে, এমন কথা মোটেও সত্য নয়। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, ‘বিকল্প’ বলতে আমরা তবে কী বুঝব?
আজ রাজনীতি নিয়ে মানুষের একটি প্রধান প্রশ্ন হলো,—‘দেশ বদল হয়, সরকার বদল হয়, অথচ সাধারণ মানুষের কপাল বদল হয় না কেন?’ এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে হলে দেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। ইতিহাস একথাই প্রমাণ দেয় যে, সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা ও দেশের সার্বিক ভাল-মন্দের বিষয়গুলো শেষ বিচারে নির্ভর করে প্রচলিত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ওপর। পুরনোদিনের ‘ব্যবস্থার’ প্রগতিশীল-গণমুখীন মৌলিক দিক-পরিবর্তন ছাড়া শুধু দেশ বদল বা গদি বদলের মাধ্যমে, কিম্বা কেবল শাসন পদ্ধতির নব-সংস্করণ সম্পন্ন করে, সাধারণ মানুষের অবস্থার উন্নতি ঘটানো যাবে না। প্রকৃত ‘বিকল্প’ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ‘ব্যবস্থা’ বদলের এই মৌলিক কর্তব্যটি একটি কেন্দ্রিক ও অপরিহার্য উপাদান।
আমাদের দেশ বহুদিন ধরে (এমনকি বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলেও) ‘অবাধ পুঁজিবাদ ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির’ নীতি-দর্শন ও ব্যবস্থার ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে। পঁচাত্তরের পর বিগত ৪১ বছর ধরে খুনি মোশতাকের দ্বারা সূচিত এই ব্যবস্থার ভিত্তিতেই দেশ চালিয়েছে জিয়া, সাত্তার, এরশাদ, খালেদা, হাসিনা, খালেদা-নিজামী, ফখরুদ্দীন প্রমুখের নেতৃত্বাধীন পর্যায়ক্রমিক সরকারগুলো। এই ‘ব্যবস্থার’ কাঠামোর মধ্যে দেশকে আবদ্ধ রেখে অনেক ঊনিশ-বিশই করা হয়েছে, অনেক সংস্কার সাধন করা হয়েছে, নব-নব সংস্করণের আবির্ভাব ঘটিয়ে গদি বদলের পর্ব সম্পন্ন করা হয়েছে,—কিন্তু সাধারণ মানুষের অবস্থার মৌলিক কোনো উন্নতি তার দ্বারা সাধন করা যায়নি। এই ব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হিসেবে উপরতলার সীমাহীন লুটপাট, উপরভাসা ‘উন্নয়নের’ কিছু চাকচিক্য ও তৃণমূলের পনের আনা মানুষের জন্য চুঁইয়ে পড়া ছিটেফোঁটা অগ্রগতি ছাড়া সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতি-নৈতিকতা প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই সমস্যা-সংকট ও অবক্ষয়-অধোগতির ধারা দশকের পর দশক ধরে ক্রমাগতই শুধু গভীরতরই হয়েছে।
এই অবস্থা থেকে যদি দেশকে উদ্ধার করতে হয় তাহলে, এই পরিস্থিতি উদ্ভবের জন্য যে নীতি-ব্যবস্থা দায়ী তা পরিবর্তন করতে হবে। এই ব্যবস্থার অব্যাহত অনুসরণ কিম্বা তার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উন্নতি সাধনের চেষ্টার দ্বারা সে কাজ হবে না। দেশ ও দেশের রাজনীতিকে তার বিদ্যমান রুগ্নতা থেকে উদ্ধার করতে হলে যে ‘নীতি-ব্যবস্থা’ অবক্ষয়-অধোগতির উত্স তা পরিবর্তন করে তার জায়গায় ‘বিকল্প নীতি-ব্যবস্থা’ প্রবর্তন ও অনুসরণ করতে হবে। এটি একটি র্যাডিক্যাল কাজ। বিকল্প গড়ার গোটা বিষয়টি তাই সামগ্রিকভাবে ‘ব্যবস্থা’ বদলে ফেলার একটি র্যাডিক্যাল কর্তব্যকে নির্দেশ করে।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব যেমন অলীক, অলীক যেমন কিনা সোনার পাথরবাটি—ঠিক তেমনি ‘সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর লুটেরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা’ এরূপ বহাল রেখে দেশ ও দেশের আপামর জনগণের জীবনে মৌলিক ধরনের অগ্রগতি সাধন ও প্রগতির ধারায় দেশের অগ্রযাত্রা আশা করাটিও হবে অলীক স্বপ্নবিলাস মাত্র। আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে গত আড়াই দশকে কয়েকবার ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। মাঝে দু’বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারও রাজত্ব করেছে। পঁচাত্তরের পর জিয়া ও এরশাদের সামরিক সরকারও ক্ষমতায় থেকেছে। কিন্তু আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মূল নীতি ও দর্শন কখনই পরিবর্তিত হয়নি। গদি বদলের মধ্য দিয়ে ‘আপদ’ দূর হয়েছে, তো এসে হাজির হয়েছে ‘বিপদ’। ‘বিপদ’ বিদায় হয়ে এসেছে ‘আপদ’। দেশ ও জনগণ ‘ফুটন্ত কড়াই’ থেকে ‘জ্বলন্ত উনুনে’ কিংবা ‘জ্বলন্ত উনুন’ থেকে ‘ফুটন্ত কড়াইয়ে’ নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এই চক্র থেকে দেশকে বের করে আনার কর্তব্যই ‘বিকল্প’ গড়ার সংগ্রামের প্রকৃত লক্ষ্য বলে গণ্য হতে পারে।
বহু যুগ ধরে দেশ পরিচালিত হচ্ছে লুটেরা পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ নির্ভরতার ‘মন্দ পথে’। এ ধারায় চলতে থাকলে ‘মন্দের ভালো’ খুঁজে বেড়ানো ছাড়া জনগণের আর বেশি কিছু পাওয়ার থাকবে না। সত্যিকার ‘ভালো’ পরিস্থিতিতে উত্তরণ করতে হলে পুঁজিবাদের ‘মন্দ পথ’ পরিত্যাগ করে দেশকে তার গণ্ডির বাইরে নিয়ে আসতে হবে। বামপন্থা তথা সমাজতন্ত্র অভিমুখীনতার পথ গ্রহণই প্রকৃত বিকল্পের ধারায় দেশের উত্তরণ নিশ্চিত করতে পারে। সেজন্য অন্য কোনো পথ আজ খোলা নেই।
কিছু বিষয়ে পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও (এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সে পার্থক্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও), রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বিকল্প ধারা, গণফোরাম এবং এমনকি জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি দলগুলোর স্পষ্ট অবস্থান হলো প্রচলিত আর্থ-সামাজিক ‘নীতি-ব্যবস্থাকে’ টিকিয়ে রেখে দেশ পরিচালনার স্বপক্ষে। সুশীল সমাজ বলে দাবিদারদের মধ্যে অধিকাংশের অবস্থানও অনুরূপ। সেই অর্থে এসব দল ও শক্তিকে ‘সমমনা’ বলে চিহ্নিত করাটি অশুদ্ধ নয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এসব দল যদি ‘সমমনা’ হয় তাহলে তাদের মধ্যে সুতীব্র দ্বন্দ্ব-সংঘাত সতত বিরাজমান কেন? এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত এতোটাই তীব্র যে তা দেশকে নৈরাজ্যের অন্ধকারে নিক্ষেপ করে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। ‘সমমনা’ হলেও এসব দল ও শক্তি এরূপ পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়ার কারণ হলো—যে ‘নীতি-ব্যবস্থাকে’ তারা সকলেই অনুসরণ করে থাকে, ‘নৈরাজ্য’ হলো তার অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য। এই ব্যবস্থার ভিত্তি হলো লুটপাট। লুটেরাদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে অনিবার্য দ্বন্দ্ব-সংঘাত হলো এই চরম নৈরাজ্যমূলক হানাহানির বৈষয়িক উত্স।
প্রকৃত ‘বিকল্পের’ থাকতে হবে তিনটি অত্যাবশ্যক উপাদান। এক. বিকল্প শ্রেণিগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাত্ সমাজ ও রাজনীতিতে মেহনতি মানুষের আধিপত্য বা নেতৃত্বমূলক ভূমিকা নিশ্চিত করা। দুই. বিকল্প কর্মসূচি হাজির করা। অর্থাত্ দেশ বর্তমানে যে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা বিষয়ক, শিল্প বিষয়ক ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে পথ ধরে চলছে তা থেকে স্বতন্ত্র প্রগতিশীল চরিত্রের বিকল্প কর্মসূচিকে জনগণের মাঝে জনপ্রিয় করে তোলা। তিন. জনগণের সক্রিয় সমর্থনের ভিত্তিতে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে এই বিকল্প কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য উপযোগী বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি-সমাবেশ গড়ে তোলা। সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ বিকল্প প্রতিষ্ঠার এই কাজে সমবেত হবে। তবে, নিজ নিজ শ্রেণিগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই, তাদের ভূমিকার ক্ষেত্রেও থাকবে নানা তারতম্য। তাদের মধ্যে যেমন থাকবে দৃঢ়-একাগ্র শক্তি, তেমনি থাকবে নানা মাত্রার দোদুল্যমান শক্তিও। তবে সাফল্য লাভ করতে হলে সম্ভাব্য সব শক্তিকে একটি র্যাডিক্যাল জাতীয় ঐক্যের ধারায় সমবেত ও ঐক্যবদ্ধ করাটা জরুরি। একইভাবে জরুরি হলো গোটা শক্তি সমাবেশের মধ্যে একটি কেন্দ্রিক একনিষ্ঠ চালিকাশক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত করা। আমাদের দেশের বিদ্যমান বাস্তবতা আজ এমনই যে, রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে এই উদ্যোগী চালিকাশক্তির ভূমিকাটি দেশের কমিউনিস্ট ও বাম-প্রগতিশীলদের গ্রহণ করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। আর সেই সাথে, সামাজিক শ্রেণি হিসেবে এই ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুরসহ শহর ও গ্রামের মেহনতি মানুষ, র্যাডিক্যাল বুদ্ধিজীবী প্রভৃতিদের।
চলতি ‘ব্যবস্থার’ কাছে গা ভাসিয়ে দিয়ে, কিম্বা এই ‘ব্যবস্থার’ সুবিধাভোগী ও প্রমোটার তথাকথিত ‘বড় দল’ দু’টির কোনো একটির কাঁধে ভর দিয়ে চলার বা তার সাথে মৈত্রী করার পথ গ্রহণ দ্বারা, বিকল্প গড়ার পথে এগিয়ে যাওয়া যাবে না। এ ধরনের কৌশল গ্রহণ করাটি বর্তমান ‘ব্যবস্থাকে’ আরো দীর্ঘস্থায়ী করবে এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা (status quo) বজায় রাখার কাজে শাসক-শোষক শ্রেণিকে সহায়তা করবে মাত্র। তথাকথিত মূলধারার বুর্জোয়া দল দুটির কোনো একটির সাথে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে তাদের অনুসৃত ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করা যাবে না। বরং যারা যুক্ত হবে তারাই উল্টো কথিত বড় দলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়বে। সাম্প্রতিক সময়কালে এটিই সকলের অভিজ্ঞতা।
শাসকগোষ্ঠী গুরুতর সংকটের সম্মুখীন হলে তা থেকে পরিত্রাণের জন্য ‘সিভিল সোসাইটির’ শাসন, বিগত তত্ত্বাবধায়ক মার্কা সেনাসমর্থিত নির্দলীয় সরকারের শাসন, জাতীয় সমঝোতার সরকারের শাসন, এমনকি সরাসরি সামরিক শাসন প্রভৃতি বিভিন্ন রূপের ‘দক্ষিণপন্থি বিকল্পের’ নানা ফর্মূলা নিয়ে হাজির হয়ে থাকে। ‘ওয়ান ইলেভেনের পরিকল্পনাকারীরা এখনো সক্রিয়। সেই এজেন্ডা এখনো তারা বহাল রেখেছে’,—এই হুঁশিয়ারি এসেছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী উভয়ের কাছ থেকে। এরূপ কিছু ঘটানো হলে তাতে দেশের সমস্যা-সংকট দূর হবে না, বরং নতুন সংকট জন্ম নিবে। বারবার আমরা সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা পেয়েছি। কিন্তু ‘ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না, এটাই ইতিহাসের বড় শিক্ষা’। তাই তৃতীয় শক্তির নামে নানা ষড়যন্ত্রের খেলার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাছাড়া, দ্বিদলীয় মেরুকরণভিত্তিক শাসন কাঠামোর দেউলিয়াপনা ও ব্যর্থতার সুযোগে যদি সাম্প্রদায়িক জঙ্গি ফ্যাসিস্ট শক্তি অল্প সময়ের জন্যও ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয় তাহলে অবস্থা আরো ভয়াবহ হয়ে পড়বে।
এসব আশঙ্কা থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র পথ হলো দেশকে একটি ‘বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প ধারায়’ পরিচালনার ব্যবস্থা করা। সে কাজ সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজন একটি গণভিত্তি সম্পন্ন, দক্ষ, যোগ্য বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি সমাবেশ গড়ে তোলা। জন সমর্থনের দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে এই শক্তি-সমাবেশকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে হবে এবং সেই সরকারের নেতৃত্বে বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য এটিই একমাত্র পথ। পরিস্থিতি বর্তমানে এমন যে, দেশ বাঁচাতে হলে, এরূপ একটি ‘বিকল্পের’ কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)