Biplobi Barta

মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৭

ওরা কেউ কথা রাখেনি

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত কবিতায় লিখেছেন—‘কেউ কথা রাখেনি’। সাধারণ বিবেচনায় বলা যায় যে, আমাদের দেশের রাজনীতিতে একথাটি এখন একটি দুঃখজনক ও নিষ্ঠুর সত্য হয়ে উঠেছে। এর ব্যতিক্রম যে নেই, তেমন অবশ্য নয়। তবে, বর্তমানে ‘চলতি হাওয়ার রাজনীতির’ যে প্রাবল্য দেশে বিদ্যমান, তার মাঝে পড়ে তা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে দুর্বল ব্যতিক্রম হিসেবে বিরাজ করছে।
‘চলতি হাওয়ার রাজনীতিতে’ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারাটাই প্রধান লক্ষ্য। নীতি-আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার ভাবনাকে ‘আহাম্মকি’ বলে ধরে নেওয়া হয়। নীতি-আদর্শ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে রাজনীতি করার বদলে, রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার সুবিধার্থে যখন-যেমন তখন-তেমন নীতি-আদর্শের বুলি কপচানোটাকেই এখন ‘বুদ্ধিমানের’ কাজ বলে বিবেচনা করা হয়। ‘চলতি হাওয়াপন্থি’ এসব রাজনীতিবিদরা যখন ক্ষমতার বাইরে থাকেন তখন তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনগণের মন ভোলাতে অনেক নীতি কথা বলেন ও অনেক প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর সে সব কথা ও প্রতিশ্রুতি বেমালুম ভুলে গিয়ে উল্টো পথ ধরতে তারা বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হয় না, বা তাতে তাদের মাঝে কোনো লজ্জা বা অপরাধবোধের জন্ম নেয় না।
দু’সপ্তাহ আগে আমি নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়েছি। এই অসুস্থতা নিয়েও ঢাকা, খুলনা প্রভৃতি জায়গায় কমিউনিস্ট পার্টির জেলা সম্মেলনগুলোতে যোগদান করেছি। অসুস্থ শরীর নিয়েও আমাকে তা করতে হয়েছে। কিন্তু ডাক্তারের বকাঝকা একেবারে উপেক্ষা করা কি যায়? শরীরও বা তা মানবে কেন? তাই ২/৪ দিন নিজেকে বাসায় আটকে রাখতে হয়েছে। বাসায় বিশ্রাম নিতে নিতে পুরানো কাগজপত্র উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছিলাম। সে সব দেখতে-দেখতে খুঁজে পেলাম ১৯৮৭ সালের ১৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে অনুষ্ঠিত ‘পনের দলের’ জনসভায় যে ঘোষণাটি পাঠ করা হয়েছিল তার কপি। যেটি কিনা পরে লিফলেট আকারে ছাপিয়ে বিলি করা হয়েছিল। লিফলেট আকারে ছাপানো ১৫-দল ঘোষিত সেই
‘প্রতিশ্রুতির দলিলটি’ পাঠ করতে করতে মনে জেগে উঠলো হায়দার হোসেনের গাওয়া একটি অতি জনপ্রিয় গানের নিম্নোক্ত লাইনগুলো—
“কী দেখার কথা কী দেখছি, কী শোনার কথা কী শুনছি,
কী ভাবার কথা কী ভাবছি, কী বলার কথা কী বলছি
তিরিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি...
...আজ তবে কি লাখো শহীদের রক্ত যাবে বৃথা,
আজ তবে কি ভুলতে বসেছি স্বাধীনতার ইতিকথা।”
পনের বছর আগের পটভূমিতে রচিত এ গানটি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট গণমানুষের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন ভঙের কথা তুলে ধরেছে। এই গানের কথাগুলো আজও প্রাসঙ্গিক। সত্য কথা বলতে, তা আজ আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। আরও বেশি এ কারণে যে, ইতোমধ্যে স্বাধীনতার ৪৫ বছরে দেশবাসী এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে সফল গণবিদ্রোহ সংগঠিত করেছে। তার মাধ্যমে জনমনে আবার জন্ম নিয়েছিল নতুন জীবনের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন। সে স্বপ্ন এখন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। শাসকরা প্রায় সব প্রতিশ্রুতি নির্লজ্জভাবে ভঙ্গ করেছে। যে নীতি-ব্যবস্থা বদলে দেওয়ার জন্য জনগণ সংগ্রাম করেছিল, সে বদল ঘটানো হয়নি। বরঞ্চ আগের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাতেই দেশ পরিচালনা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে “কী দেখার কথা কী দেখছি, কী শোনার কথা কী শুনছি...”
গানের কথাগুলো জনগণের মনে একাধারে হাহাকার ও সাথে সাথে ক্রোধের জন্ম না দিয়ে পারে না।
কী ছিল স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামে জনগণের কাছে দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি?
১৬ আগস্ট ১৯৮৭ সালে ১৫ দলীয় জোটের জনসভার প্রস্তাবে ভূমিকামূলক রাজনৈতিক বক্তব্যের পাশাপাশি ৭-দফা রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়েছিল। এসব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি।
প্রস্তাবটির ভূমিকাতে বলা হয়েছিল,
“১৯৭১ সালে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার পরিণতিতে একচেটিয়া পুঁজির শোষণ উচ্ছেদের জন্য জাতীয়করণ নীতি এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরক্ষেতা ও সমাজতন্ত্র লক্ষ্য হিসেবে স্থির করে স্বাধীন বাংলার অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার পরাজিত দুশমনরা মুক্তিযুদ্ধের ধারা এবং স্বাধীনতার মাধ্যমে অর্জিত অগ্রযাত্রাকে উল্টে দেয়। দেশকে আজ সাম্রাজ্যবাদের পদানত করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মুষ্টিমেয় দেশি-বিদেশি লুটেরা ধনিক-বণিকের শাসন-শোষণ।...
স্বৈরশাসন উচ্ছেদ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতার ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, প্রশাসনের সামরিকীকরণ বাতিল, বিরাষ্ট্রীয়করণ ও হোল্ডিং কোম্পানি আইন বাতিল, শ্রমিক-কর্মচারীদের দাবি, ছাত্র, আইনজীবীদের দাবি, কৃষক-ক্ষেতমজুরদের দাবি বাস্তবায়ন প্রভৃতি দাবিতে আজ দেশবাসীর আন্দোলন এক বেগবান স্রোতধারায় পরিণত হয়েছে।...
“যে ধারায় দেশ চলছে, দেশবাসী সেই গণবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল ধারার অবসান চায়। জনগণের সামনে রাষ্ট্রপতি এরশাদ আজ সেই চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও পরিত্যাজ্য রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থা ও ধারার প্রতীক হিসেবে উপস্থিত। এরশাদশাহীর উচ্ছেদের মাধ্যমে দেশবাসী সেই ধারার অবসান করে গণমানুষের গণতান্ত্রিক বিকল্প শাসনব্যবস্থা এবং সঙ্কটমুক্ত ও প্রগতিশীল অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনধারা প্রতিষ্ঠা করতে চায়।”
কোথায় গেল স্বৈরাচার অনুসৃত আর্থ-সামাজিক ধারা পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি? বরঞ্চ, গণহত্যা পরিচালনাকারী রাজাকার ও খুনি স্বৈরাচার এখন পালাক্রমে দুই জোটের সাথে রাষ্ট্রক্ষমতার ‘পার্টনার’ হিসেবে অধিষ্ঠিত। ‘এক জোটে রাজাকার, আরেক জোটে স্বৈরাচার’—এই হয়েছে আজ রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচার বিরোধী গণবিদ্রোহের ট্র্যাজিক পরিণতি!
১৫-দলের প্রস্তাবে ঘোষণা করা হয়েছিল, “এরশাদ সরকারের অবসানের মাধ্যমে শুধু ব্যক্তিশাসকেরই পরিবর্তন নয়, একই সাথে বর্তমানে প্রচলিত প্রতিক্রিয়াশীল ধারা ও ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে বিকল্প গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ব্যবস্থা ও ধারা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমরা দেশ, জাতি ও জনগণের সামনে নিম্নলিখিত রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি হাজির করছি”।
কি ছিল সেই ঘোষিত ৭-দফা কর্মসূচির বিষয়বস্তু? সেই ৭-দফা থেকে কিছু সরাসরি উদ্ধৃতি যুক্ত করছি।
১নং দফায় বলা হয়েছিল, “...’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও তা সমুন্নত রাখা।... চতুর্থ সংশোধনীপূর্ব ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃপ্রবর্তন করা।... প্রশাসন ও রাজনীতির সামরিকীকরণ রোধ করা। দেশ কি এসব প্রতিশ্রুত পথ ধরে চলছে? একেবারেই না! বরঞ্চ দেশ চলছে বিপরীতমুখি ধারায়। মোশতাক, জিয়া, এরশাদ অনুসৃত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ধারায়। তাই বলতেই হয় ‘কী দেখার কথা কী দেখছি, কী শোনার কথা কী শুনছি...’
২নং দফায় বলা হয়েছিল,
“বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতি ও হোল্ডিং কোম্পানি গঠনের আইন বাতিল করা। ব্যাংক বীমা ও মূল শিল্পকে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে রেখে রাষ্ট্রায়ত্ত খাত সংহত করে তা অর্থনীতির মূল খাত হিসেবে গড়ে তোলা এবং একই সাথে সমবায় খাত ও উত্পাদনমুখি বেসরকারি খাত গড়ে তোলা এবং উত্সাহিত করা।...”
৩ নং দফায় বলা হয়েছিল,
“খোদ কৃষকের হাতে জমি ও সমবায়’ নীতির ভিত্তিতে আমূল ভূমিসংস্কার, বর্গাচাষী উচ্ছেদ বন্ধ, ‘তেভাগা’ চালু, ভূমি মালিকানার সিলিং হ্রাস, ইজারাদারী ব্যবস্থা বিলোপ, উচ্ছেদসাপেক্ষে মহাজনী ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা।... প্রকৃত ভূমিহীন-ক্ষেতমজুরদের নিকট সমবায়ের ভিত্তিতে খাসজমি বিতরণ করা।... ভর্তুকি প্রদানকরত:কৃষি উপকরণের মূল্য ৫০% হ্রাস করা। বিএডিসি বিলুপ্ত করার চক্রান্ত রোধ করা।”
কর্মসূচির ৪নং দফায় বলা হয়েছিল,
“কামার-কুমার-জেলে-তাঁতী প্রভৃতি সম্প্রদায়সমূহের বিভিন্ন সমস্যার ন্যায্য সমাধান করা। প্রকৃত মত্স্যজীবী জেলেদের সমবায়সমূহের কাছে বড় বড় জলমহাল বন্দোবস্ত প্রদান করা।
বস্তিবাসী, রিকশাচালক, মুটে-মজুর প্রভৃতি গরিব ও বাস্তুহারা নিঃস্ব মানুষের জীবন-জীবিকা ও বেঁচে থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। অন্যায়ভাবে রিকশা তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র রোধ করা।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য হ্রাসের ব্যবস্থা করা ও সর্বত্র ন্যায্যমূল্যের দোকান চালু করা।”
৫ নং দফায় বলা হয়েছিল,
"সর্বজনীন, গণমুখি, সুলভ বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষানীতি চালু করা,... অপসংস্কৃতির প্রসার এবং প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ সাম্পদ্রায়িক ধ্যান-ধারণার বিস্তার রোধ করা।... হাসপাতালে প্রবর্তিত ভর্তি ফি বাতিল করা,...।"
৬নং দফার কর্মসূচিতে ছিল,
“জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর সকল প্রকার নির্যাতন বন্ধ করে তাদের সমস্যার [পার্বত্য চট্টগ্রাম] রাজনৈতিক সমাধান করা। অর্পিত সম্পত্তি আইন বাতিল করা।”
সর্বশেষ ৭নং দফায় ছিল,
“স্বাধীন ও সক্রিয় জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা। বিশ্বশান্তি ও পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব কায়েমের লক্ষ্যে কাজ করা। ভারতের সঙ্গে ফরাক্কা প্রভৃতি সমস্যা জাতীয় স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে ন্যায্য সমাধান করা এবং পাকিস্তানের নিকট থেকে ন্যায্য হিস্যা ও পাওনা আদায় করা।”
জনগণকে দেওয়া এসব প্রতিশ্রুতি পালন করা হয়নি। কার দ্বারা ও কার স্বার্থে প্রতিশ্রুতিগুলো বাতিল করে দেওয়া হলো ও সেগুলো প্রায় সবই উধাও হয়ে গেল? ঘোষিত প্রতিশ্রুতিসমূহের বরখেলাপ করে দেশ এখন কোন্ পথে চলছে সেদিকে একটু নজর দেওয়া যাক। ’৭২এর সংবিধানকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে বলে বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার করা হলেও, আসলে এরশাদ ও জিয়ার প্রতিক্রিয়াশীল সংশোধনী সংবিধানে বহাল রাখা হয়েছে। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য পরিত্যাগ করে ‘পুঁজিবাদী মুক্তবাজার ব্যবস্থা’ কায়েম করা হয়েছে। বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতি বাতিলের বদলে অর্থনীতিতে বেসরকারিকরণ, বিনিয়ন্ত্রণ, উদারীকরণ ইত্যাদি নীতি কার্যকর করা হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত খাত সংহত করার বদলে তাকে ধ্বংস করা হয়েছে। আমূল ভূমি সংস্কারের বদলে কৃষিতে ধনবান ব্যক্তিদের ‘পুঁজিবাদী খামার’ প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। কৃষি উপকরণের দাম ৫০ শতাংশ হ্রাস করার বদলে তার মূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। খাস জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণের বদলে তা বিত্তবানদের দখলে রাখার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ন্যায্যমূল্যের দোকান চালু করা হয়নি, টিসিবি শক্তিশালী করা হয়নি এবং দক্ষ-দুর্নীতিমুক্ত গণবণ্টন ব্যবস্থা চালু করা হয়নি। তার বদলে দ্রব্যমূল্য মুনাফাখোরদের মর্জির কাছে জিম্মি করে ফেলা হয়েছে। দুটি বুর্জোয়া জোট এখন পরস্পর পাল্লা দিয়ে সাম্প্রদায়িক শিক্ষা প্রসারিত করছে এবং দেশে এখন মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যম, এ-লেভেল ও-লেভেল ইত্যাদিসহ ৩/৪ ধারার শিক্ষা চালু রাখা হয়েছে। স্বাধীন ও সক্রিয় জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের বদলে দেশকে সৌদি আরবের নেতৃত্বে গঠিত সামরিক জোটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দেশকে সাম্রাজ্যবাদের ভূ-রাজনৈতিক নীল নকশার অংশীদার করা হয়েছে। নানা ধরনের গোপন সামরিক ও অন্যান্য স্ট্র্যাটেজিক বিষয়ক চুক্তি করে দেশকে তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। অথচ, একাত্তরে আমরা রক্ত দিয়ে পাকিস্তানের গোলামি থেকে যে মুক্তি অর্জন করেছিল, তা করেছিলাম নতুন করে অন্য কারো গোলাম হওয়ার জন্য নয়।
বিএনপি জোটের পক্ষে, তার দেওয়া নানা সুন্দর-সুন্দর প্রতিশ্রুতি পরিত্যাগ করে দেশকে দক্ষিণপন্থি ধারায় নিয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক বলে বিবেচিত হওয়ার কথা নয়। কারণ জন্ম থেকেই তাদের চরিত্র হলো দক্ষিণপন্থি। কিন্তু তত্কালীন ১৫-দলের শরিক আওয়ামী লীগ, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতন্ত্রী দল, সাম্যবাদী দল, ন্যাপ প্রভৃতি দল যে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বেমালুম ভুলে গিয়ে, কার্যত ডিগবাজি খেয়ে, উল্টো ধারায় দেশ চালাচ্ছে— সেটিই গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য করার বিষয়। এই পথেই যদি তারা দেশ চালাবে তবে ১৯৮৭ সালে জনগণকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের সাথে এভাবে প্রতারণা করা কেন? এটি একটি বিস্তৃত আলোচনার বিষয়। তবে, অল্প কথায় এটুকু বলা যায় যে, এর মূল কারণ হলো উল্লিখিত দলগুলোর মধ্যে কোনো-কোনোটির শ্রেণি চরিত্র বুর্জোয়া-পেটি বুর্জোয়া দল থেকে লুটেরা ধনিক শ্রেণির দলে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে পেটি-বুর্জোয়া বিচ্যুতিতে আক্রান্ত বাম দাবিদার কিছু দল তাদের আত্মশক্তির ওপর আস্থা হারিয়ে ক্ষমতার সুবিধা প্রাপ্তির আশায় বুর্জোয়া শাসক দলের লেজুড়বৃত্তিতে নেমে পড়েছে। তাদের কাণ্ডকারখানা দেখে একথার সত্যতাই প্রমাণিত হয় যে ওরা ‘কেউ কথা রাখেনি’।


লেখক :মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম,  সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)


 Post-editorial written by Mujahidul Islam Selim published in the 10th. October issue of Daily Ittefaq.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন