Biplobi Barta

মঙ্গলবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৭

চীন যে পথে যাচ্ছে





চীন আয়তনে বিশে^র তৃতীয় বৃহত্তম দেশ- নব্বই লাখ ষাট হাজার বর্গকিলোমিটার, জনসংখ্যায় প্রথম- এক শত ত্রিশ কোটি। চীনের অর্থনীতি পৃথিবী দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা রিজর্ভের অধিকারী চীন। নিজ দেশের বাইরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক বিনিয়োগকারী দেশ চীন। ২০১৬ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭.২%, যেখানে বিশ^ গড় ছিল ২.৫%। বিশ^ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে চীনের অবদান ৩০%, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি। ২০১৬ সালে চীনের মাথাপিছু আয় ৮,০০০ মার্কিন ডলার। পৃথিবীর দ্রুততম অগ্রসর অর্থনীতি চীনের। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ভোক্তা বাজার হচ্ছে চীন। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ি জনসংখ্যার ৫৭.৩৬% শহরে বাস করে। বিশ^ উদ্ভাবন সূচকে চীনের অবস্থান ২৫তম। ১৯৭৮ সাল থেকে গত ত্রিশ বছরে চল্লিশ কোটি মানুষকে দারিদ্রসীমার উর্ধ্বে তুলে এনেছে চীন। ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ি দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী চার কোটি তেত্রিশ লাখ পঞ্চাশ হাজার মানুষের (যাদের বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় ২,৩০০ ইউয়ান বা ৬০০ মার্কিন ডলারের নীচে) দারিদ্র বিমোচন করে ২০২০ সালের মধ্যে চীনে দারিদ্রসীমার নীচে কাউকে থাকতে দিবে না। ১৯৫৮ সালে সিপিসি’র চেয়ারম্যান মাও সেতুং উল্লেখ করেছিলেন চীন সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের প্রারম্ভিক পর্যায়ে (ইনিশিয়াল ষ্টেজ অব সোশ্যালিজম) রয়েছে। ’প্যারামাউন্ট লীডার’ দেং শিয়াও পিঙ বলেন, ’ আমাদের পরিষ্কার করে বলতে হবে সমাজতন্ত্র মানে কী এবং সমাজতন্ত্র কীভাবে বিনির্মাণ করা যাবে। ... সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক কাজ হচ্ছে উৎপাদিকা শক্তিকে বিকশিত করা এবং মানুষের বস্তুগত ও সামাজিক সম্পদের বিস্তৃতি ঘটানো। ১৯৫৮ থেকে ১৯৭৬ এই বিশ বছরে আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে সমাজতন্ত্র মানে দারিদ্র নয়, সমাজতন্ত্রের কাজ হচ্ছে দারিদ্র বিমোচন করা। উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ও জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন না ঘটানোটা সমাজতন্ত্র নয়।’ চীনের উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ও জনগণের জীবনমানের স্তর পর্যালোচনা করে ১৯৯২ সালে চতুর্দশ কংগ্রেসে সিপিসি ঘোষণা করে চীন সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের প্রাথমিক পর্যায়ে (প্রাইমারী ষ্টেজ অব সোশ্যালিজম) রয়েছে।
আগামী ২০২১ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এবং ২০৪৯ সালে গণচীন শততম বার্ষিকীতে পদার্পন করবে। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে সিপিসি’র অষ্টাদশ জাতীয় কংগ্রেসে সিপিসি দুটি শতবার্ষিকী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ২০২১ সালের মধ্যে চীন পরিণত হবে মোটামুটি সমৃদ্ধশালী দেশ-এ। গড় মাথাপিছু আয় ১০,০০০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে। ২০৪৯ সালে চীন হবে শক্তিশালী (স্ট্রং), সভ্য (সিভিলাইজড), সমন্বিত (হারমোনিয়াস), সুন্দর (বিউটিফুল) আধুনিক সমাজতান্ত্রিক দেশ। পার্টির সাধারণ সম্পাদক শি জিনপিঙ চীনের এ পুনর্জাগরনকে (রিযুভিনেশান) ’চীনা স্বপ্ন’ বা ’চাইনিজ ড্রীম’ আখ্যায়িত করেছেন।
চীনাদের এই চাইনিজ ড্রীমকে বাস্তবতায় পরিণত করার মহাকর্মযজ্ঞের দায়িত্ব গ্রহন করবে কারা? নিশ্চয়ই চীনের বিপুল জনগোষ্ঠীকে এ দায়িত্ব গ্রহন করতে হবে। আর এই কর্মযজ্ঞে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিবে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। অষ্টাদশ জাতীয় কংগ্রেস পার্টি সদস্যদেরকে এ কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে আদর্শিক ও নৈতিকভাবে যোগ্য হওয়ার আহবান জানিয়েছে এবং পার্টির দিক থেকে সদস্যদের যোগ্য করে তোলার সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। 
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যা ৮,৯৪,৪০,০০০। তৃণমূল (শাখা) কমিটি ৪৫,১৮,০০০ টি, কাউন্টি (জেলা) কমিটি ২,৭৮০ টি, মিউনিসিপ্যাল কমিটি ৩৯৬ টি, প্রাদেশিক কমিটি ৩১ টি। কেন্দ্রীয় কমিটির ২৫ জনকে নিয়ে পলিটব্যুরো গঠিত হয়। পলিটব্যুরোর স্ট্যান্ডিং কমিটি ৭ জনকে নিয়ে গঠিত। পার্টির সাধারণ সম্পাদক দুই টার্মের জন্য নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদককে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। 
সিপিসি’র সদস্যদের মধ্যে শ্রমিক ৭০.৯ লাখ (৭.৯২%), কৃষক ২৫৯.৬ লাখ (২৮.৯%), সেবাখাতে কর্মরত ১৩২.৪ লাখ, সরকারী কর্মচারী ৭৫.৬ লাখ, ছাত্র ১৮.৭ লাখ, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ ১৬০ লাখ, ব্যবসায়ি ৯৯ লাখ ইত্যাদি। 
এ বিপুল সদস্য সংখ্যা এবং বিশাল সংগঠনকে আদর্শিক, নৈতিকভাবে যোগ্য করার জন্য সিপিসি পার্টি শিক্ষাকে জোরদার করেছে। দলের সকল পর্যায়ে দূর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে তীব্র করেছে। পার্টি সদস্যদের জন্য আত্ম শৃংখলার নিয়মকে কঠোরতর করেছে। মিতব্যয়িতার আটটি ধারা নির্ধারন করে দিয়েছে।
পার্টি শিক্ষার গুরুত্ব: পার্টির অধীনে নানা পর্যায়ে প্রাথমিক থেকে উচ্চ পর্যায়ে পার্টি স্কুল পরিচালিত হচ্ছে। সর্বোচ্চ পার্টি স্কুল- সেন্ট্রাল পার্টি স্কুল এন্ড দি ন্যাশনাল স্কুল অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বেইজিং এ অবস্থিত। সাংহাইয়ের পুডং, শানসির ইয়ানান এবং চিয়াংসির চিংকাশানে তিনটি উচ্চমানের লিডারশীপ একাডেমি রয়েছে। সারাদেশে ৪,৫০০ পার্টি স্কুলে ১,০৮,০০০ প্রশিক্ষক প্রতিবছর দেড় কোটি পার্টি ক্যাডারকে প্রশিক্ষন দিচ্ছেন। পার্টি স্কুলে পাঠ্যসূচিতে পড়ানো হয় মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের ধ্রুপদী সাহিত্য, মাও চিন্তাধারা, চীনের সাম্প্রতিক নেতৃবৃন্দের তত্ত্ব, শি জিনপিঙ-এর বক্তৃতার সারসংকলন, সমসাময়িক বিশ^ অর্থনীতি, সমসাময়িক বিশ^ বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশল, সমসাময়িক বিশ^ আইন ব্যবস্থা, সমসাময়িক বিশ^ সামরিক বিজ্ঞান, চীনা জাতীয় প্রতিরক্ষা জ্ঞান, সমসাময়িক মতাদর্শিক ধারা।
আত্ম-শৃংখলার উপর গুরুত্বারোপ: পার্টি সদস্যদের জন্য প্রণীত হয়েছে ’চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শৃংখলা বিধি’। শৃংখলা ভঙ্গের ছয়টি ক্যাটাগরি নির্ধারণ করা হয়েছে- রাজনৈতিক শৃংখলা, সাংগঠনিক শৃংখলা, সততা শৃংখলা, গণ শৃংখলা, কর্ম শৃংখলা এবং ব্যক্তি জীবনের শৃংখলা। ২০১৬ সালে পার্টির বিভিন্ন পর্যায়ে ডিসিপ্লিনারি কমিশনে ৭,৩৪,০০০ পার্টি সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। এর মধ্যে ৩১,০০০ জনকে সতর্ক করে পার্টির নিয়ম মেনে চলার নির্দেশ দেয়া হয়। ৩,১০,০০০ অভিযুক্তকে হাল্কা শাস্তি প্রদান করা হয়। ১,০৫,০০০ অভিযুক্তকে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হয়। ১১,০০০ অভিযুক্ত পার্টি সদস্যদের অভিযোগের প্রকৃতি বিবেচনায় নিয়ে তাদের মামলা বিচারিক আদালতে প্রেরণ করা হয়।
পার্টি স্পষ্ট করে বলেছে পার্টি শৃংখলা ্এবং রাষ্ট্রীয় আইন দুটো ভিন্ন বিষয়। দুটোকে এক করা যাবে না। পার্টি সদস্যদের জন্য পার্টি শৃংখলা রাষ্ট্রীয় আইনের চেয়ে কঠোরতর। 
দূর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ের ঘোষণা: পার্টি আর্থিকসহ যে কোন দূর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম ঘোষণা দিয়ে বলেছে- ’জিরো টলারেন্স, জিরো ব্যারিয়ারস্্, জিরো লুফলস্্’। অর্থাৎ দূর্নীতির বিরুদ্ধে নিরাপোষ সংগ্রাম জারি থাকেবে। ’বাঘ এবং মাছি’ কাউকেই নিষ্কৃতি দেয়া হবে না। অর্থাৎ পার্টির বড় নেতা এবং তৃণমূল গ্রাম কমিটির নেতা যেই দূর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত হবে তাকেই চিহ্নিত করা হবে এবং শাস্তির সম্মুখিন করা হবে। ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় শৃংখলা পরিদর্শন কমিশন ২,৬০০ অভিযোগ অনুসন্ধান করে ৭৮০ টি মামলা নথিবদ্ধ করে এবং ৭৩০ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করে।
একটি কর্মশালায় একজন আলোচক একটা গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রসঙ্গে বলেছিলেন- ’বিপদ যদি আসে তাহলে পার্টির অভ্যন্তর থেকেই তার শুরু হবে।’ চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ এটা অনুধাবন করেছেন। তাদের ভাষায় জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত (অ্যাবানডেন্ট) না হতে হলে এবং দুই শতবার্ষিকী লক্ষ্যমাত্রার চাইনিজ ড্রীম বাস্তবায়ন করতে হলে পার্টি বিনির্মাণকে প্রধান গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ পার্টি হচ্ছে স্বপ্ন বাস্তবায়নের চালিকা শক্তি। সাধারণ সম্পাদাক শি জিনপিঙ তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে পার্টি বিনির্মাণ প্রসঙ্গে বলেছেন-’কঠিন মানদন্ডে পার্টি পরিচালনা করতে হবে’। সে কারণে বর্তমান চীনে মার্কস, এঙ্গেলস, মাও সেতুং চিন্তাধারা কথা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। কার্ল মার্কসের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী এবং প্রকাশনার সার্ধ শতবার্ষিকীতে পার্টি কমরেডদের ক্যাপিটাল গ্রন্থ পুনঃপাঠে উৎসাহিত করছে সিপিসি ।





লেখকঃ আব্দুল্লাহ আল কাফী রতন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন