কেউ কেউ সারা জীবন দুঃখের বোঝা বয়ে চলে, কেউ কেউ আবার সারা জীবন করে দুঃখজয়ের সাধনা। প্রথম ধারার মানুষ সমাজ ব্যবস্থার অসহায় শিকার, দ্বিতীয় ধারার মানুষ সমাজ পাল্টানোর লড়াইয়ে অসীম সাহসী সৈনিক। জসীমউদ্দিন মণ্ডল ছিলেন দ্বিতীয় ধারার একজন বলিষ্ঠ প্রতিনিধি।
প্রথম যৌবনে তিনি দেখেছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণ, যৌবন কেটেছে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে, প্রৌঢত্বের শুরুতে স্বাধীনতা যুদ্ধের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিলেন। স্বাধীনতার পর থেকে পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদের পক্ষে অবিচল ছিলেন তিনি। জ্ঞানলাভের পর থেকে এমন কোনো আন্দোলন ছিল না, যাতে তিনি অংশগ্রহণ করেননি।
কৈশোর পেরুতেই জীবিকার প্রয়োজনে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। চাকরি নিয়েছিলেন রেল কোম্পানিতে। কাজ ছিল রেলের ইঞ্জিনে কয়লা ঠেলে দেয়া। এত বিশাল রেলগাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যায় যে ইঞ্জিন, তার শক্তি আসে কোথা থেকে? কাজ করতে গিয়ে দেখেছিলেন, কয়লা আগুনে পুড়ে ছাই হয় আর কয়লা থেকে বেরিয়ে আসা শক্তির জোরে রেলগাড়িটা চলতে থাকে। সমাজ নামক রেলগাড়িটা তাহলে চলে কিসের শক্তিতে? রাষ্ট্র নামক ইঞ্জিনটাতে শ্রমিক কয়লার মতো পুড়ে যে অর্থনৈতিক শক্তি উত্পাদন করেন, তার জোরেই চলে সমাজ। কিন্তু তার শ্রমশক্তির মূল্য কি শ্রমিক পান? এমন কি কোনো সমাজ হবে যেখানে শ্রমিক শ্রমের ন্যায্য মূল্য পাবেন? কার্ল মার্ক্সের তত্ত্ব আর রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দেখাল— সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার বৈজ্ঞানিক পথ আছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ পথের যাত্রী ছিলেন।
কৃষকের দুঃখ, শ্রমিকের কষ্ট দেখে সহানুভূতি প্রকাশের লোক অনেক আছে কিন্তু দুঃখ-কষ্টের কারণ যে শোষণ, তা বুঝে কারণ দূর করার সংগ্রাম করেন যারা, তারা বিপ্লবী। জসীমউদ্দিন মণ্ডল সহজ ভাষায় জটিল তত্ত্বকে জনগণের কাছে প্রকাশ করার অপূর্ব ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন, যা অনেক মানুষকে মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু তার জন্য তাকে যে নিরলস সংগ্রাম করতে হয়েছিল, সেটা অনেকেই লক্ষ করেননি। মানুষ কীভাবে শোষণের কারণ বুঝতে পারে, কীভাবে আজীবন লড়াই করতে পারে, প্রলোভন বা হতাশার ছোবল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে, শোষিত মানুষের বুকে সংগ্রামের আগুন জ্বালাতে পারে, তার এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। মার্ক্সবাদ শুধু তত্ত্ব নয়, কর্মের পথনির্দেশের বাস্তব উদাহরণ ছিলেন তিনি।
অভাব মানুষকে অসহায় করে, অদৃষ্টবাদী করে, ভিক্ষুক করে, কখনো কখনো চোর-ডাকাতে পরিণত করে কিন্তু যখন সে মাক্সবাদের সন্ধান পায়, তখন সে হয়ে ওঠে সমাজ পরিবর্তনের সক্রিয় কর্মী। রেলকর্মী, রেলচালক জসীমউদ্দিন মণ্ডল সমাজের চালিকাশক্তির সন্ধান পেয়েছিলেন, তাই তিনি সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নে আজীবন লড়তে পেরেছিলেন।
যে কৃষক সুগন্ধি, সরু ধান ফলান, যে কিষাণী ধান থেকে চাল করেন, তার পাতে কেন ভাত থাকে না; যে শ্রমিক কাপড় বানান, তিনি কেন জীর্ণ পোশাক পরেন; সমাজের উত্পাদন বাড়ে যাদের শ্রমে, তারা কেন উত্পাদনের সুফল পান না— এসব প্রশ্ন অনেকেই করেন। কিন্তু এ নিয়ে আহাজারি করলে কি সমাধান হবে নাকি শ্রমিক কৃষক অধিকার পাবেন? সহানুভূতি চাওয়া আর অধিকার চাওয়া এক কথা নয়। তাই দুঃখের কথা ইনিয়ে বিনিয়ে বলা নয়, আহাজারি করা নয়, বরং কারণ খুঁজে বের করা এবং তা দূর করা দরকার। সারা জীবন শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ-কষ্টের কারণগুলোর প্রতি আঙুল নির্দেশ করেছেন। আর আবেদন-নিবেদন করা নয়, সংগ্রামের পথে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন শ্রমজীবীদের প্রতি। ধনী-গরিব হওয়া কপালের লিখন নয়, শ্রমিকের শ্রম চুরি না করে কেউ যে ধনী হতে পারে না— এ সত্য সাহসের সঙ্গে সব জায়গায় উচ্চারণ করতেন তিনি।
শিক্ষিত হয়ে কেউ কি চোর হবে, না চোরের সহযোগী হবে, নাকি চোরের বিরুদ্ধে লড়বে— এ প্রশ্ন করেছেন তিনি ছাত্রদের কাছে; মানুষের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন, এ অন্যায় জবরদস্তি তারা মেনে নেবে কিনা?
সংগঠন না থাকলে দরিদ্র মানুষ যে কত অসহায়, তা তিনি বারবার উপলব্ধি করানোর চেষ্টা করেছেন।
২০০ বছর ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা এল কিন্তু সাধারণ মানুষ স্বাধীনতা পেল না কেন? ২৩ বছর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আবার স্বাধীন হলো বাংলাদেশ কিন্তু মানুষের স্বাধীনতা কই? একবার ধর্মের নামে আরেকবার জাতীয়তার নামে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলেও শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সব মানুষের অধিকার যে প্রতিষ্ঠা হয় না, তা তিনি সহজ কথায় বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন সবসময়। মুসলমান মালিক মুসলমান শ্রমিককে শোষণ করতে বা ঠকাতে যেমন দ্বিধা করেন না, বাঙালি মালিকেরও তেমনি বাঙালি শ্রমিককে শোষণ করতে একটুও বাধে না। বিবেক অথবা বিবেচনা কোনো কিছুই কাজ করে না মুনাফার লোভের কাছে। জীবনের পাঠশালায় তিনি শিখেছেন— রাষ্ট্র সবাইকে সমান চোখে দেখে না। রাষ্ট্র কাউকে আপন ভেবে কাছে টানে আর কাউকে ভাবে পর। আইনের চোখে সবাই সমান— একথা যে কতটা অর্থহীন, তা তিনি সারা জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছেন। তার বক্তৃতাগুলো তাই হতো জীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাস, জীবন থেকে পাওয়া শিক্ষার সঙ্গে তত্ত্বের অপূর্ব মিশ্রণ। সে কারণেই তা আকর্ষণ করত সবাইকে।
ভূখণ্ড এক থাকলেও রাষ্ট্র যে এক থাকে না, তা দেখেছেন তিনি ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পর্বে। রাষ্ট্রের নাম পাল্টায়, শাসকদের চেহারা পাল্টায়, শোষণের ধরন পাল্টায় কিন্তু শোষণ তো থাকেই। তাই শোষণবিরোধী লড়াইটাও জারি রাখতে হবে। এ ছিল তার শিক্ষা। এ শিক্ষা অর্জন করতে পেরেছিলেন বলে লড়াই-সংগ্রামের পথ থেকে কখনো সরে আসেননি। জীবনে দুঃখ-কষ্ট যেমন ছিল, প্রলোভন কি ছিল না? অভাবের সংসারে কত জটিলতা থাকে! জেল খেটেছেন, আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে, পরিবার চলবে কীভাবে, তা কি তাকে বিচলিত করেনি? সেক্ষেত্রে স্ত্রীর সহযোগিতার স্বীকৃতি দিয়েছেন তিনি অকুণ্ঠ চিত্তে। বলেছেন, স্ত্রীর সহযোগিতা ছাড়া কেউ রাজনীতি করতে পারবে না।
দেশের মধ্যে রাজনীতির উত্থান-পতন দেখেছেন, হেরে যেতে দেখেছেন অনেক নামিদামি নেতাকে কিন্তু নিজে হার মানেননি। মস্কো-পিকিং মতাদর্শিক বিরোধে দল ভেঙে যেতে দেখেছেন, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় দেখেছেন, নিজের প্রিয় কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে যেতে দেখেছেন, অনেক বড় নেতার দল ও আদর্শ ত্যাগ দেখেছেন। এসব তাকে কষ্ট দিয়েছে কিন্তু তিনি যে দেখতে চেয়েছিলেন শ্রমিক-কৃষকের মুক্তি! তা যতক্ষণ অর্জন না হচ্ছে ততক্ষণ তিনি যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে যাবেন কীভাবে? তাই ৯৭ বছরের জীবনটাও তার কাছে ছোট হয়ে গেল। জীবনের গতির কাছে হার মেনে গেল জীবনের দৈর্ঘ্য।
এই অসামান্য মানুষটির ব্যক্তিগত জীবনের চাহিদা ছিল খুবই সামান্য। কিন্তু সমাজের কাছে তার চাওয়া ছিল বিশাল। সেই বিশাল স্বপ্ন বাস্তবায়নের চাহিদা তাকে থামতে দেয়নি কোথাও, স্থির হতে দেয়নি কখনো। মানুষের দুঃখে, বেদনায়, কষ্টে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে— এই ছিল তার সর্বক্ষণের চিন্তা। তাই মৃত্যুর পূর্বক্ষণেও হাসপাতালে তাকে দেখতে যাওয়া সাথীদের বলেছিলেন, ‘চালের দাম ৬০ টাকা কেজি আর তোমরা প্রতিবাদ না করে আমাকে দেখতে এসেছ? মিছিলে যাও।’
তার সারাটি জীবন ছিল সংগ্রামের, এই সংগ্রামী মানুষ ও তার সংগ্রামী চেতনার প্রতি লাল সালাম।
প্রথম যৌবনে তিনি দেখেছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণ, যৌবন কেটেছে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে, প্রৌঢত্বের শুরুতে স্বাধীনতা যুদ্ধের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিলেন। স্বাধীনতার পর থেকে পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদের পক্ষে অবিচল ছিলেন তিনি। জ্ঞানলাভের পর থেকে এমন কোনো আন্দোলন ছিল না, যাতে তিনি অংশগ্রহণ করেননি।
কৈশোর পেরুতেই জীবিকার প্রয়োজনে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। চাকরি নিয়েছিলেন রেল কোম্পানিতে। কাজ ছিল রেলের ইঞ্জিনে কয়লা ঠেলে দেয়া। এত বিশাল রেলগাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যায় যে ইঞ্জিন, তার শক্তি আসে কোথা থেকে? কাজ করতে গিয়ে দেখেছিলেন, কয়লা আগুনে পুড়ে ছাই হয় আর কয়লা থেকে বেরিয়ে আসা শক্তির জোরে রেলগাড়িটা চলতে থাকে। সমাজ নামক রেলগাড়িটা তাহলে চলে কিসের শক্তিতে? রাষ্ট্র নামক ইঞ্জিনটাতে শ্রমিক কয়লার মতো পুড়ে যে অর্থনৈতিক শক্তি উত্পাদন করেন, তার জোরেই চলে সমাজ। কিন্তু তার শ্রমশক্তির মূল্য কি শ্রমিক পান? এমন কি কোনো সমাজ হবে যেখানে শ্রমিক শ্রমের ন্যায্য মূল্য পাবেন? কার্ল মার্ক্সের তত্ত্ব আর রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দেখাল— সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার বৈজ্ঞানিক পথ আছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ পথের যাত্রী ছিলেন।
কৃষকের দুঃখ, শ্রমিকের কষ্ট দেখে সহানুভূতি প্রকাশের লোক অনেক আছে কিন্তু দুঃখ-কষ্টের কারণ যে শোষণ, তা বুঝে কারণ দূর করার সংগ্রাম করেন যারা, তারা বিপ্লবী। জসীমউদ্দিন মণ্ডল সহজ ভাষায় জটিল তত্ত্বকে জনগণের কাছে প্রকাশ করার অপূর্ব ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন, যা অনেক মানুষকে মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু তার জন্য তাকে যে নিরলস সংগ্রাম করতে হয়েছিল, সেটা অনেকেই লক্ষ করেননি। মানুষ কীভাবে শোষণের কারণ বুঝতে পারে, কীভাবে আজীবন লড়াই করতে পারে, প্রলোভন বা হতাশার ছোবল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে, শোষিত মানুষের বুকে সংগ্রামের আগুন জ্বালাতে পারে, তার এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। মার্ক্সবাদ শুধু তত্ত্ব নয়, কর্মের পথনির্দেশের বাস্তব উদাহরণ ছিলেন তিনি।
অভাব মানুষকে অসহায় করে, অদৃষ্টবাদী করে, ভিক্ষুক করে, কখনো কখনো চোর-ডাকাতে পরিণত করে কিন্তু যখন সে মাক্সবাদের সন্ধান পায়, তখন সে হয়ে ওঠে সমাজ পরিবর্তনের সক্রিয় কর্মী। রেলকর্মী, রেলচালক জসীমউদ্দিন মণ্ডল সমাজের চালিকাশক্তির সন্ধান পেয়েছিলেন, তাই তিনি সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নে আজীবন লড়তে পেরেছিলেন।
যে কৃষক সুগন্ধি, সরু ধান ফলান, যে কিষাণী ধান থেকে চাল করেন, তার পাতে কেন ভাত থাকে না; যে শ্রমিক কাপড় বানান, তিনি কেন জীর্ণ পোশাক পরেন; সমাজের উত্পাদন বাড়ে যাদের শ্রমে, তারা কেন উত্পাদনের সুফল পান না— এসব প্রশ্ন অনেকেই করেন। কিন্তু এ নিয়ে আহাজারি করলে কি সমাধান হবে নাকি শ্রমিক কৃষক অধিকার পাবেন? সহানুভূতি চাওয়া আর অধিকার চাওয়া এক কথা নয়। তাই দুঃখের কথা ইনিয়ে বিনিয়ে বলা নয়, আহাজারি করা নয়, বরং কারণ খুঁজে বের করা এবং তা দূর করা দরকার। সারা জীবন শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ-কষ্টের কারণগুলোর প্রতি আঙুল নির্দেশ করেছেন। আর আবেদন-নিবেদন করা নয়, সংগ্রামের পথে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন শ্রমজীবীদের প্রতি। ধনী-গরিব হওয়া কপালের লিখন নয়, শ্রমিকের শ্রম চুরি না করে কেউ যে ধনী হতে পারে না— এ সত্য সাহসের সঙ্গে সব জায়গায় উচ্চারণ করতেন তিনি।
শিক্ষিত হয়ে কেউ কি চোর হবে, না চোরের সহযোগী হবে, নাকি চোরের বিরুদ্ধে লড়বে— এ প্রশ্ন করেছেন তিনি ছাত্রদের কাছে; মানুষের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন, এ অন্যায় জবরদস্তি তারা মেনে নেবে কিনা?
সংগঠন না থাকলে দরিদ্র মানুষ যে কত অসহায়, তা তিনি বারবার উপলব্ধি করানোর চেষ্টা করেছেন।
২০০ বছর ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা এল কিন্তু সাধারণ মানুষ স্বাধীনতা পেল না কেন? ২৩ বছর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আবার স্বাধীন হলো বাংলাদেশ কিন্তু মানুষের স্বাধীনতা কই? একবার ধর্মের নামে আরেকবার জাতীয়তার নামে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলেও শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সব মানুষের অধিকার যে প্রতিষ্ঠা হয় না, তা তিনি সহজ কথায় বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন সবসময়। মুসলমান মালিক মুসলমান শ্রমিককে শোষণ করতে বা ঠকাতে যেমন দ্বিধা করেন না, বাঙালি মালিকেরও তেমনি বাঙালি শ্রমিককে শোষণ করতে একটুও বাধে না। বিবেক অথবা বিবেচনা কোনো কিছুই কাজ করে না মুনাফার লোভের কাছে। জীবনের পাঠশালায় তিনি শিখেছেন— রাষ্ট্র সবাইকে সমান চোখে দেখে না। রাষ্ট্র কাউকে আপন ভেবে কাছে টানে আর কাউকে ভাবে পর। আইনের চোখে সবাই সমান— একথা যে কতটা অর্থহীন, তা তিনি সারা জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছেন। তার বক্তৃতাগুলো তাই হতো জীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাস, জীবন থেকে পাওয়া শিক্ষার সঙ্গে তত্ত্বের অপূর্ব মিশ্রণ। সে কারণেই তা আকর্ষণ করত সবাইকে।
ভূখণ্ড এক থাকলেও রাষ্ট্র যে এক থাকে না, তা দেখেছেন তিনি ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পর্বে। রাষ্ট্রের নাম পাল্টায়, শাসকদের চেহারা পাল্টায়, শোষণের ধরন পাল্টায় কিন্তু শোষণ তো থাকেই। তাই শোষণবিরোধী লড়াইটাও জারি রাখতে হবে। এ ছিল তার শিক্ষা। এ শিক্ষা অর্জন করতে পেরেছিলেন বলে লড়াই-সংগ্রামের পথ থেকে কখনো সরে আসেননি। জীবনে দুঃখ-কষ্ট যেমন ছিল, প্রলোভন কি ছিল না? অভাবের সংসারে কত জটিলতা থাকে! জেল খেটেছেন, আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে, পরিবার চলবে কীভাবে, তা কি তাকে বিচলিত করেনি? সেক্ষেত্রে স্ত্রীর সহযোগিতার স্বীকৃতি দিয়েছেন তিনি অকুণ্ঠ চিত্তে। বলেছেন, স্ত্রীর সহযোগিতা ছাড়া কেউ রাজনীতি করতে পারবে না।
দেশের মধ্যে রাজনীতির উত্থান-পতন দেখেছেন, হেরে যেতে দেখেছেন অনেক নামিদামি নেতাকে কিন্তু নিজে হার মানেননি। মস্কো-পিকিং মতাদর্শিক বিরোধে দল ভেঙে যেতে দেখেছেন, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় দেখেছেন, নিজের প্রিয় কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে যেতে দেখেছেন, অনেক বড় নেতার দল ও আদর্শ ত্যাগ দেখেছেন। এসব তাকে কষ্ট দিয়েছে কিন্তু তিনি যে দেখতে চেয়েছিলেন শ্রমিক-কৃষকের মুক্তি! তা যতক্ষণ অর্জন না হচ্ছে ততক্ষণ তিনি যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে যাবেন কীভাবে? তাই ৯৭ বছরের জীবনটাও তার কাছে ছোট হয়ে গেল। জীবনের গতির কাছে হার মেনে গেল জীবনের দৈর্ঘ্য।
এই অসামান্য মানুষটির ব্যক্তিগত জীবনের চাহিদা ছিল খুবই সামান্য। কিন্তু সমাজের কাছে তার চাওয়া ছিল বিশাল। সেই বিশাল স্বপ্ন বাস্তবায়নের চাহিদা তাকে থামতে দেয়নি কোথাও, স্থির হতে দেয়নি কখনো। মানুষের দুঃখে, বেদনায়, কষ্টে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে— এই ছিল তার সর্বক্ষণের চিন্তা। তাই মৃত্যুর পূর্বক্ষণেও হাসপাতালে তাকে দেখতে যাওয়া সাথীদের বলেছিলেন, ‘চালের দাম ৬০ টাকা কেজি আর তোমরা প্রতিবাদ না করে আমাকে দেখতে এসেছ? মিছিলে যাও।’
তার সারাটি জীবন ছিল সংগ্রামের, এই সংগ্রামী মানুষ ও তার সংগ্রামী চেতনার প্রতি লাল সালাম।
লেখক: রাজেকুজ্জামান রতন, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন