Biplobi Barta

রবিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৭

জয়তু কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ, তোমার স্মৃতি ও কর্মের প্রতি বিপ্লবী অভিবাদন। মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের কিংবদন্তিঃ





"কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ সংবাদ-পত্র পড়া প্রসঙ্গে তিনি প্রায়ই বলতেন, কাসা বা পিতলের ঘটি-বাটি-থালাকে যেমন কি না প্রতিনিয়ত ঘষামাজা না করলে তা তার উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলে, ঠিক তেমনি জ্ঞানেরও প্রাত্যহিক চর্চা ও ঘষামাজা করতে হয়। না হলে জ্ঞানে মরিচা ধরে। একদিন তা অচল হয়ে যায়। প্রতিদিন খুব ভাল করে 'সংবাদ' পড়বেন, খুটিয়ে খুটিয়ে। কোন খবরটির ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সেটিও বোঝার চেষ্টা করতে হবে। সমস্ত পত্রিকাটি পড়া শেষ হয়ে গেলে ভাবতে হবে আগামীকাল 'সংবাদ'-এর সম্পাদকীয় কী হতে পারে। কারণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবরটি নিয়েই সম্পাদকীয় লেখা হবে। এটা মাথায় রেখে নিজেকে সেই সম্পাদকীয়র বিষয়বস্তু ও মূল পয়েন্টগুলো লিখতে হবে। তারপর অপেক্ষা করতে হবে আগামীকালের 'সংবাদ'-এর জন্য। পরদিন পত্রিকা হাতে পেয়েই প্রথমে দেখতে হবে সম্পাদকীয়টি কী বিষয়ে লেখা হয়েছে। যদি দেখেন যে, ভাবনার সঙ্গে মিলে গেছে তাহলে দু'টি লেখার মধ্যে তুলনামূলক বিচার করে নিজের ঘাটতিটুকু পূরণ করতে হবে। সংবাদপত্র নিছক কোনো তথ্য সংগ্রহের ব্যাপার মাত্র নয়, এটা রাজনৈতিক চর্চা এবং মতাদর্শিক আত্মগঠনেরও বড় হাতিয়ার।"
বহু সংকট-সমস্যা, উত্থান-পতনের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্র, জাতীয় স্বাধীনতা ও শ্রমিকশ্রেণী-ছাত্র-যুব-নারী-বুদ্ধিজীবী প্রভৃতি মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে ষাটের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি বিকাশের একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের প্রধান নির্মাতা ও সংগঠক ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ।
মোহাম্মদ ফরহাদের জন্ম ১৯৩৮ সালের ৫ জুলাই। দিনাজপুর জেলার পাবনায়। তার পূর্ব-পুরুষের বাসস্থান ছিল পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার জমাদারপাড়া গ্রামে। বর্ষণমুখর বৃষ্টির দিনে রাতের বেলায় তার জন্ম হয়েছিল বলে_ নাম রাখা হয়েছিল বাদল। তার বাবা স্কুলের ভর্তির খাতায় নাম দিয়েছিলেন আবুল কালাম আজাদ মোহাম্মদ ফরহাদ। তবে শেষ পর্যন্ত গণমানুষের কাছে মোহাম্মদ ফরহাদ নামেই পরিচিত হন। বাবা আহম্মেদ সাদাকাতুল বারী। তিনি ওই সময়ের গ্রাজুয়েট ছিলেন। এজন্য সমস্ত এলাকা জুড়ে তার ব্যাপক পরিচিতি ছিল। তিনি সরকারী চাকুরীতে না গিয়ে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন। কারণ একটাই_ মানুষের জন্য, দেশের জন্য কাজ করা। তিনি ছিলেন ১১ সন্তানের জনক। শেষ পর্যন্ত তার ৬ সন্তান বেঁচে ছিল। ফরহাদ ছিলেন পঞ্চম।
পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। শিশুকাল শৈশব কৈশর কেটেছে দিনাজপুরে। বাল্যকালে দিনাজপুর প্রাইমারী স্কুলে পড়াশুনা করেন। তখন চলছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ সময় তিনি তার বাবার কাছ থেকে যুদ্ধের বিবরণ শুনে নানা প্রশ্ন করতেন। যুদ্ধ কারা করে, কেন করে, কেন মানুষ মারে আরও কত কি? এভাবেই ধীরে ধীরে রাজনৈতিক জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন।
১৯৪৭ সালে তিনি সপ্তম শেণীর ছাত্র। তিনি ছাত্র হিসেবে খুব তুখোড় ছিলেন। তখন তিনি মুকুল ফৌজ নামে একটি শিশু-কিশোর সংগঠনের সাথে যুক্ত হন। এই সংগঠনটি ছিল মুসলিমলীগের দৈনিক মুখপত্র আজাদ পত্রিকার। পত্রিকার শিশু-কিশোর পাতায় তিনি অনেক লেখা লিখেছেন। ওই সংগঠনে কাজ করে এক পর্যায়ে তিনি সংগঠনের ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৪৮-৪৯ সালে স্কুলের মিলিশিয়াতে যুক্ত হন। এই মিলিশিয়া বাহিনীতেও তিনি যোগ্যতা অর্জন করে লিডার নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি খেলাধুলায় তেমন পারদর্শী ছিলেন না, তবে ভাল আবৃতি করতেন। নাটকও করেছেন বেশ কয়েকবার। মাছধরা, পাখি শিকার ও ঘুরে বেড়ানো তার ছিল স্বাভাবিক নেশা। ছোটবেলায় তিনি নানাভাবে মানুষকে হাঁসাতে পছন্দ করতে। কান নাচানোর অভিনয় দেখিয়ে অন্যদের আনন্দ দিতেন। সময় করে বই পড়তেন নিয়মিত। বেশী পড়তেন ডিটেকটিভ বই। একরোখা স্বভাবের এই মানুষটি যা সিদ্বান্ত নিতেন, তা করে ছাড়তেন।
১৯৩৭-৩৮ সালে কমিউনিষ্ট পার্টির দিনাজপুর শাখা গঠিত হয়। ১৯৪০ সাল থেকে ওই অঞ্চলে কৃষকদের তেভাগা আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন কমিউনিষ্টরা। তেভাগা আন্দোলনে ৬০ লক্ষ কৃষক জড়ো হয়েছিল। এই লড়াই-সংগ্রামের কথা তখন ওই অঞ্চলের শিশুরা পর্যন্ত জানতো। ফরহাদের চেতনায় এই আন্দোলন রেখাপাত করেছিল। ১৯৫০-৫১ সালে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের একটি পাঠাগারের সাথে তার সম্পর্ক হয়। এই পাঠাগার থেকে রাজনৈতিক বই নিয়ে পড়তেন। তাছাড়া বাবার কাছে কমিউনিষ্টরা সমাজের সবচেয়ে ত্যাগী মানুষ এ গল্প বহুবার তিনি শুনেছেন। কমিউনিষ্টদের নিয়ে বন্ধু-বান্ধবের কাছে গল্প করতেন। খাতায় কাস্তে-হাতুড়ি একে রাখতেন। এভাবেই ফরহাদের শৈশব চেতনা গড়ে উঠে। ওই সময় থেকে তিনি কমিউনিষ্ট পার্টির নেতা-কর্মীদের সংস্পর্শে আসেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে তিনি গ্রাজুয়েশন ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। তারপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হন। সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়াশুনার সময় তিনি পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হন। দিনাজপুর জেলা ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করেন। ওই বছর মে মাসে তিনি জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক, অক্টোবরে সহ-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ছাত্র সংসদ থেকে ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৫৪ সালের জুন মাসে তাঁকে পাকিস্তান পুলিশ কুখ্যাত নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে বিনা বিচারে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৫৫ সালে তিনি পার্টির সদস্যপদ পান। ১৯৫৬ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন দিনাজপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। ১৯৫৯ সালে তিনি গোপনে গোপনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে সংগঠিত করতে থাকেন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এম.এ পাশ করেন। ওই বছর আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের জন্য গঠিত হয় ৫ সদস্য বিশিষ্ট ছাত্র কমিটি। এই কমিটির মূল নেতা ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ।
১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে ঢাকার রাজপথে মিলিটারী ও পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে প্রথম যে মিছিল বের হয়, মোহাম্মদ ফরহাদ সেই মিছিলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৩ সালে কমিউনিষ্ট পার্টির ঢাকা জেলা কমিটির সদস্য ও পরে সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে পার্টির কেন্দ্রিয় কমিটির সংগঠক ও ১৯৬৭ সালে পার্টির কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালে পার্টির কেন্দ্রিয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও তাঁর অবদান ছিল। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর তিনি সংগঠক, নেতা ও অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী রাশেদা খানমকে (রিনা খান) সহধর্মীনী করেন। তাদের সংসারে দুটি সন্তানের জন্ম হয়।
স্বাধীনতার পর কমিউনিষ্ট পার্টি প্রকাশ্যে কাজ করার সুযোগ পায়। ১৯৭৩ সালে মোহাম্মদ ফরহাদ কমিউনিষ্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠন করে মোহাম্মদ ফরহাদকে কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত করেন এবং ওই দলের রাজনৈতিক প্রশিক্ষকের দায়িত্ব দেন। ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কমিউনিষ্ট পার্টি নিষিদ্ধ করে। ওই বছর জিয়াউর রহমান সরকার মোহাম্মদ ফরহাদকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেয়।
১৯৭৮ সালে তিনি মুক্তি পান। ১৯৭৯ সালে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮০ সালে তিনি পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসে পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালের মার্চ মাসে ৬ লক্ষ নিম্ন বেতনভূক্ত সরকারী কর্মচারীকে সংগঠিত করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। এজন্য সরকার তার উপর ক্ষুব্দ হয়। গ্রেফতার করে মোহাম্মদ ফরহাদকে। সরকার তার উপর রাজদ্রোহ মামলা রুজু করে বিশেষ ট্রাইবুনালে বিচারকার্য চালায়। এ মামলায় আফগান স্টাইলে বিপ্লবের মাধ্যমে সরকারকে উৎখাত করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। অবশেষে ১৯৮১ সালে সুপ্রিমকোর্ট তার জামিন মঞ্জুর করে।
১৯৮৩ সালে এরশাদের সেনা বাহিনী ছাত্র মিছিলে গুলি চালায়। মোহাম্মদ ফরহাদের নেতৃত্বে সারা দেশ জুড়ে এর প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় এরশাদের সেনা বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে ক্যান্টনন্টের অন্ধকার কক্ষে ১৪ দিন আটক রেখে নানামাত্রিক নির্যাতন চালায়। এই মামলা আন্দোলনের চাপে এরশাদ সরকার ১৯৮৪ সালে রাজদ্রোহ মামলা প্রত্যাহার করে। এরশাদ সরকার ক্ষমতা দক্ষলের পর ১৫ দল ও ৭ দলীয় জোটের যুগপথ কর্মসূচি, ঐতিহাসিক ৫ দফা প্রনয়ন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের প্রধান সংগঠক ও নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন।
১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি নির্বাচিত হন। ওই বছর জাতীয় সংসদ অধিবেশনের বাজেট বক্তৃতায় তিনি সরকারের গণবিরোধী চরিত্রের উপর বক্তব্য রাখেন, তা ইতিহাসে অবিস্মরণীয়।
১৯৮৭ সালের ১০ জানুয়ারী তিনি হার্টের রোগে আক্রান্ত হন। ১৯৮৭ সালের ৭-১১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত পার্টির চতুর্থ কংগ্রেসে পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। দেশের শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির সংগ্রামে নিবেদিত প্রাণ মোহাম্মদ ফরহাদ বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য ছিলেন। এছাড়াও দেশের সবচেয়ে অবহেলিত নির্যাতিত ক্ষেতমজুরকেও তিনি সংগঠিত করতেন। এ সংগঠনেরও তিনি কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ ১৯৮৭ সালের ১০ আগস্ট চিকিৎসার জন্য মস্কো যান। ৬ অক্টোবর তিনি হাসপাতাল ত্যাগ করে হোটেলে অবস্থান করেন। ৯ অক্টোবর তিনি মারা যান।


 লেখকঃ  শেখ রফিক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন