বহু যুগ আগেই গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলে গেছেন যে ‘মানুষ হলো একটি রাজনৈতিক জীব’। ইতিহাসের কোনো এক পর্যায়ে সমাজে শ্রেণি বিভাজন ঘটার মধ্যদিয়ে শোষিত শ্রেণির ওপর শোষক শ্রেণির কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বস্তুত তখন থেকেই ‘রাজনীতির’ সূত্রপাত। এরপর থেকে সমাজে রাজনীতির চর্চা চলেছে, বিভিন্ন চিন্তাধারা ও মতবাদের উদ্ভব ঘটেছে এবং ধারাবাহিকভাবে সে সবের অনুশীলনও অব্যাহত থেকেছে। রাজনৈতিক মতবাদের সাথে অতি স্বাভাবিকভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে দর্শন চিন্তা, ইতিহাসের পাঠ, অর্থশাস্ত্রের চর্চা ও চলমান ঘটনাবলির বাস্তব বিশ্লেষণ ইত্যাদি প্রসঙ্গগুলো। সমান্তরালভাবে নানা ধারার রাজনৈতিক মতবাদের পাশাপাশি চর্চা হলেও, সেগুলোর মধ্যকার বিরোধগুলোর মাঝে সচেতন বা অসচেতন রূপে, বিদ্যমান থেকেছে সমাজের বিভিন্ন শোষক ও শোষিত-বঞ্চিত শ্রেণিগুলোর মধ্যকার স্বার্থপ্রসূত বিবেচনা। শ্রেণি দ্বন্দ্বই রাজনৈতিক মতবাদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের রূপ নিয়েছে। মার্কসবাদীদের মতে, রাজনৈতিক মতবাদ নিয়ে বিতর্ক হলো চূড়ান্ত বিচারে সমাজে চলতে থাকা শ্রেণি সংগ্রামেরই একটি রূপ। রাজনৈতিক মতবাদ নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিশেষভাবে প্রবল হয়েছে সামাজিক বিপ্লব অথবা গণজাগরণ-গণঅভ্যুত্থানের সময়গুলোতে।
রাজনৈতিক মতবাদ নিয়ে বিতর্ক চলে এসেছে বহু যুগ আগে থেকেই। কিন্তু অতীতের সব কালপর্বের চেয়ে এই তর্ক-বিতর্ক ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত নতুন মাত্রা নিয়েছে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের বর্তমান যুগে। এই যুগেই জন্ম নিয়েছে ‘মার্কসবাদের’ মতবাদ। আগেকার অনেক মতবাদ থেকে উপাদান সংগ্রহ করলেও, বিদ্যমান সব মতবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই উদ্ভব ঘটেছে মার্কসবাদের। আজ থেকে ২০০ বছরের কম সময় আগে, ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে, এই মতবাদের উদ্ভব। সেই বিচারে, রাজনীতির কয়েক হাজার বছরের কালপর্বের প্রেক্ষিতে মার্কসবাদ হলো বলতে গেলে একটি তুলনামূলক ‘নবীন’ মতবাদ। মার্কসবাদ হলো সমাজতন্ত্রের জন্য শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামের তত্ত্বগত হাতিয়ার। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ফলেই তার উদ্ভবের একটি বস্তুগত ভিত্তি পায় মার্কসবাদ। সেই পটভূমিতেই জন্ম নিয়েছিল মার্কসবাদ। এই বাস্তব সামাজিক-অর্থনৈতিক ভিত্তি সৃষ্টি হওয়া ব্যতীত মার্কসবাদের উদ্ভব সম্ভব হতো না।
মার্কসবাদের উদ্ভবের সাথে সাথে তা অপরাপর সব রাজনৈতিক মতবাদের কম-বেশি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বৈরিতার সম্মুখীন হয়েছে। মার্কসবাদী মতবাদকে দুর্বল করার জন্য যারা মার্কসবাদের প্রতিপক্ষ তারা প্রথমে ‘উপেক্ষা ও নীরবতার’ অস্ত্র প্রয়োগ করেছে। তার পরে যে অস্ত্রটি তারা প্রয়োগ করেছে তা হলো মার্কসবাদের নামে মার্কসবাদের ‘বিকৃতি’ সাধনের ও তার বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচার’ চালানোর কাজ। পরিশেষে তারা ব্যবহার করেছে সরাসরি ‘আক্রমণ ও আঘাত’ হানার কাজ। আজও পৃথিবীর দেশে দেশে মার্কসবাদের, তথা শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের প্রতিপক্ষে থাকা শক্তিরা মার্কসবাদের বিরুদ্ধে তাদের সুবিধা মতো এই তিন ধরনের অস্ত্রই ব্যবহার করে চলেছে।
এক অর্থে বিবেচনা করলে, মার্কসবাদের বিকৃতি সাধনের চেষ্টাই হলো তার বিরুদ্ধে ব্যবহূত সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্ত্র। একেবারে শুরু থেকেই এই অস্ত্র প্রয়োগ করেছে পুঁজিবাদের রক্ষক ও সমর্থকরা। এই উদ্দেশ্যে অন্যান্য নানা পন্থার পাশাপাশি তারা মার্কসবাদীদের আন্দোলনের মধ্যে তাদের এজেন্ট ঢুকিয়ে দিতেও দ্বিধা করেনি। ‘লাল পতাকাকে লাল পতাকা দিয়ে মোকাবিলা করার’ কৌশল তারা অবলম্বন করেছে। এটি তারা পেরেছে মার্কসবাদী বলে দাবিদারদের কারো কারো মধ্যে বিরাজমান বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতিকে কাজে লাগিয়ে।
মার্কসবাদ হলো একটি ‘বৈজ্ঞানিক’ মতবাদ। যদি তাই হয় তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এরূপ একটি বৈজ্ঞানিক মতবাদের অনুসারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি বা বিচ্যুতির সুযোগ ঘটতে পারে কিভাবে? দুই আর দুইয়ে চার হয়, হাইড্রোজেনের দুটি অণুর সাথে অক্সিজেনের একটি অণু যুক্ত হলে পানি সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞান তো হলো এরকম বিষয়। তাহলে বিকৃতি-বিচ্যুতির সুযোগ বিজ্ঞানভিত্তিক বলে দাবিদার কোনো মতবাদে জন্ম নেয়ার ভিত্তি পায় কিভাবে? আর, বিকৃতি-বিচ্যুতির সুযোগ যেখানে থাকে তাকে আদৌ কি একটি বৈজ্ঞানিক মতবাদ বলে আখ্যায়িত করা যায়? এ প্রশ্নের পরিষ্কার জবাব আছে। এক্ষেত্রে একথাটি বুঝতে হবে যে, মার্কসবাদ হচ্ছে একটি সামাজিক বিজ্ঞান। অন্যদিকে, অঙ্কশাস্ত্র, রসায়নশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা ইত্যাদি হলো প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিষয়। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সূত্রগুলো হলো আপেক্ষিকভাবে নির্দিষ্ট ও চূড়ান্ত। কিন্তু সামাজিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সেগুলো কখনই পূর্ণরূপে নির্দিষ্ট ও চূড়ান্ত নয়। সামাজিক বিজ্ঞানকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো একরৈখিকভাবে চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করাটি হবে অবৈজ্ঞানিক যান্ত্রিকতা।
সামাজিক বিজ্ঞানের সূত্রগুলোর ও তার অণুসিদ্ধান্তগুলো বিজ্ঞানসম্মত কিনা সেটি নির্ভর করে তা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে কি হচ্ছে না— তার ওপর। বিশ্লেষণের যে ‘ঐতিহাসিক ও দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী’ পন্থা অনুসরণ করে মার্কসবাদ, সেটিই হলো তার বিজ্ঞানসম্মতার ভিত্তি। সমাজবিজ্ঞান হিসেবে মানুষ ও মানব সমাজ হলো তার বিশ্লেষণের বিষয়বস্তু। মানুষ ও তার সমাজ কোনো যন্ত্র নয়। তার একটি ঐতিহাসিক বিবর্তন-ধারা ও মোটা দাগের বৈশিষ্ট্য থাকলেও (যা বিদ্যমান সমাজ বাস্তবতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে), তা বৈচিত্র্যমণ্ডিত ও অ-সুনির্দিষ্ট। এ কারণেই মার্কসবাদ একটি চূড়ান্ত-বিজ্ঞান নয়। তা প্রধানত হলো একটি বিজ্ঞাননির্ভর বিশ্লেষণ পদ্ধতি। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে মানুষ সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্র ও তা থেকে আহরিত অণুসিদ্ধান্ত খুঁজে নেয়। মানব সমাজের গতিময়তা ও মানব চেতনার বৈচিত্র্যময় বিকাশের কারণেই সমাজ বিজ্ঞানের সব ধারা-উপধারার মধ্যেই স্বাভাবিকভাবে বিরাজ করে মনোগত (subjective) বিভ্রান্তি, বিকৃতি বা বিচ্যুতির সুযোগ।
দীর্ঘকাল ধরে মানব সমাজ পরিচালিত হয়েছে কোনো এক শ্রেণির মানুষ কর্তৃক অপরাপর শ্রেণির মানুষের ওপর শোষণের ভিত্তিতে। সে ভিত্তিতেই সমাজ বিবর্তিত হয়েছে। শোষণের রূপ ও শোষক শ্রেণির পরিচয় হয়তো বদলেছে, কিন্তু শোষণ কখনই বন্ধ হয়নি। সমাজ যদি শোষণ-ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়, তদনুসারেই সমাজে গড়ে ওঠে বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, দার্শনিক মতবাদ। সেগুলোই হয়ে ওঠে ‘চলতি হাওয়ার’ মতবাদ। তবে, শোষণভিত্তিক সমাজে শোষণ প্রক্রিয়া যেমন বাস্তব, তেমনই বাস্তব হলো শোষক ও শোষিতের মধ্যে শ্রেণি সংগ্রাম। সে কারণে, শোষক শ্রেণির মতবাদের পাশাপাশি একই সাথে পাল্লা দিয়ে গড়ে ওঠে শোষিত শ্রেণির মতবাদ। সেই মতবাদ হলো নতুন। শোষক শ্রেণির যুগ যুগের প্রাচীন সব মতবাদ ও তার সূক্ষ্ম সব প্রভাবের বিরুদ্ধে একপ্রকার যুদ্ধ চালিয়েই সেই নতুন মতবাদকে নিজের স্থান করে নিতে হয়। মার্কসবাদকেও তা করতে হচ্ছে।
বিভিন্ন ধারার বুর্জোয়া মতবাদসহ অতীতের শোষণভিত্তিক সমাজগুলোর জের হিসেবে থাকা সব ধরনের মতবাদের বিস্তৃত পরিমণ্ডলের সর্বগ্রাসী প্রভাবের বিরুদ্ধে পদে পদে যুদ্ধ করেই শ্রমিক শ্রেণির মতবাদ হিসেবে মার্কসবাদকে স্থান করে নিতে হয়েছে। এরূপ প্রবল মতবাদিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মাঝে মার্কসবাদী বলে দাবিদার বা মার্কসবাদী হওয়ার সম্ভাবনাপূর্ণ অনেকে যে বুর্জোয়া ভাবধারার প্রভাবে কোনো এক পর্যায়ে পথচ্যুত হতে পারে, সেটি মোটেও অস্বাভাবিক নয়। হবে না, তেমন ভাবাটি মোটেও যুক্তিসঙ্গত হবে না। তদুপরি, এ ধরনের সম্ভাবনা বিশেষত এ কারণেও সৃষ্টি হয় যেহেতু মার্কসবাদ শ্রমিক শ্রেণির মতবাদ হলেও তা শ্রমজীবী মানুষের মাঝে বহন করে নিতে হয় বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদেরকে। বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী তৈরি হয় প্রধানত বুর্জোয়া-পেটি বুর্জোয়া শ্রেণি থেকে। বুর্জোয়া মতবাদের সব প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়াটা তাদের জন্য একটি কঠিন আত্মসংগ্রামের ব্যাপার। সেই আত্মসংগ্রামে জয়ী হতে পারাটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার ব্যাপার। শ্রেণিচ্যুত হওয়া ও শ্রেণিচ্যুত হয়ে থাকার জন্য নিরন্তর আত্মসংগ্রাম একান্তভাবে অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে যে যখন যতটুকু সফল হন, তার মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতির আশংকা থাকে ততো কম। এই আত্মসংগ্রামে সফল হতে যে যতটুকু অপারগ হন, তার মধ্যে ততো পরিমাণে জন্ম নেয় বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতি।
অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও মার্কসবাদের চর্চা অগ্রসর হয়েছে নানা ধরনের বিকৃতি, বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতির বিরুদ্ধে প্রবল যুদ্ধ করে। বিচ্যুতি এসেছে দু’দিক থেকে। দক্ষিণপন্থি বিচ্যুতির পাশাপাশি বামপন্থি বিচ্যুতির বিরুদ্ধে মার্কসবাদকে তার বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য ক্রমাগত সংগ্রাম করতে হয়েছে। সেই সংগ্রাম করতে হচ্ছে এখনো। মাঝে-মধ্যে সে সংগ্রাম অন্য সময়ের তুলনায় সুতীব্র হয়েছে। যেমন দেশ-ভাগের পর ১৯৪৮ সালের অতি-বিপ্লবী বিচ্যুতির বিরুদ্ধে, ষাট দশকের চীন-রাশিয়া দ্বন্দ্বের সময় ‘চীনপন্থিদের’ পদস্খলনের বিরুদ্ধে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তির পর ‘মস্কোপন্থিদের’ একাংশের ‘বিলুপ্তবাদের’ বিরুদ্ধে। ‘বিলুপ্তবাদের’ বিরুদ্ধে মার্কসবাদীদের দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থার জন্ম দেয় যখন ‘বিলুপ্তবাদীরা’ পার্টি ত্যাগ করে গণফোরাম, আওয়ামী লীগ ও এমনকি বিএনপিতে যোগদান করেন। কিন্তু দ্বন্দ্বটি যেহেতু শুধু কিছু ব্যক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্ব ছিল না, এবং তা ছিল মার্কসবাদের বিকৃতি ও বিচ্যুতির বিরুদ্ধে পরিশুদ্ধ মার্কসবাদের দ্বন্দ্ব এবং যেহেতু এই বিকৃতি ও বিচ্যুতির ভিত্তি বিদ্যমান সামাজিক বাস্তবতার মাঝেই বিদ্যমান ছিল— সে কারণে এই দ্বন্দ্বের জের অব্যাহত আছে ও থাকবে।
মার্কসবাদের চর্চার ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া এসব ট্র্যাজিক বিকৃতি ও বিচ্যুতির মধ্যে স্পষ্টতই দু’ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। একটি প্রবণতা হলো, ‘ডগমা’ আশ্রয়ী দৃষ্টিভঙ্গিতে মতান্ধের মতো বাঁধাবুলির আশ্রয়ে আবদ্ধ হয়ে থাকার প্রবণতা। এই প্রবণতায় যারা আক্রান্ত কিছুতেই তাঁরা মার্কসবাদের গতিময় বৈজ্ঞানিক মর্মবাণীর দিকে মুখ ফেরাতে রাজি নন। জাত যাবে এই ভয়ে একই গ্রামোফোন রেকর্ডকেই পুনঃ পুনঃ বাজানোর মতো, গণ্ডিবদ্ধ বাধাধরা শাস্ত্রীয় মনোভঙ্গির বাইরে আসতে তাঁরা নারাজ। সাধারণত তারা যান্ত্রিক, সংকীর্ণতাবাদী ও অতি-বিপ্লবী চিন্তায় আক্রান্ত হন।
অন্যদিকে অপর প্রবণতাটি হলো, ঠিক উল্টোমুখী। এই প্রবণতায় যারা আক্রান্ত তাঁরা বিপ্লবপন্থি না হয়ে অনেকটা সংস্কারপন্থি হয়ে থাকেন। তারা সহসা বিজ্ঞানসম্মততা ও মুক্ত চিন্তার লেবেল লাগাতে অস্থির হয়ে ওঠেন। তাদের এই বিকৃতি ও বিচ্যুতিকেই প্রথমে মার্কসবাদ বলে চালিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। তা করতে না পেরে তখন তারা পড়ি-মরি করে মার্কসবাদ পরিত্যাগ করতে দৌড় শুরু করেন। ‘ডগমা’ আশ্রয়ী যে বিকৃত ধারণাগুলোকে প্রথমাবস্থা থেকে এতোদিন তাঁরা মার্কসবাদ বলে বিবেচনা করে এসেছেন, এবং যার প্রতি ‘অন্ধবিশ্বাস’ স্থাপন করে এসেছেন, সেক্ষেত্রে মার্কসবাদকে জানা ও বুঝার ব্যাপারে নিজেদের ত্রুটি স্বীকার না করে তাঁরা উল্টো মার্কসবাদের উপরেই সব দোষ চাপিয়ে নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ প্রমাণ করতে সচেষ্ট হন। বিকৃতি-নির্ভর ধারায় পথ চলার ফলে সৃষ্ট ভ্রান্তি আকস্মিকভাবে আবিষ্কার করার পর তাঁরা বস্তুত মার্কসবাদের মর্মকথার দিকে একবার ভালভাবে মুখ ফিরিয়ে যাচাই করে দেখার এবং মার্কসবাদ অনুধাবনে ভ্রান্তি থেকে মুক্ত হওয়ার প্রয়াসের বদলে একলাফে খোদ ‘মার্কসবাদকেই’ ফেলে দিতে অস্থির হয়ে ওঠেন। সুস্থিরভাবে মার্কসবাদের মর্মবাণীর দিকে একবার মুখ ফিরিয়ে দেখার কোনো প্রয়োজনও তাঁরা অনুভব করেন না।
বাহ্যত বিপরীত ধরনের প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও আসলে উভয় প্রবণতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা যেকোনো মতাদর্শকে এবং মার্কসবাদকেও, একভাবেই দেখতে অভ্যস্ত ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তা হলো ‘ডগমা’ হিসেবে। আসলে তারা সবসময়ই ‘ডগমা’র পূজারি সেটা মার্কসবাদের নামেই হোক অথবা মার্কসবাদ পরিত্যাগের নামেই হোক, কিংবা হোক তা অন্য কোনো নতুন পাওয়া মতাদর্শের নামে। উভয়ের ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাই মার্কসবাদের স্বরূপ অনুসন্ধানে প্রবল অনীহা এবং মার্কসবাদ অনুধাবনের ক্ষেত্রে ‘ডগমাটিক’ মনগড়া ধারণা আঁকড়ে থাকার প্রবণতা। অথচ মার্কসবাদের মর্মকথার দিকে, তার উেসর দিকে, তার অনন্ত সৃজনশীলতার দিকে, ক্লাসিক্যাল মার্কসবাদের দিকে ঠিকমতো মুখ ফেরাতে পারলে এই উভয় ধরনের ট্র্যাজেডি ও লজ্জা থেকে নিষ্কৃতির পথ রচনা সম্ভব।
রাজনৈতিক মতবাদের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি সেসব মতবাদের ক্ষেত্রে বিকৃতি, বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতির উেসরও রয়েছে নির্দিষ্ট শ্রেণিগত ভিত্তি। তাই, একথাটি সবসময় মনে রাখা কর্তব্য যে, মতবাদ হিসেবে মার্কসবাদকে আয়ত্ত করতে হলে এবং তার কোনো বিকৃতি ও বিচ্যুতি থেকে যথাসম্ভব মুক্ত থাকতে হলে, শ্রমিক শ্রেণি ও মেহনতি মানুষের সাথে সংযুক্ত হওয়া ও তাদের কাছে বারংবার ফিরে যাওয়াটিই হলো মার্কসবাদীদের জন্য সবচেয়ে মূল্যবান ও অত্যাবশ্যক কর্তব্য। শ্রমিক শ্রেণি ও মেহনতি মানুষই হলো প্রকৃত মার্কসবাদীদের জন্য শক্তির প্রধান উত্স।
লেখক : মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
দৈনিক ইত্তেফাক, ১৭ অক্টোবর, ২০১৬ ইং তারিখ প্রকাশিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন