Biplobi Barta

শনিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৭

কার গোয়ালে কে দেয় ধোঁয়া


সরকারের পক্ষ থেকে এ রকম একটি ঘোষণা যে সহসাই আসবে তা আগেই অনুমান করা গিয়েছিল! ঘোষণাটি হলো- সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের সভায় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রীমন্ডলী, সংসদ সদস্যবৃন্দসহ ১৫টি সাংবিধানিক পদাধিকারীদের পারিতোষক তথা বেতন-ভাতা দ্বিগুণ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত সংসদে পাস করানোর পর ২০১৫ সালের জুলাই মাস থেকে কার্যকর হবে। ইতোমধ্যে সেই জুলাই মাস থেকেই সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্তও কার্যকর হতে শুরু হয়ে গেছে। কর্মকর্তাদের সেই বর্ধিত বেতন-ভাতার সঙ্গে ‘সামঞ্জস্য’ বিধানের জন্য মন্ত্রী-মিনিস্টার-এমপি প্রমুখের জন্য এই বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করতে হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনটা করার জন্য কোনটা করা হলো, পরেরটির জন্য আগেরটি না আগেরটির জন্য পরেরটি তা নিয়ে যথার্থ সন্দেহমূলক আলোচনা আছে। সে যাই হোক, সরকার ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত সব পদাধিকারী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করার কাজ অবশেষে সমাপ্ত হলো। কিন্তু এদের মোট সংখ্যা হলো মাত্র ২১ লাখ। অথচ দেশের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা হলো ৫-৬ কোটি। অর্থাৎ সরকার যাদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করল তাদের সংখ্যা মাত্র ৪ শতাংশ। প্রশ্ন হলো, অবশিষ্ট ৯৬ শতাংশের জন্য সরকার কী পদক্ষেপ নিল? তাদের প্রতি কি সরকারের কোনো দায়িত্ব নেই? এ সরকার কি শুধু ৪ শতাংশের জন্য?
বেতন-ভাতা বৃদ্ধির বিষয়টি যর্থাথভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, প্রধানত দু’কারণে। বাজারে মূল্যস্ফীতির কারণে আগের বেতন-ভাতায় পূর্বের সমপরিমাণ দ্রব্য ও সেবাসামগ্রী যখন কোনো ব্যক্তি আর কিনে আনতে অপারগ হয়ে পড়ে, তখন তার ‘ক্রয়ক্ষমতা’ তথা ‘প্রকৃত আয়’ একান্তভাবে পূর্বাবস্থায় বজায় রাখার প্রয়োজনে বেতন-ভাতা বাড়ানোটা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। অর্থাৎ তার ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস ঠেকাতে তা করতে হয়। তবে এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় আরেকটি সম্ভাব্য দিক আছে। তা হলো, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের জীবন-মান যদি বাড়াতে হয় তাহলেও সমানুপাতে বেতন-ভাতা বাড়ানোর মাধ্যমে (কিংবা জনস্বার্থে মোট সামাজিক ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে) তা করা সম্ভব। এই দুটির কোনো একটি কারণে কিংবা উভয় কারণে বেতন-ভাতার ‘সামঞ্জস্য’ বিধানের বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হতে পারে।
কিন্তু সরকার এসব যুক্তির ধারেপাশে যায়নি। যদি তারা সেই যুক্তির পথে যেত তাহলে স্বাভাবিকভাবে উল্লিখিত ৯৬ শতাংশ কর্মজীবীর (যারা সরকারি বেতন-ভাতা বৃদ্ধির আওতার মধ্যে পড়ে না) বেতন-ভাতা-আয়-উপার্জন আনুপাতিক হারে বাড়ানোর বিষয়টি সরকারের কাছে সমভাবে প্রাসঙ্গিক হতো। কিন্তু এই ৯৬ শতাংশের ক্ষেত্রে সরকারের যেন কোনো মাথাব্যথাই নেই! ভাবটা এমন যে, ৯৬ শতাংশের যা হওয়ার তা হোক, যে ৪ শতাংশ মানুষ সরাসরি সরকারের বা রাষ্ট্রের কাজ করে, তাদের ‘সেবা’ করলেই যথেষ্ট। অথচ এই ৪ শতাংশের ‘সেবা’ করার টাকার সিংহভাগ জোগান দিতে হয় সেই অবশিষ্ট ৯৬ শতাংশ মানুষকে। তাই সঙ্গত প্রশ্ন, কার গোয়ালে কে দেয় ধোয়া? যে সরকার এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে সে কি নিজেকে কোনোভাবে ‘জনগণের সরকার’ বলে দাবি করতে পারে?
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, এমপি প্রমুখসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ঢালাওভাবে প্রায় ডবল করে সমান পরিমাণে (প্রায় ১০০ শতাংশ) বাড়ানো হয়েছে। উচ্চপদে অধিষ্ঠিত যে কর্মকর্তার বেতন ছিল ৪০ হাজার টাকা তার বেতন বাড়ানো হয়েছে আরও ৪০ হাজার। আর যে স্বল্প বেতনভুক্ত কর্মচারীর বেতন ছিল ৫ হাজার তার বেতন আর মাত্র ৫ হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির কারণে দু’জনই সমান পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও উঁচুতলার মানুষদের বেতন বাড়ানো হয়েছে স্বল্প আয়ের কর্মচারীদের তুলনায় ৮ গুণ বেশি। এর ফলে বৈষম্য কি আরও বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা করা হলো না? অথচ সম্পদের সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা চালুর লক্ষ্য নিয়েই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, লাখো শহীদ জীবন দিয়েছিল।
তাই দেখা যাচ্ছে যে, ৪ শতাংশ মানুষের বেতন-ভাতা প্রায় দ্বিগুণ করার ফলে সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও সেই সূত্রে তাদের জীবন-মানে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের প্রভাব পড়বে। সেই ভিন্ন ভিন্ন প্রভাবগুলো কী?
প্রথমত, এ কথা ঠিক যে, এই ৪ শতাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা রাতারাতি কম-বেশি মাত্রায় বাড়বে। গত কয়েক বছরের মুদ্রাস্ফীতির হার বিবেচনায় নিলে এই বৃদ্ধি যুক্তিসঙ্গত। তবে তাদের মধ্যে নিচের গ্রেডের কর্মচারীদের তুলনায়, মন্ত্রী-এমপিসহ ওপরের গ্রেডের কর্মকর্তাদের বেতন বৃদ্ধি ঘটবে অনেক বেশি পরিমাণে। সবার বেতন ‘সমান পরিমাণে’ বাড়ানোর পরিবর্তে ‘সমান অনুপাতে’ বাড়ানোর ফলে এমনটি ঘটাই স্বাভাবিক। ফলে মন্ত্রী-এমপি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য আরও বাড়বে।
দ্বিতীয়ত, এই বৈষম্যের পরিমাণ আরও বাড়বে এই কারণে যে, উচ্চস্থানে অবস্থিতদের এখন তাদের বেতনের আগের তুলনায় বেশ কম শতাংশ নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র কেনার পেছনে খরচ করতে হবে (কেউ চাইলেও চাল, ডাল, তেল ইত্যাদির ভোগ ইচ্ছেমতো তথা ৮-৯ গুণ পরিমাণে বাড়াতে পারে না)। ফলে অপরিহার্য পণ্যাদির বাইরে বিলাসদ্রব্যসহ অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী কেনার বা তাদের বাড়তি সম্পদের একাংশ বিদেশে পাচারের সক্ষমতা তাদের ক্ষেত্রে আনুপাতিক হারে আরও বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে।
তৃতীয়ত, কর্মক্ষমদের ৪ শতাংশের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ হওয়ার কারণে যদি দ্রব্যমূল্য একই অনুপাতে বৃদ্ধি পায় তাহলে শেষ পর্যন্ত কারোরই, বিশেষত নিম্নতর গ্রেডের কর্মচারীদের কোনো লাভই অবশিষ্ট থাকবে না। মূল্যস্ফীতির ফলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা আগের অবস্থায়ই ফিরে আসবে। আর নিম্নতর স্কেলের কর্মচারীরা মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের বর্ধিত বেতনের সুবিধা যেভাবে ও যতটা দ্রুত হারাবে, উচ্চতর স্কেলের কর্মকর্তারা তাদের সুবিধাটা ততটা দ্রুত হারাবে না। এর ফলেও উঁচু-নিচুর মধ্যে বৈষম্য আরও বাড়বে।
চতুর্থত, ৪ শতাংশ মানুষের বেতন বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতি ঘটবে। এই ৪ শতাংশ কোনোরকমে তা কম-বেশি সামাল দিতে পারলেও অবশিষ্ট ৯৬ শতাংশ মানুষের মধ্যে যারা শ্রমজীবী ও স্বল্প আয়ের, তারা তাদের আয় সমান গতিতে বাড়াতে পারবে না। ফলে ৯৬ শতাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা রাতারাতি হ্রাস পাবে। আগেকার সেই ক্রয়ক্ষমতা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে তাদের মধ্যকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতি মানুষের অনেক সময় লেগে যাবে। এর নিট ফলাফল দাঁড়াবে গরিব-মেহনতি মানুষের কাছ থেকে সম্পদ ওপরতলার মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণির হাতে স্থানান্তর হবে।
পঞ্চমত, মন্ত্রী-এমপি ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হলেও শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি স্কেলের সুপারিশ প্রণয়ন ও ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, অসংগঠিত খাতে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার খর্বিত থাকায় যৌথ দরকষাকষির মাধ্যমে ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার ব্যবস্থাও এখন সেভাবে নেই। প্রবর্তিত শ্রম আইনও শ্রমিকের স্বার্থে নয়। ফলে বিপুলসংখ্যক শ্রমিকসহ গ্রাম ও শহরের সাধারণ মেহনতি মানুষের মজুরির হার (টাকার অংকে) আগের স্তরেই থেকে যাবে বলে আশঙ্কা করা যায়। কিন্তু মাত্র ৪ শতাংশের বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে পরিমাণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে, এসব ৯৬ শতাংশ শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, দিনমজুরসহ অন্যদের ‘প্রকৃত আয়’ও তখন ক্রয়ক্ষমতার হিসেবে, সেই পরিমাণে হ্রাস পাবে।
ষষ্ঠত, যে ৪ শতাংশের বেতন-ভাতা বেড়েছে তাদের বাইরে যে ৯৬ শতাংশ সাধারণ মানুষ রয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই প্রকৃত আয় বিভিন্ন মাত্রায় কমবে। এদের মোট সংখ্যা হলো কম করে হলেও ৫-৬ কোটি। এই ৫-৬ কোটি মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ার ফলে তাদের শ্রমের ফসল হিসেবে সৃষ্ট এক বিশাল পরিমাণের বাড়তি ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ শেষ পর্যন্ত জমা হবে মুষ্টিমেয় লুটেরা-ধনিকদের হাতে। এভাবেই যেমন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দুর্দশা বৃদ্ধি পাবে ও বৈষম্য বাড়বে, তেমনি একই সঙ্গে মদদ পাবে অর্থনীতিতে লুটপাটের কর্মকান্ড ও ধারা।
৪ শতাংশের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির ফলে অবশিষ্ট ৯৬ শতাংশ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং ১০০ শতাংশ মানুষ তথা সবাই যেন সমানভাবে লাভবান হয় সে জন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থাগুলো একই সঙ্গে গ্রহণ করা দরকারঃ
প্রস্তাবিত পে-স্কেলে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত পর্যায়ক্রমে ১ঃ৫ কিংবা নিদেনপক্ষে ১ঃ৬-এ নামিয়ে আনা। (উল্লেখ্য, এই অনুপাত সম্পর্কে স্বাধীনতার আগে-পরে সাধারণ ঐকমত্য ছিল)।
স্থায়ী বেতন কমিশন গঠন করে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রতি বছর যৌক্তিক হারে বেতন বৃদ্ধির স্থায়ী ব্যবস্থা করা।
কলকারখানা-ক্ষেতখামারের সব শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, দিনমজুর ও মেহনতি মানুষের জন্য ১০ হাজার টাকা ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ নির্ধারণ এবং তার প্রদান-প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
অবিলম্বে শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি কমিশন গঠন করা ও তার সুপারিশের ভিত্তিতে বর্ধিত মজুরি স্কেল বাস্তবায়ন করা। সব ধরনের শ্রমিকদের স্বার্থে যৌথ দরকষাকষির অধিকারসহ অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রদান করে শ্রম-আইন ও সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান সংশোধন করা।
পৃথক মন্ত্রণালয় অথবা বিভাগের মাধ্যমে গ্রাম ও শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ‘কন্ট্রোল’ দামে চাল, ডাল, গম, তেল, চিনিসহ ১২ ধরনের পণ্য রেশন দোকানের মাধ্যমে সপ্তাহভিত্তিতে সরবরাহ করা এবং সর্বত্র সরকারি ন্যায্যমূল্যের দোকান চালুসহ শক্তিশালী, দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত ‘গণবণ্টন ব্যবস্থা’ চালু করা।
বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা, পরিবহন ইত্যাদি ক্ষেত্রে লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা এবং নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সরকারিভাবে সাশ্রয়ী আবাসন, শিক্ষা, চিকিৎসা, পরিবহন ইত্যাদির ব্যবস্থা করা। 
... ইত্যাদি।
কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় লুটেরা ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষাকারী সরকার কখনই এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না। সুতরাং ...। বুঝহে সুজন!

লেখকঃ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)  


আমাদের সময়, চতুর্থ পাতা, বুধবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৫ প্রকাশিত




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন