কমরেড জসিম উদ্দিন মন্ডলের সাথে আমার প্রথম দেখা
২০০৬ সালে মেহেরপুর কমিউনিস্ট পার্টির এক সমাবেশে ।তারিখ টা ঠিক মনে নেই, আমি তখন
কমিউনিস্ট পার্টিতে নতুন এসেছি, আমি সাভারের পার্টিতে যুক্ত হওয়ার পর ২০০৬ সালে
আমার গ্রামের বাড়ি মেহেরপুর বেড়াতে গিয়ে শুনি বিকালে কমিউনিস্ট পার্টির সমাবেশ
অনুষ্ঠিত হবে ।আমি দুপুরের পর মেহেরপুর কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক কমরেড স্বপন
আংকেল এর সাথে দেখা করলাম তিনি আমাকে সমাবেশের প্রধান অতিথি কমরেড জসিম উদ্দিন
মন্ডলের সাথে দেখা করিয়ে দিলেন । আমি কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডলকে প্রথম দেখে বড় নেতা
মনে হয়নি কারন আমার তখন মনে হতো নেতা মানে দামি পোষাক, দামি গাড়ি, চকচকে চেহারা
হবে কিন্তু কমরেড জসিম উদ্দিন মন্ডলের তার কোন টায় নেই ।কমরেড জসিম উদ্দিন কে আমার
দেখে মনে হয়েছে গ্রামের কোন এক মাটি কাটা শ্রমিক, পাকা চুল, কুচকুচে কাল চেহারা
কমরেড জসিম উদ্দিন মন্ডলের । কমরেড জসিম উদ্দিন মন্ডল
আমাকে বসার জন্য বললেন, আমি তার পাশের চেয়ারে বসলাম তিনি আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন,
কি করি, কোথায় থাকি তা জিজ্ঞেস করলেন, গার্মেন্ট শ্রমিকদের আন্দলনের কথা জানতে
চাইলেন আমি সব উত্তর দিলাম । তার পর সমাবেশে এক মঞ্চে বক্তব্য রাখলাম, কমরেড জসিম
উদ্দিন মন্ডল একেবারে গ্রামের ভাষায় এত চমৎকার বক্তব্য রাখলেন আমি তার ভক্তব্য
শুনে আমি তার ভক্ত হয়ে গেলাম, সমাবেশে সাধারণ মানুষ এত মনযোগ দিয়ে তার বক্তব্য
শুনল তা কাওকে বোঝানো যাবেনা । গত কিছু দিন আগে আমি আর ইদ্রিস ভাই মেহেরপুর গিয়ে
ছিলাম, মেহেরপুরের সবার দাবি ছিল কমরেড জসিম উদ্দিন কে মেহেরপুর নিয়ে আসার জন্য
কিন্তু মেহেরপুর বাসির সেই আশা আর পুরন হলনা ।
২০০৬ সালের পর, আশুলিয়া ও উত্তরায় গার্মেন্ট
শ্রমিক সমাবেশে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এর সমাবেশ সহ
আরো কয়েক জায়গায় এক মঞ্চে বক্তব্য দিয়েছি । গার্মেন্ট শ্রমিকদের কর্মি সভায় কয়েক
বার এসে আমাদের উপদেশ দিয়েছেন তিনি । আশুলিয়ার গার্মেন্ট শ্রমিকদের দাবির কারনে গত
২০১৬ সালে মহান মে দিবশে আশুলিয়াতে এসেছিলেন গার্মেন্ট শ্রমিক সমাবেশে প্রধান
অতিথি হয়ে কিন্তু প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টির কারনে বক্তব্য রাখতে পারেননি । এছাড়াও কমরেড
জসিম উদ্দিন মন্ডলের সাথে আমার আরো অনেকবার পার্টির আনেক কর্মসুচিতে দেখা হয়েছে,
অনেক গল্প অনেক কথা হয়েছে । কমরেড জসিম উদ্দিন মন্ডল সাভারে তার মেয়ের বাসাতে মাঝে
মাঝে আসতেন, আমার সাথেও দেখা হত । দেখা হলেই গার্মেন্ট শ্রমিকদের অনের কথা জানতে
চাইতেন, আমাকেও আনেক রকম উপদেশ দিতেন । আমাকে বলতেন ‘শ্রমিকদের সাথে মিশতে হলে
শ্রমিকদের বাসায় বাসায় যেতে হবে, শ্রমিকদের ঘরে খেতে হবে, যখন দেখবা শ্রমিকরা
তাদের নিজেরা খাওয়ার জন্য যা রান্না করেছে তোমাকে তাই
দিয়ে খেতে দিচ্ছে তখন তুমি বুঝবা শ্রমিকরা তোমাকে আপন করে নিয়েছে, শ্রমিকরা তোমাকে
তাদের পরিবারের এক জন মনে করছে, শ্রমিকদের আপন হতে না পারলে তুমি সংগঠন বাড়াতে
পারবেনা, তুমি যে এলাকাতে থাকবে সেই এলাকার অলি গলি চিনে রাখবে কারন তুমি যাদের
বিরুধে কথা বলছো তারা অনেক শক্তিশালী প্রয়োজনে মালিকরা তোমার বিরুদ্ধে পুলিশ,
সন্ত্রাসী, মাস্তান লেলিয়ে দিবে’ । আমি ২০০৬-২০০৯-২০১০-২০১৩-২০১৫
সালে কমরেড জসিম উদ্দিন এর উপদেশ এর কথা মনে করে ০৫ বারেরও বেশি গ্রেফতার এড়িয়েছি
। ২০০৯ সালে এস সুহি সোয়েটার কারখানাতে শ্রমিকরা পিস রেট বৃদ্ধি করা দাবিতে ও
শ্রমিক ছাঁটাই প্রতিবাদে কর্ম বিরতি চলা কালে কারখানার নিরাপত্তা কর্মীরা
শ্রমিকদের উপর গুলিছুড়ে, গুলিতে আলামিন সহ তিন জন শ্রমিক নিহত হয়, যার প্রতিবাদে
সাভার-আশুলিয়া সহ সকল শিল্প অঞ্চলে গার্মেন্ট শ্রমিকরা আন্দলনে নামে । আমি ঢাকা
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিহত আহত শ্রমিকদের দেখে বাসায় ফেরার পথে শুনতে পেলাম পুলিশ
আমার বাসা তল্লাশি চালাছে, সেদিন পুলিশ আমার বাসায় লেপ, তোষক, বালিশ ছিড়ে টুকরো
টুকরো করে বই খাতা কাগজ প্রত্র যা ছিল সব কিছু থানায় নিয়ে গিয়েছিল । আমি কৌসল গত
ভাবে গ্রেফতার এড়িয়ে ছিলাম কমরেড জসিম উদ্দিন মন্ডলের কথা মনে করে । ২০১০ সালে
গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির আন্দলনে যে রাতে শ্রমিকনেতা এড মন্টু ঘোষ
গ্রেফতার হলেন সে রাতে শ্রমিকনেতা কমরেড মনজুরুল আহসান খান আমাকে ফোন করে সতর্ক
করলেন আমি বাসা থেকে রাত্রি ২ টায় বের হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর পুলিশ আমার বাসা
ঘেরাও করলেন । কমরেড জসিম উদ্দিন এর উপদেশ মত যদি আমি অলি-গলি রাস্তা চিনে না
রাখতাম তাহলে সেই রাতেই আমি গ্রেফতার হতাম । এ রকম অনেক বার আমি নিজেকে গ্রেফতার
এড়িয়েছি অলি-গলি রাস্তা চিনে রাখার করনে ।
কমরেড জসিম উদ্দিন মন্ডল বলতেন ''যে কথা আমরা
ঢাকায় বলি, সেটি যদি গ্রামে না নিয়ে যাই, আমতলা, বাঁশতলা, কাঁঠালগাছের নিচে, হাটে, ঘাটে, মাঠে, গ্রামের মানুষের
কাছে না নিয়ে যাই, তাহলে কিভাবে হবে, সে জন্য ঢাকায় আসতে চাইনি । আমার কথা হলো, পার্টিকে গ্রামে
নিতে হবে'' অথচ আজ
আমাদের গণ সংগঠন বলেন আর পার্টি বলেন আমরা যারা নেতা সবায় ঢাকা প্রেসক্লাব
কেন্দ্রীক কর্মসূচি পালন করছি কারন পত্রিকায় উঠবে, টিভিতে দেখা যাবে । আমরা মনে
করছি প্রেসক্লাবের সামনে যেমন তেমন একটা কর্মসূচি পালন করে ছবি তুলে ফেসবুকে দিলেই
আমার জনপ্রিয়তা বেড়ে যাবে । কমরেড জসিম উদ্দিন মন্ডলের কোন ফেসবুক ছিলনা, টিভিতে
টকশ করতেননা, পার্টি অফিসের সামনে নিয়মিত আড্ডা দিতেননা, প্রেসক্লাবের সামনে
নিয়মিত বক্তব্য দিতেননা, বিদেশ সফর করতেন না । তিনি একটা লুঙ্গি, একটা গামছা, একটা
পাঞ্জাবি সাথে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন, টাকা পয়সাও থাকতোনা সাথে তবু তিনি
ঘুরেছেন । কমরেড জসিম উদ্দিন মন্ডল অভাব অনটনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, ১৭ বছর জেল
খেটেছেন অনেক নির্ষাতন ভোগ করেছেন কিন্তু ৯৫ বছর বয়সেও তিনি হতাশ হননি । তিনি
বলতেন ‘এই সমাজ ভাঙ্গতেই হবে’ তিনি মৃত্যর মধ্যে দিয়ে নিজের জনপ্রিয়তা প্রমান করে
দিলেন তিনি বুঝিয়ে দিলেন, জনপ্রিয়তা হতে ফেসবুক লাগেনা, পার্টি অফিসের সামনে আড্ডা
দেওয়া লাগেনা, টকশ করা লাগেনা, প্রেসক্লাবের সামনে বক্তব্য দেওয়া লাগেনা । জনপ্রিয়তা
অর্জন করতে হলে গ্রামে গ্রামে যেতে হবে, খেটে খাওয়া-পা ফাটা মানুষের কাছে যেতে হবে
। তিনি বলতেন ‘ভদ্রলোকদের দিয়ে পার্টি হবেনা, ভদ্রলোকি ভাব দেখালেও পার্টি হবেনা’
। প্রথম দেখাতে কমরেড জসিম উদ্দিনকে বড় নেতা মনে না হলেও আজ বুঝি বড় নেতা হতে হলে
কমরেড জসিম উদ্দিন মন্ডলের মত হতে হবে ।
লেখকঃ খাইরুল মামুন মিন্টু, সাংগঠিক সম্পাদক,
গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন