Biplobi Barta

বৃহস্পতিবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৭

কে ঘোরাবেন চীনের চাকা?

আবু হেনা মোস্তফা কামাল
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন। নানা কারণে চীন এখন বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রে। ১৮ অক্টোবর বেইজিংয়ের গ্রেট হলে দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। ক্ষমতাসীন দলটির নেতৃত্বে কে আসছেন, তা ওই দিন নির্বাচন করা হবে। এই দলের নেতৃত্বে যিনি আসবেন, তিনিই ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশের বৃহত্তম অর্থনীতি পরিচালনা করবেন।
প্রতি পাঁচ বছর পর কমিউনিস্ট পার্টি এই সম্মেলনের মাধ্যমেই তাদের পরবর্তী নেতৃত্ব নির্বাচন করে। এ কারণেই এখন নতুন করে চীনের দিকে তাকিয়ে আছে পুরো বিশ্ব। কে হচ্ছেন দলের নেতা, কে ঘোরাবেন চীনের চাকা—এসব প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে বিশ্ব রাজনীতিতে।
বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ধারণা করা হচ্ছে, চীনের প্রেসিডেন্ট ও কমিউনিস্ট পার্টির বর্তমান নেতা সি চিন পিং তাঁর পদে অপরিবর্তিত থাকবেন। চীনে কমিউনিস্ট পার্টির ২ হাজার ৩০০ প্রতিনিধি আছেন। কিন্তু ১৮ অক্টোবরের সম্মেলনে ১৩ জন অংশ নিতে পারবেন না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যথাযথ আচরণ না করায় ১৩ জনকে সম্মেলনে যোগদানের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি সবাই সম্মেলনের জন্য বেইজিংয়ের গ্রেট হলে সমবেত হবেন। সম্মেলনে গোপনীয়তার সঙ্গে প্রতিনিধিরা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির জন্য ২০০ সদস্য নির্বাচিত করবেন। কেন্দ্রীয় কমিটি ২৪ সদস্যবিশিষ্ট পলিটব্যুরো নির্বাচিত করবে। পলিটব্যুরো থেকে সাত সদস্যবিশিষ্ট স্থায়ী কমিটি করবে কেন্দ্রীয় কমিটি। সদস্যসংখ্যা কমবেশিও হতে পারে। দেশটির রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনার জন্য এই স্থায়ী কমিটি সর্বসময় ক্ষমতার অধিকারী।
বিবিসি বলছে, কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি দলটির শীর্ষ নেতা মানে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে। দলের সাধারণ সম্পাদকই দেশের প্রেসিডেন্ট হন। ধারণা করা হচ্ছে, চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং আবারও দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হবেন এবং তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহাল থাকবেন। দলের কিছু পদের ক্ষেত্রে অলিখিত নিয়মকানুন নির্ধারণ করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী পলিটব্যুরোর অধিকাংশ সদস্য, যাঁদের বয়স ৬৮ বছরের বেশি হয়েছে, তাঁরা হয়তো পদ ছেড়ে দেবেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন চীনের দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানের প্রধান ওয়াং কিশান। তবে তিনি সি চিন পিংয়ের খুব ঘনিষ্ঠজন। তাই হয়তো তাঁকে কাজ চালিয়ে যেতে বলা হতে পারে।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের ক্ষমতা শুধু যে রাজনীতিকদের হাতেই যায়, তা কিন্তু নয়। বরং দেশটির অর্থনীতিতে অপরিসীম অবদান রাখা ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারাও এই নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পারেন। তাই প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং আবারও যে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হবেন এবং তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহাল থাকবেন, তা এই মুহূর্তে হলফ করে বলা যাচ্ছে না। রুদ্ধদ্বার সম্মেলনের পরেই হয়তো বিশ্ববাসী তা জানতে পারবেন।
কে ঘোরাবেন চীনের চাকা? 
চীনের ক্ষমতা কার হাতে যেতে পারে—এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছে সিএনএন। তারা নেতৃত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে নানা দিকে এগিয়ে থাকা পাঁচজন ক্ষমতাধর ব্যক্তির কথা বলেছে। এই পাঁচজনের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। ধারণা করা হচ্ছে, কোনো কারণে তিনি বাদ পড়ে গেলে বাকি চারজনের যে–কারও হাতে চলে যেতে পারে ক্ষমতা।
সি চিন পিং
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক জেফ্রে ওয়াসেরস্ট্রম বলেছেন, চীনের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের থেকে পাঁচজনকে তুলে আনা খুব কষ্টকর ব্যাপার। জেফ্রে বলেছেন, তারপরও যদি তালিকার শুরুতে কাউকে রাখতে হয়, তিনি প্রেসিডেন্ট ও কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক সি চিন পিং। চীনকে একটি শক্তিশালী দেশে রূপান্তরের স্বপ্ন দেখা বিপ্লবী নেতা দেং শিয়াও পিংয়ের পর সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন সি। হয়তো দলের এই সম্মেলনে তিনি নিজের ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারেন।
জ্যাক মা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা চীনের ক্ষমতাধর পাঁচ ব্যক্তির তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে রেখেছেন অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান জ্যাক মাকে। প্রেসিডেন্ট সির পরে তিনিই ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তিনি একজন চীনের শীর্ষ ধনী ব্যক্তি। তাঁর আসল নাম মা ইয়ুন। চায়নিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের সেন্টার ফর চায়না স্টাডিজের অধ্যাপক উইলি লাম বলেন, অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও সাম্রাজ্য গড়ে তোলা যায়, তা জ্যাক করে দেখিয়েছেন।
চীনের দুর্নীতি বিরোধী প্রতিষ্ঠানের প্রধান ওয়াং কিশান। ছবি: রয়টার্স
ওয়াং কিশান

চীনের দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানের প্রধান ওয়াং কিশান। তিনি বেইজিংয়ের সাবেক মেয়র ও ২০০৮ অলিম্পিকের আয়োজক ছিলেন। দ্য ইকোনমিস্ট সাময়িকীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়াং ২০১২ সালের নভেম্বরে দলের কেন্দ্রীয় কমিশন ফর ডিসিপ্লিন ইন্সপেকশনের (সিসিডিআই) দায়িত্ব নেন। এরপর থেকে সরকারের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাঁকে যমের মতো ভয় করে। অনেকে আবার দুর্নীতির দলিলপত্র জমা দিয়ে তাঁদের অন্যায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। নেতৃত্বে পেশাগত গুণের কারণে ওয়াং সজ্জন হিসেবে পরিচিত। প্রভাব-প্রতিপত্তি বিচারে চীনের রাষ্ট্রপতি সি চিন পিংয়ের পরই তাঁর অবস্থান। দুর্নীতিবাজেরা তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় বলে মনে করা হয়।
বিবিসি বলছে, দলের আসন্ন সম্মেলনে ওয়াংয়ের বয়স ৬৯ হবে। তাই সম্মেলনেই নিয়ম অনুযায়ী তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারেন। তবে ধারণা করা হচ্ছে, প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় বিশেষ বিবেচনায় তাঁকে ক্ষমতা কাঠামোতে রাখা হতে পারে।
মা হুয়াতেং
চীনে ফেসবুক ও টুইটার নেই। তবে সবার স্মার্টফোনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইচ্যাট আছে। এটি চীনে খুবই জনপ্রিয়। এই উইচ্যাটের প্রতিষ্ঠাতা মা হুয়াতেং ফোর্বস সাময়িকীর দৃষ্টিতে দেশটির ধনকুবেরও বটে। উইচ্যাট পরিচালনাকারী টেনসেন্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান মা হুয়াতেংয়ের ডাকনাম পনি।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের শীর্ষ পাঁচ ক্ষমতাধর ব্যক্তির তালিকায় মা হুয়াতেংকে দ্বিতীয় অবস্থানে রেখেছেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির দ্য ইউনিভার্সিটি চায়না সেন্টারের পরিচালক রানা মিতার। ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের চীনের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক টম র‍্যাফারটি তাঁর তালিকার তৃতীয় অবস্থানে রেখেছেন মা হুয়াতেংকে। তিনি বলেন, উইচ্যাটের মাধ্যমে চীনের অর্থনীতিতে বিশাল প্রভাব রেখেছেন মা।
চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেছিয়াং। ছবি: রয়টার্স
লি কেছিয়াং
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা লি কেছিয়াং ২০১৩ সালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। বেইজিংয়ের ঐতিহাসিক গ্রেট হলে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে প্রায় তিন হাজার আইনপ্রণেতার ভোট পেয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। চীনের রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ঝিইয়ু বো বলেন, চীনের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে দারুণ ভূমিকা রেখেছেন। নিঃসন্দেহে তিনি এখন ক্ষমতাধর মানুষ।
চীনের ক্ষমতা আসলে কার হাতে যাচ্ছে, তা জানতে এখন অপেক্ষার পালা। নেতৃত্ব বদল না হওয়ার যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, তা যদি ঠিক থাকে, তাহলে হয়তো সি চিন পিংয়ের হাতে একই ধারায় চলবে চীন। আর বদল হলে নতুন করে ঘুরবে বিশাল এই অর্থনীতির চাকা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন