Biplobi Barta

সোমবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৭

মার্কসবাদে নিশ্চল চূড়ান্ত সত্যের স্থান নেই


অনেক পাঠক আগ্রহ প্রকাশ করায় রাজনৈতিক ও দার্শনিক তত্ত্ব নিয়ে আবার দু’চার কথা লেখার জন্য আজ কলম ধরেছি। পত্রিকার কলামের ছোট পরিধির মধ্যে এসব গুরুতর কথা ব্যাখ্যা করে লেখা সম্ভব নয়। একথা জেনেও মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সে বিষয়ে কিছু কথা লিখছি এ আশায় যে, এসব কথা হয়তো কারো কারো মাঝে তত্ত্বচর্চায় আগ্রহ সৃষ্টি করবে।
মার্কসবাদী দর্শন চিন্তার একটি প্রধান প্রতিপাদ্য হচ্ছে বহির্জগতের বাস্তব অস্তিত্বের স্বীকৃতি। এই বহির্জগত্ চেতনা নিরপেক্ষভাবে বাস্তবে বিরাজ করে। এই বহির্জগেকই দার্শনিক ভাষায় আখ্যায়িত করা হয় বস্তুজগত্ হিসাবে। প্রায় সব দর্শনশাস্ত্র মতে অস্তিত্বের সবকিছুই হয় চেতনাজগত্ অথবা বস্তুজগত্— এই দুইয়ের কোনো একটির অন্তর্ভুক্ত। চেতনাজগতের বাইরের সব সত্তাকেই মার্কসবাদ বস্তুজগতের অঙ্গীভূত বলে বিবেচনা করে। অর্থাত্ বস্তুজগতের প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য হলো তার চেতনা নিরপেক্ষ বাস্তব অস্তিত্ব।
দর্শনের প্রধান একটি প্রশ্ন হলো, চেতনাজগত্ ও বাস্তবজগতের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে। এ বিষয়ে মার্কসবাদের স্পষ্ট জবাবটি হলো— সবকিছুর মাঝে বস্তুজগত্ই আদি ও প্রধান। বস্তুজগতের বিবর্তনের ধারাতেই মানুষকে ও মানুষের বুদ্ধি-শক্তিকে ভিত্তি করে চেতনাজগতের উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু মার্কসবাদ, এখানেই এ সম্পর্কে তার বক্তব্যের ইতি টানে না। শুধু এটুকু পর্যন্ত বললে কথাটা দাঁড়াতো এরকম যে, বস্তুজগত্ই চেতনাজগতের নিয়ন্ত্রক এবং বস্তুজগতের ওপর চেতনাজগতের কোনো স্বাধীন প্রভাব নেই। মার্কসবাদ কিন্তু একথা বলে না। বরঞ্চ মার্কসবাদ একথাই বলে যে, বস্তুজগত্ থেকে চেতনাজগতের উত্পত্তি হলেও এবং তার দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত থাকলেও, চেতনাজগত্ও আবার স্বাধীনভাবে বস্তুজগতের উপর উল্টো ক্রিয়া করে। যান্ত্রিক বস্তুবাদী ধারণার সাথে এখানেই মার্কসবাদের মৌলিক পার্থক্য। বস্তুজগত্ ও চেতনাজগতের মধ্যে ‘কোনিট প্রধান’ সে বিষয়ে মার্কসবাদের প্রতিপাদ্যটি বুঝতে পারাটি তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ এবং সবাই সেটাকেই গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কিন্তু এই দুই জগতের পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্কের জটিল ও দ্বন্দ্বাত্মক dialectical প্রক্রিয়া সম্পর্কে মার্কসবাদের প্রতিপাদ্যটি অনেক সময়ই নজর এড়িয়ে যায়। বিষয়টি যথার্থভাবে অনুধাবনের জন্য অনেকটা মাথা খাটানোরও প্রয়োজন হয়। অনেক সময় মার্কসবাদের স্বরূপ উপলব্ধির ক্ষেত্রে নানা বিকৃতির ভিত্তি রচিত হয় এর ফলে।
আরেকটি ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয় বস্তুজগত্ শব্দের ব্যবহারকে ঘিরে। মার্কসবাদ বস্তুজগত্ শব্দটিকে দার্শনিক অর্থে ব্যবহার করে থাকে। বস্তুজগত্ হলো চেতনাজগতের বাইরে অস্তিত্বমান সবকিছু। অর্থাত্ সমাজ জীবনের নানাবিধ উপাদান এবং একই সাথে বস্তু, ফিল্ড, তরঙ্গ ইত্যাদিসহ প্রাকৃতিক জগতের বিভিন্ন ধরনের উপাদান। এসব অনেক কিছু সম্পর্কে কিছুদিন আগেও হয়তো আমাদের কোনো জ্ঞান ছিল না এবং বস্তুজগতে এমন অনেক কিছুরই হয়তো অস্তিত্ব আছে, যা সম্পর্কে আমাদের এখনো কোনো জ্ঞান নেই। কিন্তু আমরা সে সম্পর্কে জ্ঞাত হই বা না হই, বস্তুজগতের মধ্যেই তার অস্তিত্ব আছে। সে সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান আছে কি নেই অথবা তা কতটা আছে তার ওপর সামগ্রিকভাবে বস্তুজগতের অথবা তার কোনো উপাদানের অস্তিত্ব নির্ভরশীল নয়।
আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, আধুনিক কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তত্ত্ব প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নবতর আবিষ্কারগুলো বস্তুজগত্ (দার্শনিক অর্থে) সম্পর্কে পূর্বের অনেক ধারণাকে বদলে দিয়েছে। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গুণগত নতুন মাত্রিকতা ও উপাদান যুক্ত করেছে। মহাজাগতিক (cosmic) এবং পারমাণবিক (subatomic) পরিমণ্ডল সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার দ্রুত সমৃদ্ধ হয়ে ওঠার সাথে সাথে এক্ষেত্রে বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো দার্শনিক ক্ষেত্রে অনেক নতুন জিজ্ঞাসা ও ধারণার জন্ম দিয়েছে। এর ফলে নিঃসন্দেহে পুরনো অনেক দর্শনসংশ্লিষ্ট ধারণাকে নতুন করে বিবেচনা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এই প্রসঙ্গটি পৃথকভাবে বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু, এ বস্তুজগেক (দার্শনিক অর্থে) আরো ভালো করে জানার প্রক্রিয়াতেই এ সবকিছু ঘটছে। এসব নব আবিষ্কার ও তার ফলে দার্শনিক ক্ষেত্রে উত্থাপিত নবতর জিজ্ঞাসা ও ধারণাগুলো বস্তুজগতের বস্তুনিষ্ঠ অস্তিত্ব, চেতনাজগত্ ও বস্তুজগতের মধ্যে বস্তুজগতের মৌলিকত্ব, চেতনাজগতের স্বকীয় সক্রিয়তা এবং এই দু’য়ের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের বিষয়ে মার্কসবাদের প্রাথমিক প্রতিপাদ্যগুলোকে নাকচ করে না। বরঞ্চ এসব বিষয়ে মার্কসবাদের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির জায়গাটি আরো স্পষ্ট করার মাধ্যমে তা নবায়িত করে তোলে মাত্র। বিজ্ঞানের আধুনিকতম আবিষ্কারগুলো মার্কসবাদকে ভুল প্রমাণ করেছে, এবং এর ফলে মার্কসবাদ প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে, একথা বলে যারা মার্কসবাদ পরিত্যাগের যুক্তি রচনা করতে চান— তাদের সে বক্তব্য সম্পূর্ণই অমূলক।
মার্কসবাদী মতাদর্শের আরেকটি প্রধান ভিত্তিমূলক প্রতিপাদ্য হলো, বস্তুজগতের ক্ষেত্রেই হোক বা চেতনাজগতের ক্ষেত্রেই হোক সব সত্তার অস্তিত্বই গতিময়। সবকিছুই অনন্ত গতিময়তার মধ্যেই অস্তিত্বমান এবং গতি ছাড়া কোনো সত্তারই অস্তিত্ব নেই। একইসাথে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব সত্তাই পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্কের দ্বারা একটি একক সমগ্র হিসেবে অস্তিত্বমান। কোনো কিছুই অন্য যে কোনো কিছু থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন নয়, এবং সবকিছুই একে অপরের সাথে অনন্তভাবে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করছে। সবকিছুই অনন্ত প্রবহমান ধারায় স্থানান্তরিত হচ্ছে, রূপান্তরিত হচ্ছে এবং কিছুই এক জায়গায় এক অবস্থায় স্থির থাকছে না।
মার্কসবাদের সার্বজনীন আন্তঃসম্পর্ক ও গতিময়তার সূত্র সব সত্তার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তা বস্তুজগতের ক্ষেত্রে হোক অথবা চেতনাজগতের ক্ষেত্রে হোক। এই দুই ক্ষেত্রের মধ্যেও আবার পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্ক বিদ্যমান। সামাজিক সত্তার ক্ষেত্রে বস্তু ও চেতনার আন্তঃসম্পর্ক যেমন রয়েছে, প্রাকৃতিক জগতের ক্ষেত্রেও তা আছে। আধুনিক কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, বস্তু ও চেতনার এই আন্তঃসম্পর্কের জটিল বিষয়টিকেই স্পষ্ট করেছে। মার্কসবাদের দর্শন চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা এক্ষেত্রেও লক্ষণীয়। এই সূত্র থেকে একই সাথে একথাই প্রত্যায়িত হয় যে, বস্তুজগতের মতো চেতনাজগত্ও অনন্ত গতিময়তার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। এটাই যদি মার্কসবাদের অন্যতম মর্মকথা হয় তাহলে কি যুক্তিতে অভিযোগ উঠতে পারে যে, মার্কসবাদ চিন্তাজগতে ও তত্ত্বচর্চায় স্থবিরতার ধারক, মুক্ত চিন্তার বৈরী? বরঞ্চ মার্কসবাদের মর্মকথা এটাই যে, ‘কোনো কিছুই’ - এমনকি চিন্তা, তত্ত্ব, চেতনা এসব কোনো কিছুই স্থির নয়। সবকিছুই চির বিকাশমান। এ-কারণেই একটি অনুসরণীয় মতাদর্শ হিসাবে মার্কসবাদ চিন্তা, মনন, জ্ঞান, তত্ত্বচর্চা এসবকে এক চিরবিকাশমান প্রবাহ হিসাবে জীবন্ত করে তোলে। চেতনাজগতের এসব উপাদানের বিকাশে কোনো শেষ কথা নেই এবং তত্ত্বের ক্ষেত্রেও তা নেই—এটিই মার্কসবাদের কথা। মার্কসবাদ অনুসরণের অর্থ হলো এই উপলব্ধিকে ভিত্তি করে তত্ত্বচর্চায় অগ্রসর হওয়া। মার্কসবাদী হওয়ার বিষয়ের সাথে তাহলে ‘ডাগমা’ আশ্রয়ী হয়ে পড়ার অভিযোগ কোনোভাবেই উত্থাপিত হতে পারে না। অথচ এরূপ অভিযোগ তোলা হয়ে থাকে। যারা এধরনের প্রশ্ন তোলেন তারা আসলে মার্কসবাদের জ্ঞান তত্ত্বের মর্মকথাকেই বুঝে উঠতে পারেননি।
মার্কসবাদের জ্ঞানতত্ত্বের আরেকটি গোড়ার কথা হলো বিশ্বজগত্ জ্ঞেয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সত্তাসমূহ শুধু অস্তিত্বমানই নয়, চেতনায় সে সম্পর্কে সত্যিকার জ্ঞান অর্জনও সম্ভব। চেতনা এই জ্ঞানকে প্রকৃতভাবেই ধারণ করতে সক্ষম। জ্ঞান সত্য কিনা তার প্রমাণ কি? এখানেই মার্কসবাদের আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপাদ্য। মার্কসবাদ অনুসারে, জ্ঞান সত্য কি না তা যাচাইয়ের কষ্টিপাথর হলো ‘প্রয়োগ’। তত্ত্ব ও প্রয়োগের ধারাতেই নতুন জ্ঞানার্জন সম্ভব। এবং অর্জিত জ্ঞানের সাধারণীকরণের ভিত্তিতে রচিত ‘তত্ত্বে’র যথার্থতা যাচাই একমাত্র প্রয়োগের মাধ্যমেই সম্ভব। প্রয়োগের মাধ্যমে তত্ত্ব-যাচাইয়ের ধারায় নতুন প্রয়োগ নতুন জ্ঞানের উপাদান বয়ে নিয়ে আসে। আগের জ্ঞানের সাথে নতুন জ্ঞানের সমাবেশ ঘটে। জ্ঞান আরো একধাপ এগিয়ে যায়। এভাবেই ক্রামগত জ্ঞানের বিস্তৃতি ও বিকাশ ঘটতে থাকে। সেই সাথে তত্ত্বেরও।
মার্কসবাদ যেভাবে প্রয়োগ ও তত্ত্বের আন্তঃসম্পর্কটা বিবেচনা করে তা কিন্তু সরল ‘প্রয়োগবাদ’ নয়। প্রয়োগবাদী মতাদর্শের কথা হলো, প্রতিটি বিষয়কে নির্দিষ্ট মুহূর্তের প্রয়োগের মধ্যদিয়েই সত্য বলে দেখতে হবে। প্রয়োগবাদের তত্ত্বে জ্ঞানের সাধারণীকরণের কোনো সুযোগ নেই এবং সে কারণে সাধারণ তত্ত্বচিন্তারও কোনো সুযোগ নেই। প্রয়োগবাদের এই সরলীকৃত দৃষ্টিভঙ্গি মার্কসবাদ গ্রহণ ও অনুসরণ করে না। এক্ষেত্রে মার্কসবাদের প্রতিপাদ্য হলো এই যে, নির্দিষ্ট জ্ঞান এবং জ্ঞানের সাধারণীকরণের ভিত্তিতে রচিত তত্ত্ব—এই দু’য়ের মধ্যে একটি ডায়ালেকটিক আন্তঃসম্পর্ক সবসময় বিদ্যমান। এটাই যুক্তিবিদ্যার ‘বিশেষ’ ও ‘সাধারণের’ মধ্যে, তথা ইনডাকটিভ ও ডিডাকটিভ পদ্ধতির মধ্যে ডায়ালেকটিক্যাল সম্পর্কের বিষয়ে মার্কসবাদের সূত্র। নির্দিষ্ট জ্ঞান সাধারণীকৃত তত্ত্বজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে, আবার তত্ত্বের মাধ্যমে সাধারণীকৃত তত্ত্বজ্ঞান নির্দিষ্ট জ্ঞানকে আরো গভীরতর করে তোলে। এটা দ্বিমুখী পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্কের ব্যাপার। লজিকের ইনডাকটিভ ও ডিডাকটিভ পদ্ধতির উভয়মুখীন আন্তঃসম্পর্কের বিষয়। সুতরাং প্রয়োগবাদের মতাদর্শে তত্ত্বচিন্তা ও জ্ঞানের সাধারণীকরণের বিষয়ে যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বিরাজ করে, মার্কসবাদ তাকে সঠিক বলে মনে করে না। তত্ত্বচর্চা সত্যকে দূরে ঠেলে দেয় না, বরঞ্চ তাকে ক্রমাগতই আরো নিকটবর্তী করতে সহায়তা করে। বস্তুতঃ, চেতনা ও জ্ঞান মানেই আসলে কোনো না কোনো মাত্রায় তত্ত্বায়ন। ‘তত্ত্ব থেকে মুক্তির’ ধারণা তাই অলীক কল্পনা ব্যতীত অন্য কিছু নয়।
মার্কসবাদী চিন্তানুসারে সত্যানুসন্ধানের ক্ষেত্রে তত্ত্বচর্চার বিশেষ গুরুত্ব ও প্রয়োজন আরেকটি কারণে রয়েছে। সত্তার সার্বজনীন আন্তঃসম্পর্ক যেহেতু একটি বাস্তব সত্য, তাই কোনো বিশেষ বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান তখনই সমৃদ্ধতর হতে পারে যখন, অপর বিষয় সম্পর্কে এবং সম্ভাব্য যত বেশি বিষয় সম্পর্কে, জ্ঞান তার সাথে যুক্ত করে বিবেচনা করা যায়। মার্কসবাদী মতাদর্শের এই মৌলিক কথাগুলো বুঝতে চেষ্টা না করে যেভাবে কিছু কিছু ব্যক্তি তত্ত্বচর্চার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে থাকেন এবং যেভাবে ‘তত্ত্বায়নের শৃঙ্খল থেকে চিন্তার মুক্তির’ সপক্ষে ক্যানভাস করে থাকেন, তা তাদের চিন্তা-শক্তির দীনতাকেই প্রকাশ করে মাত্র।
বিশ্বজগত্ জ্ঞেয়। কিন্তু জ্ঞেয় হলেও সে সম্পর্কে লব্ধ জ্ঞান কি কখনোই পরিপূর্ণ হতে পারে? এ সম্পর্কে মার্কসবাদের কথা হলো, - না জ্ঞান কখনোই পূর্ণ হয়ে ‘পরম সত্য’ হয়ে উঠতে পারে না। তার কারণ, প্রথমত বিশ্বের সব সত্তা সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে সব জ্ঞান একীভূত করা সম্ভব নয়। কেননা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হলো অনন্ত, তা হলো অনন্ত সত্তার সমাহার। দ্বিতীয়ত সব সত্তাই এবং সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অনন্ত গতির মধ্যে রয়েছে। তাই সমগ্রের ক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি একটি নির্দিষ্ট সত্তা সম্পর্কে জ্ঞানের সত্যতা এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে পারে না। তৃতীয়ত সব সত্তা যেহেতু বিশ্বজনীন আন্তঃসম্পর্কের দ্বারা প্রভাবিত, তাই কোনো একটি অংশ সম্পর্কে জ্ঞান-সমগ্র সম্পর্কে জ্ঞান ব্যতীত পূর্ণ হতে পারে না। এসব থেকে মূল কথাটি যা দাঁড়ায় তাহলো এই যে, বিশ্বজগত্ জ্ঞেয় হওয়া সত্ত্বেও জ্ঞান কখনোই চূড়ান্তভাবে পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে না। ‘পরম সত্য’ বাস্তব কারণেই অবাস্তব।
তাহলে কি মার্কসবাদ একথাই বলতে চায় যে, কোনো জ্ঞানই সত্য নয়? না, মার্কসবাদের কথা মোটেও তা নয়। জ্ঞান আংশিক হলেও তা সত্য এই অর্থে যে, তার মধ্যে সত্যের উপাদান রয়েছে। প্রয়োগের মাধ্যমেই সেই জ্ঞানের সত্যাসত্য যাচাই করা যায়। জ্ঞানের অনন্ত ক্রমবিকাশমান বিস্তার সেই সত্যের উপাদানকেই ক্রমাগত সমৃদ্ধতর করে চলেছে। মার্কসবাদের বিবেচনায় জ্ঞান অন্বেষণ তাই একটি অন্তহীন বিকাশমান প্রক্রিয়া। এই অন্তহীন যাত্রাপথে নির্দিষ্ট মুহূর্তের নির্দিষ্ট বিষয়ক জ্ঞানই হলো সেই জ্ঞান অন্বেষণের অন্তহীন প্রক্রিয়ার অমূল্য সম্পদ। আংশিক জ্ঞান বা আপেক্ষিক জ্ঞান সে কারণেই মিথ্যা নয়, সেটিও সত্য। সে কারণে বলা যায়— জ্ঞান ও সত্যের অন্বেষায় মার্কসবাদ নিঃসন্দেহে একটি যথার্থ ও সঠিক পথনির্দেশ।
লেখক :মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম,  সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন