“শ্রম
আইন” শুনলেই প্রথমে ধারণা হয় এই আইন শ্রমিকদের জন্য।
প্রকৃতপক্ষে আইন শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্যইতো হওয়া উচিৎ। যেই শ্রমিকদের শ্রমের
ফলে মানব সভ্যতা বিকশিত হয়, প্রকৃতির সাথে সেই শ্রম যুক্ত
হয়ে এই জগতের সকল বস্তু তৈরি হয়, পরিবর্তন হয়, মানুষের ব্যবহারযোগ্য হয়, যেই শ্রমিকের শ্রম ছাড়া এই
দুনিয়া এক মুহূর্তও চলতে পারে- সেই শ্রমিকশ্রেণি শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে শোষণ ও
বঞ্চনায় নিষ্পেষিত। বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী ঔপনিবেশিক শাসনের নামে আমাদের সম্পদ লুণ্ঠনের
ধারা অব্যাহত রাখতে আমাদের জনগণের ওপর তীব্র শোষণ ও দমনীতি চালিয়েছিল। ব্রিটিশ
শাসকরা যখন মানবিক মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি পায়ের তলায় পিষ্ঠ করে আমাদের
ওপর শোষণের স্টিমরুলার চালায় তার প্রধান শিকার হন শ্রমজীবী মেহনতি জনগণ। এ যাবৎকাল
শ্রমিকের ওপর মালিকের শোষণ, দুর্বলের ওপর সবলের
অত্যাচার-নির্যাতন যেমন চলছে তেমনি শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামেরও
গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। ব্রিটিশের শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন রকম
আন্দোলন সংগ্রাম করে নানান অধিকার আদায় করতে হয়। তারই ধারাবাহিকতায় সর্বপ্রথম
বৃটেনে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক ও অধিকার সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন হয় ১৮৮০ সালে। ভারতের
শ্রমিকদের পর্ব থেকেও আইন প্রণয়নের দাবি তোলা হয় এবং পরের বছর ১৮৮১ সালে “ভারতীয় শিল্প আইন” নামে আইন প্রণীত হয়। এরপর বিভিন্ন
সময় বিভিন্ন বিষয়ে শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষার জন্য আইন প্রণীত হয়। ১৯৪৭ সালে
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পরেও ভারতবর্ষে/পাকিস্তানেও সেই আইনগুলো বহাল
ছিল। যার ফলে তখন ৭ জন শ্রমিক মিলে একটি ইউনিয়ন করতে পারতো। ১৯৬৯ সালে সেই আইন
পরিবর্তন করে ৩০ শতাংশ শ্রমিক সদস্য না হলে ইউনিয়ন করা যাবে না মর্মে শর্ত জুড়ে
দিয়ে অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার খর্ব করা হয়। যাতে আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ অনুসরণ
করা হচ্ছে না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও শ্রীলঙ্কায় ৭ জন, ভিয়েতনামে
৮ জন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও
কম্বোডিয়ায় ১০ জন শ্রমিক মিলে একটি ট্রেড ইউনিয়ন করার বিধান এখনও বহাল আছে। অতএব
পূর্বের ন্যায় ৭ জন শ্রমিক একত্রিত হলেই একটি ইউনিয়ন করার অধিকার এখন সময়ের দাবি।
শ্রমিক ও নাগরিক এবং মানুষকে রেজিষ্ট্রেশনের বেড়াজালে আবদ্ধ রাখাটাই মানবাধিকার
পরিপন্থি। ফলে মানবাধিকার বাস্তবায়ন করতে হলে রেজিষ্ট্রেশন পদ্ধতি বাতিল করা
আবশ্যক। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালে মহান
মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা পরবর্তীকালে প্রতিটি গণতান্ত্রিক
আন্দোলনে এ দেশের শ্রমিক-কর্মচারীদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও বার বার
শ্রমিকরা বঞ্চিত হয়েছে নানাভাবেই। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সদস্য
রাষ্ট্র হিসেবে যে সকল কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে এদেশের আইন প্রণয়ন ও কার্যকর সেই
সকল কনভেনশন অনুসারেই হওয়ার কথা। তার কোনোটাই হচ্ছে না। মজুরির ক্ষেত্রেও তাই
কনভেনশন ১৩১ অনুসারে শ্রমিকের পরিবারের মানবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করার মতো মজুরি
প্রদান করার কথা, তা আজও করা হয়নি। এমনিভাবে যেমন আইএলও
কনভেনশন মানা হচ্ছে না, তেমনি দেশের সংবিধান, শ্রমনীতি এবং সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাও মানা হচ্ছে না। কেননা
বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে সকল নাগরিকের স্বাধীনভাবে সংগঠন করা ও মত প্রকাশের
অধিকার থাকলেও শ্রম আইন অনুসারে শ্রমিকরা সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে
আইন-বিধি এমনভাবে করা হচ্ছে যেন আইন-কানুনই শ্রমিকদের হাতে পায়ে শিকল বেঁধে
নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। পাকিস্তান আমল থেকে দীর্ঘদিন যাবৎ ১৯ (ক)
ধারাবলে শ্রমিকদেরকে চাকুরিচ্যুত করার অবাধ অধিকার মালিকদের ছিল। পরবর্তীতে সেই
ধারা পরিবর্তন করে ১৯ (ক) এর পরিবর্তে ধারা ২৬ করা হয়েছে। কিন্তু এখনও কোন প্রকার
কারণ ছাড়াই শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত করার অবাধ অধিকার মালিককে দেয়া হয়েছে। যা বাতিলের
জন্য জোর দাবি জানানো হয়েছে। বর্তমানে শ্রমনীতি করা হয়েছে ২০১২ সালে, যেখানে স্বীকার করা হয়েছে যে, লড়াই সংগ্রামের
পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নেও শ্রমিকদের অবদান সর্বজনবিদিত। এই শ্রমনীতি স্বীকার
করছে যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল
শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষের শোষণমুক্ত, মর্যাদাসম্পন্ন
ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা। আসলে যেমন শিয়ালের কাছে মুরগি বরগা দিয়ে মুরগির
নিরাপত্তা আশা করা আহাম্মকি ছাড়া কিছুই না তেমনি লুটেরা ধনিক গোষ্ঠীর কাছে
রাষ্ট্রক্ষমতা রেখে স্বাধীনতার স্বপ্ন, শ্রমিক কৃষকের অধিকার
চাওয়া চরম আহাম্মকি। এর জন্য প্রয়োজন শ্রমিকশ্রেণির রাজনৈতিক উত্থান এবং শ্রমিক
রাজ কায়েম করা। আমরা স্বাধীনতার পর থেকে সকল সরকারের আমলেই উন্নয়নের কথা, অধিকার বাস্তবায়নের কথা শুনছি। কিন্তু শ্রমিকদের আইনানুগ অধিকার, সামাজিক অধিকার সবকিছু ক্রমান্বয়ে কমিয়ে দেয়া হয়েছে। শ্রমিকশ্রেণির সাথে
সব সরকারই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আজ শুধু শ্রম আইনের কতিপয় বিষয় তুলে ধরছি–পরবর্তীতে এর সুফল ও কুফল বিস্তারিত বলবো। শ্রমনীতি অনুসারে বিনিয়োগবান্ধব
পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে উৎপাদনশীল, বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত রাষ্ট্র বিনির্মাণের লক্ষ্যে শ্রম আইনের প্রয়োজনীয় পরিবর্ত ও
সংশোধনের কথা বলা থাকলেও করা হচ্ছে তার উল্টাটা। বিএনপি’র
শাসনামলে ২০০৬ সালে অতীতের সকল আইন, বিধি ও অধ্যাদেশ বাতিল
করে শ্রম আইন-২০০৬ প্রণয়ন করে শ্রমিকদের অনেকগুলো অধিকার কর্তন করা হয়। একই সাথে
এমন কতগুলো শর্ত আরোপ করা হয় যাতে মালিকরা ইচ্ছামত শ্রমিকদের চালাতে পারে।
শ্রমিকদের স্বাধীনতা বলে কিছু রাখা হয়নি। যার ফলে আমরা শ্রমিকরা আইন সংশোধন করার
দাবি তুলেছিলাম। ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ওয়াদা করলেন ক্ষমতায়
গেলে তারা শ্রমিকদের দাবি অনুসারে আইন সংশোধন করবেন। ক্ষমতায় আসার অনেক পরে রানা
প্লাজা ও তাজরিন ফ্যাশনের হত্যাকাণ্ডের পরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানান চাপে শ্রম
আইনের ৮৭টি ধারা সংশোধন করা হয়। সেখানে প্রায় সবগুলোতেই শ্রমিকদের দাবিকে উপেক্ষা
করে মালিকদের স্বার্থে সংরক্ষণ করা হয়। পরিশেষে ২০১৫ সালে করা হয় শ্রমবিধিমালা।
যেটি শ্রমিক নির্যাতনের হাতিয়ার। কেননা শ্রম আইনের ধারা ৩৫১ অনুসারে আইনের
উদ্দেশ্য পূরণকল্পে বিধি প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে। অথচ এই বিধিমালাটি হুবহু
মালিকদের করে দেয়া। যা শ্রম আইনের সাথেও অসঙ্গতিপূর্ণ এবং সাংঘর্ষিক। বাস্তবে বার
বার আইন, বিধি ইত্যাদি প্রণয়ন-সংশোধন যাহাই করা হচ্ছে তার
সবটাতেই শ্রমিকদের সাথে ধাপ্পাবাজি করে স্বাধীনতার লক্ষ্যকে নস্যাৎ করে মালিকদেরকে
শ্রম শোষণের মাত্রা বাড়িে দেয়ার পথ তৈরি করে দেয়া হচ্ছে। ২০১৬-১৭ সালের আইএলও
কনফারেন্সে বাংলাদেশের শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার সুরক্ষা সংক্রান্ত যেসব
সুনির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে তার ভিত্তিতে আইএলও’র
নির্দেশক্রমে বাংলাদেশের শ্রম আইন সংশোধনের জন্য ত্রি-পক্ষীয় কমিটির কার্যক্রম
শুরু হয়েছে। আগামী নভেম্বর–২০১৭ এর মধ্যে শ্রম আইন সংশোধনের
কথা থাকায় ত্রি-পক্ষীয় আলোচনা চলছে। আলোচনা চলাকালীন ত্রি-পক্ষীয় মতামত ছাড়াই
সরকার আইএলও’র নিকট একটি সুপারিশমালা পেশ করেছে। মালিকদের
শর্ত পূরণের জন্য সরকারের এক তরফা প্রস্তাবনাকে প্রত্যাখান করা হয়েছে বাংলাদেশের
সকল শ্রমিক-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে। কাগজপত্রে কার্যক্রম চালালে আর প্রত্যাখান
করলেই হবে না, বাংলাদেশে ৬ কোটিরও বেশি শ্রমিক যাদের জীবন আজ
বিপন্ন, অনাহারে-অর্ধাহারে থাকা সেইসব শ্রমিকদেরকে মালিকদের
স্বার্থ সংরক্ষণকারী বর্তমান শ্রম আইন দ্বারা শোষণ করেও লুটেরা ধনিকগোষ্ঠী
মালিকদের এবং তাদের সরকারের সন্তুষ্টি হচ্ছে না। এক সময় যেমন শ্রমিকের পায়ের সাথে
লোহার শিকল দিয়ে মেশিনে বেঁধে কাজ করানো হতো এখন শ্রম আইন নামক শিকলে বাঁধার গভীর
ষড়যন্ত্র চলছে। প্রয়োজন শ্রেণি সচেতন তীব্র শ্রমিক আন্দোলন, যেই
শ্রমিক আন্দোলনকে শ্রমিকশ্রেণির অর্থনৈতিক আন্দোলনে সীমাবদ্ধ রাখলেই চলবে না। শ্রম
দাসত্বের শিকল ভাঙতে হবে, সমাজতন্ত্র কায়েমের চেতনা
শ্রমিকদের মাঝে নিয়ে যেতে হবে। পুঁজিবাদী শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। সেই
শক্তি শ্রমিক শ্রেণির আছে। আসুন শ্রম আইনের এই সংগ্রাম, মজুরির
সংগ্রামে কমিউনিস্টরা যুক্ত হই, সফল হই। তাহলে এই সফলতার পথ
ধরেই বিপ্লবের পথ রচনা হবে। শ্রমদাসত্বের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করার উদ্দেশ্যে
প্রণীত শ্রম আইন নামক শিকল ভেঙে ফেলতে হবে। বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী।
লেখক : কাজী
রুহুল আমিন, কার্যকরি সভাপতি, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন