কমরেড ফরহাদকে প্রথম দেখি ১৯৬৫ সালে। তখন
সবে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি
হয়েছি। ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মীও হয়ে
উঠেছি। গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ
হয়েছে। কলেজের পাঁচজন ছাত্রকর্মীকে
নিয়ে মতি ভাই (মতিউর রহমান) পার্টি গ্রুপ গঠন
করেন। দুটি গ্রুপ বৈঠকের পর তৃতীয় গ্রুপ
বৈঠকেই কমরেড ফরহাদের দেখা পেয়েছিলাম।
মতি ভাইয়ের বংশালের বাসার অন্দরমহলে ঢুকে
খোলা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলে বাড়ির ছাদে
তাঁদের দুই ভাইয়ের থাকার যে দুটি ঘর ছিল, তার
একটিতে আমরা পড়ন্ত বিকেলে গ্রুপ বৈঠকের
উদ্দেশ্যে ঘড়ির কাঁটা ধরে নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত
হয়েছি। বৈঠক শুরুর ঠিক আগে মতি ভাই পাশের ঘর
থেকে একজন ছোটখাটো মানুষকে সঙ্গে নিয়ে
এসে বসলেন। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি
হলেন কবীর ভাই। পরনে তাঁর সাদা পায়জামা ও
পাঞ্জাবি। হাতে কাগজপত্র রাখার মতো একটা ছোট
রেক্সিনের ব্যাগ। অতি সাধারণ বেশভূষার ছোটখাটো
মানুষটার আগমন বৈঠকের অবয়বে সামান্য হেরফের
ঘটালেও, বেশ মনে আছে, মুহূর্তের মধ্যেই
এক অদৃশ্য ইন্দ্রজালে সবাই আবিষ্ট হয়ে
পড়েছিলাম। সন্ধ্যা নামার একটু পর গ্রুপ বৈঠক শেষ
করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন কবীর
ভাই। কে যেন কানে কানে আমাকে জানিয়ে দিল,
এই কবীর ভাই-ই হলেন কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ;
তাঁর ডাকনাম বাদল।
সেদিনের বৈঠকের পর দুই দশকের বেশি সময়
ধরে কমরেড ফরহাদের সঙ্গে পথ চলেছি। সভা-
সমাবেশ-মিছিল-বৈঠকে, আত্মগোপন অবস্থায় গোপন
‘ডেনে’, যুদ্ধক্ষেত্রে গেরিলা ক্যাম্পে,
বিদেশে, মাসের পর মাস জেলখানায় একই ঘরে
পাশাপাশি চৌকিতে থেকেছি। কমিউনিস্ট পার্টির
সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সংস্থায়ও তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত
চার-পাঁচ বছর একসঙ্গে কাজ করেছি। খুব কাছ
থেকে দেখেছি তাঁকে।
বৈঠকি আলোচনায় ফরহাদ ছিলেন তুলনাহীন। কদাচিৎ
উচ্চ স্বরে বাক্যবিনিময় করতেন। কোন বিষয়টি
উপস্থিত বৈঠকেই প্রভাবিত করে ফয়সালা করতে
হবে আর কোন বিষয়গুলো পরবর্তী সময়ের
জন্য রেখে দিতে হবে, সেই বিচারে তিনি
ছিলেন বিচক্ষণ। বৈঠকি আলোচনার জন্য তিনি কাগজে
পয়েন্টস লিখে প্রস্তুত হয়ে আসতেন। একটি-দুটি
শব্দে অথবা ছোট ছোট বাক্যাংশে তাঁর বক্তব্য
আগেই লিখে সাজিয়ে নিয়ে আসতেন। জনসভায়
তিনি যুক্তি দিয়ে বক্তৃতা করতেন। আগে থেকে
নোট তৈরি করে বক্তৃতার মঞ্চে উপস্থিত হতেন।
তাঁর বক্তৃতায় উত্তেজনা থাকত কম।
রাজনৈতিক দলিল, প্রস্তাব, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ইত্যাদি রচনায়
কমরেড ফরহাদের দক্ষতা ছিল অসাধারণ। একটানা লম্বা
সময় ধরে না লিখেও তিনি বেশ দ্রুত লিখতে
পারতেন। বড় কিছু লেখার আগে সে সম্পর্কে
তিনি আগেই একটি ছক তৈরি করে নিতেন।
মাঝেমধ্যে ডিকটেশন দিয়েও লিখতেন।
জেলখানায় একসঙ্গে থাকাকালে তাঁর প্রায় সব
রাজনৈতিক চিঠিপত্র ডিকটেশন দিয়ে আমাকে দিয়েই
তিনি লেখাতেন। তা ছাড়া পয়েন্টস বলে দিয়ে ছাত্র
ইউনিয়নের একাধিক সম্মেলনের রিপোর্ট, পার্টি
কংগ্রেসের রিপোর্টের অংশ আমাকে দিয়ে তিনি
লিখিয়ে নিতেন।
কমরেড ফরহাদের বাস্তবতাবোধ যে গভীর ছিল,
নানা ক্ষেত্রেই এর অভিপ্রকাশ ঘটত। প্রতিটি কাজের
ছোটখাটো খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে তাঁর মনোযোগ
ছিল। ছোট-বড় ঘটনা, সেটা রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক
বা অন্য যা কিছুই হোক না কেন, তা সাজিয়ে গুছিয়ে
সুন্দরভাবে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর ছিল অসাধারণ
দক্ষতা। তিনি ছিলেন অতুলনীয় সংগঠক। কর্মীদের
শক্তি-দুর্বলতা, সামর্থ্য-ঘাটতি ইত্যাদির হিসাব তাঁর
নখদর্পণে থাকত। কর্মীদের ব্যক্তিগত জীবন
সম্পর্কেও খোঁজখবর রাখতেন। একটি বড় কাজের
জন্য তিনি একটি কর্মী টিম গড়ে তুলে সেই
টিমকে উদ্বুদ্ধ করে কাজে নামিয়ে দিতে
পারতেন। কখন কী করতে হবে, কীভাবে
করতে হবে, তা সংশ্লিষ্ট কর্মীকে ডেকে
নিয়ে বলে দিতেন অথবা নির্দেশমূলক চিঠি দিয়ে
জানাতেন। এভাবে কমরেড ফরহাদই হয়ে উঠতেন
সেই কাজের নেপথ্য নায়ক।
রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণেও তিনি ছিলেন অনন্য
প্রতিভার অধিকারী। পার্টির অভ্যন্তরে অথবা বাইরে
সর্বত্রই তাঁর এই দক্ষতার প্রকাশ দেখতে পাওয়া
যেত। রাজনৈতিক, সাংগঠনিক সব বিষয়কে তিনি যেমন
সময়ের মাপকাঠিতে বিচার করতেন, তেমনি সময়ের
আরও বিস্তৃত ক্যানভাসে বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে
তিনি কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারতেন। দূরের দিকে
দৃষ্টি রেখে তিনি বর্তমানের কাজের স্বরূপ নির্ধারণ
করতেন এবং কাজের কৌশল এমনভাবে গ্রহণ
করতেন, যাতে নির্ধারিত দূরবর্তী লক্ষ্যাভিমুখে
কাজের গতিমুখিনতা থাকে। আর সেই গতিমুখিনতার
স্টিয়ারিংটি ধরা থাকত তাঁর নিজের হাতে।
রাজনীতিতে বা সংগঠনের কাজে কোনো বিশেষ
পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন
সিদ্ধহস্ত। কাকে কখন কোন কথা বলতে হবে,
কাকে দিয়ে কখন কোন কাজ করাতে হবে, কার
মাধ্যমে কোন কথা কার কাছে পৌঁছাতে হবে,
যৌথ বৈঠকে একটি মনমতো সিদ্ধান্ত বের করে
আনার জন্য আগেই কীভাবে এবং কাকে কাকে
নিয়ে মতামতের সপক্ষে অনুকূল একটা
চক্র গড়ে তুলতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে নিখুঁত
পরিকল্পনা করে পদক্ষেপ নিতে তিনি অসাধারণ
পারদর্শী ছিলেন। শক্তির বিন্যাস কীভাবে কতটা
অনুকূলে নিয়ে আসা যায়, সে সম্পর্কে তাঁর হিসাব-
নিকাশ করার ÿক্ষমতা ছিল অসাধারণ। কোথায় কার সঙ্গে
কোন প্রশ্নে আপস করে যথাসম্ভব অনুকূল
আপাত–ফল বের করে আনা যেতে পারে, তিনি
সেটা খুব ভালোভাবে হিসাব করে পদক্ষেপ নিতে
পারতেন।
গণ-আন্দোলনের গতিধারা সম্পর্কে কমরেড
ফরহাদের অসাধারণ প্রায়োগিক জ্ঞান ছিল। কখন
এগোতে হবে আর কখন পেছাতে হবে, কিংবা
কখন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে আর কখন
সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে—
এসব বিষয়ে তাঁর প্রায়োগিক জ্ঞান অসাধারণ ছিল।
গণ-আন্দোলনের প্রক্রিয়াকে চালনা করে
নেওয়ার অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শনে তিনি সক্ষমতার
প্রমাণ রাখতে পেরেছিলেন। কমরেড ফরহাদকে
বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনের মস্তিষ্ক, উনসত্তরের
গণ-অভ্যুত্থানের নেপথ্যের স্থপতি,
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণকক্ষের
নায়করূপে ভূষিত করা হয়।
কমরেড ফরহাদ মুক্তিযুদ্ধেরও একজন শীর্ষ
সংগঠক ছিলেন। পার্টির শক্তিকে সশস্ত্র যুদ্ধের
কাজে সুশৃঙ্খলভাবে নিয়োজিত করা, ন্যাপ-কমিউনিস্ট
পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলাবাহিনীর
সামরিক সংগঠন পরিচালনা ইত্যাদি কাজের পাশাপাশি
মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা
তৎপরতায় সম্পৃক্ত থেকে বিশেষ বিচক্ষণতার
পরিচয় দেন। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের
পরপরই তিনি পার্টির কাছে লিখিত রিপোর্টে সশস্ত্র
সংগ্রামের কথা বলেছিলেন।
কমরেড ফরহাদ ভেতরে-ভেতরে খুবই
রোমান্টিক মনের মানুষ ছিলেন। ছিলেন
অনুভূতিপ্রবণ ও গভীরভাবে সংবেদনশীল।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে তিনি ভালোবাসতেন। প্রচুর
সিগারেট খেতেন। ভালো সিগারেট, উন্নতমানের
সাবান, শেভিং ক্রিম—এসবের প্রতি তাঁর একটা সহজাত
আকর্ষণ ছিল। জমিয়ে আড্ডা দিতে, মন খুলে হাসি-
ঠাট্টা করতে পছন্দ করতেন তিনি।
কমরেড ফরহাদ স্বপ্ন দেখতেন বিপ্লবের। সময়
যেন তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। বিংশ শতাব্দীর
মধ্যে বিপ্লব করার কথা তিনি বলেছিলেন। জীবিত
থাকতেই পার্টিকে ক্ষমতায় নিয়ে যাওয়ার প্রাণান্তকর
প্রয়াসে তিনি তাঁর সর্বসত্তা নিবেদন করেছিলেন।
সব কাজে সেভাবে মিল দেওয়ার জন্য তিনি
ঘটনাবলির ইচ্ছাশক্তি দিয়ে ত্বরিতগতিতে প্রবাহিত করার
নানা প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ
নয় এমন কিছু কৌশলী পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ
করতে প্রলুব্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু কেবল
ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সবকিছু করা যায় না, বিপ্লব তো নয়ই।
তাই শেষ পর্যন্ত সব ঘটনা তাঁর মনমতো ঘটেনি।
ফরহাদ ছিলেন সর্বাংশে একজন কমিউনিস্ট,
সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ ও মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের
আদর্শের প্রতি আত্মনিবেদিত। পার্টির জন্য তিনি
সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি
ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান ও সাধনার প্রধান কেন্দ্র।
কমরেড ফরহাদ ও কমিউনিস্ট পার্টি ছিল এক নাড়িতে
বাঁধা, অভিন্ন সত্তা। এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে তিনি হয়ে
উঠেছিলেন একজন জাতীয় নেতা।
চিরঞ্জীব কমরেড ফরহাদ, লাল সালাম!
সবে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি
হয়েছি। ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মীও হয়ে
উঠেছি। গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ
হয়েছে। কলেজের পাঁচজন ছাত্রকর্মীকে
নিয়ে মতি ভাই (মতিউর রহমান) পার্টি গ্রুপ গঠন
করেন। দুটি গ্রুপ বৈঠকের পর তৃতীয় গ্রুপ
বৈঠকেই কমরেড ফরহাদের দেখা পেয়েছিলাম।
মতি ভাইয়ের বংশালের বাসার অন্দরমহলে ঢুকে
খোলা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলে বাড়ির ছাদে
তাঁদের দুই ভাইয়ের থাকার যে দুটি ঘর ছিল, তার
একটিতে আমরা পড়ন্ত বিকেলে গ্রুপ বৈঠকের
উদ্দেশ্যে ঘড়ির কাঁটা ধরে নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত
হয়েছি। বৈঠক শুরুর ঠিক আগে মতি ভাই পাশের ঘর
থেকে একজন ছোটখাটো মানুষকে সঙ্গে নিয়ে
এসে বসলেন। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি
হলেন কবীর ভাই। পরনে তাঁর সাদা পায়জামা ও
পাঞ্জাবি। হাতে কাগজপত্র রাখার মতো একটা ছোট
রেক্সিনের ব্যাগ। অতি সাধারণ বেশভূষার ছোটখাটো
মানুষটার আগমন বৈঠকের অবয়বে সামান্য হেরফের
ঘটালেও, বেশ মনে আছে, মুহূর্তের মধ্যেই
এক অদৃশ্য ইন্দ্রজালে সবাই আবিষ্ট হয়ে
পড়েছিলাম। সন্ধ্যা নামার একটু পর গ্রুপ বৈঠক শেষ
করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন কবীর
ভাই। কে যেন কানে কানে আমাকে জানিয়ে দিল,
এই কবীর ভাই-ই হলেন কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ;
তাঁর ডাকনাম বাদল।
সেদিনের বৈঠকের পর দুই দশকের বেশি সময়
ধরে কমরেড ফরহাদের সঙ্গে পথ চলেছি। সভা-
সমাবেশ-মিছিল-বৈঠকে, আত্মগোপন অবস্থায় গোপন
‘ডেনে’, যুদ্ধক্ষেত্রে গেরিলা ক্যাম্পে,
বিদেশে, মাসের পর মাস জেলখানায় একই ঘরে
পাশাপাশি চৌকিতে থেকেছি। কমিউনিস্ট পার্টির
সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সংস্থায়ও তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত
চার-পাঁচ বছর একসঙ্গে কাজ করেছি। খুব কাছ
থেকে দেখেছি তাঁকে।
বৈঠকি আলোচনায় ফরহাদ ছিলেন তুলনাহীন। কদাচিৎ
উচ্চ স্বরে বাক্যবিনিময় করতেন। কোন বিষয়টি
উপস্থিত বৈঠকেই প্রভাবিত করে ফয়সালা করতে
হবে আর কোন বিষয়গুলো পরবর্তী সময়ের
জন্য রেখে দিতে হবে, সেই বিচারে তিনি
ছিলেন বিচক্ষণ। বৈঠকি আলোচনার জন্য তিনি কাগজে
পয়েন্টস লিখে প্রস্তুত হয়ে আসতেন। একটি-দুটি
শব্দে অথবা ছোট ছোট বাক্যাংশে তাঁর বক্তব্য
আগেই লিখে সাজিয়ে নিয়ে আসতেন। জনসভায়
তিনি যুক্তি দিয়ে বক্তৃতা করতেন। আগে থেকে
নোট তৈরি করে বক্তৃতার মঞ্চে উপস্থিত হতেন।
তাঁর বক্তৃতায় উত্তেজনা থাকত কম।
রাজনৈতিক দলিল, প্রস্তাব, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ইত্যাদি রচনায়
কমরেড ফরহাদের দক্ষতা ছিল অসাধারণ। একটানা লম্বা
সময় ধরে না লিখেও তিনি বেশ দ্রুত লিখতে
পারতেন। বড় কিছু লেখার আগে সে সম্পর্কে
তিনি আগেই একটি ছক তৈরি করে নিতেন।
মাঝেমধ্যে ডিকটেশন দিয়েও লিখতেন।
জেলখানায় একসঙ্গে থাকাকালে তাঁর প্রায় সব
রাজনৈতিক চিঠিপত্র ডিকটেশন দিয়ে আমাকে দিয়েই
তিনি লেখাতেন। তা ছাড়া পয়েন্টস বলে দিয়ে ছাত্র
ইউনিয়নের একাধিক সম্মেলনের রিপোর্ট, পার্টি
কংগ্রেসের রিপোর্টের অংশ আমাকে দিয়ে তিনি
লিখিয়ে নিতেন।
কমরেড ফরহাদের বাস্তবতাবোধ যে গভীর ছিল,
নানা ক্ষেত্রেই এর অভিপ্রকাশ ঘটত। প্রতিটি কাজের
ছোটখাটো খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে তাঁর মনোযোগ
ছিল। ছোট-বড় ঘটনা, সেটা রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক
বা অন্য যা কিছুই হোক না কেন, তা সাজিয়ে গুছিয়ে
সুন্দরভাবে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর ছিল অসাধারণ
দক্ষতা। তিনি ছিলেন অতুলনীয় সংগঠক। কর্মীদের
শক্তি-দুর্বলতা, সামর্থ্য-ঘাটতি ইত্যাদির হিসাব তাঁর
নখদর্পণে থাকত। কর্মীদের ব্যক্তিগত জীবন
সম্পর্কেও খোঁজখবর রাখতেন। একটি বড় কাজের
জন্য তিনি একটি কর্মী টিম গড়ে তুলে সেই
টিমকে উদ্বুদ্ধ করে কাজে নামিয়ে দিতে
পারতেন। কখন কী করতে হবে, কীভাবে
করতে হবে, তা সংশ্লিষ্ট কর্মীকে ডেকে
নিয়ে বলে দিতেন অথবা নির্দেশমূলক চিঠি দিয়ে
জানাতেন। এভাবে কমরেড ফরহাদই হয়ে উঠতেন
সেই কাজের নেপথ্য নায়ক।
রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণেও তিনি ছিলেন অনন্য
প্রতিভার অধিকারী। পার্টির অভ্যন্তরে অথবা বাইরে
সর্বত্রই তাঁর এই দক্ষতার প্রকাশ দেখতে পাওয়া
যেত। রাজনৈতিক, সাংগঠনিক সব বিষয়কে তিনি যেমন
সময়ের মাপকাঠিতে বিচার করতেন, তেমনি সময়ের
আরও বিস্তৃত ক্যানভাসে বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে
তিনি কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারতেন। দূরের দিকে
দৃষ্টি রেখে তিনি বর্তমানের কাজের স্বরূপ নির্ধারণ
করতেন এবং কাজের কৌশল এমনভাবে গ্রহণ
করতেন, যাতে নির্ধারিত দূরবর্তী লক্ষ্যাভিমুখে
কাজের গতিমুখিনতা থাকে। আর সেই গতিমুখিনতার
স্টিয়ারিংটি ধরা থাকত তাঁর নিজের হাতে।
রাজনীতিতে বা সংগঠনের কাজে কোনো বিশেষ
পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন
সিদ্ধহস্ত। কাকে কখন কোন কথা বলতে হবে,
কাকে দিয়ে কখন কোন কাজ করাতে হবে, কার
মাধ্যমে কোন কথা কার কাছে পৌঁছাতে হবে,
যৌথ বৈঠকে একটি মনমতো সিদ্ধান্ত বের করে
আনার জন্য আগেই কীভাবে এবং কাকে কাকে
নিয়ে মতামতের সপক্ষে অনুকূল একটা
চক্র গড়ে তুলতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে নিখুঁত
পরিকল্পনা করে পদক্ষেপ নিতে তিনি অসাধারণ
পারদর্শী ছিলেন। শক্তির বিন্যাস কীভাবে কতটা
অনুকূলে নিয়ে আসা যায়, সে সম্পর্কে তাঁর হিসাব-
নিকাশ করার ÿক্ষমতা ছিল অসাধারণ। কোথায় কার সঙ্গে
কোন প্রশ্নে আপস করে যথাসম্ভব অনুকূল
আপাত–ফল বের করে আনা যেতে পারে, তিনি
সেটা খুব ভালোভাবে হিসাব করে পদক্ষেপ নিতে
পারতেন।
গণ-আন্দোলনের গতিধারা সম্পর্কে কমরেড
ফরহাদের অসাধারণ প্রায়োগিক জ্ঞান ছিল। কখন
এগোতে হবে আর কখন পেছাতে হবে, কিংবা
কখন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে আর কখন
সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে—
এসব বিষয়ে তাঁর প্রায়োগিক জ্ঞান অসাধারণ ছিল।
গণ-আন্দোলনের প্রক্রিয়াকে চালনা করে
নেওয়ার অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শনে তিনি সক্ষমতার
প্রমাণ রাখতে পেরেছিলেন। কমরেড ফরহাদকে
বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনের মস্তিষ্ক, উনসত্তরের
গণ-অভ্যুত্থানের নেপথ্যের স্থপতি,
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণকক্ষের
নায়করূপে ভূষিত করা হয়।
কমরেড ফরহাদ মুক্তিযুদ্ধেরও একজন শীর্ষ
সংগঠক ছিলেন। পার্টির শক্তিকে সশস্ত্র যুদ্ধের
কাজে সুশৃঙ্খলভাবে নিয়োজিত করা, ন্যাপ-কমিউনিস্ট
পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলাবাহিনীর
সামরিক সংগঠন পরিচালনা ইত্যাদি কাজের পাশাপাশি
মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা
তৎপরতায় সম্পৃক্ত থেকে বিশেষ বিচক্ষণতার
পরিচয় দেন। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের
পরপরই তিনি পার্টির কাছে লিখিত রিপোর্টে সশস্ত্র
সংগ্রামের কথা বলেছিলেন।
কমরেড ফরহাদ ভেতরে-ভেতরে খুবই
রোমান্টিক মনের মানুষ ছিলেন। ছিলেন
অনুভূতিপ্রবণ ও গভীরভাবে সংবেদনশীল।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে তিনি ভালোবাসতেন। প্রচুর
সিগারেট খেতেন। ভালো সিগারেট, উন্নতমানের
সাবান, শেভিং ক্রিম—এসবের প্রতি তাঁর একটা সহজাত
আকর্ষণ ছিল। জমিয়ে আড্ডা দিতে, মন খুলে হাসি-
ঠাট্টা করতে পছন্দ করতেন তিনি।
কমরেড ফরহাদ স্বপ্ন দেখতেন বিপ্লবের। সময়
যেন তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। বিংশ শতাব্দীর
মধ্যে বিপ্লব করার কথা তিনি বলেছিলেন। জীবিত
থাকতেই পার্টিকে ক্ষমতায় নিয়ে যাওয়ার প্রাণান্তকর
প্রয়াসে তিনি তাঁর সর্বসত্তা নিবেদন করেছিলেন।
সব কাজে সেভাবে মিল দেওয়ার জন্য তিনি
ঘটনাবলির ইচ্ছাশক্তি দিয়ে ত্বরিতগতিতে প্রবাহিত করার
নানা প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ
নয় এমন কিছু কৌশলী পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ
করতে প্রলুব্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু কেবল
ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সবকিছু করা যায় না, বিপ্লব তো নয়ই।
তাই শেষ পর্যন্ত সব ঘটনা তাঁর মনমতো ঘটেনি।
ফরহাদ ছিলেন সর্বাংশে একজন কমিউনিস্ট,
সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ ও মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের
আদর্শের প্রতি আত্মনিবেদিত। পার্টির জন্য তিনি
সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি
ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান ও সাধনার প্রধান কেন্দ্র।
কমরেড ফরহাদ ও কমিউনিস্ট পার্টি ছিল এক নাড়িতে
বাঁধা, অভিন্ন সত্তা। এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে তিনি হয়ে
উঠেছিলেন একজন জাতীয় নেতা।
চিরঞ্জীব কমরেড ফরহাদ, লাল সালাম!
লেখকঃ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট
পার্টির (সিপিবি)
দৈনিক প্রথম আলো, ৯ অক্টোবর ২০১৭
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন