Biplobi Barta

সোমবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৭

ক্রিমিনাল এলিমেন্টের খপ্পরে বড় দুই দল,

শতকরা ৯৭ ভাগ সংসদ সদস্যদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড টিআইবি’র জরিপ প্রকাশ পাওয়ার পর এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
সংসদ সদস্যদের প্রশাসনিক কাজে প্রভাব বিস্তার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়ন বরাদ্দের অপব্যবহার, অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িত হওয়ায় সমর্থন, সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তার, নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্লট বরাদ্দ পাওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠে আসে টিআইবির প্রতিবেদনে। নেতিবাচক কর্মকাণ্ড বন্ধের জন্যে সাংসদদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সংসদে ‘আচরণবিধি বিল’ পাসেরও দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।
সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে অনির্বাচিতদের ক্ষমতায় আনতেই টিআইবি এধরনের অভিযোগ তুলছে।
আর বিরোধীদল বিএনপি বলছে টিআইবির প্রতিবেদন সরকারদলীয় এমপিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
তবে এ দুটি বড় রাজনৈতিক দল কি সংসদকে কার্যকর করতে ব্যর্থ হচ্ছে না। তা জানতে চেয়েছিলাম বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের কাছে। তিনি মনে করছেন একটা ক্রিমিনাল এলিমেন্টের খপ্পরে পড়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আর দল দুটির যে কোনো একটি এ থেকে মুক্তি পেতে চাইলেও উপায় নেই, অন্য দলে পাড়ি জমাবে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা।
তাহলে উপায় কি? মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম মনে করছেন, একটা প্রচণ্ড বিদ্রোহ যা আগামী দিনের রাজনৈতিক চাহিদাকে সামনে রেখে একটা লক্ষ্যমাত্রার দিকে ধাবিত হবে অথচ তা পথভ্রষ্ট হবে না। রিয়েল টাইম নিউজ ডটকমের সাথে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তার সেই কথোপকথন।
প্রশ্ন: ৯৭ শতাংশ সংসদ সদস্য নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সাথে কিভাবে জড়িত হয়ে যাচ্ছে?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: সমস্যাগুলো ষোল আনা সত্য এবং তথ্য বহুল। এসব সমস্যা উত্তরণের জন্যে যে পরামর্শ টিআইবির পক্ষ থেকে করা হয়েছে, সেগুলো কেউ সমর্থন না করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু টিআইবির সুপারিশগুলোর মধ্যে দিয়ে উপশমগুলো হয়ত কিছুটা মলম লাগিয়ে নরম করা যাবে, কিন্তু তার উৎস দূর করা যাবে না। আমাদের সংসদ সদস্যদের মধ্যে যে বর্তমান পরিস্থিতি বিরাজ করছে, এর পেছনে মূল দায়ী হল আমাদের রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ। কমার্শিয়ালাইজেশন অব পলিটিক্স। আমরা সকলেই জানি নমিনেশন বাণিজ্য কিভাবে হয়। কিংবা বিভিন্ন দলে পদায়নের জন্যে যে টাকা পয়সার লেনদেন হয়, এমনকি মূল দল তার থেকেও তার যে অঙ্গ সংগঠনগুলো তার ছোট খাট পদ পাওয়ার জন্যে টাকা পয়সা দিয়ে এক ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম করানো হয়। এ ধরনের বাণিজ্যিক ব্যবস্থার মধ্যে পদায়ন ও মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টিকে একটা সিস্টেম হিসেবে দাঁড় করিয়ে ফেলা হয়েছে। প্রধানত আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি এই ধরনের দলগুলো থেকে যারা নমিনেশন পায় তারা স্বাভাবিকভাবেই তার বিনিয়োগকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্যে আপ্রাণ চেষ্ট করে। এজন্যে আরো বেশি টাকা তারা খরচ করে, টাকার খেলার মাধ্যমে নির্বাচনে জিতে আসার জন্যে। যত টাকা বিনিয়োগ করে তার দশ, পঞ্চাশ বা একশ’গুণ টাকা নির্বাচিত হবার পর দুই, চার বা পাঁচ বছরে উশুল করে আনার জন্যে তারা কিন্তু ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
অর্থনীতিতে একটা টার্ম আছে, ‘অপরচুনিটি কস্ট’। পার্লামেন্টে পাঁচ মিনিট থাকলে পরে আপনি কিন্তু পাঁচ মিনিট তদ্বির ব্যবসা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করছেন। সুতরাং এত বড় কস্ট দিয়ে তারা হয়ত পার্লামেন্টে থাকতে চায় না। সে কারণে পার্লামেন্টের কার্যক্রম যেভাবে হওয়া উচিত সেভাবে মোটেও হচ্ছে না। টিআইবি এমন একটা সংগঠন কেনো সংসদ সদস্যরা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ছে তার মূল উৎস নিয়ে নিজেকে জড়িত করতে চাইবে না। কিন্তু একটু রাজনৈতিক সচেতন প্রতিটি মানুষ কিন্তু ভাবলেই বুঝতে পারবে আসল লোভের উৎসটা হল বাজার অর্থনীতি ও বাজার অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে যে বাজার রাজনীতি চালু হয়েছে এবং সেখানে রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ তারই উপাদান হিসেবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নমিনেশন বাণিজ্য ও টাকার খেলা দেখছি। এটার ফলেই নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব থেকে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার মত উপসর্গগুলো দেখা যাচ্ছে।
প্রশ্ন: মনোনয়ন বাণিজ্যের ওপর যে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে রাজনৈতিক দলগুলো সেই অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার উপায় কি?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: একটি উপায় প্রচলিত অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। সেই অর্থে বললে, মানে বিপ্লবের চেয়ে একটা কম কিছু দিয়ে আপনি সম্ভবত এ রোগ থেকে মুক্তি পেতে পারবেন না। সুতরাং সেই রকম একটা নবজাগরণ আমাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের মতই একটা রাজনৈতিক তাৎপর্য্যের ধারাবাহিকতার মাধ্যমে একটা বৈপ্লবিক জাগরণের ভেতর দিয়েই কেবলমাত্র এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। এবং সেটার নেতৃত্ব দিতে পারে এদেশের বামপন্থী শক্তিগুলোই।
এবং তাদের শক্তি বৃদ্ধি এবং যথেষ্ট সামর্থ সম্পন্ন হয়ে ওঠার উপরেই কিন্তু পরিস্থিতি থেকে নিস্কৃতি চূড়ান্তভাবে হতে পারে বলে আমি মনে করি।
প্রশ্ন: আগামী সংসদে সংসদ সদস্যদের গুণগত কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে কি না কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর এ ব্যাপারে কোনো লক্ষ্য রয়েছে কি না
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: না না, বুর্জোয়া রাজনৈতিকদলগুলো কোনদিনই তাদের রাজনৈতিক মনোভাব পরিবর্তন করবে না। তাদের জায়গায় যদি বিকল্প শক্তিগুলো, তারা জনগণের আস্থা অর্জন করে শক্তি সম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে, তাহলে পরে এ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব। এজন্যে বামপন্থীদলগুলোর সঙ্গে আরো সৎ উদার রাজনৈতিকদলগুলো যদি সম্মিলিতভাবে একটা বিকল্প হিসেবে দাঁড়াতে পারে তাহলে বুর্জোয়া দলগুলো দেশকে যে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির এখান থেকে বের হয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই। কেননা আওয়ামী লীগের পক্ষে যদি তারা এ ধরনের রুগ্ন শক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলে তারা সঙ্গে সঙ্গে সেই সব শক্তি বা ব্যক্তি বিএনপিতে গিয়ে যোগ দেবে। আর বিএনপি যদি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে তারা এসে আওয়ামী লীগে যোগ দেবে। সুতরাং এই দুইটা দলই কিন্তু ক্রিমিনাল এলিমেন্ট বা যারা এইধরনের অর্থ দিয়ে রাজনীতিকে একটা বিকৃত পথে নিয়ে গেছে তাদের হাতে জিম্মী হয়ে পড়েছে। সেখান থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ সম্ভবত বুর্জোয়া দলগুলোর আর নেই। যার ফলে এই মেরুকরণের ভেতর থেকে একটা শুভ পরিবর্তন নিয়ে আসবে এরকম আশা করা একেবারেই দুরাশা।
তবে এই দলগুলোর ভেতর থেকে একটা বিরাট রকমের প্রতিরোধ যদি গড়ে না ওঠে বা একটা বিদ্রোহ, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো কারণ দেখছি না যে তারা নেতিবাচক কর্মকাণ্ড থেকে বের হয়ে আসার সাহস করতে পারবে। কারণ এ থেকে বের হয়ে আসার মানেই হল ক্ষমতা হারানো। আর ক্ষমতা যদি এক দল হারায় তাহলে সমস্ত ক্রিমিনাল এলিমেন্ট আরেক দলে চলে যাবে। আবার যদি ওনারা সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলে এরা এদিকে চলে আসবে। অর্থাৎ বড় দুটি রাজনৈতিক দল একারণেই ক্রিমিনাল এ্যাক্টিভিটি থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না।
প্রশ্ন: টিআইবি বলছে সংসদ সদস্যদের জন্যে আচরণ বিধি করে দেয়া প্রয়োজন।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: দেখুন আচরণ বিধিতে অনেক কিছুই থাকে। আচরণ বিধি অনুসরণ করা হবে সেটার নিশ্চয়তা দেবে কে? সর্ষের মধ্যে যদি ভুত থাকে তাহলে তাদের কাছ থেকে আচরণ বিধি যত শুদ্ধভাবেই নির্মাণ করা হোক না কেন, সেইটার বাস্তবায়ন কোনদিনই সম্ভব হবে না। এটা মনে রাখতে হবে রাজনীতি হল অর্থনীতিরই ঘনীভূত প্রকাশ। সুতরাং অর্থনীতির জায়গায় যদি লুটপাটের সুযোগ থেকে যায়, তারমানে সেটা অবশ্যম্ভাবীভাবে রাজনীতিতে প্রতিফলিত হবে। হয়ত অবস্থান একটু উন্নতি হতে পারে কিন্তু সেখান থেকে সম্পূর্ণভাবে বের হয়ে আসতে পারবেন না।
প্রশ্ন: তাহলে সংসদে বিরোধীদল না যাওয়ায় এবং সরকারি দল সংসদে যাওয়ার পরও রাজনীতি দুর্বৃত্তায়ন হয়ে পড়ায় তা পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়ছে?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: সংসদ নিয়ে বড় দুটি দল যে আচরণ করে, সেটাতো কোনো নীতিগত অবস্থান থেকে না। কেবল কোনটা ক্ষমতায় যাবার বা থাকার জন্যে উপযোগী বা পলিসি অব কনভেনিয়ন এই ধরনের পদ্ধতি তারা অনুসরণ করে। সুতরাং সংসদে না গেলে যদি একটা এই ধরনের ক্রাইসিস দিয়ে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতাকে শটসার্কিট করা যায় কিংবা এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যায় যাতে বিদেশি প্রভুরা তাদের সমর্থন শিফট করে এই পক্ষ থেকে অন্য পক্ষে নিয়ে যাবে এই রকম হিসেব নিকেশ করেই তারা কিন্তু বিষয়টাকে দেখে। সুতরাং এখানে যে জনগণের দাবি দাওয়া এবং তাদের আশা আকাঙ্খার কথা ব্যক্ত করার জন্যে এবং একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটা ভিত্তিভূমি হিসেবে সংসদকে ব্যবহার করা সেটা বিরোধীদলও জিনিষটাকে সেভাবে দেখে না বা সরকারও সেভাবে বিবেচনা করে না।
প্রশ্ন: তরুণদের আগামী দিনের আশা আকাঙ্খায় সন্নিবেশিত করে নতুন একটা গণজাগরণ কিভাবে সৃষ্টি করা যায়?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: দেশের বেশিরভাগ অর্থাৎ পনের আনা মানুষ এই পরিস্থিতিকে মেনে নিতে রাজি না। কিন্তু একটা সমস্যা হল তারা দৃশ্যমান কোনো বিকল্প চোখের সামনে দেখতে না পারায় হতাশ হয়ে নিজেদের নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিচ্ছে। এবং হয়ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন কিছু ক্ষোভ বিদ্রোহ করছে। কিন্তু এটাকে যদি একটা রাজনৈতিক প্রতিরোধের ধারায় এবং রাজনীতির বিকল্পের ধারায় যদি জনগণ সমবেত না হয়, তাহলে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ মোটেও সম্ভবপর হবে না। এখনো পর্যন্ত আমাদের তরুণ সমাজের মধ্যে সেই উপাদানটা থাকলেও তার বহি:প্রকাশটা আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি না। তারা হয়ত আশা করে বসে আছে, যে বড় দলগুলোর ভেতরে যদি শুভ বুদ্ধির উদয় হয়, এই কথাটি তারা বুঝতে পারছে না, যে শুভ বুদ্ধি আশা করে লাভ নেই, আমাদের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির পেছনে সমবেত হতে হবে। এবং এই প্রক্রিয়া যতদিন না আসে আমরা খুব একটা পরিবর্তন আশা করতে পারব না।
অবশ্য বামপন্থী দল এইধরনের সৎ, প্রগতিশীল দল তাদের দিক থেকেও প্রচেষ্টা আরো বাড়াতে হবে, যাতে মানুষের আস্থা এবং বিশ্বাস তারা অর্জন করতে পারে এবং সেইখানে একটা দৃঢ় এবং বিস্তৃত একটা মনোভূমি প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
লেখকঃ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, সিপিবি (১৫।১০।২০১২)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন